মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর, ২০২১

কবিতাগুচ্ছ * হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়




' জলের আয়নায় রেখেছি ধ্বনিময় বৃষ্টিপাত ' কিংবা '  আমার আধপোড়া শরীর / ভেসে চলুক নদীর পর নদীতে / অশক্ত শরীর নিয়েও আমি ঠিক তাক করে থাকব ধনুর্বাণ/ যতক্ষণ না গহনতম সঙ্গীত জন্মায় ' সহজ ব্যঞ্জিত মগ্ন উচ্চারণে এইভাবে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে চলেন কবি হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমরা অপেক্ষায় থাকি সেই ' গহনতম সঙ্গীত 'কখন বেজে ওঠে কবিকণ্ঠে....পড়ছি ----



 কবিতাগুচ্ছ * হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়


অপর নাম প্রেম



বিরহের অপর নাম প্রেম, পালতোলা নৌকো

ভাসাও যদি জলে গদ্যে কবিতা হলে

কেউ কেউ ছন্দের এদিক ওদিক শুধু খোঁজে

বিষ্ণু দে কিংবা সমর সেন যারা পড়েনি কখনো

চক্রবর্তী অমিয় অথবা বুদ্ধদেব বসু

ওদের কবিতা এরা বোঝেনি কখনো

প্রতিভা থাকে না বাধা শিকলে শিকলে

জেনো, কবিদের কিশোর স্বভাব

প্রথম পাঠে বড়ো কষ্ট তেতো নিম

তারপর নেমে গেলে জলে অথৈ অথৈ...

বিরহের অপর নাম প্রেম, ভালবেসে বধির

হ ওয়া ভালো,মনে হবে পারি আমি ও তো পারি

আরেকটু এগোতে গিয়ে দেখি

সে কষ্ট গ্রহণযোগ‍্য নয়...



হে সমবেত নীরবতা


কী কথা বলতে গিয়ে কী কথা বলেছি

নিশ্চিত মানি আজ গাছে গাছে

কাটারির দাগ , স্পর্শ মাত্র বিদ্যুৎ প্রবাহ

শূন্য থেকে শুরু হলে এ অপবাদ জনরব

দারুণ ডায়ালগ বলে লোকে

কৌতুক ওড়ায় আর কিছুই বোঝেনা যারা

তারা ধুলোয় ধুলোয় কাটাকুটি খেলে

অথচ ব‍্যালটে কত ছবি আধারে কত মুখ

তিমিরে জড়ানো কত দাঁড়ে বসা পাখি

হলো তো এ কাব‍্যি, কৃষিকাজ

ঝুলে ঝুলে পড়ে ক‍্যালেন্ডার,নীল পাতা

ঝাঁকে ঝাঁকে ডিম পাড়ে মাছে

সুবর্ণ পিদিম জ্বেলে নীরবতা শব্দ করে ফাটে


 ধনুর্বাণ


একটি দুটি করে ঝরে পড়ছে বকুলপাতা দিনকেদিন

আমার জন্মদিনের মহামূল্য উপহারগুলি

কেউ না কেউ এসে আমার সামনে গুছিয়ে রাখছে

রঙ ঝলমলে কাগজগুলি

আজ রাত্রিতে তুমুল খাওয়াদাওয়া

আমোদ হবে খুব ...

তবু আমার মনে সুখ নেই

ভালোমন্দ সব চক্রান্তকারীদের নখদন্তহীন মুখচ্ছবি

কেন যে ভেসে আসছে মুহূর্মুহূ

এতদিন পরেও ভুলতে পারছি না

কে কখন কীভাবে আমায় কাচি করে দিয়েছিল

ভুলতেতো চাই সমূলে কিন্তু

নীল ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে আসছে বিষহরি

নিরন্তর নজরদারি, শব্দ করে ফোঁসফোঁস...


আদিগন্ত ভস্মস্তুপ ফেলে যায় যে অপমান

মনে পড়ে সেকথাও

মানুষ ভালবাসা ভুলে যায় অপমান ভোলেনা কখনো

বোধবুদ্ধিহীন সবকিছু 

থমকে যায় সুবাতাস, উপত্যকা অটোগ্রাফ

লাল ডায়রি ডটপেন

আলকঝঙ্কৃত ধনুকের ছিলা  


উন্মোচন


জলের আয়নায় রেখেছি ধ্বনিময় বৃষ্টিপাত

হলুদ ঘাঘরা থেকে লেসকাটা ঝালর

চেনা অচেনা অনেক সহজ কামিনী ফুলের গন্ধ

স্তব্ধতা থেকে উঠে আসা মাকড়সার জাল

ধীরে ধীরে সরে যায় লেজবিহীন টিকটিকি

আজ চিনতে পেরূছো কি এমন নিপুণ উপহার

এখন বুঝি নি:স্বতা তোমার ও সম্বল

মনে আছে নিশ্চয় একদিন তুমি ই 

স্তব্ধতার কথা বলতে আর আমি কোলাহল

জুই গাছগুলির কেপে ওঠার কথা বলতে

আমি কাঠটগরের চুইয়ে পড়া কান্নার

ঝগড়াঝাঁটি ,মতানৈক্য গুলি কথা শুরু করেছে আবার, এখনো 

কৃপণতা মহিয়সী?

কেন এত ধ্বংসের দিকে যাওয়া

জেনো,একদিন ঠিক পাতাঝরানোর শেষ হবে

বাথটবে জলপরীরা নাচবে

এই শবরীর অপেক্ষাও শেষ হবে

ঠাকুরভাসান কুয়াশা জন্ম শেষ হবে

রাতের আকাশে উঠবে কোজাগরী চাদ

এই পরাভব এই গ্লানি মুছে ফুটে উঠবে

পার্থিব বিজ্ঞাপন...

ততোদিন তুমি অপেক্ষা করো আর আমার আধপোড়া শরীর 

ভেসে চলুক নদীর পর নদীতে

অশক্ত শরীর নিয়েও আমি ঠিক তাক করে থাকব ধনুর্বাণ 

যতক্ষণ না গহনতম সঙ্গীত জন্মায় ...


বেআব্রু


বাড়িতে কেউ আসছে শুনলে তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত 

একসময়, অতীত স্মৃতির ছবিগুলো

আ্যলবাম থেকে বেরিয়ে আসতো

শিরশির করে উঠত সারাটা শরীর

ভিয়েন বসতো রান্নাঘরে

বিছানার চাদর পাল্টে যেতো অনায়াসে

খুব নিজের, কাছের মানুষের কথা ভেবে এই

আপ‍্যায়ন নয় ,তখন এরকমই ছিল নিয়ম

এত ঘৃনা এত দ্বেষ এত সন্দেহের বিষে জর্জরিত

ছিল না প্রতিবেশীদের মন পিসি মাসি মামীমা 

সন্তান সন্ততি নিয়ে ঠিক জায়গা করে নিতো

সংসারে...


সেসময় পুকুরে নীল সাদা ময়ূরপঙ্খী হাস ,গোয়ালে গাভীন গরু 

খামার বাগান খড়ের পালুইয়ের নীচে কুকুর বিড়াল

খাচায় ময়না অতিরিক্ত বলে মনে হতো না কিছুই


প্রকাশ‍্যে কিংবা অন্তরালে গোল গোল কথার

আবহে পড়তে হতো না

এই সব ইন্টারনেট তত্ত্ব অত‍্যাগসহন একদিন ছিল বটে 

দেওয়ালে টাঙানো

ছবির মতোই আজ আর নেই

আজ সবকিছু বড় বেশী নিয়মমাফিক ,সংগোপনে যুক্তি তর্কের 

বেড়াজালে ঠিকঠাক

ভদ্র ও মহান, আজ আর বে আব্রু হবার

উপায় নেই...

আজ শুধু ঠোঁটের কষে লেগে আছে অবিরল

সময়ের ফেনা ...


চাপ


সকলেই খুব চাপে আছে বোঝা যায়

চোখ খোলা রাখলে বেশ বোঝা যায়

যে রাজমিস্ত্রি ইট গাথছে সিমেন্ট ও বালির ফাঁকে তারও 

আছে অস্বস্তির ঘাম

যে বালক পিঠে করে বইছে  বইয়ের বোঝা

স্কুলের জানলা দিয়ে সে দেখছে বিস্তৃত এক 

খেলার মাঠ, মানুষ যা চায় তাতো হয়না কখনো

অথচ এই সরল বাক্যটুকু বুঝতে সময় লেগে যায়, প্রেম

ভালোবাসর  মতো নিম ও শিরীষ

বট ও আশুত জাম জামরুল কী বিশাল ডানা দিয়ে ঢেকে রাখে 

যাবজ্জীবন....

তবু জীবনের তুচ্ছতম ঘটনায় তাকে মিথ্যে খোঁজা চায়, আসলে 

কারুরই তো সুখ নেই জীবনে হাসির ফাঁকে তবু সে রেখেছে 

চেপে

সমূহ যন্ত্রণা ঘৃনা অপমান

আদতে সে রেখে যেতে চায়

হিসেবনিকেশ সারা জীবনভর কি কি পাওয়া হল,কতটা 

সম্মান....



শাখাপ্রশাখা


কত দীর্ঘ হলে মূল ,ভুলে যাওয়া যায়

শাখাপ্রশাখায় থাকে প্রেম তবু অনির্বচনীয়

ব্রহ্মনাদ,বর্ণ আর নাভি ঘিরে কুহু গান

শূন্য থেকে শুরু

সলমাজারি ,চোখে চোখ খুলে ঢেউ

বিজ্ঞাপন নিয়ন ভেসে যায় কড়ি ও কোমল

কত দীর্ঘ হলে বিস্ময় রোমাঞ্চ বিস্ফোরণ ঘটায়

কী কথা বলতে গিয়ে কী কথা বলেছি

আজ অমর ভিখারি, আয়ু থেকে ঝরে যায় নদী

নির্ঘুম অবসাদ ,নিরূপায় শরীর অনুবাদ

কে যেন বলে ,জানান দেয় অবিরাম

এই দিনগত ক্ষয় সেতো আর অন্য কিছু নয়

ঝরে যায় মোম

উৎসব শুরু হলে ফেলে আসা বিমূর্ত সময় ...

 

পা থেকে মাথা পর্যন্ত


আপনার অবাক হওয়া দেখে মেয়েটি তার

ভারী চশমার কাচ মোছে

সুন্দর দেখাচ্ছে... অপরাহ্নের আলো

এসে পড়েছে আপনার গালে

বেগুনি রশ্মি এসে চোখে লাগে

এর থেকে মুক্তি নেই আজ...

নি:শ্বাস নিস্তব্ধ... নিজ মুখে কী আর বলবো

কোনো বুকির কাছে জমা দিইনি আত্মা

কবেই তো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল

আজ শব্দে শান্তি নামলো

টেস্ট ম্যাচ খেলার সময় গ‍্যালারিতে হান্ড্রেড, হান্ড্রেড চিৎকার 

উঠলে যেমন

ঠিক তার পর পর দুরন্ত এক ছক্কার জন্যে

শান্ত সব কিছু পা থেকে মাথা পর্যন্ত...

আপনার অবাক হওয়া দেখে

আপনাদের অসমবয়সী পোশাক পর্যন্ত

প্রজাপতির মতন উড়তে থাকে

আর শহরে রাত্রি নামে ...



হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ 


ঢেউ * অরণি* নিরালম্ব * অসহনীয়

অত‍্যাগসহন * বিধিবদ্ধ উপত্যকা

ছায়া ফেলি ছবি হয় * বসন্ত অপেরা

নীল আলোর গল্প ইত্যাদি 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন