আলাপ-আলোচনা
অশোক কুমার সাহা
কিছু কিছু মানুষ স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের জন্য সমাজের পরিচিত জনের কাছে বিশিষ্ট হয়ে উঠে। এখানে "বিশিষ্ট" শব্দটির অর্থ সমাজের বিস্তৃত অংশের মানুষের কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠার বিষয়টির ইঙ্গিতবাহী নয়--একটি গণ্ডীবদ্ধ পরিচিত নিকটজনের মধ্যে চিহ্নিত হয়ে ওঠা। স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য বলতে কিছু কিছু আচার-ব্যবহার, ধরন,দৈহিক ভঙ্গি,কথা বলার ঢঙ, বাচন ভঙ্গি বা মুদ্রাদোষ, বা আলাপ -আলোচনার ধরন ইত্যাদিকে বোঝাতে চাইছি। এগুলোর মধ্যে যে স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য আলোচকের একান্ত তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ লব্ধ অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে তা হোল আলাপ-আলোচনার ধরন। আর এই অভিজ্ঞতা হয়তো অন্য অনেকের কাছে সম-অভিজ্ঞতায় একটি প্রতিনিধিমূলকও হতে পারে। তাই তাদের সঙ্গে আমার এই অভিজ্ঞতার অংশ ভাগ করে নিতে চাই বলেই বিষয়টির অবতারণা।
আমার নিকট-পরিচিত জনদের মধ্যে দু'একজন আছে বন্ধুর মতো দাদা ও বন্ধুর মতো ভাই। এরকম হয়তো সমাজের অন্য অনেক মানুষেরই আছে কারণ একটা বয়সের পর এরকম সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে-----অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখানে বয়সের পার্থক্যজনিত কারণ বন্ধুর মতো সম্পর্ক গড়ে উঠতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এরকমই এক বন্ধুর মতো দাদার টেলিফোন পেলাম কয়েকদিন আগে,আমার বিশেষ পরিচিত জনের মধ্যে একজন। জীবনের একটা বিশেষ দীর্ঘ সময় আমরা একেবারে নিকটবর্তী প্রতিবেশী ছিলাম। তারপর পেশাগত কারণে দূরবর্তী হয়ে পড়ি। অল্পবয়স থেকেই লক্ষ্য করেছি যে সে যখন পরিচিত জনের সাথে কথাবার্তা বলে তখন শুধু শুরুটা হয় কুশল বিনিময় দিয়ে ,তারপর কথাবার্তা হয়ে দাঁড়ায় একমুখি যানচলাচলের মতো। অন্য বক্তা তখন বেমালুম নির্বাক শ্রোতা হতে বাধ্য হয়।কারণ অপর জনের কথার স্রোত ছেদবিহীনভাবে অনর্গল প্রবাহিত হতে থাকে। সামান্য হ্যাঁ, হু ,ছাড়া অন্যজনের প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো সুযোগ সে রাখে না। আর তার কথার মধ্যে বেশিটাই থাকে আত্মপ্রচার ও নিজের জ্ঞান,বুদ্ধি,সাফল্যের প্রকৃত-অপ্রকৃত বিজ্ঞাপন। একসময়ে সে যাননিয়ন্ত্রনকারী পুলিশের মতো হাত নেড়ে অন্যজনের প্রতিক্রিয়া জানানোর রাস্তা no entry বোর্ড ঝুলিয়ে তার সময়মতো হঠাৎই চলে যান।
কয়েকদিন আগে পাওয়া টেলিফোনে তার কথাবার্তাও এর ব্যতিক্রম হোল না। প্রায় দশ মিনিট ধরে কথা চললো। অবশ্যই আগের মতোই একমুখী।আমার হ্যাঁ, হু ছাড়া কোন নিজস্ব কথা বলার সুযোগ সে দিলো না। আমিও বাধ্য শ্রোতার মতো শুনে যেতে বাধ্য হলাম। তার যতিবিহীন কথা,যার অধিকাংশই ছিল সেই আগের মতো । মূলত আত্মপ্রচার, তার সাফল্য,অন্যের উপর তার প্রভাব-প্রতিপত্তি,সামাজিক মান্যতা,বৃত্তিগত উৎকর্ষ ইত্যাদি।
এরকমই আর এক বন্ধুরমতো ভাইয়ের কথা বলি। যেকোন বিষয় নিয়েই আলাপ-আলোচনা হোক না কেন, সঠিকভাবে সে বিষয়ে জ্ঞান থাক আর না থাক অংশগ্রহণ করে চাই। শুধু অংশগ্রহণ করা নয় বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে সে দুবার ভাবে না। অবলীলায় জোরের সঙ্গে সে তার মতামত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। যাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে তিক্ততা সৃষ্টির আবহাওয়া এড়ানোর জন্য তার তথ্য-প্রমাদ,অতিরঞ্জিত বা ত্রুটিযুক্ত উপস্থাপনা থাকা সত্বেও ,তারা চুপ করে যায়। সবচেয়ে লক্ষনীয় বিষয় হলো সে যতক্ষণ ধরে কথা বলবে ততক্ষণ অন্যের কোনো সুযোগ থাকবেনা কিছু বলার। সেই একমুখী যানচলাচল। এখানেও পরোক্ষভাবে আলোচ্য বিষয়ের গভীরজ্ঞান পরিচায়ক আত্মপ্রতিষ্ঠার আপ্রাণ জোরালো চেষ্টা।
উপরোক্ত দুটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে কথাবার্তার বা আলাপ-আলোচনার যে অলিখিত সাধারণ আচরণবিধি তা তাদের বিবেচনায় রাখা হয়নি । যেমন---- "একে যবে কথা কয়/অন্যে চুপ করে রয়। অন্যজন কথা কয়/অপর সবাই বোবা রয়। একে অপরকে সুযোগ দিলে/আলোচনার সুফল মেলে।" আমি মনোবিদ নই তবুও সাধারণভাবে আমার কাছে মনে হয় এই ধরণের ব্যক্তিরা উৎকর্ষের আপেক্ষিক জটিল মনোভাবে (সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স) ভোগে।
টেলিভিশনের পর্দাতেও আমরা এর প্রায় সমপর্যায়ের নমুনা দেখতে পাই। কোন বিশেষ বিষয়ে আলোচনা সভাতে একজনের বক্তব্যের বিঘ্ন ঘটিয়ে অন্যজন প্রতিবাদ করে উঠেন। ফলে হৈ -হট্টগোলের আবহ সৃষ্টি হয়। কারও বক্তব্যই শোনা বা বোঝা যায় না। এখানে সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সের প্রতিফলন না ঘটলেও আলোচনার অলিখিত সাধারণ আচরণবিধি মান্যতা পায় না। এই আচরণবিধি বিবেচনায় রাখলে, তা সে যেকোনো বিষয়ের আলাপ-আলোচনা বা কথাবার্তা হোক না কেন সেটি উপভোগ্য ও পরস্পর গ্রহণযোগ্য হবে ওঠে এবং তিক্ততা এড়ানো যায়।
মতান্তর মনান্তর এ পরিণত হয় না।
সুতরাং আলাপ-আলোচনা বা কথাবার্তা উভমুখী যান চলাচলের অনুসারী অভ্যাসের অনুশীলন হয়ে উঠুক আমাদের প্রত্যেকের আচরণের অঙ্গ।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন