মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর, ২০২১

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা




ধুলোর সিংহাসন

পর্ব * চার


( পূর্বানুষঙ্গ : বৈশাখী দুর্যোগ মাথায় কোচিং-এ পড়াতে আসে অশোক। ক্লাস শুরু করে। মাথায় ঘুরতে থাকে অর্থচিন্তা। ফ্ল্যাটের ই এম আই দেওয়ার পর হাতে দশটা টাকাও নেই। ইতিমধ্যে, অলি, অশোকের স্ত্রী মেয়ে উপমাকে দিয়ে খবর পাঠায় ,বাড়ি ফেরার পথে যেন দু'কিলো চাল আর একটা সরষের তেল নিয়ে যায়। মাথায় চাপে দুশ্চিন্তার ঘন মেঘ। এরই মধ্যে মিরুজিন পত্রিকায় প্রকাশিত কবি তুষার চৌধুরীর কবিতা পড়তে থাকে অশোক। )



কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল অশোক...।

' আসব স্যার ?' টুয়েলভের অমিত রাজু কৃশানু মনিকার প্রশ্নে যেন সম্বিত ফিরল। যেন হিমশৈলে গোত্তা খাওয়া টাইটানিক। ভেঙে চুরমার হল কল্পনার অলীক  জগৎ । ফিরে এল বাস্তবের রুক্ষ ধূসর মাটিতে।

' এসো  এসো  ' শশব্যস্ত অশোক।

' স্যর, শিবম রাহুল নেহা নাজনিন.. ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। '

' দিক না, তোমরা ঢুকে পড়ো।'


অশোক বুঝতে পারে, অমিতরা ওদের কেস  খাওয়াতে চাইছে। প্রতিদিনই ওদের এ ওর নামে কেস দেওয়া দেয়ি চলে। এরা তবু একটু বড়। সেভেন এইটের তো কথাই নেই। সারাক্ষণ এ ওর পিছনে লাগছে আর ভুরি ভুরি নালিশ। এ সব টেকনিক এখন অশোক বোঝে। আগে মাথা গরম করে ফেলত। উল্টোপাল্টা মেরেও দিত। পরে নিজের মনেই কষ্ট পেত, এতটা জোরে না মারলেই হত। তাই এখন আর মাথা গরম করে না। ঠান্ডা মাথায় ওদের দুস্টুমী সামলাতে চেষ্টা করে ।


' বৃষ্টি পড়ছে তো স্যর, হাওয়াও দিচ্ছে জোর ' মানে ওদের মনের ইচ্ছে ,স্যর এক্ষুণি বেতের লাঠি নিয়ে সবক'টাকে রাস্তা থেকে টেনে এনে কোচিংয়ে ঢোকাক, দু'চার ঘা দিয়ে। আর ওরা মজা লুটুক। কিন্তু সে ফাঁদে পা দিল না অশোক। বলল, 'ওরা আসুক না, তোমরা তোমাদের পড়াটা দেখতে থা। ওরা তো বাচ্চা ছেলে না, মেরে ধরে আনতে হবে। যখন ইচ্ছে আসুক, এখনও তো ক্লাস শুরু হয়নি। '

' আচ্ছা স্যর। '

বলতে না বলতেই শিবম রাজু... হুড়মুড় করে ঢুকতে শুরু করল একে একে, এ ওকে ঠেলা গুঁতো মেরে। ঝড় উঠেছে জোরে। হওয়ার গতি যেন বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। আর বাইরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।

' সব ক'টা ভিজেছে, ঠিক হয়েছে, আড্ডা,পড়তে  এসে আড্ডা !' অমিত ঠেস কাটল।

' তোদের কী ? ' আমরা যা ----'

আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অশোক ধমকে থামল। ' সবাই চুপ করো, এবার নাম ডাকব।'

' হ্যাঁ স্যর ' সায় দিল সবাই ।


অনেকেই আজ আসেনি। আসতে পারেনি ঝড়- বৃষ্টির জন্য। উপস্থিতির হার খুবই কম। মাত্র দশ জন এসেছে পঁচিশ জনের মধ্যে। অশোক একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় ,আর মনে মনে হিসেব কষে, যা এরা দশজনই তো মাইনে দিয়ে দিয়েছে। তাহলে এই ব্যাচ থেকে আজ আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। বিমর্ষ হয় অশোক মনে মনে, কিন্তু ছাত্রদের বুঝতে দেয় না। নাম ডাকা শেষ হতে না হতেই একসাথে বলে ওঠে সবাই, ' স্যার, আজ পড়া হবে ? '

' কেন ? হবে না কেন ? '

' সবাই তো আসেনি। তাছাড়া এই ঝড়-বৃষ্টি... '

' তাতে কী, তোমরা তো এসেছ, তোমাদের পড়াটা মার যাবে কেন ? '

' ও আর একদিন বেশি করে পড়ে নেব' মনিকা বলে।

'  আমি একটা কথা বলব স্যর ' উঠে দাঁড়ায়  শিবম।

' কী কথা ?'

' স্যর,আজ একটা গল্প বলুন।'

' হ্যাঁ স্যর, হ্যাঁ স্যর ' চিল্লে ওঠে গোটা ক্লাস।


' আস্তে,আস্তে! ' দীপকবাবুর পরোক্ষ শাসানির কথাটা মনে পড়ে।

' একটা ভূতের গল্প বলুন স্যার।' আবদার নাজনিনের।

কিছুটা চুপ করে থেকে অশোক বলে, ' আচ্ছা দাঁড়াও, আজ কী ক্লাস ছিল শুনি আগে।'

' ফিলোজফি আর এডুকেশন। '

' আচ্ছা শোনো, ওসব ভূত-পেত্নির গল্প শুনে কোনও লাভ নেই। আজ বরং ফিলোজফির কিছু গল্প বলি।পড়ারও কাজ হবে, আবার গল্প শোনাও হবে। কি রাজি তো ? '

' হ্যাঁ স্যর, হ্যাঁ স্যর।'

' কিন্তু একটা শর্ত আছে।'

' কী শর্ত ?' উদগ্রীব সবাই।

' শর্ত এই ,আমি যা বলব, সেটা থেকেই পরে তোমাদের প্রশ্ন করব। দেখব, কে কতটা মনোযোগ দিয়ে শুনেছ।'

' ওকে স্যর ' আত্মপ্রত্যয়ী অমিত, শিবম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নেহা নাজনিন, 'সেই পড়া !'


' না পড়লে, না শিখলে , জানবে কী করে? আর না -শিখলে, না -জানলে, বড়ই বা হবে কী করে। দেখ, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবাই হাতে-পায়ে বড় হয়। কিন্তু পড়াশুনো করে যে নিজেকে খোঁজে, মানে নিজের ভেতরের শক্তির উন্মেষ ঘটাতে পারে, তা সে শিল্প -সাহিত্য -বিজ্ঞান যে-কোনও  দিকেই হোক না কেন, তবেই সে সত্যিকারের বড় হল। যেমন বড় হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, নিউটন, পিকাসো, ভ্যান গখ প্রমুখ জগৎ বিখ্যাত মানুষেরা।

'হ্যাঁ স্যার,হ্যাঁ স্যার  একদম ঠিক।' সবাই সায় দেয়।

গল্প বলার আগে, এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকাটা সেরে নেয় অশোক। তারও কারণ আছে,গল্পচ্ছলে পড়ানো মাদাম মন্তেস্বরী পদ্ধতি অনুযায়ী, সেটা যেমন একটা ব্যাপার, তেমনই  ছাত্রছাত্রীরা কেউ যাতে বাড়ি গিয়ে ভুল করে বলে না ফেলে যে, স্যর আজ পড়ায়নি,গল্প করেছে। তাহলে গার্জিয়ানরা রেগে টঙ হবে। মনে মনে ভাববে, টাকা দিয়ে ঝড়-জলের মধ্যে ছেলেমেয়েকে কোচিংয়ে পাঠাই কি ছেলেমেয়েকে  ভূতের গল্প শোনানোর জন্য।


' তাহলে এবার শুরু করা যাক।'

' হাঁ স্যর।' হোল ক্লাস লাফিয়ে ওঠে।


' শোনো আজ আমি তোমাদের ভারতীয় দর্শনের এমন একজন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে গল্পের মতো করে কিছু  আলোচনা করব , যাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসম বলেছেন 'এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন তার মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ । কী,জানতে ইচ্ছে করছে তো ,মানুষটি কে ? '

' হ্যাঁ স্যার, কে ? কে ? '

' তিনি হলেন ----'

কথাটা শেষ হলো না, অমনি লোডশেডিং। আলকাতরার মতো অন্ধকার নেমে এল চারদিকে। একসঙ্গে চিল্লে ওঠে সবাই। বিকট চিৎকারে আঁতকে ওঠে মনিকা ,নেহা ,নাজনিন। চট করে মোবাইলের ফ্ল্যাশটা জ্বালে অশোক।


দমকা হাওয়া সজোরে ধাক্কা মারছে বেড়ার দেয়ালে। দুম করে পড়ল হোয়াইটবোর্ডটা। ঘরটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। বাজ পড়ছে মুহুর্মুহু। আলকাতরার মতো ঘন অন্ধকার চিরে হীরের দ্যুতির মতো ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ। মেঘ গজরাচ্ছে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। ভয়ে জড়োসড়ো সবাই।

' স্যর বাড়ি যাব, ছুটি দিয়ে দিন।' প্রায় কেঁদে ফেলল কেউ কেউ।

' না, না এই দুর্যোগের মধ্যে কী করে যাবে। ঝড় না থামা পর্যন্ত কেউ বেরোবে না। চুপচাপ বোসো। কালবৈশাখী বেশিক্ষণ থাকে না। থেমে যাবে। ' ভরসা দেয় অশোক।


মিনিট পনেরো তান্ডবলীলা চালানোর পর ঝড়টা থামল। বৃষ্টিও ধরে এসেছে অনেকটা। কারেন্ট এখনও আসেনি। কোথাও লাইটপোস্ট উপড়েছে  নিশ্চয়ই।

' স্যর, এবার আমরা যাই ? '

' যেতে পারবে ?'

' হ্যাঁ স্যর।'

' পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটি সম্পর্কে আর শোনা হল না।'     

'  ঠিক আছে, আরেকদিন শুনবে।'

 ' কে স্যর, নামটা অন্তত বলে দিন।'

 ' বুদ্ধদেব। '

 ' ওকে স্যার। '

' সাবধানে যেও সবাই। '



ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। ' অঙ্কিত ক্লাস নাইন ( মা ) ' স্ক্রিনে ভাসছে লেখাটা।

' হ্যাঁ স্যার, অঙ্কিতের মা বলছি। '

' হ্যাঁ দিদি, বলুন।'

' আজ পাঠাব ? '

অশোক না বলতে যাচ্ছিল অমনি মনে পড়ল, অঙ্কিতের মা আজই ছেলের মাইনে পাঠাবে বলেছিল। প্রত্যেক মাসে দশ তারিখেই দেয় , এবার কী অসুবিধার জন্য বারো তারিখ দেবে, সকালে ফোন করে বলেছিল। আমতা আমতা করে অশোক বলল, ' হ্যাঁ, চলে আসতে পারে, আমি তো কোচিংয়েই আছি। '

' আচ্ছা।'

আলমারি থেকে মোমবাতি বার করে অশোক। টেবিলের ড্রয়ার থেকে দেশলাই । দু'তিনটে কাঠি ছিল। নেতিয়ে গেছে। জ্বলল না। শেষটা এক ঝলক স্ফুলিঙ্গ দেখাল শুধু । ' প্রবীরদের ঘর থেকে জ্বালিয়ে আনি 'মনে মনে ভেবে যেই বেরিয়েছে, অমনি ফোনটা বেজে উঠল আবার। সেই একই লেখা ' অঙ্কিত ক্লাস নাইন (মা)'

' হ্যাঁ দিদি, বলুন।'

' স্যার বলছি, আজ আর পাঠাচ্ছি না, ওর বাবা বলল, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আজ আর যেতে হবে না।'

' ঠিক আছে।'  অশোকের সংক্ষিপ্ত জবাব।


তাহলে আর মোম জ্বালিয়ে কী হবে । ন'টা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। আজ আর কেউ আসবে না। বাড়িই  যাই। বরং উপমাকে নিয়ে বসি গিয়ে।



কোচিং বন্ধ করতে গিয়ে অশোকের নজরে পড়ল ' তপোবন কোচিং সেন্টার ' লেখা ব্যানারটা তিন দিক ছিঁড়ে দরজার মাথার ওপর ঝুলছে। এত অন্ধকার এখন আর ঠিক করা যাবে না। কাল ছাত্রদের দিয়েই করাতে হবে।

কোচিং-এর  তালা বন্ধ করে বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়াল অশোক। চাল-তেলটা তাহলে মেজদার দোকান থেকে ধারেই নিয়ে যাই । কিন্তু দু'পা এগিয়ে দেখল, দোকান বন্ধ। এমনিতে ওদের দোকান প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে । ঝড় বৃষ্টির জন্য আজ বোধ হয় তাড়াতাড়ি বন্ধ করেছে ।


ঠিক এই সময়ে সেই আশ্চর্য কান্ডটা ঘটল। ঝড়-বৃষ্টি আর নেই। কিন্তু সে যে এসেছিল তার চিহ্ন  ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আশপাশের দোকানে, বাড়িতে, গাছপালায় চারপাশে। অলোকদের শুকনো নারকেল গাছটা মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তায়। ইলেকট্রিকের তার জড়িয়ে ঘড়িয়ে  বিশ্রাম নিচ্ছে মাটিতে। নমিদিদের টালির চাল খানিকটা ভেঙে পড়েছে। দুই ছেলেকে নিয়ে নমিদি সেখানে প্লাস্টিক ঢাকা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রাস্তায় টাঙানো ' তপোবন কোচিং সেন্টারে'র ব্যানারটা ছিঁড়ে-ভুড়ে উড়ে এসে পড়েছে ' সানন্দা জুয়েলার্স '-এর মাথায়। মুদি দোকান না, রাজুর রোলের দোকানটায়ও না,  একেবারে জুয়েলার্সের মাথায় ! ভাবতে কেমন যেন একটা হালকা বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল অশোকের মনে। এও কি প্রকৃতির এক ভীষণ ঠাট্টা ওর সঙ্গে !


বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করেছে অশোক। কিন্তু মনে হচ্ছে পথঘাট সব অচেনা।  এই পথে  সে আর হাঁটছে না। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে...সুদূর অতীতের কোন রাস্তায় ' বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে যেখানে ছিলাম আমি...'


' আমায় চিনতে পারছেন? '

' হ্যাঁ দিব্যি ! তুমি তপোবন কোচিংয়ের অশোক স্যর।'

' আর আপনি মৌর্য সম্রাট অশোক ! '

' বেশ, ডাকলে কেন বল, দেখ, আমার মন মেজাজ খুব একটা ভালো নেই। ক'দিন আগেই কলিঙ্গ যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এখনও রক্ত জমাট বেঁধে আছে কলিঙ্গের রাস্তাঘাটে,অলিতে গলিতে। হাজারে হাজারে হাতি-ঘোড়া, কলিঙ্গরাজ এবং আমার নিহত সৈনিকেরা, শিশু-কিশোর, নর -নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মরে পড়ে আছে। দুর্গন্ধে হাঁটা-চলা যাচ্ছে না।'

' ভাল লাগছে শুনতে, বলুন না, সেই ছোটবেলা থেকে ইতিহাসে পড়ে আসছি ' অশোকের কলিঙ্গ বিজয় ' আর আজ আপনার নিজের মুখেই শুনছি সেই মর্মন্তুদ কাহিনি। বেশ লাগছে।

' তুমি তো আচ্ছা লোক হে মাস্টার ! কোথায় আমার মনের ওপর দিয়ে  ঝড় বয়ে যাচ্ছে ,উথাল-পাতাল চলছে মনে, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে ভাবছি, এরই মধ্যে সন্ন্যাসী উপগুপ্ত ডেট দিয়েছেন, আগামী শুক্রবারে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেব।'

' দীক্ষা নেবেন কেন? আটানব্বইজন ভাইকে মেরে ,হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে , এখন অনুশোচনা হচ্ছে ,বুঝি ?'

' তোমার তো সাহস কম নয় মাস্টার ! আমি মৌর্য  সম্রাট অশোক আর তুমি দীন ভিকিরি  প্রাইভেট টিউটর অশোক। তোমার এত বড় সাহস হয় কী করে ,আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাও? '

 ' না না রেগে যাবেন না, রেগে যাবেন না, তাহলে ভয়ে  আসল কথাটাই বলতে পারব না।'

' বেশ ,বল কী তোমার আসল কথা? রাগছি না।' দেখুন, আমি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক, এইটুকু প্রশ্ন করার অধিকার আমার নেই? '

' রাখ তোমার গণতন্ত্র, খালিপেটে গণতন্ত্র হয় না। তোমার অত উল্টোপাল্টা প্রশ্ন শোনার আমার সময় নেই। তাড়াতাড়ি বল কী বলতে চাও।

' আমার একটা কথাই বলার আছে। '

' কী কথা, বল।'

' রাস্তায় বিশেষ কাউকে দেখছি না। তাই আপনাকেই বলছি। '

' আরে বল বল, থামলে কেন?'

 ' দেখুন না ওই যে সানন্দা জুয়েলার্স -এর মাথায় আমার কোচিংয়ের ব্যানারটা লটকাটচ্ছে,ওটা একটু আমার সঙ্গে ধরে আমার কোচিংয়ের দরজার উপরটায় লাগিয়ে দিয়ে আসবেন? ওখানে যেটা ছিল ছিড়ে একেবারের তেনা হয়ে গেছে।'


এই সময় কে যেন ঠাটিয়ে আমার গালে একটা থাপ্পড় কসাল । চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি। সম্রাট অশোক ? কই না। বিশ্রী গালাগাল করছে কেউ।

বাইক থামিয়ে বাহাতে হেলমেট ঝুলিয়ে ডান হাতের তর্জনী আমার মুখের সামনে এনে চিল্লাচ্ছে, ' বানচোদ কখন থেকে হর্ন দিচ্ছি, একদিকে নারকেলগাছ ভেঙে পড়ে আছে আর এইটুকু সরু যাতায়াতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ার বাল বিড়বিড় করছে। '


অ্যালকোহল মেশানো কথাগুলো ভুর  ভুর করে নাকে এল।


চড়  হজম করে এবার আমি এগোচ্ছি বাড়ির দিকে। সুভাষ পার্কের কাছে এসে দেখি আর এক কাণ্ড ! পার্কের ভেতর ঢোকার মুখে ' সুভাষ পার্ক শিশু উদ্যান ' বোর্ডটা ছিঁড়ে  কাত হয়ে ঝুলছে। দেখামাত্র কী যেন হয়ে গেল ভিতরে ! আবার ভুলতে শুরু করেছি পথ-ঘাট...সব,সব অচেনা ঠেকছে... পার্কের  ঠিক মাঝখানে রাজকীয় বেশ পরিহিত কে যেন একজন সৌম্যদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। একটা উঁচু বেদীর উপর। তাঁর চারপাশ ঘিরে বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত অভিজাত ব্যক্তি আর তাঁদের চারপাশ ঘিরে আরও বহু লোক...কেউ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় কেউ, কেউ বা শূদ্র, কাঙাল ভিখিরিও মনে হল কাউকে কাউকে। আমি চুপচাপ ওদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখিই না কী ব্যাপার !


রাজা একজন ব্রাহ্মণ পন্ডিতকে ডেকে বললেন, ' বলুন, আপনার কী প্রার্থনা?'

' মহারাজ, আমি আপনার ' রত্নাবলী ' নাটক সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করব। '

' এ তো উত্তম প্রস্তাব ' ভীষণ খুশি মহারাজ মন্ত্রী মশাইকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ' এই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে ত্রিশটি গ্রাম আর দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দিন। ’

' রত্নাবলী ' নাটক? বইয়ে পড়েছি তো।  শুধু রত্নাবলী না, নাগানন্দ  প্রিয়দর্শিকা... এ তো লিখেছিলেন সম্রাট হর্ষবর্ধন। কী আশ্চর্য !


ও বুঝেছি, এটা সুভাষ পার্ক নয়, প্রয়োগের মেলা। গঙ্গা -যমুনার মিলনস্থল। রাজকীয় বেশ পরিহিত মানুষটি তাহলে এলি তেলি কেউ নন, উনি সম্রাট হর্ষবর্ধন ! ওই তো ওনার বাঁ দিকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ, যেমনটি বইয়ে দেখি উনার অবয়ব, ইতিহাস বইয়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে হুবহু । ওই তো ডানদিকে সভাকবি বানভট্ট, কবি মৌর্য ও কবি ভর্তৃহরি। অদূরে দাঁড়িয়ে রাজ্যশ্রী, সম্রাট হর্ষবর্ধনের ভগিনী। সামনে-পিছনে বর্শা বল্লম উঁচিয়ে সশস্ত্র প্রহরী সব। এক.. দুই...তিন....গুনে শেষ করা যাচ্ছে না।


প্রয়াগের দানক্ষেত্র। সম্রাট হর্ষবর্ধন দান করছেন। কী যোগাযোগ ! প্রায় লাফিয়ে উঠে হাততালি দিলাম জোরে।

পাশের ভিখিরিটা ধমক লাগাল, ' অত পুলক জেগেছে কেন, শেষ পর্যন্ত কী পাও দেখ।' দমে  গেলাম। চুপচাপ দেখছি ----

পাওয়ার আশা আছে তাহলে ! কী চাইব আমি ,যদি মহারাজ ডাক দেন...ভাবছি...আচ্ছা ,কতগুলো স্বর্ণমুদ্রা চাইলে বারো লাখ টাকার ব্যাংক লোন শোধ করতে পারব ? না, আমি চাইলেই তো হবে না, মহারাজ অনুগ্রহ করে যা দেবেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী গড়ায়।


মহারাজ এবার দ্বিতীয় একজন ব্রাহ্মণকে ডেকে বললেন, ' বলুন কী প্রার্থনা আপনার? '

' মহারাজ আমি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। '

'কী চাই বলুন?'

' আপনি অনুগ্রহ করে যা দেবেন মহারাজ।'

' মন্ত্রী মশাই, এই ব্রাহ্মণকে পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দিন। '

' আজ্ঞে , মহারাজ।'


এইবার একজন কৃষককে কাছে ডেকে নিলেন মহারাজ, ' কী প্রার্থনা বলুন? '

' খরা আর অজন্মায় সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, আমাকে বাঁচান মহারাজ। '

' ওহে মন্ত্রী , এই কৃষককে দুহাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দাও। '

' আজ্ঞে ,মহারাজ। '

 ' মহারাজ, অভয় দেন তো একটা কথা বলি।'

' কী  কথা? '

' মহারাজ স্বর্ণ ভান্ডার প্রায় ফুরিয়ে আসছে। '

' যতক্ষণ আছে দিতে থাক। ' যা ! আমার পোড়া কপালে কি শেষ পর্যন্ত জুটবে না কিছু।


এইবার কাঙাল ভিখিরি মতো একটা লোককে ডেকে নিলেন মহারাজ।

' কী  চাই ? '

' মহারাজ পরনে পোশাক নেই, চালে খড় নেই।'

 ' মন্ত্রী মশাই , একে বাকি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দাও। আর ভগিনী রাজ্যশ্রীকে ডেকে বলো, আমাকে একটা কৌপিন দেয় যেন।

' আজ্ঞে মহারাজ বলছি। '


রাজ্যশ্রী এসে মহারাজ হর্ষবর্ধনের হাতে একটি বস্ত্রখন্ড তুলে দিল। বস্ত্রখণ্ড, না কৌপিন ? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এতদূর থেকে। কৌপিনই হবে। খুলতেই দেখা গেল গেরুয়া রং। কৌপিন পরে এবার মহারাজ রাজবেশ তুলে দিলেন ভিখিরিটির হাতে। সঙ্গে মন্ত্রী দিল অবশিষ্ট স্বর্ণমুদ্রা।  

' আমি আর ভিখিরি না, রাজা রাজা ' বলতে বলতে আনন্দে দু'হাত তুলে নাচতে লাগল লোকটা।


যা ! সব তো শেষ হয়ে এল ! আমাকে কি মহারাজ হর্ষবর্ধন দেখতে পাননি ? ডাকবেন না আমাকে? ভাবছি যেই, অমনি দেখি মন্ত্রীমশাই আমাকেই  ইশারায় ডাকছেন।

গুটি গুটি পায়ে আমি হাজির হলাম মহারাজ হর্ষবর্ধনের পদতলে।

' আপনার কী প্রার্থনা ? '

' দু'কিলো চাল আর একটা সরষের তেল। '


( আগামী পর্বে )





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন