কিচিরমিচির
স্বপন চক্রবর্তী
আঠারো তারিখ৷ এবং শ্রাবণ মাস৷
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মে৷
যে প্রকৃতির নিয়মে আমি সকল প্রেম, আর্দ্রতা এবং কান্নাকে অতিক্রম করে
এসেছি৷
কবে যে অতিক্রম করে এলাম--- বুঝতেই পারি নি৷
কবে যে এসেছিলাম এই ধরণীর বুকে--- ঠিক যেমন বুঝতে পারি নি তা-ও ৷
এই দুই বুঝতে-না-পারা’র মধ্যবর্তীতে একটা পর্ব গ্যাছে জীবনে--- যখন প্রেম
ছিল, বিরহ ছিল, উল্লাস-উন্মাদনা ছিল; ছিল বৈরাগ্য৷
এবং ছিল অনুরাগও ৷
যখন অঙ্কুরিত বীজ দেখলে
বৃক্ষে কুসুম দেখলে
লতায় মঞ্জরী দেখলে
চোখে ইশারা দেখলে
অন্তর রোমাঞ্চিত হতো---
আনন্দে
উল্লাসে
স্বপ্নে
আশ্বাসে৷
পথে নিরাশ্রয় দেখলে
অবোধ অসহায় দেখলে
মন হু হু করে উঠতো, কান্নায়৷
যখন সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে, চন্দ্রকলার বিন্যাসে উড়ে বেড়াতো মন--- গানে গানে,
উন্মাদনায়--- দিগন্তে, দিনান্তে, জ্যোৎস্নায়, অমায়৷
কোথায় যে সে হারিয়ে গ্যালো, কবে যে গ্যালো, কখন--- বুঝতেই পারি নি৷
বুঝতেই পারলাম না ‘আমি’ বলতে কে ছিল এই জীবনে৷
বুঝতেই পারলাম না এই ধরিত্রীর, এই প্রকতির, এই দিবা-অমানিশার মানে৷
*
লিখতে গিয়ে হাত কাঁপছে৷
হাতের লেখা প্রতিদিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে৷
গতকাল রাতে বিজয় একটা ছবি পাঠিয়েছিল আমায়---WhatsApp-এ৷ অনেক
পশু-পাখি-পতঙ্গ দিয়ে তৈরি একটি মানুষের মুখাবয়ব৷ নীচে লেখা ছিল: ওদের
মধ্যে একটি ‘উট’ আছে--- ওই ভিড়ের মধ্যে; যদি আমি সেই ‘উট’টিকে খুঁজে
বের করতে পারি তাহলে বুঝবো আমার অ্যালজাইমার নেই৷
আমি ছবিটার দিকে প্রায় তিন-চার মিনিট তাকিয়ে থেকে নানানভাবে তন্ন তন্ন
করে খুঁজেও কোনও উট আবিষ্কার করতে পারি নি সেই ছবির মধ্যে৷
বিজয়কে জানালাম সেই কথা৷
বিজয় বললো, ওর পাঁচ সেকেন্ডের মতো সময় লেগেছে উট
খুঁজে বের করতে৷
মধ্যবর্তী ওই পর্বটিই হলো মহাকাল! যা আমাকে গ্রাস করেছে৷
এর জন্য কোনও আক্ষেপ নেই, হতাশা নেই, বেদনা নেই৷ কেবল একটু
কৌতুক মিশিয়ে তাঁর সঙ্গে নীরব অভিমানের ভাব-বিনিময় করি৷
আবেগ বলতে এইটুকু৷
*
দশই আশ্বিন৷
অথচ প্রকৃতিতে বৃষ্টি, মেঘ, মেঘের ফাঁকে হঠাৎ চকিত রোদ্দুর৷
আমার অন্তর চাইছিল ঝকঝকে নীল আকাশ৷
চাইলেই তো আর হয় না৷
অবশ্য যদি ইচ্ছাপূরণের বর পেতাম : যা চাইবো তা-ই--- তবে যেন আকাশ
অমনি ঝকঝকে নীল হলো!
তাতেই বা কী?
কী হতো--- যদি আজ ঘন কালো সজল মেঘের বদলে আকাশে শুভ্র মেঘ
থাকতো ঝকঝকে রুপোলী?
কোনও মেঘেই যে আমি ভেসে পড়তে পারি না আর!
ডানা দুটোয় পক্ষাঘাত৷
না কি, ডানা ছিলই না কখনো?
মাঝে মাঝে এই ভ্রম হয়--- যেন কোনও এক পর্বে, জীবনে, -ওই রুপোলী
মেঘে ভেসে বেড়িয়েছিলাম কোথায় কোথায়--- বনে, উপবনে৷
সেখানে যেন ছিল গহনে পাখির ডাক
ছিল স্রোতস্বিনীর আভাস--- যাকে বলে নির্ঝর৷
ছিল, মনে মনে ভাবতাম, অনুভব করতাম--- কুসুমঘ্রাণ৷
সেসব কি মিথ্যে? সব মিথ্যে?
অ্যাতো বড় মিথ্যে?
তবে, জীবনটা কী--- এই বর্তমান আর ওই অতীতপর্ব মিলে?
শুধুই প্রতারণা? ভ্রম?
সব মিলে কেমন যেন নির্মম মনে হয়, প্রতিপক্ষকে৷
‘প্রতিপক্ষ’ যে কে--- তা-ও জানতে পারলাম না আজও৷
অথচ, জীবন ফুরিয়ে এলো৷
স্বপন চক্রবর্তীর একটি জনপ্রিয় বই

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন