' আজ সকাল থেকেই নিদ্রাহীন স্বপ্নের নৈঃশব্দে / জেগে থাকা অন্তলোকের প্রতিটা শব্দে, বর্ণে, অক্ষরে /অঝোরধারায় বৃষ্টি পড়ছে।' এভাবেই কবি জয়রাজ পাল ' শ্রাবণ অর্ঘ্য ' সাজিয়েছেন তাঁর প্রিয় কবি রবীদ্রনাথের প্রতি। আমরা চাইব জয়রাজের অন্তর্লোকও কবিতাবোধে বর্ণে, গন্ধে ,অক্ষরে আরো সেজে উঠবে অচিরেই । আপাতত পড়ি ------
কবি জয়রাজ পাল-এর দুটি কবিতা
স্বাধীনতার খোঁজে
হৃদয়ের খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসা পৃথিবীর প্রতিটা
সুরুজ সকালে,
সরষেফুলের রং ছড়ানো সবুজ ধানক্ষেতের আলে, একরাশ
কামনা সঞ্চিত প্রেমের কুঞ্জবনে আমি দেখেছিলাম;
আমার মায়ের দু'চোখ জুড়ে মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো জ্বলজ্বলিয়ে ওঠা
সেই শেষ-শুদ্ধ অস্তিত্ব রক্ষার আকণ্ঠ তৃষ্ণা।
হয়তো কোনো এক অজানা অচেনার উন্মাদ নেতৃত্ব খরস্রোতা নদীর
তুমুল বেগে উঠে এসে হত্যা করতে চেয়েছিল তাঁর
আত্মিক পরিচয়কে।
দুর্নীতির ঝলসানো আক্রোশের দাবানলে পুড়ে পুড়ে খাঁক করে
দিতে চেয়েছিল নির্যাতিত আইনের ঘরে বন্দী সকল
মৌলিক চাহিদাকে।
ঠিক তখনই মায়ের আদিগন্ত বিস্তৃত বুকের সীমাহীন পরিসর
জুড়ে মরণপণ কান্নার তুষার হয়ে জমে থাকা,
শহীদের ডানপাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনা সতেজ
রক্তের গভীর থেকে গভীরতর শোক-
দৈর্ঘ প্রস্থের বিশাল গোলকধাঁধায় জট পাকিয়ে শূন্যাকাশে
আপন মনে জ্বলতে থাকা অনিশ্চয়তার ধ্রুবতারার সাথে...
আমাকেও মুক্তির ঘনঘোর বরষায় জীবনবেষ্টিত পূর্ণতার দীপ্ত
সমাহারে আলোকিত করে তুলেছিল।
তবে আমিও দেশের মাটির অম্লান ঘ্রাণ গায়ে মেখে আমার মাকে,
নিজের জীর্ণদেহের শিরা-উপশিরার জমিয়ে রাখা ন্যায্যতার
তীব্র আশায়, তীব্র ইচ্ছায় অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরেছিলাম;
আর আমার উদাত্ত কন্ঠের প্রবহমান সুরের ধ্বনিতে সমগ্র প্রাণিকূলকে
একত্রিত করে ছিনিয়ে এনেছিলাম অস্ত্রহাতের
উদ্বেলিত সেই স্বাধীনতা।
আসলে শেষ নিঃশ্বাসের সময় আমার মা পরাধীনতার ছায়াতলে
পড়ে থাকা পোশাকগুলো আত্মবলিদানের জয়গান গেয়ে, বীর
বীরাঙ্গনার লাল সেলাম জানিয়ে-
সবার ঘরে, মনে, প্রাণে সম্প্রীতি ও ঐক্যের হয়ে অত্যন্ত সযত্নে
সেলাই করে একসূত্রে বেঁধে রেখেছিল।
শ্রাবণ অর্ঘ্য
নব পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় বালিশের নিচে ছুঁয়ে দেখা আমার
একান্ত আপন পৃথিবীকে দৃষ্টি প্লাবিত কান্নার মতো আচমকা
অন্ধকার করে দিয়ে...
কেন জানি না আজ সকাল থেকেই নিদ্রাহীন স্বপ্নের নৈঃশব্দে
জেগে থাকা অন্তলোকের প্রতিটা শব্দে, বর্ণে, অক্ষরে
অঝোরধারায় বৃষ্টি পড়ছে।
মনে হচ্ছে আমার পাঁচিল দেওয়া শুষ্ক তপ্ত মরুবুকে একফোটা জলের
তৃষ্ণায় নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত কবিতার ওপারে
বর্ষার থৈ থৈ বিল, মেঘের গমগমে গর্জন।
এমনকি সৃষ্টির মহিরুহের প্রলম্বিত ঘন কুয়াশায় আবৃত
মনের খোলা জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়া জীবনস্মৃতির আঁকাবাঁকা
গতিপথ তরতাজা হয়ে উঠে আমাকেই বারবার বলছে,
"তুই হেরে গেছিস, তুই হেরে গেছিস।
অসম্পূর্ণতার উদাসীন শরণ পাতায় বেদনার কিঞ্চিত কালো জলছবি
ফুটিয়ে এবার অন্তত থাম!
ঐশ্বরিক সুখের নির্যাস গায়ে মেখে একরাশ শূন্যতায় নিজেকে খোঁজার,
বেলাশেষের ছায়াপথ পেরিয়ে আলো জ্বালাবার
প্রদীপটাকে নিভিয়ে দে!"
কিন্তু রক্তের মায়াটানে বার-বার ফিরে আসা চিরায়ত বন্ধন ও বিশ্বাসের
সকল দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে সর্বনাশী হিংসুটে এক ঝড়ের মতো
আদিগন্তে উড়াল দিয়ে ভেসে গিয়ে-
আমি তখন গভীর মনোযোগে, অপরিসীম আনন্দে, নাগরিক ক্লান্তিতে
ছবি আঁকার চেষ্টা করছি এক বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের।
এমনকি শৈশবে মায়ের মৃত্যু, কৈশোরে বন্ধুপ্রতীম বৌদির মৃত্যু,
যৌবনে স্ত্রীর অকাল মৃত্যু...
এই সমস্ত কল্পনাতীত শোককে যান্ত্রিক সভ্যতার ঈশানকোণে জড়সড় করে
উদ্ভ্রান্ত পথিকের মতো ছুটে চলে আমি মানবাত্মার
সান্ত্বনাস্থলে আশ্রয় পেতে চাইছি-
আমার বাঁধনহারা প্রতিমুহূর্তের অবলম্বন, অস্তিত্বহীন রণতরীর
গীতবিতানের সুর, আর অন্তরাত্মার সাথে একান্তে মিশে থাকা
কালজয়ী ঈশ্বরের।
আসলে পঁচিশে বৈশাখের মতো বাইশে শ্রাবণেও
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রবি-ভক্তদের আজন্ম উজাড় নিবেদনে
আমি বড়ো গভীর উপলব্ধি করি আমার প্রাণপ্রিয় সাহিত্যের
সেই অমর স্রষ্টাকে।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন