অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ,দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়-এর কলমে -----
বাঁচার ঠিকানা
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
মনখারাপের মহল সারা ষ্টেশন জুড়ে। প্রতিদিনের সেই চিৎকার ,ব্যস্ততা উধাও। সকলের গলায় আটকে থাকা কান্নার ছটফটানি।কাজে মন নেই কারো। ঠাকুমার জন্য সকলের চোখে জল !
ষ্টেশনের অঘোষিত অভিভাবক 'ষ্টেশন ঠাকুমা'। ঠাকুমার ইতিহাস কেউ জানে না। শুধু জানে ঠাকুমার মমতাময়ী আঁচল সারা ষ্টেশন জুড়ে।কোন অন্যায়,পাপ আর নয়। ষ্টেশন মাষ্টার,রেল পুলিশের বড়বাবু,হকার, নিত্যযাত্রী সকলেই খুশি। ষ্টেশনের নোংরা আবর্জনা সাফ হয়ে এক শান্তিনিকেতন যেন ! হকারদের কাছ থেকে তোলা চাওয়া নেই। রাতে মদ খেয়ে ষ্টেশনে অসামাজিক কাজকর্ম নেই। হঠাৎ এদিক ওদিক দোকান দিয়ে যাত্রীদের অসুবিধা করা নেই।রেলপুলিশের কাজ গেছে কমে। তবে রেল পুলিশ ঠাকুমার সুরক্ষায় সদা সতর্ক। তবুও এলাকার অপরাধ জগতের স্বঘোষিত বাদশা গালকাটা বিল্টুর হাত থেকে ভাগ্যের জোরে দুবার বেঁচেছে ঠাকুমা।
ঠাকুমা ষ্টেশনের বাচ্চাগুলোকে আলোর পথ দেখিয়েছে।বোতল বিক্রির টাকায় ডেনড্রাইটের নেশায় আসক্ত বাচ্চাদের মনে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছে প্রাণের প্রৈতিতে। ছেলেমেয়েগুলো এখন সকাল সন্ধেয় পড়াশোনা করে ঠাকুমার কাছে। ওদের গলায় " আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে" সত্যিই ষ্টেশনে প্রাণের পরশ এনেছে। ছেলেমেয়েগুলো বেড়ে উঠছে এক আনন্দময় পরিবেশে।রেলপুলিশ খুশি। বড়বাবুর উদ্যোগে রেল কোয়ার্টারের পিছনে পরিত্যক্ত দুটো ঘর মেরামত করে বাচ্চাগুলোর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ঠাকুমা নাম দিয়েছে ' জীবনের আশ্রয়' ! ষ্টেশনে এক অন্তর্লীন ভালোবাসার বন্ধন গড়ে উঠেছে একটু একটু করে। বড়বাবু ও ষ্টেশন মাষ্টারের সাহায্যে বাচ্চাগুলোর দুবেলা খাবার, জামাকাপড়ের ব্যবস্থা হয়েছে।'গুড আর্থ' নামে কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাচ্চাগুলোর লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে।এক আলোমুখী ভবিষ্যতের দিকে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে চলেছে ষ্টেশন ঠাকুমা বনস্পতির ছায়া হয়ে।
বিল্টুর রাগ ওখানেই।আগে ষ্টেশনের বাচ্চাগুলোকে বোতল কুড়োনো, নেশা ধরানো, ছোটখাটো অপরাধের কাজে লাগাতো ও। সেই 'সাপ্লাই লাইন' এখন বন্ধ ঠাকুমার সৌজন্যে।যে কাজ রেলপুলিশ দীর্ঘদিন করে উঠতে পারেনি,তা ঠাকুমা একাই বাচ্চাগুলোকে ভালোবেসে করে চলেছে। মৃত্যুর পরোয়া নেই।এই শেষ বয়সে এসে জীবনকে আঁকড়ে ধরা আষ্টেপৃষ্ঠে। মুচকি হেসে মাঝে মাঝে বলে :"পৃথিবীতে এসেছিস যখন,দাগ রেখে যা"!
মুগ্ধতার রেশ তখন সকলের মনে।
আস্তে আস্তে ঠাকুমার কাছে বাচ্চার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ডেনড্রাইটের নেশায় আসক্ত বাচ্চাদের জীবনমুখী করার প্রয়াসে রেল পুলিশ ঠাকুমার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে নিয়ে আসে। ওদের মধ্যে বাঁচার নেশা জাগিয়েছে ঠাকুমার ভালোবাসা।আর কোনরকম পাপকাজ নয়,আগুন চোখে ওদের অঙ্গীকার।এই জায়গাতেই বিল্টুর রাগ দিনে দিনে বাড়ছে।আগে ষ্টেশনের বড়ো মেয়েগুলোকে বিল্টু দেহব্যবসায় নামাতো জোর করে ।সেটাও এখন পুরোপুরি বন্ধ ঠাকুমার সতর্ক প্রহরায়। কিছুদিন হলো চাঁপা বলে মেয়েটিকে বিল্টু বিরক্ত করছে খুব।ওর ঠাগর শরীর বিল্টুকে লোভী করে তুলেছে ।
কাল সন্ধ্যায় ঘটনাটা ঘটলো। ষ্টেশনে বাচ্চাগুলোর পড়াশোনা চলছে ঠাকুমার কাছে। চাঁপা একটু বাইরে গেছে প্রকৃতির ডাকে। অনেকক্ষণ হলো চাঁপা আসছে না। ঠাকুমার উদ্বিগ্ন মুখ। হঠাৎ একটা ছেলে খবর দিল বিল্টুর ছেলেরা চাঁপাকে তুলে নিয়ে গেছে বাঁধের ধারে। ঠাকুমা বুঝলো সব। পাশে পড়ে থাকা লোহার রড তুলে ছুটলো আগুন চোখে। পিছনে পিছনে বাচছাগুলোও চললো।রেলপুলিশে খবর দিল ষ্টেশনের হকাররা।
ঠাকুমা বাঁধে গিয়ে দেখলো চাঁপা প্রায় উলঙগ। বিল্টুর দুই সাগরেদ চাঁপাকে শক্ত করে মাটিতে চেপে ধরেছে। বিল্টু ওকে জোর করে ধর্ষণ করার চেষ্টা করছে। ঠাকুমা দিগ্বিদিক জ্ঞান শূণ্য হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। লোহার রড দিয়ে লাগাতার আক্রমণ চালাতে লাগল ওদের। ঠাকুমা যেন রণ চন্ডী তখন ! ঠাকুমার হঠাৎ আক্রমণে ওরা দিশেহারা।এই শীর্ণকায় মানুষটার গায়ে এতো জোর ওরা ভাবতেও পারেনি। বিল্টুর সঙ্গী দুজন মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বিল্টু উঠে ছুরি নিয়ে ঠাকুমাকে আক্রমণ করতে গেলেই ঠাকুমা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোহার রড বসিয়ে দিল বিল্টুর মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। ছিটকে পড়লো বিল্টু ।কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে করতে আস্তে আস্তে নেতিয়ে গেল ও। প্রায় অচৈতন্য চাঁপার শরীর নিজের আঁচলে জড়িয়ে ঠাকুমা চললো 'জীবনের আশ্রয়ে'।
রেলপুলিশ এলো। বিল্টু ও দুই সাগরেদকে হাসপাতালে পাঠালো তৎক্ষণাৎ। বিল্টুর শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। বাঁচার আশা কম। বড়বাবু দুহাত তুলে কান্না ভেজা চোখে বিল্টুর জীবন প্রার্থনায়। বিল্টু বেঁচে গেলে ঠাকুমা খুনের হাত থেকে বেঁচে যাবে। নাহলে, বাচ্চাগুলো 'মা' হারা হবে ! ওদের বড়ো হবার স্বপ্ন ভেসে যাবে ! এই প্রথম সকলে দেখলো এক কুখ্যাত অপরাধীর প্রাণ বাঁচাতে রেল পুলিশ প্রার্থনায় !
******************************************************************************


খুব ভালো লাগল
উত্তরমুছুন