পেশায় শিক্ষিকা, মৌসুমী চৌধুরী-র শক্তিশালী কলমে গল্পের চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। আমরা অনুভব করি, জীবন যন্ত্রণার কী করুণ ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সমাজের আনাচে-কানাচে। তেমনই একটি গল্প এবার আমরা পাঠ করি ----
ভাইফোঁটা
মৌসুমী চৌধুরী
সুরেলা রিংটোনে সকালবেলার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল শুভমের। সাত সকালে মিসেস সমাপ্তি সেন ফোন করে আজ তাঁর বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। শুভমের "ছন্দনীড়" অ্যাপার্টমেন্টের ৬৪ এ/২/বি-ব্লক এর এই ফ্ল্যাটটাতে সকালটা একটু দেরী করেই শুরু হয়। শুভমের যে পেশা, তাতে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে। আজ অনেক -দিন পর ফোন করলেন মিসেস সেন। আগে তো মাঝে মাঝেই ফোন করে ডাক পাঠাতেন।
এই মহানগরে এই পেশা শুরুর প্রথম দিনটিতে মিসেস সমাপ্তি সেন ছিলেন তার প্রথম কাস্টমার। সংস্থার কাছে তিনি সেদিন ফ্রেস, এডুকেটেড, একটু কমবয়সী ছেলে চেয়েছিলেন। কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সেদিন শুভমের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হননি মিসেস সেন। সারা রাত ধরে শুনিয়ে গিয়ে- ছিলেন নিজের জীবনের বঞ্চনার করুণ কাহিনী। কিভাবে সৎ মা আর বাবা তাঁকে ঠকিয়ে একজন নপুংসক ধন-কুবের বস্ত্র ব্যবসাায়ীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন।
তারপরের দিন সকালে শুভমের প্রাপ্য টাকাটুকু তার হাতে গুঁজে দিয়ে মিসেস সেন বলেছিলেন,
— "ভাই রে, এ বড় পাপের জায়গা। পালা এখান থেকে। ফিরে যা কাঁকদ্বীপে।"
ভাই!!!
বুকের ভিতরে একটা সজোরে ধাক্কা খেয়েছিল শুভম। কিন্তু তখন তো তার আর পিছন ফিরে দেখবার সময় ছিল না। সুদূর কাঁকদ্বীপে ঠিক সেই সময় কতগুলো অসহায় মুখ তার দিকে হাঁ করে চেয়ে বসেছিল।
সে বছর ইলিশ মরসুমে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে গেলে বাপটা চলে গেল। তিন ভাইবোন-মা মিলে পাঁচটা পেট চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ল একা শুভমের কাঁধে। অবশেষে তৃতীয় বর্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক স্তরের পড়া ছেড়ে কাকদ্বীপ থেকে সে সোজা চলে এসেছিল কলকাতায় রোজগারের ধান্ধায়। বেশ কয়েক মাস ঘুরে ঘুরে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যাবার পর সে বুঝতে পারল যে, কাজের বাজারে তার স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পড়ার কোন দাম নেই। টুকটাক পেপার, ম্যাগাজিন, ধুপকাঠি বিক্রি করে, টিউশান পড়িয়ে কোনক্রমে সংসারটা টানছিল সে। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তার চারটি পেটের অনেক বড় গর্ত। শুভম সেই গর্ত ভরাট করতে পারছিল না। বাঁশগাছের মত তরতর করে বাড়ছিল সোমত্থ বোনদুটো। মা তাদের বিয়ের ব্যাবস্থা করার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছিলেন। খুব অসহায় লাগছিল শুভমের। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।
অনেক চেষ্টা করেও মোটা রোজগারের যুৎসই কোন কাজ না পেয়ে হঠাৎ এক বন্ধুর পরামর্শে সে ঢুকে গিয়েছিল পুরুষ যৌনকর্মী -দের এই পেশায়। সেই বন্ধু একটা মডেলিং কোম্পানিতে কাজের আড়লে এই পেশায় যুক্ত বহুদিন। ইতিমধ্যে বহু টাকাও রোজগার করে ফেলেছিল।
প্রথম প্রথম শুভমের কেমন যেন ভয় হত, লজ্জা লাগত ভীষণ। বছর তিনেক হল এখন সব সয়ে গেছে। সেজন্য অবশ্য সেই মডেলিং কোম্পানিটি শুভম এবং তার মত আরও কিছু নতুন ছেলেদের প্রপার ট্রেনিং দিয়েছিল। কিভাবে খদ্দের সামলাতে হবে, ফিগার ঠিক রাখার জন্য খাওয়া-দাওয়া কিভাবে করতে হবে, কিভাবে করতে হবে শরীরচর্চা, অন-লাইন পেমেন্ট কিভাবে হ্যান্ডেল করবে মায় হিন্দি-ইংলিশ ফ্লুয়েন্টলি বলা — সবই শিখিয়ে নিয়েছিল সেই সংস্থাটি। বদলে তার প্রথম দু' মাসের রোজগারের পঞ্চাশ শতাংশ দিতে হয়েছিল সংস্থাটিকে। প্রথম প্রথম বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে ওই কোম্পানিই খদ্দের ঠিক করে দিত। এখন বেশ পরিচিতি হয়ে গেছে শুভমের, তাই নিজেই স্বাধীনভাবে কাজটা করছে সে।
এখন অশান্ত, অভুক্ত নারী শরীরকে তৃপ্তি দেওয়াই শুভমের পাকাপাকি কাজ। এই কাজে ধরে গেছে তীব্র নেশাও। রাতের পার্কস্ট্রীটে তার ছ'ফুট লম্বা, শ্যামলা, পেশীবহুল শরীরটার বেশ চাহিদা। তবে, এখন আর রাস্তায় দাঁড়াতে হয়না। বিভিন্ন নামকরা সাইটে নাম রেজিস্টার করে রেখেছে। কাস্টমারেরাই ডেকে নেন।রিসর্ট, হোটেল, কখনও কাস্টমারের বাড়িতে গিয়েও সার্ভিস দিতে হয়। শুভম একটু কষ্টলি। আউট-অফ-স্টেশনে গেলে আরও বেশি টাকা নেয়। একদিনে সকাল-দুপুর-রাত করে তিনটি কেসও কখনও কখনও সামলায় সে। তার এখন প্রচুর রেজগার।
এটা দেখে শুভমের ভারী অবাক লাগে যে, সমাজের উচ্চবিত্ত, প্রভাবশালী আর মাঝ বয়সী মহিলারা শরীরী সুখের জন্য কী অকাত -রেই না মুঠো মুঠো টাকা ওড়ায়! অথচ তাদের গ্রামে আজও কত অনাহারী পরিবার! মার্ক্সের শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্বের কথা মনেপড়ে শুভমের। নাহ্ , পুঁজিপতিদের হাত থেকে শরীরের বিনি -ময়ে অর্থ লুটেপুটে নিয়ে সে একদম ঠিক কাজ করে। এই ভাবনায় তার কুন্ঠা, অপরাধ -বোধও এক মূহুর্তে যেন লাঘব হয়ে যায়।
এখন সে বাড়িতে পর্যাপ্ত টাকা পাঠাচ্ছে। ভাই আর ছোটবোনটা স্কুলে পড়ছে। দু'মাস আগে বড় বোনের বিয়ে দিয়েছে একটা উচ্চ- মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষকের সঙ্গে। ভদ্র এবং শিক্ষিত পরিবার তাঁরা। কেউ শুভমের এই পেশার কথা জানে না। তার শরীর-বেচা টাকায় বাড়িটা পাকা দোতলা করেছে। কিনেছে কিছু চাষের জমিও। ট্রাক্টর কিনে চাষ আবাদও ভালোই চলছে।
জীবন যুদ্ধে লড়তে লড়তেও মিসেস সেনের কথা, সেই প্রথম দিনের কথা কখনও ভুলতে পারেনি শুভম। তিনিও কেন যেন কোন অজানা কারণে শুভমকে একটু স্নেহ নজরে দেখেন। ভালোমন্দ কিছু রান্না করলে মাঝে মাঝেই তাকে ডেকে খাওয়ান। প্রথম প্রথম মিসেস সেন ফোন করলে তাঁর ফ্ল্যাটে যেতে কেমন একটা কুন্ঠা বোধ করত শুভম। কিন্তু পঞ্চব্যঞ্জন বেড়ে দিয়ে সামনে বসে থেকে তিনি যখন শুভমকে খাওয়ান , তখন তাঁর মুখে যেন অপরূপ এক মায়াময় আলো জ্বলতে দেখে সে। দেখে মনটা বড় দ্রব হয়ে আসে। নিঃসঙ্গ, নিঃসন্তান এই অপরিচিতা নারীর শরীর থেকে তখন যেন একটা মা মা গন্ধ ভেসে আসে!
কানাঘুষোয় সে শুনেছিল, তাদের কোম্পানির একজন বয়স্ক জিগোলো মিসেস সেনের শরীরী চাহিদা মেটাচ্ছেন। কিন্তু আজ হঠাৎ বহুদিন বাদে তিনি কেন যে তাকে ডেকে পাঠালেন বুঝতে পারছিল না শুভম! যাইহোক, মিসেস সেনের বাড়িতে যখন সে পৌঁছল তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটা বাজে।সুদৃশ্য ড্রয়িং রুমের নরম আলোয় বিস্ফারিত চোখে শুভম দেখল চন্দন বেটে, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে, সাদা খোলের লাল পাড় গরদের শাড়িতে সেজে সমাপ্তি সেন অপেক্ষা করছেন তাকে ভাইফোঁটা দেবার জন্য!
আজ ভাইফোঁটা! চোখদু'টো হঠাৎ ঝাপসা হয়ে ওঠে শুভমের, গলার কাছে কি যেন এক -টা পাকিয়ে আসে!
মৌসুমী চৌধুরী-র প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ - আশ্রয়


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন