শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি
স্বামী সারদানন্দ
১)
একটি সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে (১)
সেদিন ছিল সোমবার ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে নভেম্বর। তখন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আমরা অধ্যয়ন করি এবং ইতিপূর্বে দুই-তিনবার মাত্র দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের পুণ্য দর্শন লাভ করিয়াছি। কোন কারণে কলেজ বন্ধ থাকায় আমরা [বরদা পাল, হরিপ্রসন্ন (স্বামী বিজ্ঞানানন্দ) এবং আমি] ঐ দিবস অপরাহ্ণে ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হইব বলিয়া পরামর্শ করিয়া স্থির করিয়াছিলাম। স্মরণ আছে নৌকাযোগে দক্ষিণেশ্বরে যখন উপস্থিত হইলাম তখন বেলা দুইটা বা আড়াইটা হইবে।
ঠাকুরের ঘরে প্রবেশ করিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে প্রণাম করিবামাত্র তিনি বলিলেন, 'তাই তো, তোমরা আজ আসিলে; আর কিছুক্ষণ পরে আসিলে দেখা হইত না; আজ কলকাতায় যাইতেছি, গাড়ি আনিতে গিয়াছে; সেখানে উৎসব, ব্রাহ্মদের উৎসব। যাহা হউক, দেখা যে হইল তাই ভাল, বস। দেখা না পাইয়া ফিরিয়া যাইলে। মনে কষ্ট হইত।'
ঘরের মেঝেতে একটি মাদুরে আমরা উপবেশন করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, 'মহাশয়, আপনি যেখানে যাইতেছেন সেখানে আমরা যাইলে কি প্রবেশ করিতে দিবে না?' ঠাকুর বলিলেন, 'তাহা কেন? ইচ্ছা হইলে তোমরা অনায়াসে যাইতে পার -সিঁদুরিয়াপটি মণি মল্লিকের বাড়ি।' একজন নাতিকৃষ্ণ গৌরবর্ণ রক্তবস্ত্র-পরিহিত যুবক ঐ সময় গৃহে প্রবেশ করিতেছেন দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাকে বলিলেন, 'ওরে, এদের মণি মল্লিকের বাড়ির নম্বরটা বলিয়া দে তো!' যুবক বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, '৮১ নম্বর চিৎপুর রোড, সিঁদুরিয়াপটি।' পরে জানিয়াছিলাম যুবকটির নাম বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দ)।
অল্পক্ষণ পরেই গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল এবং ঠাকুর বাবুরামকে নিজ গামছা, মশলার বটুয়া ও বস্ত্রাদি লইতে বলিয়া শ্রীশ্রীজগদম্বাকে প্রণামপূর্বক গাড়িতে আরোহণ করিলেন। বাবুরাম পূর্বোক্ত দ্রব্যসকল লইয়া গাড়ির অন্যদিকে উপবিষ্ট হইলেন অন্য এক ব্যক্তিও সেদিন ঠাকুরের সঙ্গে কলিকাতায় গিয়াছিলেন। অনুসন্ধানে জানিয়াছিলাম, তাঁহার নাম প্রতাপচন্দ্র হাজরা।
ঠাকুর চলিয়া যাইবার পরেই আমরা সৌভাগ্যক্রমে একখানি গহনার নৌকা পাইয়া কলিকাতায় বড়বাজার ঘাটে উত্তীর্ণ হইলাম। পরে সন্ধ্যা সমাগতা হইলে উৎসবস্থলে আগমন করিলাম। বাটির সম্মুখে রাস্তায় পৌঁছিতেই মধুর সংগীত ও মৃদঙ্গের রোল আমাদের কর্ণগোচর হইল। তখন কীর্তন আরম্ভ হইয়াছে বুঝিয়া আমরা দ্রুতপদে বৈঠকখানায় উপস্থিত হইয়া যাহা দেখিলাম তাহা বলিবার নহে। ঘরের ভিতরে বাহিরে লোকের ভিড় লাগিয়াছে। প্রত্যেক দ্বারের সম্মুখে এবং পশ্চিমের ছাদে এত লোক দাঁড়াইয়াছে যে, সেই ভিড় ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করা এককালে অসাধ্য। সকলেই উদগ্রীব হইয়া গৃহমধ্যে ভক্তিপূর্ণ স্থিরনেত্রে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিয়াছে; পার্শে কে আছে বা না আছে, তাহার সংজ্ঞামাত্র নাই। সম্মুখের দ্বার দিয়া গৃহে প্রবেশ অসম্ভব বুঝিয়া আমরা পশ্চিমের ছাদ দিয়া ঘুরিয়া বৈঠকখানার উত্তরের এক দ্বারপার্শে উপস্থিত হইলাম। লোকের জনতা এখানে কিছু কম থাকায় কোনরূপে গৃহমধ্যে মাথা গলাই দেখিলাম -অপূর্ব দৃশ্য!
গৃহের ভিতরে স্বর্গীয় আনন্দের বিশাল তরঙ্গ খরস্রোতে প্রবাহিত হইতেছে। সকলে এককালে আত্মহারা হইয়া কীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হাসিতেছে, কাঁদিতেছে, উদ্দাম নৃত্য করিতেছে, ভূমিতে আছাড় খাইয়া পড়িতেছে, বিহ্বল হইয়া উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করিতেছে। আর ঠাকুর সেই উন্মত্ত দলের মধ্যভাগে নৃত্য করিতে করিতে কখনও দ্রুতপদে তালে তালে সম্মুখে অগ্রসর হইতেছেন, আবার কখনও বা ঐরূপে পশ্চাতে হাঁটিয়া আসিতেছেন এবং ঐরূপে যখন যেদিকে তিনি অগ্রসর হইতেছেন, সেই দিকের লোকেরা মন্ত্রমুগ্ধবৎ হইয়া তাঁহার অনায়াসে গমনাগমনের জন্য স্থান ছাড়িয়া দিতেছে। তাঁহার হাস্যপূর্ণ আননে অদৃষ্টপূর্ব দিব্যজ্যোতি ক্রীড়া করিতেছে এবং প্রতি অঙ্গে অপূর্ব কোমলতা ও মাধুর্যের সহিত সিংহের ন্যায় বলের যুগপৎ আবির্ভাব হইয়াছে। সে এক অপূর্ব নৃত্য -তাহাতে আড়ম্বর নাই, কৃচ্ছ্রসাধ্য অস্বাভাবিক অঙ্গবিকৃতি বা অঙ্গ-সংযম-রাহিত্য নাই; আছে কেবল আনন্দের অধীরতায় মাধুর্য ও উদ্যমের সম্মিলনে প্রতিটি অঙ্গের স্বাভাবিক সংস্থিতি ও গতিবিধি! নির্মল সলিলরাশি প্রাপ্ত হইয়া মৎস্য যেমন কখন ধীরভাবে এবং কখনও দ্রুত সন্তরন দ্বারা চতুর্দিকে ধাবিত হইয়া আনন্দ প্রকাশ করে, ঠাকুরের এই অপূর্ব নৃত্যও যেন ঠিক তদ্রুপ। তিনি যেন আনন্দ-সাগর -ব্রহ্মস্বরূপে নিমগ্ন হইয়া নিজ অন্তরের ভাব বাহিরের অঙ্গসংস্থানে প্রকাশ করিতেছিলেন। এইরূপে নিত্য করিতে করিতে তিনি কখনও বা সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িতেছিলেন। কখনও বা তাঁহার পরিধেয় বসন স্খলিত হইয়া যাইতেছিল এবং অপরে উহা কোটিতে দৃঢ়বদ্ধ করিয়া দিতেছিল। আবার কখনোবা কাহাকেও ভাবাবেশে সংজ্ঞাশূন্য হইতে দেখিয়া তিনি তাহার বক্ষ স্পর্শ করিয়া তাহাকে পুনরায় সচেতন করিতেছিলেন।
২)
একটি সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে (২)
(সেই অপূর্ব দৃশ্য -গৃহমধ্যে স্বর্গীয় আনন্দের বিশাল খরস্রোতে সকলে এককালে আত্মহারা হইয়া উদ্দাম নৃত্য করিতেছে।)
বোধ হইতেছিল যেন ঠাকুরকে অবলম্বন করিয়া এক দিব্য উজ্জ্বল আনন্দধারা চতুর্দিকে প্রসৃত হইয়া যথার্থ ভক্তকে ঈশ্বরদর্শনে, মৃদু বৈরাগ্যবানকে তীব্র বৈরাগ্যলাভে, অল্প মনকে আধ্যাত্বিক রাজ্যে সোৎসাহে অগ্রসর হইতে সামর্থ্য প্রদান করিতেছিল এবং ঘোর বিষয়ীর মন হইতেও সংসারাসক্তিকে সেই ক্ষণের জন্য কোথাও বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছিল। তাঁহার ভাবাবেশ অপরে সংক্রমিত হইয়া তাহাদিগকে ভাববিহ্বল করিয়া ফেলিতেছিল এবং তাঁহার পবিত্রতায় প্রদীপ্ত হইয়া তাহাদের মন যেন কোন এক উচ্চ আধ্যাত্মিক স্তরে আরোহন করিয়াছিল। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আচার্য গোস্বামী বিজয়কৃষ্ণের তো কথাই নাই, অন্য সকলের অনেকেই সেদিন মাঝে মাঝে ভাবাবিষ্ট ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পতিত হইয়াছিলেন। আর সুকন্ঠ আচার্য চিরঞ্জীব সেইদিন একতারা সহযোগে 'নাচ রে আনন্দময়ীর ছেলে, তোরা ঘুরে ফিরে, -ইত্যাদি' সংগীতটি গাইতে গাইতে তন্ময় হইয়া যেন আপনাতে আপনি ডুবিয়া গিয়াছিলেন। ঐরূপে প্রায় দুই ঘন্টারও অধিককাল কীর্তনানন্দে অতিবাহিত হইল।
অনন্তর রূপ-রসাদি বিষয় হইতে মন উঠাইয়া লইয়া ঈশ্বরে অর্পণ করিতে পারিলেই জীবের পরম শান্তিলাভ হয়, এই প্রসঙ্গে ঠাকুর সম্মুখস্থ লোকদিগকে অনেক কথা কহিতে লাগিলেন। স্ত্রী ভক্তেরাও তখন বৈঠকখানাগৃহের পূর্বদিকের চিকের আড়ালে থাকিয়া তাঁহাকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে নানা প্রশ্ন করিয়া উত্তরলাভে আনন্দিতা হইতে লাগিলেন। ঐরূপে প্রশ্ন সমাধান করিতে করিতে ঠাকুর প্রসঙ্গোত্থিত বিষয়ের দৃঢ় ধারণা করাইয়া দিবার জন্য শ্রীশ্রীজগদম্বার নাম আরম্ভ করিলেন এবং একের পর অন্য করিয়া রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতি সাধক-ভক্তগণ রচিত অনেকগুলি সংগীত গাইতে থাকিলেন।
ঠাকুর যখন ঐরূপে মা-র নাম করিতেছিলেন তখন গোস্বামী বিজয়কৃষ্ণ গৃহান্তরে যাইয়া কতকগুলি ভক্তের নিকটে তুলসীদাসী রামায়ণের পাঠ ও ব্যাখ্যায় নিযুক্ত ছিলেন। সায়াহ্ন উপাসনার সময় উপস্থিত প্রায় দেখিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উক্ত কার্য আরম্ভ করিবেন বলিয়া তিনি এখন পুনরায় বৈঠকখানাগৃহে উপস্থিত হইলেন। বিজয়কে দেখিয়াই ঠাকুর বালকের ন্যায় রঙ্গ করিয়া বলিতে লাগিলেন, 'বিজয়ের আজকাল সংকীর্তনে বিশেষ আনন্দ। কিন্তু সে যখন নাচে তখন আমার ভয় হয় পাছে ছাদসুদ্ধ উল্টে যায়! (সকলের হাস্য) হ্যাঁগো, এইরূপ একটি ঘটনা আমাদের দেশে সত্য-সত্যই হইয়াছিল। সেখানে কাঠ মাটি দিয়েই লোক দোতলা করে। এক গোস্বামী শিষ্যবাড়ি উপস্থিত হয়ে ঐরূপ দোতালায় কীর্তন আরম্ভ করেন। কীর্তন জমিতেই নাচ আরম্ভ হল। এখন, গোস্বামী ছিলেন (বিজয়কে সম্বোধন করিয়া) তোমারি মতন একটু হৃষ্টপুষ্ট। কিছুক্ষণ নাচবার পরেই ছাদ ভেঙে তিনি একেবারে একতলায় হাজির! তাই ভয় হয়, পাছে তোমার নাচে সেইরূপ হয়। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর বিজয়কৃষ্ণের গেরুয়া বস্ত্র-ধারণ লক্ষ্য করিয়া এইবার বলিতে লাগিলেন, 'আজকাল এঁর গেরুয়ার উপরেও খুব অনুরাগ। লোকে কেবল কাপড়-চাদর গেরুয়া করে। বিজয় কাপড়, চাদর, জামা, জুতা জোড়াটা পর্যন্ত গেরুয়ায় রঙিয়েছে। তা ভাল, একটা অবস্থা হয় যখন ঐরূপ করতে ইচ্ছা হয় -গেরুয়া ত্যাগের চিহ্ন কিনা, তাই গেরুয়া সাধককে স্মরণ করিয়ে দেয়, সে ঈশ্বরের জন্য সর্বস্ব ত্যাগে ব্রতী হয়েছে। গোস্বামী বিজয়কৃষ্ণ এইবার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন এবং ঠাকুর তাঁহাকে প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করিলেন, 'ওঁ শান্তি, শান্তি, প্রশান্তি হোক তোমার।'
ঠাকুর যখন মা-র নাম করিতেছিলেন, তখন আরেকটি ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল। উহাতে বুঝিতে পারা যায়, অন্তর্মুখে সর্বদা অবস্থান করিলেও তাঁহার বহির্বিষয় লক্ষ্য করিবার শক্তি কতদূর তীক্ষ্ণ ছিল। গান গাহিতে গাহিতে বাবুরামের মুখের প্রতি দেখিয়া তিনি বুঝিয়াছিলেন, সে খুব ক্ষুধা পিপাসায় কাতর হইয়াছে। তাঁহার অগ্রে সে কখনোই ভোজন করিবে না একথা জানিয়া, তিনি নিজে খাইবেন বলিয়া কতকগুলি সন্দেশ ও এক গ্লাস জল আনয়ন করাইয়াছিলেন এবং উহার কণামাত্র স্বয়ং গ্রহণপূর্বক অধিকাংশ শ্রীযুত বাবুরামকে প্রদান করিয়াছিলেন। অবশিষ্ট উপস্থিত ভক্তসকলে প্রসাদরূপে গ্রহণ করিয়াছিল।
বিজয় প্রণাম করিয়া সায়াহ্নের উপাসনা করিতে নিম্মে আসিবার কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরকে আহার করিতে অন্দরে লইয়া যাওয়া হইল। তখন রাত্রি নয়টা বাজিয়া গিয়াছে। আমরা ঐ অবকাশে শ্রীযুক্ত বিজয়ের উপাসনায় যোগদান করিবার জন্য নিম্নে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। উপাসনাকার্য কিছুক্ষণ চলিবার পরে ঠাকুর সভাস্থলে উপস্থি…
৩)
শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশপ্রণালী (১)
ঠাকুরের পুণ্যদর্শন ইতঃপূর্বে অল্পকালমাত্র লাভ করিলেও তাঁহার অমৃতময় বাণীর অপূর্ব আকর্ষণ আমরা প্রথম দিন হইতেই উপলব্ধি করিয়াছিলাম। উহার কারণ তখন হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিলেও এখন বুঝিতে পারি, তাঁহার উপদেশ দিবার প্রণালী কতদূর স্বতন্ত্র ছিল। উহাতে আড়ম্বর ছিল না, যুক্তিতর্কের ছটা, অথবা বাছা-বাছা বাক্যবিন্যাস ছিল না, স্বল্পভাবকে ভাষার সাহায্যে ফেনাইয়া অধিক দেখাইবার প্রয়াস ছিল না, কিংবা দার্শনিক সূত্রকারদিগের ন্যায় স্বল্পাক্ষরে যতদূর সাধ্য অধিক ভাব প্রকাশ করিবার চেষ্টাও ছিল না। ভাবময় ঠাকুর ভাষার দিকে আদৌ লক্ষ্য রাখিতেন কি না বলিতে পারি না, তবে যিনি তাঁহার কথা একদিনও শুনিয়াছেন, তিনিই লক্ষ্য করিয়াছেন অন্তরের ভাব শ্রোতৃবর্গের হৃদয়ে প্রবেশ করাইবার জন্য তিনি কিরূপে তাহাদিগের জীবনে নিত্য পরিচিত পদার্থ বা ঘটনা সকলকে উপমাস্বরূপে অবলম্বন করিয়া চিত্রের পর চিত্র আনিয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে ধারণ করিতেন। শ্রোতৃবর্গও উহাতে তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা যেন তাহাদিগের চক্ষের সমক্ষে অভিনীত প্রত্যক্ষ করিয়া তাঁহার কথার সত্যতায় এককালে নিঃসন্দেহ ও পরিতৃপ্ত হইয়া যাইত। ঐসকল চিত্র তাঁহার মনে তখনই তখনই কিরূপে উদিত হইত, এই বিষয়ে অনুধাবন করিতে যাইয়া আমরা তাঁহার অপূর্ব স্মৃতিকে, অদ্ভুত মেধাকে, তীক্ষ্ণ দর্শনশক্তিকে, অথবা অদৃষ্টপূর্ব প্রত্যুৎপন্নমতিকে কারণস্বরূপ নির্দেশ করিয়া থাকি। ঠাকুর কিন্তু একমাত্র মা-র কৃপাকেই উহার কারণ বলিয়া সর্বদা নির্দেশ করিতেন; বলিতেন, 'মার উপরে যে একান্ত নির্ভর করে, মা তাহার অন্তরে বসিয়া যাহা বলিতে হইবে, তাহা অভ্রান্ত ইঙ্গিতে দেখাইয়া বলাইয়া থাকেন, এবং স্বয়ং তিনি (শ্রীশ্রীজগদম্বা) ঐরূপ করেন বলিয়াই তাঁহার জ্ঞানভাণ্ডার কখনও শূন্য হইয়া যায় না। মা তাঁহার অন্তরে জ্ঞানের রাশি ঠেলিয়া দিয়া সর্বদা পূর্ণ করিয়া রাখেন, সে যতই কেন ব্যয় করুক না, কখনোই শূন্য হইয়া যায় না।' এই বিষয়টি বুঝাইয়া তিনি একদিন নিম্নলিখিত ঘটনাটির উল্লেখ করিয়াছিলেন :
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির উত্তর পাশেই ইংরেজ রাজের বারুদগুদাম বিদ্যমান আছে। কতকগুলি সিপাহী তথায় নিয়ত পাহারা দিবার জন্য থাকে। উহারা সকলেই ঠাকুরকে নিরতিশয় ভক্তি করিত এবং কখন কখনও তাঁহাকে তাহাদিগের বাসায় লইয়া যাইয়া ধর্মবিষয়ক নানা প্রশ্নের মীমাংসা করিয়া লইত। ঠাকুর বলিতেন, একদিন তাহারা প্রশ্ন করিল, 'সংসারে মানব কিভাবে থাকিলে তাহার ধর্ম লাভ হইবে?' অমনি দেখিতেছি কি, কোথা হইতে সহসা একটি ঢেঁকির চিত্র সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত। ঢেঁকিতে শস্য কুটা হইতেছে এবং একজন সন্তর্পনে উহার গড়ে শস্যগুলি ঠেলিয়া দিতেছে। দেখিয়াই বুঝিলাম, মা বুঝাইয়া দিতেছেন, ঐরূপে সতর্কভাবে সংসারে থাকিতে হইবে। ঢেঁকির গড়ের সম্মুখে বসিয়া যে শস্য ঠেলিয়া দিতেছে, তাহার যেমন সর্বদা দৃষ্টি আছে, যাহাতে তাহার হাতের উপর ঢেঁকির মুষলটি না পড়ে, সেইরূপ সংসারের প্রত্যেক কাজ করিবার সময় মনে রাখিতে হইবে, ইহা আমার সংসার বা আমার কাজ নহে, তবেই বন্ধনে পড়িয়া আহত ও বিনষ্ট হইবে না। ঢেঁকির ছবি দেখিবামাত্র, মা মনে ঐ কথার উদয় করিয়া দিলেন এবং উহাই তাহাদিগকে বলিলাম। তাহারাও শুনিয়া পরম পরিতুষ্ট হইল। লোকের সহিত কথা বলিবার কালে ঐরূপ ছবিসকল সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন