মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর, ২০২১

গল্প * রাহুল দাশগুপ্ত

 



বিশ্ব সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের অলিগলি তাঁর নখদর্পণে। গল্প , কবিতা , উপন্যাস --- সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর  স্বচ্ছন্দ  বিহার। কবিতা ও উপন্যাসের উপর আলোচনা গ্রন্থও রয়েছে রাহুলের | তাঁর সুসম্পাদনায় ' চিন্তা ' সাময়িকপত্রটি ইতিমধ্যেই সাহিত্যমোদীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।' স্বরবর্ণে'র বর্তমান সংখ্যায় আমরা পড়ব, রাহুল দাশগুপ্তের একটি অসাধারণ ছোটোগল্পযিনি কখনো আঁকা শেখেননি,গল্পটি পড়লে , তাঁর হাতও রং -তুলি স্পর্শ করতে চাইবে ।  



গতি

রাহুল দাশগুপ্ত


এই গল্পটা আমি শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। সমুদ্রের ধারে মার্বেল পাথরের একটি মন্দিরের সিঁড়িতে বসে সে আমাকে গল্পটা শুনিয়েছিল। আমরা দু’জন সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসেছিলাম। চমৎকার হাওয়া বইছিল। সামনে বালুতটে অনেকেই অন্ধকারে বসেছিল। ছোট ছোট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আলোর টুকরোয় তাদের দেখা যাচ্ছিল। রাত প্রায় আটটা। অন্ধকারের মধ্যেই ঢেউয়ের সাদা সাদা ফেনাগুলো চোখে পড়ছিল। সমুদ্র অবিরাম গর্জন করে যাচ্ছিল। যেন এক প্রাগৈতিহাসিক জন্তু গুমরে গুমরে উঠছিল আর জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছিল।


        আমার বন্ধুটি বলল, ঘটনাটি শুরু হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। রোজ ভোরবেলায়, ঠিক পাঁচটার সময়, ছেলেটির মন এক গভীর বিষাদে ভরে যেত। সেই বিষাদ তার সারা মনে ছেয়ে যেত। বিষাদ না অবসাদ, সে ঠিক বুঝতে পারতো না। কিন্তু সেই অনুভূতি তার মনে জাগিয়ে তুলত একটা প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতার বোধ। তার প্রচণ্ড জোরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করত। সে অনুভব করত, তার ভেতরে কেউ কাঁদছে। কেঁদেই চলেছে। আর তখনই সে একটা শিশুর মতোই তার স্ত্রীর বুকের মধ্যে ঢুকে মুখ লুকোতো। যেন এখুনি একটা প্রবল আঘাত নেমে আসবে তার ওপর। এইভাবে সে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকত। ঘুমের মধ্যে তার স্ত্রীও তাকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরতো। আর এইভাবে একটু একটু করে, স্ত্রীর বুকের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে, তার নিরাপত্তাবোধ আবার ফিরে আসতো। তার বিষাদ, ঠিক আছে বিষাদই বলা যাক, কেটে যেত। তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতো। এবং একসময় সে ঘুমিয়েও পড়তো।


       এই কথাটা সে কাউকেই বলতে পারতো না। কিন্তু তার ভেতরে ক্রমে একটা অস্থিরতার জন্ম হলো। রাতে শুতে যাওয়ার আগে তার মন অশান্ত হয়ে উঠতো। অনেক রাত পর্যন্ত সে জেগে শুয়ে থাকত। আর ভাবত, ভোর পাঁচটাকে কিভাবে ঠেকানো যায়! কিভাবে ওই ভয়ানক বিষাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু একসময় তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতো। 


       কিন্তু ঠিক ভোর পাঁচটায় কে যেন তার বুকের ভেতরে কেঁদে উঠত। তার ঘুম ভেঙে যেতো। সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করতো, রাতে শুতে যাওয়ার সময় তো চিহ্নমাত্র ছিল না, অথচ ভোরে তার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে এক গভীর বিষাদে। কোথা থেকে এলো এই বিষাদ? কোথায় ছিল এই বিষাদ? এর কারণ কী? তার মনে হতো, ভেতরে যেন ধস নেমেছে। তার আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আর একটা প্রচণ্ড অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তা বোধের অভাব একটু একটু করে তার চেতনাকে অবশ করে দিচ্ছে। সে তখন মরিয়া হয়ে তার ঘুমন্ত স্ত্রীকে খুঁজতো। তার বুকের ভেতর গুটিশুটি মেরে ঢুকে নিজেকে লুকোতে চাইতো। সেখানে, সেই অন্ধকারে আর নরম, মধুর উষ্ণতায় ভেতরের সেই প্রচণ্ড বিষাদ নিয়ে প্রবেশ করে সে আরাম পেতে চাইত। তার স্ত্রী তার কাছে ছিল এক বৃহৎ বটবৃক্ষের মতো।


      এক আশ্চর্য মেয়ে ছিল সে। নির্লোভ, অকপট, সৎ। জীবনকে সোজাসুজি ও স্পষ্টভাবে দেখতে জানত। কোনও বিভ্রান্তি বা মোহ তাকে আচ্ছন্ন করতে পারতো না। জীবনের কাছ থেকে, সম্পর্কের কাছ থেকে তার চাহিদা ছিল যৎসামান্য। ছেলেটি একথা জানত। আর তাই প্রতিদিন অন্তত হাজারবার মনে মনে সে উচ্চারণ করত, আমাকে ক্ষমা করো।


      ছেলেটি আরও জানতো, তার ভেতরে একজন লোভী, উচ্চাকাঙ্খী ও একা মানুষ লুকিয়ে আছে। এই মানুষটি আত্ম-প্রতারণা করে। নানারকম ছলনা জানে। পরিশ্রমী ও সৎ হয়েও আরও কিছু পাওয়ার জন্য অনাবশ্যকভাবেই আপোশ করে। সমঝোতা করে। মন যুগিয়ে চলতে থাকে। জীবনে অযথা ঝুঁকি নিয়ে ফেলে। আর নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। তখন সে আত্মরক্ষা করতে পারে না। খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে থাকে।


       শেষপর্যন্ত তার যাওয়ার একটিই জায়গা থাকে। আর তা হলো, তার স্ত্রীর উষ্ণ ও সহিষ্ণু হৃদয়। সব জায়গায় গুঁতো খেয়ে খেয়ে সে একটা খুনির মতোই পালাতে থাকে। আর শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে স্ত্রীর বুকের মধ্যে মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে জানে, ওখান থেকে কেউ তাকে ফেরাবে না। ওখানে কোনও অনিশ্চয়তা নেই। ওখানে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ও নিরাপদ।


       মেয়েটি নিজের থেকে কখনও প্রায় কিছুই চাইতো না ছেলেটির কাছে। ছেলেটি তার মহত্ব বুঝতো। মেয়েটির তুলনায় নিজের ক্ষুদ্রতাকে অনুভব করতো। এবং সেই কারণে মনে মনে সঙ্কোচও বোধ করতো। জলের মতো স্বচ্ছ যে আত্মা, তাকে সহজে চেনা যায় না। যার মধ্যে অস্বচ্ছতা যত বেশি, সে ততো বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে চারপাশের মানুষের চোখে। কোনও মানুষ যদি গড়পড়তা মানুষের মাপে না আঁটে, তখন তার বিস্তারকে নানাভাবে কেটেছেটে ছোটো করে দেখানোর চেষ্টা শুরু হয়। ছেলেটি এসব জানতো। মনে মনে সে তার স্ত্রীকে খুবই সম্মান করতো। কিন্তু তাই বলে নিজেকে বদলানোর মতো মানসিকতাও তার ছিল না। এ ব্যাপারে নিজের সীমাবদ্ধতাও সে জানতো।


        তার সমস্ত রকম দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতা-অক্ষমতা সত্ত্বেও মেয়েটি তাকে ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসা ছিল এতোই নিঃস্বার্থ, যে সে কখনও ক্ষমা করার কথাও ভাবতো না। ছেলেটির প্রতি তার অভিমান ছিল ঠিকই। আবার গর্বও ছিল। ছেলেটিকে সে শুধু নিজের সমানই ভাবতো না, নিজের চেয়েও বড় করে দেখতে চাইতো। আর সেই কারণেই ছেলেটি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় আর অনুতাপে পুড়ে যেত। মেয়েটি মুখ ফুটে সামান্য কিছু চাইলেও, সেটা দিতে পারলে সে কৃতার্থ বোধ করতো।


      তার এরকম বোধ করার আরো কারণ ছিল। আসলে ওই সামান্য চাহিদা মেটানোও কখনও কখনও তার পক্ষে কঠিন হতো। নিজের পিছনে অযথা সে অনেক অর্থ ব্যয় করে ফেলত। নিজের শখ-আহ্লাদ মেটাতো স্বার্থপরের মতো। অথচ কিছুতেই নিজেকে সে বদলাতে পারতো না। আরও দশটা গড়পড়তা মানুষের মতো এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। 


      কিন্তু একদিন মুখ ফুটে মেয়েটি তার কাছে একটা জিনিস চাইলো। সেটা ছিল একটা রবিবারের সকাল। বাইরে যাওয়ার কোনও তাড়া ছিল না। ঘুম থেকে উঠে দু-একটা মামুলি কথার পর মেয়েটি বলে উঠল, তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব?

    মেয়েটি কখনও এরকমভাবে বলে না। ছেলেটি তাই মনে মনে কৃতাৰ্থ বোধ করল। মুখে বলল, হ্যাঁ, বলোই না... 

    মেয়েটি বলল, ছোটোবেলা থেকেই আমার বড় ছবি আঁকার শখ। আমি আঁকতে চাই। ছবি আঁকা শিখতে চাই। তুমি আমায় ভর্তি করে দেবে? 

     ছেলেটি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল। 


     সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মেয়েটি একটি আঁকার স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। জীবনে কোনও কিছুকেই হালকাভাবে নেওয়া তার স্বভাবে নেই। প্রথম দিন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সে আঁকার স্কুলে যাবে বলে তৈরি হয়ে গেল। সে জানতো, তার স্বামীর রোজগার খুব একটা বেশি নয়। বেশ টেনেটুনেই তাদের চলে। তাই আগে থেকে সে কিছুই চায়নি। শুধু একটা ড্রয়িঙের খাতা আর পেনসিল নিয়ে সে চলে গেছিল। যদিও তার ভেতরের উত্তেজনা যথেষ্টই টের পাওয়া যাচ্ছিল। নানা টুকিটাকি প্রশ্ন সে করে চলেছিল ছেলেটিকে। ঠিক বেরোনোর মুখে পেছন ফিরে সে জানতে চাইল, তোমার কী মনে হয়, আমি পারবো তো? 


        মেয়েটি পারবে কী পারবে না, সে বিষয়ে ছেলেটির কোনও ধারণাই ছিল না। মেয়েটির উত্তেজনা তার ভালো লাগছিল। মেয়েটি কিছু চাইছিল বলেও তার ভালো লাগছিল। মেয়েটি তো নিজের থেকে কখনও কিছু চায় না। তার কোনও চাহিদা নেই। এরকম চাহিদাহীন, নির্লোভ, সৎ ও আন্তরিক মেয়ে জীবনে কখনও সে দেখেনি। মেয়েটির প্রতি আবারও তার মনে কেমন একটা শ্রদ্ধাভাব জেগে উঠল। 


      মেয়েটি উৎসুকভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, মেয়েটির এই আন্তরিক নির্ভরতার তুলনায় তার অস্তিত্ব কত তুচ্ছ! একটা প্রদীপের শিখার সামনে যেন একটা মশা চুপটি করে বসে রয়েছে। মেয়েটি যা জানতে চাইছে, আসলে তার উত্তর সে জানে না। ছবি আঁকার বিষয়ে সে কতটুকুই বা জানে? মেয়েটিকে খুব সামান্যই সে সাহায্য করতে পারে। কিছুটা হালকাভাবে আর কিছুটা মেয়েটিকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তবু সে বলে উঠল, হ্যাঁ, পারবে, নিশ্চয়ই পারবে। 


কিন্তু আমি তো কোনওদিন আঁকা শিখিনি।

তাতে কী হয়েছে? এবার শিখবে।

এই বয়সে? আর কী হবে?

কেন হবে না? শেখার কী কোনও বয়স আছে? বিশেষ করে, ছবি আঁকার মতো একটা বিষয়...

মেয়েটি যেন আশ্বস্ত হলো একটু। তারপর বলল, তুমি তাহলে চাও, আমি শিখি?

হ্যাঁ, আমি সত্যিই চাই। ছেলেটি বলল।

আর শেষপর্যন্ত যদি আমি না পারি?

পারা না পারায় কী এসে যায়? তুমি কী কোনও প্রতিযোগিতায় নেমেছো? তোমার ভালো লাগে, তাই তুমি আঁকবে...

মেয়েটি একটু ইতস্তত করে। তারপর জানতে চায়, আসলে আমি জানতে চাইছি, এর পরিণতি কী? 


      ছেলেটি বলে ওঠে, সেটা এখনই বোঝা যাবে কী করে? তাছাড়া, পরিণতি ভেবে কেউ কাজ শুরু করে না। শিল্পীরা কাজ করে কাজের আনন্দে। নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করতে চায় বলে। আর জলে না নামলে তুমি নদী পেরোবে কী করে? জলে পা ভিজিয়ে এসো আগে। দ্যাখো, জল কতটা গভীর...


      ছেলেটি বুঝতে পারে, মেয়েটি আসলে খরচের কথা ভাবছে। কোনও অপচয় সে চায় না। ছেলেটি কত কষ্ট করে রোজগার করে, মেয়েটি জানে। ছেলেটির অনেক গুণ ছিল। অনেক কিছু হতে পারতো তার জীবনে। কিন্তু কিছুই হয়নি। ছেলেটি যেন তার কপালের লিখন পড়তে পারে এখন। তাই দিন দিন তার বিষাদ আর অবসাদ বেড়েই চলেছে। মেয়েটি তার ওপর কোনও বোঝা চাপাতে চায় না। ছেলেটিকে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করতে চায় শুধু। এই ছবি আঁকার ব্যাপারটা ছেলেটির ওপর আবার বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না তো? মেয়েটি নিজের ব্যর্থতার কথা ভেবে ভয় পায়।


     ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে ওঠে, না, না, শিল্পী-টিল্পী, ওসব অনেক বড় বড় শব্দ। ওসব হতে চাই না আমি। আমি শুধু ভাবছি, তোমার কষ্ট হবে না তো?


         ছেলেটি ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে না? 


      মেয়েটি চলে যায়। ফিরে এসে সে দেখতে পায়, ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে। আজ ছুটির দিন। রবিবার। অন্য দিনগুলোর খাটুনি ছেলেটি ছুটির দিনগুলোয় পুষিয়ে নেয় একটু বেশি ঘুমিয়ে। মেয়েটি তার মাথায় হাত বুলোয়। আর সেই আলতো স্পর্শেই ছেলেটির ঘুম ভেঙে যায়।


       সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত মেয়েটি কথা বলেই চলে। সবই আঁকার ক্লাসের গল্প। সে তার আঁকার স্যারের বর্ণনা দেয়। আঁকা শেখার পদ্ধতির কথা বলে। স্যারের ছোট ছোট মন্তব্যগুলিকেও বাদ দেয় না। আর বলে, পরদিন ক্লাসে তার কী কী লাগবে। রং-তুলি-কাগজ, সবই বলে দিয়েছেন স্যার। ওগুলো এ সপ্তাহেই কিনে ফেলতে হবে। তারপর সে বর্ণনা দেয়, তার সঙ্গী-সাথীদের। তাদের মধ্যে অল্পবয়সী ছেলে বা মেয়ে যেমন আছে, তেমনই একজন বয়স্ক মহিলাও আছেন। এই মহিলাকে নিয়ে মেয়েটি রগড় করে খুব। মহিলাটি নাকি যেমন মেজাজি, তেমনই আমুদে। আজকের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনিই।


      শুনতে শুনতে ছেলেটির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। মেয়েটির উত্তেজনা আর খুশি তার ভালো লাগে। মেয়েটির জন্য কিছু করতে পেরেছে ভেবে সে একটু একটু ব্যক্তিত্বের জোরও অনুভব করে। নিজেকে সবসময় তার পোকামাকড়ের মতোই মনে হয়। তার মধ্যে যেন কোনও ওজন নেই। কোনও ভার নেই। হালকা, সাদা তুলোর মতো লাগে নিজেকে। কিন্তু তার মতো মানুষও ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা সূক্ষ্ম গর্ব অনুভব করে। অন্তত সে তো শুরু করতে পেরেছে। এবার ধরে রাখাটাই আসল কাজ। মেয়েটি যা চায়, তার যোগান তাকে দিতেই হবে। তাতে খরচা যা হয় হবে। খরচা নিয়ে সে আর ডরায় না।


      পরদিন ভোর পাঁচটায় ছেলেটি জেগে ওঠে। গভীর বিষাদে ভরে আছে তার সমস্ত মন। হাত বাড়িয়ে সে আঁকড়ে ধরতে যায় মেয়েটিকে। তাহলেই আবার সে আরামে ঘুমোতে পারবে। একটু একটু করে বিষাদ কেটে যাবে। কিন্তু মেয়েটি তো নেই! চমকে উঠে বসে ছেলেটি। কোথায় গেল মেয়েটি? তার পাশে শূন্যতা আর একরাশ অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। ছেলেটি মনের ভেতরে দ্বিগুন বিষাদ বোধ করে। তারপর খাট থেকে নেমে দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরের ঘরে আসে।


     মেয়েটি বসার ঘরে মাদুরে বসে একমনে ছবি আঁকছিল। ছেলেটি আস্তে আস্তে তার পাশে এসে বসে। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলে, কখন উঠেছো? ছেলেটিকে দেখে মেয়েটির মন খুশিতে ভরে ওঠে। মুখে হাসি ফোটে। তারপর বলে, কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না। ছটফট করছিলাম। কালই স্যার এই ছবিটা দিয়েছেন। আঁকার চেষ্টা করছিলাম। দেখো তো, হচ্ছে আমার? পারছি কিছুটা? 


       ছেলেটির ঘুম কেটে গেছিল। সে বলে উঠল, তুমি দেখে আঁকছো কেন?


       আমি তো না দেখে ছবি আঁকতে পারি না। মেয়েটি বলে উঠল হঠাৎ।


       ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মেয়েটি যা বলল, তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করল। তারপর বলল, ঠিক আছে, যেভাবে পারো সেভাবেই আঁকো। হয়তো কিছুদিন পর নিজের মনেও অনেক ছবি ভেসে উঠবে। তখন কিছু না দেখেও আঁকতে পারবে। কোনও অসুবিধা হবে না। স্রেফ মনের মধ্যে ভেসে ওঠা ছবিগুলো, বাইরের কোনও সাহায্যের দরকার হবে না...


       মেয়েটি কথাগুলো শুনে একটু যেন বিষণ্ণই হলো। তারপর বলল, আমার মনের ভেতর কোনও ছবি ভেসে ওঠে না। আমি যা দেখি, শুধু তাই আঁকতে পারি। তোমাকে তো বলেইছি... 

      বেশ তো। ছেলেটি আর কথা বাড়ায় না। তারপর বলে, আঁকতে তুমি ভালোবাসো। সেটাই তো যথেষ্ট। আর কী চাই?

      মেয়েটির মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে। সে বলে, আমার বাবা-মা আমার জন্য যথাসাধ্য করেছেন। কিন্তু তাদের সাধ্যই ছিল কম। আর দূরদৃষ্টিও তেমন ছিল না। যদি আরও আগের থেকে আমি নিয়মিত আঁকার সুযোগ পেতাম... 


এখন ওসব ভেবে কোনও লাভ আছে কী? তুমি বরং সামনের দিকে তাকাও।


      ছেলেটি মন দিয়ে মেয়েটির ছবিটি দেখতে থাকে। একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য। তাতে ঘন গাছপালা আছে, নদী আছে, ঝর্ণা আছে, ঝর্ণার জল নদীর বুকে এসে পড়ছে, গাছপালার পেছনে পাহাড় আছে, সেই পাহাড়ের বুক চিড়েই ঝর্ণাটি নেমে আসছে, আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ আছে, নদীর ধার দিয়ে পায়ে চলার পথ আছে। একটা চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য।


    ছেলেটি সেকথাই বলল, চমৎকার দৃশ্য। কিন্তু শুধু প্রকৃতি কেন? কোথাও কোনও মানুষ নেই কেন?

     মেয়েটি আঁকতে আঁকতেই বলল, আমি শুধু প্রকৃতি আঁকতেই পারি। মানুষ আঁকতে তো শিখিনি।

    

     ছেলেটি চুপ করে গেল। একটু পরেই তাকে অফিসে যেতে হবে। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিষাদ কখন কেটে গেছে। ভেতরের সেই নিরাপত্তাহীনতার বোধটাও লুকিয়ে পড়েছে। কোথাও ঘাপটি মেরে আছে নিশ্চয়ই। সময়মতো নিশ্চয়ই আবার নখ বার করবে!


       ছেলেটি বেরোনোর সময় মেয়েটি মনে করিয়ে দিলো, ফেরার পথে আমার রং-তুলি-আর্ট পেপার কিনে এনো। আর একটা ফাইল। আর্ট পেপার চার ভাঁজ করলে প্রতিটি ভাঁজ যে সাইজের হয়, তার চেয়ে একটু বড় সাইজের। ছবিগুলো রাখতে হবে তো! 


      ছেলেটি বললো, ঠিক আছে। তার মনও খুশিতে ভরে উঠেছিল। ছবিটিতে রং দিলে কেমন দেখাবে সেকথা ভাবতে ভাবতেই সেদিন সে অফিসে পৌঁছে গেল। আর ফিরে এলো মেয়েটির কথামতো প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে। মেয়েটির পেনসিলে আঁকা শেষ হয়ে গেছিল। সে রঙের অপেক্ষায় ছিল। ছেলেটিকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সে বলে উঠল, এনেছো?


     ছেলেটি বলে উঠল, আনবো না? তুমি তাই চেয়েছিলে?

      তারপর দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল।


     সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই মেয়েটি আর্ট পেপারে নতুন করে ছবিটি আঁকতে শুরু করল। একটু একটু করে সে আঁকে, আর মাঝেমাঝেই ছেলেটিকে সেটা দেখায়। তারপর জানতে চায়, কেমন হচ্ছে?


         এরপর থেকে রোজই ভোরে উঠে ছেলেটি দেখে, মেয়েটি আগেই উঠে গেছে। বুক ভরা বিষাদ ও অবসাদ নিয়ে ছেলেটি নিজেও অন্ধকারে মশারির ভেতর উঠে বসে। তারপর বসার ঘরে গিয়ে দেখে মেয়েটি একমনে বসে ছবি আঁকছে।


       একটা ব্যাপার দেখে ছেলেটির একটু অবাকই লাগে। মেয়েটি সবকিছুই খুব ধীরে ধীরে করে। খুব আস্তে আস্তে খায়। সামান্যই সাজগোজ করে, কিন্তু সেটাও অনেক সময় নিয়ে। যখন হাঁটে, সেটাও খুব ধীরে ধীরে। সাংসারিক ব্যাপারে সে একদমই অপটু। আর একটু পরে পরেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।


         কিন্তু ছবি আঁকার সময় সে একেবারে অন্য মানুষ। তখন সে খুব দ্রুত আর একমনে কাজ করে। ছেলেটি রোজ ভোরে উঠে মেয়েটির হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব দ্রুত চলছে সেই হাত। তুলি আর রঙের কারুকাজে ভরে যাচ্ছে শাদা পাতা। নিবিষ্ট হয়ে মেয়েটি এঁকে চলেছে। কোনওদিকে খেয়াল নেই। যে মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই খুব আস্তে আস্তে সব কাজ করে, সে এতো দ্রুততার সঙ্গে ছবি আঁকছে কী করে? ছেলেটির কাছে হেঁয়ালির মতোই মনে হয় ব্যাপারটা।


        একদিন ছেলেটিকে পাশে বসতে দেখে মেয়েটি হঠাৎ বলে ওঠে, যত দিন যাচ্ছে, আমি যেন রঙকে আবিষ্কার করছি!

      মানে? ছেলেটি অবাক হয়ে জানতে চায়।


        মেয়েটি বলে, আগে ছবি দেখলে আমার মনে হতো, রংগুলো বুঝি স্থির। কিন্তু এখন মনে হয়, আমার ধারনাটা ভুল ছিল। কোনও রংই আসলে স্থির নয়। রং সবসময়ই পরিবর্তনশীল। ভোরবেলা ওই গাছের পাতার রং যেমন, বিকেলবেলা তেমন নয়। আবার সকালে যেমন, দুপুরে তেমন নয়। এই বদলে যাওয়াটাই আমি ধরতে চাইছি ছবিতে।


        ছেলেটি দেখল, মেয়েটি খুব যত্ন করে তাদের জানলার পাশের গাছটিকে এঁকেছে। প্রতিটি ছবিতে গাছের পাতার রংগুলো বদলে গেছে। একটি বাদে বাকি রংগুলি সবই চেনা। দিন-রাতের বিভিন্ন সময়ে ওই রংগুলিকেই দেখা যায়। শুধু ওই একটিতে সে গাছের পাতার রং করেছে বেগুনি।


          ছেলেটি জানতে চায়, বেগুনি কেন? গাছের পাতার তো এরকম রং হয় না?

         ওটা আমি ইচ্ছা করেই করেছি।

         তা, ইচ্ছারও তো একটা যুক্তি থাকে। এখানে যুক্তিটা কী?


          মেয়েটি একটু হাসে। কিছুদিন আগে একটা আর্ট এক্সিবিশনে ছেলেটিকে নিয়ে গেছিল মেয়েটি। তারপর প্রবল আবেগে একটির পর একটি ছবি বিশ্লেষণ করে তাকে দেখিয়েছিল। মেয়েটির সেই বিশ্লেষণক্ষমতা দেখে ছেলেটি চমকে গেছিল। তার কেবলই মনে হচ্ছিলো, ছবি এতো ভালো বোঝে মেয়েটি? অন্তত এই দিনটার আগে কখনও সে ঠিক এইভাবে ব্যাপারটা টের পায়নি। কখনও কখনও কোথাও কোনও ছবি দেখে মেয়েটি হয়তো ছেলেটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারপর জানতে চেয়েছে, বলো তো, এই ছবিটা দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?


         ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেও কিছু বুঝতে পারেনি। মেয়েটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছে। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে জলের মতো স্বচ্ছতায় ছেলেটিকে বুঝিয়ে দিয়েছে। ছেলেটি চমকে উঠেছে সেই মুহূর্তগুলোয়। কিন্তু তারপর আবার ভুলেও গেছে। কিন্তু এ যে একের পর এক ছবি। আর রঙে-রেখায় বেশ দুর্বোধ্য সে-সব ছবি। কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট, কোথাও মূর্ত, কোথাও বিমূর্ত, কখনও বা মনে হয় নেহাৎ খেয়ালখুশি, কিছুতেই যেন ধরা যায় না, পিছলে পিছলে যায়। মেয়েটি কিন্তু খুব সহজেই ছবিগুলি বুঝিয়ে দেয় আর ছেলেটির তখন মনে হয়, ব্যাপারটা তাহলে এই! আর আমি কিছুই ধরতে পারিনি!


         মেয়েটি সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল, দ্যাখো, শিল্পীমাত্রই কোনো একটা লজিকে আঁকে। একজন দর্শককে সেই লজিকটা বুঝতে হবে। সেই লজিকটা ছবির ভেতর থেকে খুঁজে বার করতে হবে। যারা বলে, যে যেমনভাবে খুশি দেখবে, সেটা দর্শকের স্বাধীনতা, আমি তাদের কথা ঠিক বুঝতে পারি না...

        ছেলেটি বেগুনি রং দেখে আসলে সেই লজিকের প্রশ্নটাই তোলে। 

        মেয়েটি ব্যাপারটা বোঝে। তারপর বলে, তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু এখানে সত্যিই কোনও যুক্তি নেই। তীব্র ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুই নেই। আসলে গাছের পাতার রং বেগুনি হলে কেমন লাগে, সেটাই আমি দেখতে চেয়েছি। যা অসম্ভব, তাকে সম্ভব করে তোলাই শিল্প, তাই না?


       ছেলেটি ঠিক ধরতে পারে না মেয়েটির কথাগুলো।


       একদিন মেয়েটি আঁকার ক্লাস থেকে এসে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন খুব ক্লান্ত লাগছিল তাকে। ছেলেটি মেয়েটির ফাইল খুলে তার আঁকা ছবিগুলি দেখতে থাকে। আর তখনই তার মনে কেমন একটা শিহরণ খেলে যায়। একটার পর একটা ছবি, আর ছেলেটি চমকে চমকে ওঠে। তারিখ অনুযায়ী ছবিগুলিকে সে সাজায়। সবকটি ছবির বিষয়ই প্রকৃতি। আর সে-ই প্রকৃতিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কম-বেশি একইরকম। কিন্তু তবুও ছবিগুলি একে অন্যের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা।


        প্রথম ছবিটিতে, সবকিছুই যেন একটা ক্যালেণ্ডারের ফটো থেকে তুলে আনা। বেশ সাজানো-গুছানো সব। নিখুঁত আকার। চড়া রং। বেশ দক্ষতার সঙ্গেই নকল করেছে মেয়েটি। কিন্তু শুধু এইটুকু হলে বলার কিছু ছিল না। আর সেখানেই রয়েছে আসল হেঁয়ালি। ফটো থেকে আঁকা হলেও ছবিটি ফটো হয়ে ওঠেনি। একটি মৌলিক ছবিই হয়েছে। আর তার কারণ, নদীর পাশ দিয়ে যাওয়া একটি রাস্তা। সেই রাস্তাটাও ফটোতে আছে। কিন্তু ফটোর রাস্তা কোনও বিশেষ অনুভূতিই জাগায় না। কিন্তু মেয়েটি যে রাস্তাকে এঁকেছে, তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র গতি। রাস্তাটি যেন চলমান। তার ভেতরে যেন একটা স্রোত বয়ে চলেছে। তীব্র গতি সৃষ্টি হয়েছে সেই স্রোতের মধ্যে। সেই গতির দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর এখানেই মেয়েটির মৌলিকতা। একটি স্থির, বিবর্ণ, একঘেয়ে রাস্তাকে সে তুলির আঁচড়ে অসম্ভব জীবন্ত আর তীব্র গতিময় করে তুলেছে। ছবিটির দিকে তাকালে, তাই বারবার চোখ চলে যায় রাস্তাটির দিকে। তার ভেতরে তৈরি হওয়া তীব্র গতির দিকে। আর তখন সেই গতির ভেতর থাকা প্রচণ্ড আবেগ, উত্তেজনা ও অস্থিরতাকে টের পাওয়া যায়। ছেলেটি বুঝতে পারে, এই কারণেই প্রথম ছবিটি দেখে সে ওইভাবে চমকে উঠেছিল। 


         দ্বিতীয় ছবিটিতেও একই ব্যাপার। কিন্তু এবার রাস্তার বদলে নদীর জল। তৃতীয় ছবিটিতে প্রচণ্ড বাতাসে দুলতে থাকা গাছের সবুজ পাতা। চতুর্থ ছবিটিতে নদীর বুকে ঝুলতে থাকা একটি সেতু। পঞ্চম ছবিটিতে বরফ-ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে থাকা একটিমাত্র বাড়ির দেওয়াল। ষষ্ঠ ছবিটিতে গোধূলির সিঁদুর রঙের আকাশ। প্রতিটি ছবিতে কোথাও না কোথাও তীব্র গতির সৃষ্টি হয়েছে। সেই গতির ভেতর প্রচণ্ড আবেগ, অস্থিরতা আর উত্তেজনা। কিন্তু ওই অংশটুকু বাদ দিলে বাকি ছবিটা নিছক ফটোর মতোই। সেখানে সবকিছুই স্থির। অর্থাৎ মেয়েটি নিজের অজান্তেই ওই গতির সৃষ্টি করে ফেলেছে। আসলে সে একটি ফটোর নকল আঁকতেই গেছে। কিন্তু নিখুঁতভাবে নকল করতে করতে হঠাৎ তার মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। ভেতরের আবেগ আর অনুভূতি যেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বেরিয়ে এসেছে। আর প্রতিটি ছবিতেই তীব্র প্রাণসঞ্চার করেছে, তাদের মৌলিক ছবি করে তুলেছে, ছবিগুলি নিছক ফটোর নকল হয়ে থাকেনি!


       হ্যাঁ, মেয়েটি নিজের অজান্তেই গতিকে সৃষ্টি করতে চেয়েছে। কিন্তু কোথায় ছিল এই গতি? কোথায় আছে এই গতি? এই প্রশ্নটাই এই ছবিগুলির আসল হেঁয়ালির জায়গা। সে তো কোনওদিন এই গতির সন্ধান পায়নি। বাইরে থেকে দেখে কখনও কিছু বোঝা যায়নি। মেয়েটির আচরণে, স্বভাবে, ধাতে, কোথাও এই গতির চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু এই গতি লুকিয়ে ছিল তার হৃদয়ে, তার আত্মায়, সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। তাকে জাগিয়ে তুলেছে তুলির আঁচড়ে। রেখায় আর রঙে মেয়েটি নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেছে। নিজের অজান্তেই তার আত্মাকে মেলে ধরেছে। আর সেই আত্মা মোটেই ধীর, স্থির, শান্ত, নিরীহ নয়। সেই আত্মার ভেতর রয়েছে প্রচণ্ড জীবনীশক্তি। আর এটাই যেন ছেলেটিকে একদম হতচকিত করে দেয়। দশ বছর মেয়েটির সঙ্গে বিবাহিত জীবন কাটানোর পর হঠাৎ করে মেয়েটিকে নতুন চোখে, অপ্রত্যাশিত আলোয় দেখার সুযোগ করে দেয়!


       পরদিন মেয়েটি ঘুম থেকে ওঠার পর ছেলেটি বলে ওঠে, তোমার ছবিগুলো কাল খুব মন দিয়ে দেখছিলাম। তুমি জানো তুমি কী করেছো?

      মেয়েটি অবাক হয়ে তাকায়।


      ছেলেটি অভিভূতের মতো বলে যায়, কী প্যাশন তোমার ছবিতে! কী প্রচণ্ড গতি! যে সব ছবি তুমি এঁকেছো, সেগুলো একেবারেই তোমার স্বভাববিরোধী। নকল নয়, তুমি মৌলিক ছবিই এঁকেছো। এই ছবিগুলিতে আমার চেনা তুমি কোথাও নেই। তোমার ভেতর থেকে এক অচেনা তুমি জেগে উঠেছে। একে আমি চিনি না। সত্যিই চিনি না। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। কাল রাত থেকে তোমাকে আমি খুঁজে চলেছি। কোনটা আসল তুমি? তুমি, আমার স্ত্রী? না এই ছবিগুলি যে এঁকেছে, সেটাই আসল তুমি?


        মেয়েটি ছেলেটির কথাগুলো কিছুই বুঝতে পারে না। ছেলেটি বুঝতে পারে, এই কথাগুলির তুলনায় মেয়েটি আসলে বড় বেশি নিস্পাপ। তার ভেতরে কী আছে, সে নিজেই জানে না। এই ছবিগুলির মধ্য দিয়ে সে যে নিজেকেই উন্মোচিত করে চলেছে, আবিষ্কার করে চলেছে, এটাই সে জানে না। কিন্তু এখন তার কী করা উচিত? মেয়েটি সত্যিই স্বীকার করে, ছেলেটির কোনও কথাই সে বুঝতে পারেনি।


       ছেলেটি মেয়েটিকে বোঝে। তারপর বলে, আসলে, আমি যা বলতে চাইছি, তা হলো, তোমার ছবিগুলির কিছুটা অংশ জীবিত, কিছুটা মৃত। যে অংশটি জীবিত, সেটা অসাধারণ, তাতে অসম্ভব প্রাণ। আর যে অংশ মৃত, সেটা খুব সাদামাটা, একঘেয়ে, পিকচার পোস্ট কার্ডের মতো। তোমাকে এই অসঙ্গতি দূর করতে হবে। এই দুটো অংশের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে... 


     মেয়েটি হতাশভাবে বলে, আমার সবটাই হয়ে গেছে। আমি সচেতনভাবে কিছুই করিনি...ছেলেটি একটু ভাবে। তারপর বলে, আমার মনে হয় তোমার জীবনটা কেটেছে খুব সাদামাটা আর একঘেয়েভাবে। তাই ওই প্রবণতাগুলো তোমার মধ্যে থেকে গেছে। কিন্তু তুমি জানো না, তোমার ভেতরেও একটা অসাধারণ জীবন লুকিয়ে আছে। নইলে তোমার ছবিতে এরকম তীব্র প্যাশন আসে না। এই লুকিয়ে থাকা, না চিনতে পারা জীবনটাই বেরিয়ে আসে তোমার ছবিতে। তোমার অজান্তেই। এর ওপর তোমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু তুমি সেই অসাধারণত্বকে বহন করে চলেছো...


       মেয়েটি অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, তোমার কথা আমি মাঝেমাঝে সত্যিই বুঝতে পারি না!


      একদিন মেয়েটি ছেলেটির সঙ্গে পার্কে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটি কিশোরকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। তারপর তার দিকে ইশারা করে ছেলেটিকে বলে, ও আমাদের সঙ্গে ছবি আঁকে। ভারি অদ্ভুত। একটু বোধহয় অ্যাবনর্মাল। 

কেন? 

তুমি দেখে বুঝতে পারছো না? 

হ্যাঁ, ছেলেটি ভালো করে দেখে বলে, সেরকমই মনে হচ্ছে বটে... 


     কয়েকদিন আগে ছবি আঁকার ক্লাসে ও একটা অদ্ভুত কথা বললো। ও একটা ছবি আঁকার পর স্যার সেটার ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকে। ও কিন্তু তাতে মোটেই খুশি হয় না। তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, তোমার কেমন লেগেছে সেটা বড় কথা নয়। আমার নিজের কাছে ভালো লেগেছে, এটাই শেষ কথা! তারপর আর একটিও কথা না বলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে সে বেরিয়ে যায়। ঘটনাটা কিন্তু আমার মনে খুব দাগ কেটে গেছে! 


       ছেলেটি বলে, শিল্প আমি তেমন একটা বুঝি না। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, শিল্পীরা, যদি সে প্রকৃত অর্থেই একজন শিল্পী হয়, সে বোধহয় এরকমই হয়। কিন্তু আমার অবাক লাগছে তোমার প্রতিক্রিয়া দেখে। অনেকেই হয়তো এই ঘটনাটাকে বিশেষ আমল দিতো না। ছেলেটাকেই হাসি-ঠাট্টার খোরাক করে ছাড়তো। কিন্তু তুমি ঠিক জায়গাটাই ধরতে পেরেছে। ওই ছেলেটি একজন প্রকৃত শিল্পী। শিল্পের এই খাঁটি জায়গাটাকে তুমি বুঝতে পেরেছো... 


       একদিন সমুদ্রের ধার দিয়ে ছেলেটি আর মেয়েটি হাঁটছিল। হঠাৎ ছেলেটি বলে উঠল, তুমি ঠিক এই মানুষের দুনিয়ার কেউ নও। অনেকটা যেন এই সমুদ্রের মতো। অথবা এই সমুদ্রের ওপর বিছিয়ে থাকা আকাশটার মতো। নিষ্পাপ, বিশাল আর উদাসীন। অপার্থিব। তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা করছে...


      মেয়েটির চোখের কোণে হঠাৎ দেখা গেল একবিন্দু জল। ক্রমে সেই জলের বিন্দুটি একটি ফোঁটা হয়ে মেয়েটির গাল দিয়ে গড়িয়ে নামলো। 


       ছেলেটি সেই জলের রেখাটিকে মোছার কোনও চেষ্টাই করলো না। শুধু বিষন্ন গলায় বলে উঠল, আমার মনে এতো অবসাদ! এতো বিষাদ! আমার কী হবে! রোজ ভোরবেলায় আমি উঠে যাই। ঠিক পাঁচটায়। আর তখন মনে হয়, মনের ভেতর যেন একটা অতল কালো গহ্বর ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই গর্তের ভেতর পাক খেয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। এত মন খারাপ হয়ে যায় তখন!

       পরদিন ভোরবেলা ছেলেটি ঠিক ভোর পাঁচটায় উঠে দেখল মেয়েটি তার পাশেই শুয়ে আছে। চোখ খোলা। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ছেলেটি থতমত খেয়ে উঠে বসল। তারপর বলল, তুমি এখানে? আঁকতে যাওনি? 

     যাবো। তারপর হঠাৎ ছেলেটির মাথা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, তবে তার আগে তোমার সমস্ত অবসাদ, সমস্ত বিষাদ শুষে নেবো। আমার রং-তুলির জোর কী এতোই কম?

      মেয়েটির বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ছেলেটি বুঝতে পারল, তার ভেতরটা আলোয় আর বাতাসে ভরে উঠছে।

    আর কখনও ভোর পাঁচটায় ছেলেটির ঘুম ভাঙেনি।


   গল্পটা শেষ করে আমার বন্ধু বলল, আসলে ছেলেটি মরতে বসেছিল। হতাশায়, বিষাদে, অবসাদে। ছবি আঁকতে গিয়েই মেয়েটি নিজের ভেতরে একজন শিল্পীকে আবিষ্কার করেছিল। জীবনটা খুব সাদামাটাভাবে, শ্লথতায় কেটে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ একদিন সে সুযোগ পেল। আর তার ভেতর থেকেবেরিয়ে আসতে শুরু করল প্রচণ্ড গতি।


       মেয়েটা বদলে গেছিল একেবারে। সে সৌন্দর্যকে চিনতে পারছিল। জীবনীশক্তিকে টের পাচ্ছিল। প্রচণ্ড গতির ভেতর দিয়েই সে একটু একটু করে হয়ে উঠছিল একজন শিল্পী। আর তাই সে ছেলেটিকেও ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল তার জীবন। হ্যাঁ, সেই জীবন, ছেলেটি যাকে হারিয়ে ফেলেছিল...


      আমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম, মেয়েটি ঠিক ওইরকম ছিলো, ওই সমুদ্রের মতো...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন