মূলত কবি; কিন্তু কাব্যচর্চার পাশাপাশি তাঁর কলম খুঁজে ফেরে আধুনিক নগর সভ্যতার অন্তরালে চাপা পড়া বাংলার লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ এক উজ্জ্বল জগত। বিশেষ করে মানভূম -পুরুলিয়ার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী লোক সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। আবার ওই অঞ্চলের বঞ্চিত মানুষের জীবনযাপনচিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর ক্ষুরধার কলমে। তেমনই একটি গল্প ---- ।
ভিখিরি
তপন পাত্র
আলুথালু চুল । এলোমেলো পোশাক । খালি পা , জুতো নেই । চোখগুলো বড়ো বড়ো করে ক'দিন আগের একটা সংবাদপত্র মুখের সামনে ধরে হঠাৎ জোর করে ছুঁড়ে দিল আকাশের দিকে । তারপর সে মাটির দিকে তাকাচ্ছে , চারদিকের যতো সব মাটির দিকে । রিলেমালা যেন মাটি খোঁড়ার চেষ্টা করছে । এদিক-ওদিক লাফাচ্ছে । এদিক-ওদিক লাফাচ্ছে আর একটা আলু-খুসা ছোট কোদাল নিয়ে যেখানে সেখানে কোপ মারছে ।
কী খুঁজছে রিলেমালা ? ওর বাবা ছোট সাগেন বুঝতে পারছে না রিলেমালার মতলব । মা জুনপুকিও বুঝতে পারছে না মেয়েটার হলো কী ! ভেবে পাচ্ছে না একটা এমন ছোট কোদাল নিয়ে রিলেমালা এখান ওখান লাফাচ্ছে কেন ?
কোদাল টা নিয়ে কোপ মারছে উঠোনে, দাওয়ায়, ধারিতে, মেঝেতে , যেখানে অযত্নে বেড়ে উঠেছে কয়েকটা পুই লতা সেখানেও । জল জমে জভি হয়ে থাকা ঘরের ছাঁচ কোলটাতেও ।
ওর এই পাগলামি দেখে মুরগিটা কুক্ কুক্ কুক্ কুক্ কুকুরুচ্চূ--- করে ডেকে উঠলো ; হাঁসগুলো ওর দিকে তাকিয়ে ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ --- ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ করে ওর দিকেই খরোখরো ছুটছে । তাল ডাল দিয়ে ঢাকা ভাঙ্গা চালার ভেতর থেকে থলবোলে গভ্ভিন গাইটা হাম্বালছে । রিলেমালার কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ।
গতকাল পুরুলিয়া জেলা সদরের মহিলা বিদ্যালয় থেকে একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করে ঘুরে আসার পরে সে ভিতরে ভিতরে অনেক কিছুই ভাবছে । ওদের কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক তেমন কোনো ছেলে মেয়েদের না পেয়ে ওর মতো তিন-চারটি পাস আউট মেয়েকে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেয়েছিল সেমিনারে । রিলেমালা ক'দিন আগে কথা প্রসঙ্গে তার মাকে বলেছিল , ওই স্যারটা নাকি কী একটা সর্বহারার পার্টি করতো । কথায় কথায় বলতো তাদের শিকল ছাড়া আর কিছুই হারাবার নেই । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কী যে হলো , শিকল হারানো তো দূরের কথা , আজ তারা সবাই ভালবেসে বেসে সেই শিকলটাকেই আরও শক্ত করে দু'হাতে বাঁধছে ।
রিলেমালা পড়াশোনায় তেমন কোনো মনোযোগী নয় , কোনোকালেই ছিল না । গতকাল "বর্তমান বাংলার আর্থ-সামাজিক চিত্র ও সমকালীন রাজনীতি" বিষয়ক কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির চাঁছাছোলা বক্তব্য শুনে মনের ভিতরে কোথায় যেন একটা গোলকধাঁধা শুরু হয়ে গেছে । যদিও সেই সমস্ত লম্বা-চওড়া ব্যক্তিদের অনেক ভারি ভারি কথাই তার বাম কান ঘেঁষে মাথার উপর দিয়ে পার হয়ে গেছে । সে কখনো হাসছে, কখনো হা করে তাকিয়ে থাকছে গ্রামের পশ্চিম দিকের ডুংরি ঘেষা জঙ্গলটার দিকে । আবার থেকে থেকে কোদালের কোপ মারছে । এসব কান্ড-কারখানা দেখে ওর মা জুনপুকির কলজেটা দূর্ভাবনায় ধড়ফড় করে উঠছে ।
পড়াশোনায় ভালো না হলেও রিলেমালা মোটামুটি খারাপ মেয়ে নয় । মেয়ে হিসেবে সে বিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনের অন্যতম কণ্যাশ্রী । মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিকে স্কুলের হাতে যে নাম্বার গুলো ছিল, সেগুলো পেয়ে সে গর্বের সঙ্গে টেনেটুনে কোনরকম পাশ করে গেছে । এবার হয়তো কলেজ পার হওয়াটা বড় সুকঠিন ছিল । কিন্তু , কোন এক অস্পষ্ট চক্রান্তে যেহেতু ঘরে বসেই বই-খাতা খুলে অথবা কোন শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা আর দু'চার দিন পর সময়-সুযোগমতো কলেজে এসে খাতাটা ফাপড়িয়ে দিয়ে এলেই ব্যতিক্রম ধরণের পাস , সেহেতু প্রিন্সিপালের ভাঙ্গা চেয়ারটারও কোনো দুশ্চিন্তা নেই । মাস্টাররা নাম্বার দিতে বাধ্য । কারণ তাদেরও তো চাকরিটা রাখতে হবে ।
তাই রিলেমালা এবার মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিকের প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ নাম্বার পেয়ে ভালোভাবে পাস করেছে । এদিকে লকডাউনের অকর্মণ্য শুভলগ্নে কুইলাপাল থেকে একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে, ছেলেটা সিভিক ভলেন্টিয়ার । মেয়ে পছন্দও আছে পাত্রপক্ষের । এতোদিন ওদের সমাজে বরপনের কোনো ব্যাপার ছিল না । তবে যেহেতু যুবশ্রী বলে কিছু নেই । আর প্রায় বিনে ঝামেলাতেই মেয়েরা "রুপশ্রী"র করকরে পঁচিশ হাজার টাকা পেয়ে যাচ্ছে, তাই ছেলেরাও নিদেনপক্ষে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা পন না নিয়ে কেউ বিয়ে করতে সম্মত নয় । ধীরে ধীরে এই সমাজটায় এখন বরপণ থাবা বসাতে শুরু করেছে । একটা নতুন ধরণের পক্ষপাত সমাজটাকে এবড়ো-থ্যাবড়ো করে দিচ্ছে ।
জুনপুকি ভাবছে এইসব কোন ভাবনাই কি রিলেমালার মাথায় ভর করেছে ? নাকি কোনো ভুত, প্রেত, কালকুদরা , কুদ্রা বঙ্গার কুনজর পড়েছে তার উপর । পড়তেই পারে কারণ এই আঁধার রাতেও ওগুলোকে সন্তুষ্ট করার মতো কোনো ভাতা দেবার ব্যবস্থা সরকার আজও করলো না । অবাক পক্ষপাতিত্ব ! সেদিন রিলেমালা বলছিলো ওদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না করার কারণ ভূত-প্রেত-কালকুদরার আজও কোন ভোটাধিকার নেই ।
কী সব বিড়বিড় করতে করতে ছোটসাগেন জুনপুকিকে বলছে , "এ রিলির মাই , সা'ত হ'ল ত বা'হরা । আমি ভরেই একটা আধলা ইঁট দাঁড় কঁরা'য় দিয়ে আ'সেছি পোস্টোপিষের মুখ ছামুটায় । ইবার যাঁইয়্যা দাঁড়া'তে ত হব্যাক । আর তুঁইও বড় ইস্কুলের দিকে চলে যাবি লক্ষ্মীর ভান্ডারের লাইন দিতে। "
রিলেমালা বাপের দিকে চায় , যেভাবে দুপুর পেরোলো বিকেলের দিকে ধা'ড়হাঁস হেলেপড়া সূর্যের দিকে তাকায় । বেলা আটকাল করে । জুনপুকি বলে , "ভালুক ভালুক, আমরা লাইন দিভ চল, লাইন করি । লাইন না করলে ইসময় কিছুই মিলবেক নাই । লাইন দিলে লাদটা, মুতটা সবটাঁই পাবি । পঢ়া লোন থা'কে পুয়াতি লোন কনটাই আটকিব্যাক নাই "।
এদিকে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে রিলেমালা । জোরে । সজোরে । তারচেয়েও জোরে কোপ মারে কোদালের । টং করে ওঠে মাঝ উঠান ।
জুনপুকি জ্বলন্ত আংরার মতন গসগ'সা মুখে বলে ওঠে "একটা ভালঅ কাজে যখন বাইরাছি , তখন ষাঁড়ের মতন পেছনল্যা গাংগাছিস ক্যানে, তুই কী খুঁজচিস্ ব'লভি ? কি খুঁজচিস হারামজাদি !
রিলেমালা আরো জোরে চিৎকার করে বলে, "ভিকারী খুঁজচি ভিকারী । এই মাটির নিচে আলু-পিয়াজ-রসুন-আলতি-আদা কিছুই নাই । কচু-উ চাষ হব্যাক নাই ইঠ্নে । কু'ড়লেও ভিকারী আর চ'ষলেও ভিকারী ।"
বিটির মুখে এইসব ক্ষ্যাপি পাগলির মতো কথা শুনে আঁতকে ওঠে ছোট সাগেন ও জুনপুকি । জুনপুকি রিলেমালার বাবাকে বলে, "অ্যা গ, ওই পস্টোপিষে আধার কাঁড়ের লাইন দিয়ে, বড় ইস্কুলে লক্ষ্মী ভাঁড়ারের লাইন দিয়ে কাজ নাই খ্যা, আগে চল্অ অঝা ডাখ্যা বিটিটাকে ঝাড়ফুঁক কঁরাই। না ঝাড়া'লে সারাই লকে দষ দিব্যাক। চলহ ।"
ছোট সাগেন একবার বিটিটার দিকে আরেকবার বহুটার দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকায়। অদূরে টোটো তে বাঁধা প্রচার মাইকের চোঙা থেকে ব্লক অফিসের আরো কী একটা নতুন ঘোষণা ভেসে আসে ।


গল্পের মধ্যে কি সুন্দর ভাবে বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন! সত্যিই অসাধারণ।
উত্তরমুছুন