ভাষা শিল্পের জাদু কারিগর তিনি । যে কথা তিনি বলতে চান ,সহজেই তা চারিয়ে যায় পাঠকের অন্তরে। আমরা মুগ্ধ হই তাঁর ভাষা ও শব্দের সম্মোহনী শক্তিতে । চলমান জীবন কত স্মৃতি রেখে যায় মানসপটে। স্মৃতির গহীনে ডুবে তিনি তুলে এনেছেন তেমনই এক পুজোর স্মৃতি। পড়ছি সম্রাট মুখোপাধ্যায়-এর ----
'বিষাদকর্মা'
সম্রাট মুখোপাধ্যায়
না,তখনও বিশ্বকর্মা দেবতাকে এখনকার মতো এতটা উত্তর-ভারতীয় দেখতে হয়ে যায় নি।তার মুখে দাড়ি লাগিয়ে বিশেষ একজনের মতো দেখতে করার দায়ও ছিল না তখন।
তখনও তাকে দেখতে হত নিচের প্রতিমার মতো।বেশ খানিকটা কার্তিক-কার্তিক।আমরা মজা করে বলতাম আগের পুজোয় যে কার্তিকরা প্যান্ডেল পায় নি,তারাই ফিরে এসেছে এবার বিশ্বকর্মা অবতারে।
তখনও বাঙালির গণেশ পুজো হত পয়লা বৈশাখে।পুজোর আগে প্যান্ডেল সাজিয়ে বসে নি।
তখনও বিশ্বকর্মা পুজোই ছিল শারদোৎসবের আগমনী।বন্ধু অভিনেতা অনল চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিল যাত্রাদলগুলোর পথ চলা একসময় শুরু হত এই দিন থেকে।
১
মফস্বলে বেড়ে উঠেছে আর বিশ্বকর্মা পুজোয় আমোদ পায় নি,এমন ছেলে খুব কমই আছে।এ'ছিল বিশুদ্ধ,আজকের ভাষায় 'সাব অলটার্ন' দেবতার পুজো।
পাড়ায় পাড়ায় যার সবচেয়ে বড় প্যান্ডেলটা করত রিকশাওয়ালারা।ব্যাপক জোরে মাইক বাজত।অদ্ভুত সুরের সব হিন্দি গান(পরে জেনেছি ওগুলো ভোজপুরি গান)।দুপুরে খিচুড়ি খেতে আসত রিকশাচালকদের পরিবার আর ছেলেমেয়েরা।রাস্তার ধারেই পাত পেড়ে চলত খাওয়াদাওয়া।ঐদিন চিনতাম কোন রিক্সাওয়ালার বউ কিংবা বাচ্চা কে ? এদের কেউই অবশ্য আমাদের স্কুলে পড়ত না।রাতে মাইক চালিয়ে হত ধুম নাচ।মা-মাসিমারা প্যান্ডেলের সামনে দিয়ে গেলে নাকে রুমাল চাপা দিত।সেদিন কেউ রিকশায় চাপত না।
আমাদের বাড়ির বাঁধা রিকশাওয়ালা ছিল শিকারিকাকা।বিহারি।তার দাদার নাম ছিল রুদল।মানে কী আজও বুঝি নি।সে ভ্যান চালাত।দুই ভাই থাকত আমাদের খেলার মাঠের ধারে চালা বেঁধে।যেটা দেখতে ছিল অনেকটা তাঁবুর মতো।যখন গল্পের বইয়ে রাজার শিকারে বা যুদ্ধে গিয়ে তাঁবু পাতার বিবরণ পড়তাম,তখন শিকারিকাকার ঐ ডেরার কথা মনে হত।
বেশ চওড়া আর শক্তপোক্ত চেহারা ছিল শিকারিকাকার।আদিবাসিদের মতো।রিকসা চালানোর সময় কাঁধের আর হাতের পেশিগুলো ফুলে থাকত।আর কয়েক বছর পরে দেখলে হয়ত কলকাতায় খেলতে আসা চিমা ওকোরির সঙ্গে তুলনা করে ফেলতাম।
শিকারিকাকার কাঁধে চেপে ঐ পুজোয় যেতাম সকালে।'বোম্বাই সে আয়া মেরা দোস্ত' গানের সঙ্গে শিকারিকাকা নাচত আমায় কাঁধে নিয়ে।অনেকক্ষণ আমি চেয়ারে বসে বসে দেখতাম ওদের টলটলায়মান পায়ের আনন্দ।মাঝে মাঝে প্রতিমার পেছনে চলে যাওয়া,আর আরও খুশি মনে আবার ফিরে আসা।তারপর ওদের খাওয়ার সময়ের আগে বাড়ি ফিরে আসতাম।শিকারিকাকাই পাতায় মুড়ে বাড়িতে খিচুড়ি দিয়ে যেত।বাড়ির কেউ কখনও খেয়েছে বলে মনে পড়ে না।
তবে আমার খুব আনন্দ হত।সন্ধ্যাবেলা অন্ধকারে দোতলার বারান্দা থেকে ওদের বাল্বের হলুদ আলোয় নাচ দেখতাম।শিকারিকাকাও আনন্দ করছে দেখে মন ভালো হয়ে যেত।
তারপর একদিন থেকে শিকারিকাকা আর রিক্সা চালাতে পারত না।মুখ দিয়ে রক্ত বেরোত।শুনলাম টিবি হয়েছে।সেই তাঁবুতে শুয়ে থাকত।একদিন বিকেলে বল ঢুকে গেল ঘরে।আনতে গিয়ে দেখলাম চুপ করে শুয়ে আছে।নোংরা,তেল চিটচিটে বিছানায়।
এর কিছুদিন পরে ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে দেখলাম পাড়ার রিক্সাওয়ালারা বাবার কাছে এসেছে টাকা চাইতে।শিকারিকাকাকে পোড়াতে নিয়ে যাবে।
২
এখন যেমন সবাই দুর্গাঠাকুর দেখতে বেরোয়,আমরা বন্ধুরা সেপ্টেম্বরের ১৭য় বিশ্বকর্মা ঠাকুর দেখতে বেরোতাম।
হ্যাঁ,এতটাই রমরমা তখন এই দেবতার এই শিল্পাঞ্চলে।কী ভিড় হত সেদিন রাস্তায়!
এদিকে পলতার বেঙ্গল এনামেল।ওদিকে পিনকলের গৌরীশংকর জুটমিল।এই ছিল আমাদের বিশ্বকর্মা দেখতে বেরোনোর ভুগোল।তার সীমানা।কত আলো দিয়ে সাজানো হত তখন!
মনে হত দুর্গাপুজোর পর্দাটা উঠল।
এই অভিযানে আমার সঙ্গী ছিল পার্থ,আমার ছেলেবেলার সাথী Parthapratim Mitra।মনে আছে ১৯৮৬র বিশ্বকর্মা পুজোয় সে'ই খবরটা এনে দিল।সঙ্গে সজল ছিল কি,(sajal saha)মনে পড়ছে না।
পিনকলে একটা দোকানে রুটির ভেতর ডিমের মামলেট('ওমলেট' শব্দের চল ছিল কেবল ইংরেজি পাঠ্যবইতে) পুরে,তাতে পেঁয়াজ আর লেবু দিয়ে দিচ্ছে।এই আজব খাবারের নাম দিয়েছে 'এগরোল'।তিনটাকা করে দাম।হাফ করে নিলে দেড় টাকা।মানে হাফের দাম বাংলা সিনেমার টিকিটের দামের কাছাকাছি।আর ফুল খেলে পেটে গেল একটা হিন্দি সিনেমার টিকিটের দাম(তখন আমাদের জীবনে মুদ্রামানগুলো এইভাবে সিনেমা হলের টিকিটের দামের নিরিখেই স্থিরীকৃত হত)।তা,শলাপরামর্শ করে আমি আর পার্থ আসন্ন দুটো বাংলা সিনেমাই আমাদের জীবন থেকে খসিয়ে দিলাম।আর দুটো অর্ধ-এগরোল আমাদের পেটে গেল!
সেই আমাদের প্রথম এগরোল খাওয়া।বিশ্বকর্মা দেবতার পুজোর সন্ধ্যায়।তখনও আমাদের মফস্বলের ফুটপাত চাউমিন,চিকেন রোল,মোমো...এসবে মুখ ঢাকে নি।সেসব আরও হাফ থেকে দু দশক পরের গল্প।
আমাদের কলেজবেলার 'চয়েস' চলত মোগলাই না রোল,এই নিয়ে।বন্ধুদের সঙ্গে হাফ-হাফ।
৩
এর পরের বছর বিশ্বকর্মা দেবতা এসে ঢুকে পড়ল আমাদের বাড়ির ভেতরেই।১৯৮৭সালে বাবা বাড়ির পাশে শুরু করল ফার্নিচারের দোকান।সঙ্গে কাঠের গোলা।
অতএব বিশ্বকর্মা বাড়ির বাৎসরিক দেবতা হলেন।মা গোছগাছ করত।বাবার নামেই পুজোটা চড়ত,সবই ঠিক,কিন্তু পুজোটা নিয়ে মাতত আসলে গোলার কর্মচারী আর মিস্ত্রিরা।দুপুরে ফ্রায়েড রাইস হত।সঙ্গে আলুর দম।আর বেগুনি(তখনও চিলি চিকেন নামের বস্তুটি আসে নি)।আর রাতে মোগলাইয়ের সঙ্গে কষা মাংস।
মদ বস্তুটি নিষিদ্ধ ছিল।
শিকারিকাকাকে যেমন তার বিশ্বকর্মা দেবতা বাঁচাতে পারে নি,আমাদের বাড়ির ব্যবসাটাকেও পারল না।এক দশক পুরোলো না,বিশ্বকর্মা গণেশ দেবতাকে নিয়ে উল্টোলেন।
পাট চুকলো সব কিছুর।
কারখানার ধোঁয়ারাও রুগ্ন হতে হতে হতে একসময় মিলিয়েই গেল।কারখানার দরজার পাশে ধর্ণার ঝুপড়ি গড়ে উঠল,মিলিয়ে গেল...।বিশ্বকর্মা বিবর্ণ হতে থাকলেন।
আর আমাদের শহর ইছাপুরের ভুগোল তার চেনা চিন্হগুলো হারাতে শুরু করল।
৪
যেখানে পুজো হত সেই দোকান আর গোলার জায়গাটা এখন ভগ্নস্তুপ।ফ্ল্যাট তোলার কাজ চলছে।
পলতার বেঙ্গল এনামেলের জায়গাতেও বহুতলখচিত সিটি হবে শুনি।
বিশ্বকর্মা দেবতা উদ্বাস্তু।
শিকারিকাকার উত্তরাধিকারীরা অবশ্য শহরে-শহরে এখনও বিশ্বকর্মাকে টিকিয়ে রেখেছে।আজও তাই বক্স বাজে। খিচুড়ি কিংবা ফ্রায়েড রাইস চাপে।নাচ হয়। রাত অবধি আলো জ্বলে। বিশ্বকর্মার মুখটা বছরে একবার ভেসে ওঠে।শিকারিকাকার সঙ্গে মিলে যায়।
মরা সময়ের নাসপাতির গন্ধ ভেসে আসে মন্ডপের পেছনে চাপানো রুগ্ন হাঁড়ির ঢাকনা সরিয়ে!



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন