রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

গুচ্ছকবিতা * দীপংকর রায়‌



দীপংকর রায়‌ * কবিতাগুচ্ছ 

পাথুরে বোধনের কান্না শুনি কাশবনে

         ( উৎসর্গ : দীপ্তিশিখা দাস )


১.

অনেকটা দূর থেকে এই হেমন্তকে

মিলিয়ে নিতে চেয়েছি বলেই

অনেক বিপন্নতায়

মাথা পেতে দেওয়া ;


বিশ্রাম চেয়েছিলে 

যেখানে 

সেখানেও কপটতার শিকার ?


সেই রহস্যময় হাসি 

চেন নি ।

চেন নি অভ্যাসকে ব্যবহার ক'রে যে ষড়যন্ত্র 


প্রকাশের মধ্যে যে শান্তি 

তাকেও এমন ভাবে 

ব্যবহার করা যায় ?


মন খুলে বলতে চেয়েছো বলেই 

গোপন কর নি কিছুই;

যদিও প্রবৃত্তিকে সংযত করাও অন্যায় 

আর এই দেখাই ,তাকে আলাদা করলো !


যদি তাই হয় 

তাহলে আবারও সেই ,

সেই অভ্যাসের গগন-ফাটানো চিৎকারের 

                            সঙ্গেই গলা মেলাও 

বিপন্নতা যতোই আসুক ;


আচ্ছা , সেখানেও কি সেই-ই----- ?

না হলে, এই হেমন্তে তার কথা 

                 মনে পড়বে কেন ?


যে অনেক দূরে ;


দূর সংক্ষিপ্ত করে দেয়

এই আশ্বিনের শেষ দুপুর 


তাই তো 

তারই ছায়ায়  মাথা পেতে থাকি কিছুক্ষন , 


বিশ্রাম চেয়েছিলাম বলেই               ‌            

সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙে 

                    তাকেই অনুভব করি ?


২.

কত নাম না জানা !


তার বুকের নিচেয় ধুকপুক করেতে দেখি

তোমার মুখের রেখাদের ;


কী যে কমনীয় অসহায়তা সে সব 

সে যে কত জীবনের গান

এই একলা পথের ;


জীবন যেন তারই গলায় চলেছে ছুটে....


সে যে কত পথ

কত নদী

কত মাঠ চিরে গড়ে দেয় তাঁকে 


সেই মূর্তিই একমাত্র সম্বল

সেই আলোয় ,মেঘে ;

ছায়ায় গড়ে যে শরীর 

তাও যে কতকালের উপাসনা 

সে কথা কি জানা হলো 

               এই ধুলায় ধুলায়.....


ওহে মেঘ-রোদের কাশবন 

আমি যে তোমাতে নদী হই 

কতবার পাহাড় 

কত সমুদ্র ওড়াই তার বুকে, 

সে কথা যদি কেউ জানতো 

তাহলে এই শরীর , এই মান অভিমান

এই বোধ 

সকলই তো  তাঁর হতো 


সে যে কাঁদে এই ভাদ্রের পথের আলোয়, 

এই রোদে ...


আমি যে কী করে যাই ফিরে

কোথায়ই বা যাবো ;

কী করেই বা যাই ভুলে

যা কিছু ধরা দিয়ে যায় চলে 

                          ওই দূরে ....


যে ছিল একটু আগেও নির্বাক ?!


৩ 

তাঁর ধুলো-বাতাসে 

ভাসতে চাইলে 

এক ধরণের গন্ধ ;

লালমাটি উঠে গিয়ে যেন মানুষ রূপ পায় 

জানায় অভিবাদন ;

বরণডালা তুলে ধরে সাল-শেগুনের মুখের উপর ;

মেঘফাগুনের আকাশ উড়িয়ে দেয়.....


শুধুই প্রশান্তি 

হাওয়ায় হাওয়ায় কেবলই গান ....


আমাদের হৃদয়ে আজ 

পরিব্রাজকের অনন্ত শুধুই ----


সে তো জানে না 

তার রূপের খুশিতে ঝুরোমাটির 

ভাষা কেমন হয় ----


পথের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর শুষ্ক মুখের ছায়া খানিক মুখে মাখি ;

এই ধুলো-বাতাসে 

ভাসতে আসি বলেই, সকল গঙ্গা লুকোয় 

মহাকালের জটায় --- !


এই ধুলো বাতাসে ভাসতে চাই যেই ,

চলার পথের উপর এক ধরণের 

গন্ধ পাই ---- 


দুঃখ হয় 

সে, সে সুবাস টের পায় না ----- টের পায় না এই চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারও ;------


৪ 

সিগনাল না পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল

যে ট্রেন, দূর মাঠে 

তাল গাছের মাথায়

তখন যে সূর্যাস্ত ---

লাফ কেটে কেউ কেউ

              নেমেও গেল,

কেউ যেন রসের হাঁড়িটি পেড়ে আনবে বলে ছুটলো .....


ওপাশে খাড়া পাহাড়

পাথরে পাথরে

ভাসছে রাঢ়বাংলার

                সুবাস ---

ওদিকে ইঞ্জিনের সেই

ঘ্রাণ নিয়ে যাবে আরো

               কত দূর 

কেউ তা জানে না -----


সত্যি সত্যিই স্টেশন

কোথাও আছে কি ---

যেখানে রোজ দেখা হয় আমাদের !


কথা ছিল 

এরপর পথের গান শুনবো

করতালি উঠবে

সব শিমুল-পলাশে ....


দেখতে পেলাম না বলে এবার সেও 

মুখ লুকিয়ে নিলো 

           তাঁর -----?


৫ 

এ কোথায় চলেছো 

শুরু হয়েছে যেখানে 

          স্বপ্নের পথ ....?



তুলে দিলে দু'হাত           

           ভরিয়ে 

মেঘেদের আকাশ নয়,

কাশ-মেঘের অনেক 

             দৌড়-কথা ---

কত গল্পের সঙ্গে কত গল্পের মহারূপ পূর্ণ করলো সে , 

সে কথা যদি সত্যি-ই জানতে, সেইসব ঝর্ণা-দের 

নদী হয়ে যাওয়া 

     রূপ-কথাদের..... ;



এরপর কাশেদের 

         ‌শারদ ডাক ----

শুরু হয় যেন রোজ এক একটি জীবন নতুন করে ....



কেন শুধুই নারী হয়ে ওঠো বারবার ---- একটি বার দুর্নিবার ঢেউ হয়ে 

        দেখই না কেন ;












তার চোখ 

মেঘেদের বর্ণমালায় হারিয়ে যায়  

আমরা ভাষা খুঁজি---- লিপি অক্ষরে গড়ি 

কালের অনেক অবহেলিত দৃশ্যমালাদের --- 

সেও ভুলে যায় কোথাকার নাগরিকত্ব কোথায় কেমন ভাষায় লেপ্টে যায় 

কার মুখের মাঝে -----


আকাশেরা চলেছে যেন অনেক আকাশের তথ্যচিত্র তৈরি করে  

ছুটতে ছুটতে ......


অস্পষ্ট স্বরে আজ যত দূরে সরে যায় 

ততোই আতঙ্কিত হই 

পরবর্তী অধ্যায়ে .....;


মেঘেদের বর্ণমালায় 

সেজে উঠে যে ভাষায়ই তাঁকে অনুবাদ করতে যাই 


দুর্বদ্ধতা অসীমে নৃত্যরত ----সে যেন কেবলই ঝঞ্জা---- 


যে চমকেই তাঁকে রেখাঙ্কিত করি না কেন , 

এমনকি তুমি নিজেও চিনতে পারো নি, 

সেই খেয়ালী রূপ ; একটি হু হু

পথই ছুটছে শুধু--- ছুটছে .....


কখন সে তাঁর চোখ ভেঙে গড়িয়ে নামবে এই খাঁ খাঁ বুকের উপর  


সেই বিভঙ্গ রূপ দেখে, এই পড়ন্ত বেলারাও যেন 

সকালবেলার হাসিমুখ ভাঙতে থাকবে অনেক অদৃশ্য মাঠের আয়নায়‌ ; 


নতুন ভাষা শিখে নিও হে মহাপ্রাণ , নতুন ভাষা ------- 

যে অনন্তকাল তাঁর মুখ এঁকে চলেছে 

এইসব মেঘেদের বর্ণমালায় ......


সময় আমার যায় যে

বাকি দিনের বাঁকে বাঁকে ....


ঘরে ঘরে ঘুরি কার ?

আবার ঘরের মাঝেই 

                       মরি ;

যেই সরি 

মুখটি অমনি ভার।


আমি যে কার 

কে আমার!

তাঁহার দিনেই ঘুরি ফিরি, পাই আর না পাই , চাই যে তাঁকেই 


সে হয় কি ;

না, আমি হই তাঁর!

কার কার মাঝে তাকেই খুঁজি ....?

সময় আমার যায় যে

    সময়ের ওপার -----

অপার হয়ে থাকি 

 সেই চোখেরই কোনায় ?


অন্ধকারে 

কোথাও একটু আলো চলকে উঠলে 

মনে হয় বাতাসে ভেসে এলো মহানদী -----

আচ্ছা , অন্ধকার কি কখনো বিশুদ্ধ হয় , 

ওই আকাশের মতো নির্মল আনন্দে ? 

তারাদের নিঃসঙ্গতা যখন হাঁটু গেড়ে  

পড়ে থাকে রাতের ধু ধু ফসলশূন্য মাঠে‌---- 

আমাদের ভেতরের নিরন্নতাকে  

কে আর জানে , সেই সব পল্লির পথে পথে ঘুরে , 

নগরের ধূসরতায় মেশে যখন ;


তিনি কোথায় কোথায় ঘোরেন , কোন বিহ্বলতায় ; 

তিনি কি শুনতে পারেন , একটু আগে , 

সমস্ত অন্ধকারের ভেতর থেকে একঝলক আলো  

চলকে উঠেছিল বলেই , আমরা তাঁর মুখ দেখলাম আজ সামান্য আলোয় !


ও , বিভঙ্গ তরঙ্গ 

তুমি আরো দূরে চলে যাও, যে প্রাণ চলেছে ছুটে অন্ধকারের 

       মহাসমুদ্রে.......


মনে হলো তার কাছে যাবো ,

দু'হাতে তুলে ধরবো চিবুকটি ; 


শরীরটাই আছে , শরীরে মন কই  

তোমার মনোরমা ?


ঘরের ভেতর হাউমাউ করে উঠলো চাঁদ-তারারা ---- 

উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো ; এখন আমি কাকে ছুঁই ?

কার বুকের ভেতর নিঃসঙ্গ মুখটি ডুবিয়ে আমিও খানিক চিৎকার করে উঠবো ---- 

বলবো , এই তো রক্তের তরঙ্গে সাঁতার কাটছো 

তুমি আগুন-পলাশের ঢেউএ ঢেউএ ........ ;


তবে কি বসন্ত এলো 

ওহে, তোমার প্রদীপে ?


এই রাত 

আমাদের হাহাকারে আরো কত সহস্র বছর তরঙ্গে তরঙ্গে 

ভাসতে ভাসতে চলে যেতে থাকবে যে,


সেই মহামিলনের অপেক্ষায় ----

সেটাই ভাবছি ;


১০ 

তার বিচিত্র খেয়াল 

প্রহসন চেনালো ;


কী খেলায় মেতেছে 

ধর্মাধর্ম ;

জীবন চেনেনি জীবনের ন্যায় অন্যায় কিছুই কখনো!


নৈঋতে আছো 

উত্তরে , দক্ষিণে

পশ্চিমে ,পুবে ---

যতোই চাও না কেন 

সব বিফলে ;


আছি 

তবুও আছি ,

সকল চৈতন্য জুড়ে 

      আমিই ----


দেখ তো তোমার আমাকে ঘিরে ;

যত দূরেই যাও না কেন ,যতোই ফেলো না কেন জাল 

কুয়াশার সকল বৈচিত্র তুমি  

হাঁটুতে ভাঙতে পারো নি ,দুরছাই বলে ;----

শিশিরে 

নিয়রে মাখামাখি এই যে অঘ্রাণ 

পথে পথে করে চলেছি প্রদক্ষিণ , চালতা বনে, বকুলে 

মুকুলে , যে অর্যুণ বৃক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম নির্জন ;

সে কান্না-কথায় 

দুর্বল সামর্থের 

কোনো অধিকার নেই । 


জানি , আমার সকল ঘিরেই  

তাঁর দয়া 

আমার সকল নিয়েই তোমার খেলায়‌ যে ঢেউ চলেছে .....


তাতে কোথাও নেই 

সেই দীর্ঘশ্বাস 


বাজি আমার বাজির পরে বাজি ; যে অস্থি-পাশায়‌ কুরুক্ষেত্র ----- 

সেখানেও তুমিই সখা 

জানি ;


গাণ্ডিব খসে নি, খসে নি অঙ্গিকার 

যুদ্ধেও আছি , আছি তাঁহার 

প্রকৃত না‌ জেনেই...... !?


********************************************************************************************



দীপংকর রায়‌

আশির দশকের অন্যতম বিশিষ্ট কবি জন্ম ১৯৫৮ কলকাতায় ছেলেবেলা কেটেছে ওপার বাংলায় জীবন জীবিকা সূত্রে এপার বাংলায় বাঁধা হলেও, তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে ফেরে ওপার বাংলায় ধুলায় মৃত্তিকায় কবিতা ও গদ্য মিলিয়ে আটটিরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা । সম্পাদনা করেন এবং কথা নামে একটি সাহিত্যপত্র 

কবিতার বই  *  অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *  অপ্রচলিত 

আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 

কবিতা উপন্যাস *  অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে 

গল্পগ্রন্থ * ইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না   আত্মজৈবনিক  উপন্যাস * কোথাকার অতিথি আমি  

আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ


২টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. এবারের 'স্বরবর্ণ' নয়-এ প্রকাশিত কবি দীপঙ্কর রায়ের কবিতাগুচ্ছ "পাথুরে বোধনের কান্না শুনি কাশবনে"এক মগ্ন কবির অতলস্পর্শী ভাবনায় গহন ও অনন্য। মিত শব্দচয়ন নিটোল বাকবিন্যাস সাবলীল ভাষার স্বচ্ছন্দ গদ্যছন্দের সঙ্গে ভাবপ্রবাহের অন্তর্লীন মিতালী কবিতাপ্রেমীদের আবিষ্ট করে সহজেই ।

    কবি দীপঙ্কর রায়ের কবি মনের অতলে রয়েছে এক বাউল। তাঁর কবিতায় মাঝেমধ্যেই বাউলের কণ্ঠস্বর ফুটে ওঠে। তাঁর কোন কোন কবিতা পড়তে গিয়ে দীপঙ্কর রায়কেই বাউল বলে মনে হয়। তবে এ বাউল সে বাউল নয়।এ বাউল জীবনবিবাগী নন , একান্তই জীবনমুখী। এখানেই তাঁর অনন্যতা। ঐতিহ্যকে স্বকীয়তায় জারিত করেই তার কবিতায় ধরা থাকে আধুনিকতার অভিমুখ।

    রূপে রসে গন্ধে ভরা এই চরাচরের বুকে তাঁর জীবনযাপনের চারপাশে অচিন পরম পুরুষকে খুঁজে চলেছেন...,
    "ওহে মেঘ-রোদের কাশবন

    আমি যে তোমাতে নদী হই

    কতবার পাহাড়

    কত সমুদ্র ওড়াই তার বুকে,

    সে কথা যদি কেউ জানতো

    তাহলে এই শরীর , এই মান অভিমান

    এই বোধ

    সকলই তো তাঁর হতো "


    গুচ্ছ কবিতার সবকটি পড়তে পড়তে মনে হয় কবি তাঁর চিৎকমলে দ্বৈত ও অদ্বৈত এর লীলাকে অবধারণ করে মনের মুকুরে প্রতিফলিত করেছেন। আর সেটাকেই কবিতার অক্ষরে ফুটিয়ে তুলে আমাদের এই কবিতা গুচ্ছ উপহার দিয়েছেন।

    উত্তরমুছুন