কবিতা, কবির চেতন-অবচেতনে লালিত কোনও এক চকিত মুহূর্তের তন্ময়তার ফসল । দীর্ঘ কবিতা যেন তারই প্রলম্বিত রূপ । একটি সার্থক দীর্ঘ কবিতা ,কবির কতখানি অভিনিবেশ দাবি করে ,সমস্ত সত্তার কতখানি উজাড় তন্ময়তা ছুঁতে চায় ,তা বলার অপেক্ষা রাখে না । তেমনই মনোমুগ্ধকর একটি দীর্ঘ কবিতা এবার আমরা পড়ব , কবি কল্পোত্তমের কলমে ----
বৃক্ষ, ছায়া ও ভালোবাসা
কল্পোত্তম
যেখানে বৃক্ষ নেই সেখানে ভালোবাসা নেই
যেখানে নদী নেই সেখানে ভালোবাসা নেই
নেই বয়ে চলা অনন্তের দিকে।
মানুষের বাঁধ কত আর...
শ্লেটের গায়ে শিশুর আঁকা চকের দাগের মতো
হারিয়ে যায় যাতায়াতে শিশু আঙুলের।
পেরিয়ে গেলে বাধাহীন মুক্তদ্বার
নিয়ে যাবে সমুদ্রের দিকে।
হে সখা হে কৃষ্ণ
তুমি বৃক্ষ হও
তুমিই সমুদ্র হও
হও ভালোবাসা বিহঙ্গ-সকালে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকো, ভাষাহীন
ছায়া পড়ে নদীর জলে
আমি বার বার ধরতে যাই তোমার ছায়া
ধরি না তোমাকে।
তোমাকে ধরলে কাঙাল হবো না কোনোদিন।
তোমার ভাব জানি না
জানি না মনের গভীরতা
ভাবি, স্রোতের বয়ে চলার পথে
ছায়ারাও বয়ে যায় কবে?
মোহনা বিলুপ্ত হলে, দেখে নিও
বয়ে যেতে অন্য পথ হবে।
তোমার ভালোবাসা
তোমাকে শুধু কদমগাছ চিনিয়েছে,
আমার ভালোবাসা, আমাকে চিনিয়েছে
মহুয়া, শাল, পলাশ, শিমুল, শিরীষ
আরও কত সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা
বৃক্ষরাজির ছায়া
ছুঁয়ে যাওয়া মেঠো পথ
পথিকের পদচিহ্ন আর
ধুলায় ধুসরিত ঘাসের প্রজাতি।
চেনারই নাম ভালোবাসা হলে
অগুনতি ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখে আমাকে।
একটাই নদী চেনো তুমি, যমুনা, আমি
কাঁসাই, কুমারী, টটকো, সুবর্ণরেখা নামের কত নদী
চিনে চিনে চলে আসছি।
কোথাও হাঁটু জল, কোথাও কোমর জল
কোথাও অতলান্ত জল, তবু
ডুব দিতে ভুলিনি কখনো।
এইসব নদীদের অবস্থান
সাঁতারের অনেক রকম কৌশল
শেখালো আমাকে।
এখন ডুবি না আর
অতল নদীর খাতে
দিব্যি ভেসে থাকি। ভেসে থাকার কৌশল শিখিয়েছো
শিখিয়েছো ডুব দিয়ে মুক্তো তুলে নিতে
সহজ কৌশলে।
নদীর তলদেশে জমে থাকা পলির উপর
নির্লিপ্ত ভালবাসা নিয়ে
আমাদের অচেনা লিপিতে
কত কিছু লিখে রাখে আবেগী ঝিনুক।
বিষয় যা কিছু হোক
লেনদেনের স্বীকৃতি স্বরূপ, আদিবাসী যুবক যুবতী
অনায়াসে পরেছে টোপর।
নদী ঘাটে পলি নেই আর
পায়ে পায়ে ধুয়ে গেছে মিশে থাকা বালি
হারিয়েছে পাতাদের
নদী ঘাটে গজিয়ে ওঠা ঘাস
শেকড়ের ভরসায় বেঁচে আছে শুধু
কতদিন হয়ে গেল
যখন নতুন ছিল ঘাট
পরতে পরতে ছিল পলি
কত যে পায়ের ছাপ পড়েছিল!
পেয়েছিলাম পূজারিনির শরীরের আস্বাদ।
মুছে গেছে, সব ছাপ মুছে
বালি আর শেকড়ের সংযোগ অহরহ
অহরহ ঘর্ষনে জ্বলে যাওয়া
মুছে দেওয়া প্রাচীন সব লিপি
মুছে দেওয়া সময়ের ব্যবধান
আমরা শুধুই লিখি এই সেই
আমরা শুধুই খুঁজি মান
বৃক্ষই পৃথিবীর যোগ্য সন্তান।
তোমাকে পেয়েছে যে
উপল রাশির মাঝে রাশি রাশি
হরেক রত্ন খুঁজে পেয়েছে অনায়াসে
অটুট অনভ্যাসে, ছবি তার
বিপুল ক্যানভাসে এঁকেছে ঈশ্বর।
যে যাই বলুক, ধূলিকণা জুড়ে জুড়ে
হয়েছে নগর।
বলেছিলে, আমাকে পেখম দেবে,
আমিও বর্ষার খোঁজে
কাটিয়ে দিলাম তাই বহুকাল
সরিয়ে দিলাম বহু জঞ্জাল
জীবনের পাতা থেকে ছিঁড়ে
কাটিয়ে দিলাম এক
নুয়ে পড়া ইতিহাস কাল।
সকাল বিকাল
আমাদের ঋতুকাল পেরিয়ে যাওয়া
সময়ের অপেক্ষায় নুব্জ হয়ে পড়ি।
কথা তো অনেক হলো,
পেখমের দেখা নেই তবু
দেখা নেই ঘনঘোর বর্ষার।
আদিম ময়ূরী নেই
নেই আমার নাচ দেখাবার,
অনেক নদীকে চিনি
স্রোতকে চিনি না তাই, যাই বারবার
হঠাৎ তৈরি করো ঘূর্ণন
ইচ্ছা হলে পাড় ভাঙবার
প্রসারিত করে তোলো নিজেকে সেখানে।
আমার শেকড় ধুয়ে সাদা হয়
জলের কাঁপনে কাঁপি বারবার,
সঙ্গীর মৃত্যু হলে
যেভাবে কাঁপতে থাকে শরীর
সীমানায় নিযুক্ত সহযোদ্ধার।
দাঁড়িয়ে থাকা হে বৃক্ষরাজি
তোমরাও গান বাঁধো, পরস্পর ঘর্ষণে জমে ওঠা
সুর নিয়ে পাতায় পাতায়।
বিকেলে বলাকা এলে বলো
গেয়ে যেতে। বলো
নিরিবিলি কুঞ্জ খোঁজা
সবথেকে সুকঠিন বর্তমানে,
নীলগিরি, হিমাদ্রি, সুন্দরী-গরান ঘেরা সুন্দরবন
সবারই চলছে অনটন, অবিরল
সাগরের তলদেশে অহরহ জনবিস্ফোরণ
ঝিনুক পুড়িয়ে মারে
পুড়ে যায় পুরো উন্মীলিত
মুক্তার যতন।
যেখানে প্রবাহ নেই সেখানে শৈবাল
যেখানে প্রবাহ নেই, বুঝতে হবে
কাছেপিঠে অবস্থিত
কোনো না কোনো আল,
স্রোতের জলে ভেসে আসা
ঝরাপাতাদের
ঠিকানা পাওয়ার
কোনো এক সঠিক ঠিকানা।
পাতা ঝরে, ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যায় স্রোতধারায়
আমিও ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যায় নিম্নদেশে
তুমিও কি ভাসো?
তুমিও কি এগিয়ে যাও নিম্নদেশে
সমুদ্র মন্থনের ক্ষণে?
যার মাথায় পা রেখে নেচেছিলে তুমি, সেই
রাজ্য বিস্তার করেছে এখন
গোকুলে, মুকুলে, তোমার আমার ঘরে ঘরে
প্রতিটা নদীর চরে চরে
নগরে-বন্দরে, কালিদহে না থেকেও ক্ষতি নেই
তোমার আমার মাঝে
কেউ আর সতী নেই
আমি আর তুমিও সে পথেই।
শরীরে শরীরে খুঁজি প্রেম
খুঁজে পাই প্রলয় আগুন, প্রতি তনুতেই,
ঝলসানোর অশেষ ক্ষমতা আছে
মনোসঙ্কোচন হয় যেতে কাছে
তবুও পুড়িয়ে ফেলি ডানা
অনায়াসে আকাশে ওড়ার।
আমি জানি, এই তোমার ছল
আমাকে বিঁধতে তির
দু'চোখে পরেছো কাজল
মহোময় বেশে, হেঁটেছো আমার আগে আগে
নিশ্চিত পোড়াবে বলে ডানা।
কাঠ পোড়ে, অঙ্গার পোড়ে, পোড়াতে পোড়াতে যাকে
আগেই করেছো ছাই
পোড়াবে কিভাবে?
চলো আজ কুঞ্জ খুঁজি
যে কুঞ্জে ঈশ্বর জন্মাবে।
যেখানে বৃক্ষ নেই, ছায়ারা কোথায়?
যেখানে তুমি নেই
ঈশ্বরেরও অস্তিত্ব নাই
কেবল মায়াবী খেলা
ঈশ্বর আর আমার মাঝখানে এবেলা ওবেলা
আড়ি পাতাপাতি অযুত প্রেমের।
প্রদীপে থাকে না তেল, থাকে আয়ু, তবুও
দপ্ করে নিভে যায়
হঠাৎ হাওয়ায়
কালসর্পযোগে।
মহাবৃক্ষে সংযুক্ত গ্ৰহ, নক্ষত্র, উপগ্ৰহ
বামন গ্ৰহের গায়ে গর্ত খুঁড়ে
আমাদের বাস,
অফলা জমির গায়ে
আমাদের চাষ, তবু
ফসল দিয়েছো তুমি ফলায়ে ফলায়ে
পাথরের গায়ে।
বেঁচে আছে শাল-সেগুন, পলাশ-শিমুল, আরও কত
বুনো ঝোপঝাড়,
পোকামাকড়ের ভিড়ে আমার আহার
হারিয়েছে কত দিন রাত
না নেওয়া বরাত
বুলবুলি গান গায়
ডাহুকরা ডেকে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ।
কেউ কি পেয়েছে বেশি?
কেউ কি পেয়েছে কম?
ঘড়ি কি চলেছে কোনোদিন
না দিতেই দম?
সময় পেরিয়ে যায়
মৃত্তিকার ভিতরে ভিতরে, বায়ু, জল
তাপ নিতে নিতে
তোমার ইচ্ছাবলে
অলক্ষ্যে সবার
হতে থাকে অঙ্কুরোদগম।
অঙ্কুর আমিও চিনি
চিনি না সে কতবড়ো হবে
দিন পেরিয়ে যেতেই, যখন সে
পরিপূর্ণ হবে, হবে
ছায়া দানকারী এক অমূল্য রতন
শিখে যাবে নিতে
তোমার আমার মাঝে অনেকের
পূর্ণ যতন।
পথ নেই, এই কথা বলেছো মানেই
ইচ্ছা নেই চলার তোমার
ইচ্ছার জোরে মরুদ্যান গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে সাম্রাজ্য
গহীন আঁধারে
তোমার আমার যদি ভালবাসা থাকে
কোন্ কাজ আটকে রাখে
কাঁটাতারে? জোয়ারে জোয়ারে
ক্ষয়ে যায় আমার তোমার মাঝে
গড়ে ওঠা ভূমি।
শুধু যদি তাকিয়ে থাকো তুমি
শহস্র বছরের নিদ্রাহীন চোখে
ছেদহীন ঘুম নামে
প্রতি বাকে বাকে
উঠে আসে ইতিহাস
উড়ে আসে জারজ বাতাস
প্রতি সংসারে।
কে তুমি? একা একা ফুটিয়েছো
বনে ফুল ফল
দেশান্তরে পেরিয়ে যাওয়া মেঘ থেকে
ঝরিয়েছো জল,
উথাল পাথাল নদী শুকিয়েছো
জেগে থাকা চোখ থেকে
চুরি করে নিয়েছো কাজল।
কদম্বের ফুল ফোটে
কোথাও কোথাও শুধু ঝড় ওঠে
আমিও দেখেছি মাঠে গরু
এদিক ওদিক ঘোরে, তৃণভূমি, ফসল ক্ষেত
লোকালয় ঘিরে থাকা সবুজ সংকেত
পেরিয়ে যায় অনায়াসে
যে তোমাকে ভালোবাসে, সেই ছাড়ে
শব্দশর, সম্মোহিনী শর সৃষ্টি করে
যাদুময় মুরলীর ভিতর
কেঁপে কেঁপে ওঠে সবুজাভ নারী
শক্তিশালী শর দর্শনে।
অনেক হয়েছে লেখা মানুষের গান
এবার স্বপ্ন লেখো আত্মার ভিতর
যুগান্তর পেরিয়ে আসা বোধিবৃক্ষের।
বেঁচে যদি থাকো কোনো বেশে
ঝুরিও শেকড় হয়ে শেষে
সুকঠিন মাটি ভেদ করে
উঠিয়ে আনবে একদিন কৌশিক জল। তখন
তুমিও কমল, তুমিও কোমল
তোমারও চারপাশে দিব্যি কোলাহল
পরবাসে একাকীত্ব
কষ্টিপাথরে ঘষা হবে চিত্ত
সেই গান ছড়াবে তোমার
লাগবে না মাহেন্দ্রক্ষণ
লাগবে না ঠেলে দিতে কোনো শিষ্যের।
আকাশ ছোঁয়ার আছে?
পা রেখে মা-মাটির কাছে
বিস্তার ঘটিয়ে দাও ছায়ার, নিদাঘ দুপুরে।
শীতঘুমের সমাপ্তি ঘটিয়ে
উঠে এসে হও জঙ্গম
তোমার চলার পথ থেকে
সরে গিয়ে দাঁড়াবে ভুজঙ্গম।
পায়ে পায়ে হেঁটে যাবে তুমি, কঠিন পাথরে।
শালবন পেরিয়ে গেলে
পেরিয়ে গেলে তুমি
অর্ধেক জীবন,
এভাবেই করো যদি
তুমি শালবন
আমিও পেরিয়ে যাব তোমার মতন
বৃক্ষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
পাতা আর ডালেদের কাছে গিয়ে
একটু নুয়ে নুয়ে।
একেও প্রণাম বলে
বলে ঝুঁকে চলা
গাছেদের কানে কানে, মর্মের
সব কথা বলা
শাল পিয়ালের দেশে
বেঁচে আছি ভালোবেসে
পলাশ-শিমুল আর যতসব বুনো, মেঠো ঝোপ
দাঁড়িয়ে রইলে কেন পাতকুঁয়োর পাশে?
তোলো জল, তৃষ্ণা মিটিয়ে ফেরো ঘর
কষাকষি করো না কভু দর
ভালোবাসায় উঠে আসে ঝড়
বৃক্ষ জানে, কিভাবে বাঁচতে হয়
শীত-গ্ৰীষ্ম-বর্ষা হেমন্তের উঠানে
কতদিন হয়ে গেল, তোমার আমার
খুব একটা হয় না আর দেখা
যেখানে বৃক্ষ নেই সেখানে মানুষ বড় একা।
বৃক্ষই জানে, কিভাবে বাঁধতে হয়
ছোটো ছোটো মৃত্তিকা কণাদের
অটুট বাঁধনে।
কিভাবে রাখতে হয় ধরে, পরস্পরে
পাশাপাশি বাস করে যারা।
আমরা দিশেহারা।
আমাদের পায়ের তলার মাটি ধুয়ে যায়
মন, মান নুয়ে যায়
পাড়ের মাটির মতো খসে যায় পড়শিরা
নিলেও যতন।
ঘষাঘষি নেই,
দূরে দূরেই অবস্থান
দাবানল তবুও দেখতে পাই
এক একটা শাখার ভিতর
জমে থাকা অন্ধকারে
এক একটা বুনো ঝোপের এপারে ওপারে।
আমিও জ্বলবো, তুমিও জ্বলবে
যদিও থাকো দূরে,
জঙ্গলেই প্রবাহিত সুগভীর নদীর
স্রোতধারার এপারে ওপারে
দেখা দেবে জলোচ্ছ্বাস।
কোনোদিন খেয়েছো তুমি পরিপক্ক ফল?
কোনোদিন করেছো পান থকথকে জল?
কোনোদিন পা ফেলে বুঝেছো পিছল।
সাগর অতল?
মুখ দিয়ে দেখেছো কি কতখানি নোনা
মিশে আছে প্রাকৃতিকভাবে?
আমাদের স্বভাবে স্বভাবে
হারিয়েছি সবকিছু
সবার থেকেই আজ নিচু
করেছি নিজেকে।
বটের ঝুরিরা জানে, জীবনের মানে
কিভাবে বাঁচতে হয় কঠিন পাষাণে
কিভাবে বাঁচাতে হয় বিজনে স্বজনে
কিভাবে বা হতে হয় শেকড়
চেয়ে থাকা মাটিদের টানে।
তপস্বী বৃক্ষ বট
করে না ছটফট
নেমে এলে ঘন ঘোর বর্ষা, অথবা
জমাট বাঁধা শীতে
গ্রীষ্ম দাবদাহে,
কুঠারের আঘাতে তৈরি হওয়া
শরীর প্রদাহে।
তুমিও কি সেভাবেই তৈরি করেছিলে
তাই সব সহ্য করে নিলে
অনলে অনলে গেলে চলে
সারাটা জীবন?
কিভাবে সইলে তুমি
সুগভীর এমন দহন, যা ছিল
সবারই মরণ বাঁচন?
যেখানে দহন নেই সেখানে ভালোবাসা নেই
যেখানে মরণ নেই সেখানে ভালোবাসা নেই, শুধু
বেঁচে থাকার ভালোবাসায়
কে বা কি পেল?
ঈশ্বর জানে তাই
তোমার পাপড়ি থেকে
চতুরতায় আমাকে সরালো।
আবার জন্ম নেব পৃথিবীতে।
স্বর্গের দেবদেবী অথবা মুনির কোনো অভিশাপে
জন্ম যেন কখনো না হয়,
তোমার প্রেমের টানে জন্ম নেব
রেখো না সংশয়।
আমরাও করেছি প্রেম কুমারীর তীরে
কাঁসাই নদীর তীরে মহুল ছায়ায়
আমরাও গিয়েছি হেঁটে বহুদূর
পিচাশী ডুমুরশোল,
মাঝে মাঝে করেছি কোন্দল
উন্মীলিত ফুলের মায়ায়।
সুচারু বৃন্ত নিয়ে বিকশিত, কোমল শালুক
দু'হাতে দিয়েছো তুলে
দিয়েছো তুলে সুখ
ক্ষণ ভঙ্গুর দ্বীপে
প্রবাল সাগরে।
আমাকে রেখেছো তুমি আকরে আকরে
বহুকাল আগে খোঁড়া খনির ভিতরে
যেখানে খচিত আছে রত্ন সব
যেখানে খচিত আছে কলরব
শ্রমিকের শুকে যাওয়া ঘাম
অশেষ আরাম।
বহু বছরের থেকে জমে ওঠা
পললের আবরণে
আমিও চেয়েছি হতে বারবার
আবরিত। আমিও চেয়েছি
গাছের পাতার মতো ঢাকা পড়ে যেতে
কালোত্তীর্ণ জীবাশ্ম হয়ে যেতে
জমে ওঠা পলির ভিতর
যেখানে থাকলে তুমি
অনুভবে অনুভবে, চাপে, তাপে
আমাকে রাঙাবে,
আমাকে করবে তুমি মর্মর
যেখানে বাঁধবে ঘর ইতিহাস
সেই আমার প্রতিভাস
এই জনমের।
সুপ্রাচীন বৃক্ষ-ছায়া জানে, কতটুকু
চিরন্তন নদীর উজানে
যেতে হয় নৌকা বেয়ে
যেতে হয় গান গেয়ে
নব নব অতিথির খোঁজে,
এমনও তো জায়গা আছে
যেখানে সবাই মাথা গোঁজে।
এক তৃতীয়াংশ কাল জীবনের, কেটে যায়
হিসেব পায় না খুঁজে কেউ
দিগন্ত দরাজে
বাতাসের সুর ভাসে
অন্য এক সুরের আলিঙ্গনে
আমাদের অঙ্গনে অঙ্গনে।
সম্ভাবনাময় বৃক্ষই আসে না শুধু,
পৃথিবীর বুক চিরে রক্ত আসে
আসে আগুন
নিজেকে ছড়াতে
কৌশলে অকৌশলে অন্যকে জড়াতে
স্বপ্নে অভিঘাতে।
অসম্ভব নিপুণতায়, গড়ে ওঠা চর ভেঙ্গে যায়
ভেঙ্গে যায় বাসস্থান সম্ভাবনাময়, সময় সময়
কলঙ্কময় হয়ে ওঠে
আমাদের পায়ে চলা পথ
আমিও কি পুরোপুরি সৎ?
বৃক্ষই সৎ এই চরাচরে
আমার গোচরে,
অন্যদেরও, বিচারের আছে কি অন্য পথ?
বৃক্ষ তুমি জেগে রও
বৃক্ষ তুমি হাওয়া দাও
প্রতিটা কীটের ঘরে ঘরে
জেগে উঠুক মনোবল প্রতিটা অন্তরে
জেগে উঠুক মহাজাগতিক রেখা
শেকড়ে শেকড়ে, আমারও
শেকড়ের সংযোগ, শেষাবধি মিলে যায়
গাছের শেকড়ে। পাতা যদি না ঝরে কোনো শীতে
সন্তুষ্টির, বসন্ত কি আসে?
বাতাসে বাতাসে প্রেম ভাসে? ভাসে রেণু?
খুঁজে পাওয়া যায় কামধেনু?
কত রকমের ঘাট
কত রকমের সিঁড়ি
যেভাবেই থাক তারা, উঠে যাওয়াই শেষ কথা
স্রোতের গর্ভ থেকে চাঁদের ওপারে, দ্বারে দ্বারে
নক্ষত্ররা ফেরে
সর্বগ্রাসী ব্ল্যাকহোলের। সেই কৃষ্ণগহ্বরে
কারোর জন্ম হয়, কেউ কেউ হারায় চিরতরে
মধ্যগ্ৰাসী অবস্থায় ফেলে আসা সময়ের প্রথম প্রহরে
যতকিছু ঘটেছিল, সেইসব
স্মৃতিমেদুর ঘটনার চিরুনী তল্লাশি
কতবার হয় জানো?
সহস্র চিত্ত যজ্ঞে,
শঙ্খবার, পদ্মবার
পৃথিবীকে ঘিরে থাকা পায়ে চলা পথে
পা পড়ে যতবার,পদবর্ষ ধরে,
মনের ভেতরে, উঁকি মারে
ততবার কোনো এক পাখি
বিরহী রোদনে ডাকে ঘন কুয়াশায়।
এগিয়ে আসে পূজারিণী
আগে আগে আসে তার ফুল, তারপর কুচদ্বয়
সিক্ত সাদা শাড়ি ঢাকা দোদুল হৃদয়, একাগ্ৰে
কদম্বের ছায়ায় খোঁজে
ভেঙ্গে যাওয়া বাঁশুরির সুর
অম্ল-মধুর যত বাঁধনে বাঁধনে,
তারও শেকড় আছে
হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে বেদনার নুর।
দু'হাত ভরে দিলেও কেউ কাঁদে
সব নিয়ে নিলেও কেউ হাসে
অসম্ভব খেলা এই পৃথিবীতে
আমরা তো ভালোই বাঁচি গ্ৰীষ্ম শীতে
ফুল ফোটাই বারোমাস কেউ না কেউ
বছরের পুরো বারোমাসে
তারা শুধু বেদনা প্রকাশে
তোমার মোহন বাঁশি জানে সব
কোথায় কিসের এতো কলরব
তাই চাঁদ হাসে
দেখে দেখে এই খেলা, মানুষ সবাই শতো
দুঃখ পরিহিত।
এক একটা নক্ষত্র
এক একটা পরিপক্ক ফল কৃষ্ণবৃক্ষের
আমরা তার চারপাশে ঝিকিমিকি জোনাকির মতো
হঠাৎ আলোর শিখা হঠাৎ আঁধারে সমাহিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন