এ সময়ের অন্যতম শক্তিশালী তরুণ কবি। চেতন -অবচেতনার গভীর ছুঁয়ে উচ্চারিত হয় তাঁর কাব্যকথা। ' কাকে ভাষা দিতে গিয়ে কেড়ে নিলাম পাপের সাতান্নভাগ রাত্রি—' কিংবা ' একে একে সমস্ত নদী বয়ে চলছে, পালে লেগে আছে গোধূলির নামাজের ব্যস্ততা। ' এমনতর ঘন ভাববিন্যাস মুগ্ধতা আনে। পড়ছি ------
কবি জেম সাহার দুটি কবিতা
এপিটাফ
রূপালী দুর্বোধ্যতায় ঘেরা জলাশয়ের প্রত্যেকটি হা হুতাশ যেন কণ্টকপ্রিয় প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত— মৌলিক। এই জীবন, বারবার দেখেছি মরুভূমির শূন্যতা থেকে ঘুরে ঘুরে নেমে আসা পাতায়। নিঃসংকোচ নেমে আসা। পৃথিবীর সমস্ত পাড়াগাঁয়ে কোনো অনুচ্চারিত সংকট লুকিয়ে রয়েছে। সেইরকমই আমি, বাতিঘরগুলোকে অনুসরণ করেছি, তাকিয়ে থেকেছি রাত্রি-দিন, তারপর কালের গর্ভে বিধুর সাপের মত কুণ্ডলী পাকিয়েছি শীতের আকাশে। ঢেলেছি বিষ জানালার ওপাশে। বিহ্বল শরীর আমার, মনও ক্লান্ত শরীরের যত্নে— কাকে ভাষা দিতে গিয়ে কেড়ে নিলাম পাপের সাতান্নভাগ রাত্রি— আরও জড়তা আসে, ক্লান্তি নেমে আসে বুড়ো বটের জটের মতো, মাটি চায়, নদী চায়, ড্রেসিং টেবিল চায়— ভেদ করে ঢুকে পড়তে চায় সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর দেহে, মানুষের সুখের এঁটো কাটা চায়। নদীর অতল থেকে কাঠের বাক্সের মত কবর উঠে আসে অন্ধকারে— সশব্দে, ডাকে।
ধূমাবতী সন্ধ্যা
আমার কবিতারা কুম্ভকপ্রিয়। শব্দ টানে, ধরে রাখে, অস্বচ্ছ বাঁজা প্রান্তরের মত, তারপর ছেড়ে দেয়। ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওই প্রান্তরের দিকেই সরে এলাম, সেইখানেই শুরু হয়েছে সারসের বর্ধিষ্ণু ফেরার পথগুলো। শিরীষ গাছের ফুলের মত আমাদের এই জীবন— মুখ লুকায় বিধবা মুসলিম রমণীর ঘোমটায়। পাশেই তৃতীয় লিঙ্গের নৌকো চলার পথ। সারাজীবনের নৈরাশ্য আজ ভিড় করে আছে রূপবতী বাঁশবনের আঁধারে, তীক্ষ্ম তার শরীর যেন জল কেটে স্রোতের সাথে পিরিত জমাতে চায়। ফিসফিস করে লেবু গাছটির পেছনে কে যেন বললে, শাড়ির গভীরে দিনযাপনের অবসাদ আছে, বাড়ি ফিরে যাও। একে একে সমস্ত নদী বয়ে চলছে, পালে লেগে আছে গোধূলির নামাজের ব্যস্ততা। সামনের-পেছনের গ্রামগুলো মিছে মিছে সত্যি হওয়া বন্ধ করে দেবে । এখন অপদেবতার নদী পারাপারের সময়। ধানক্ষেতগুলো আস্তে আস্তে এবার গুটিয়ে নিতে শুরু করে দিয়েছে। কেউ গালাগাল দিচ্ছে : ‘ মাইনসের মাছ মাইনসে ধরে ! হারামজাদা, নদীটা কি তোর বাপের সম্পত্তি।’ কেতুর শূন্যতা আমাদের ঘিরে ধরেছে, অন্যদিকে, দশমহাবিদ্যার চলাফেরা ফুরিয়ে এলো। ধূমাবতীর কাকধ্বজা উড়ে গেলো শূন্য বড়শি আর নক্ষত্র-সরলতায় ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন