মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়



দুলছে সব আনন্দে

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


পেশা কখন যেন নেশায় বদলে গেছে অভীকের। অফিসের সকলে ওকে ' কাজ - পাগলা ' বলে!

অভীক জানে এসব।ওর কিছু করাও নেই।মা ছাড়া আর কোন পিছুটান নেই।এই মধ্য - চল্লিশেও তথাকথিত আইবুড়ো। অফিসের

 সকলেরই খুব প্রিয়পাত্র অভীক।অফিস কর্তৃপক্ষ এটা ভালোই জানে।আর জানে, অভীকের মেধার ওপর নিশ্চিত ভরসা করে কোম্পানির টার্ন ওভার আকাশচুম্বি করা যায়। তাই সিনিয়র ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে প্রোমোশন ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। অফিসের সকলেই খুব খুশি।এই অল্প বয়সে এতো উঁচুতে ! অতএব কাছের মানুষের মতো আবদার, বড়ো একটা পার্টি চাই।

প্রতি বছর অফিসের কর্মীদের নিয়ে একটা সেমিনার হয় বাইরে কোথাও। বেড়ানোও হয় সহকর্মীদের।রথ দেখা কলা বেচা ! কর্তৃপক্ষও চায় এটা।তাই অভীক এবারে প্রত্যেক কর্মী পরিবারকেও জুড়ে দিল অফিস সেমিনারে।পরিবার নিয়ে একটা পিকনিকের দাবি ছিল কর্মীদের অনেকদিন ধরেই । অভীকের কর্তৃপক্ষকে রাজী করাতে বেশি বেগ পেতে হলো না। কর্তৃপক্ষের পূর্ণ বিশ্বাস ,অভীক পরে নিশ্চয়ই এটাকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানিরই সুবিধা করবে!

অতএব এক শণিবার চলো ডায়মন্ডহারবার, ডায়মন্ডহারবার চলো ! শণিবার ধর্মতলা থেকে অফিসের দুটো ভলবো বাস ছাড়বে। নামী ও দামি এক রিসর্টে থাকা এক রাত। পরদিন বিকেলে ফেরা। সকলের উদ্বাহু উচ্ছাস বুঝিয়ে দিল কতোখানি আশার ছিল এ সেমিনার কাম ট্যুর।

এক সপ্তাহ দৌড়াদৌড়ি করে অভীক সব ব্যবস্থা করে ফেলল। পূর্ণ সহযোগিতায় অয়ন।অয়নও ব্যাচেলার !ওর মা মারা গেছে এক বছর আগে। বাড়িতে বাবা আর ও। কিছুদিন আগেই বাবার ডান হাঁটুর অপারেশন করিয়েছে।তাই অয়ন যেতে পারবে না জানালো। কিন্তু অভীক নাছোড়। অফিসে সবচেয়ে কাছের এইটা অয়ন।ও না গেলে হয় !অভীক ওর গাড়িতে অয়নের বাবার যাবার ব্যবস্থা করলো।অয়ন একসময় অভীকের মরিয়া চেষ্টার কাছে হার মানলো। সহকর্মীরা খুশি।এই সুযোগে যদি অয়ন দেবলীনা একটু কাছাকাছি আসতে পারে।

দেবলীনা অয়নের বিভাগেই কাজ করে। কম্পিউটার অপারেটর।অয়নের প্রতি দেবলীনার দূর্বলতা অফিসবিদিত।সকলে মজা করে এটা নিয়ে।অয়নকে দেখে মনে হয় ওর একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে দেবলীনার প্রতি। কিন্তু অয়ন বাবার বিষয়টায় বড়ো কাতর। বিয়ের পর চাকুরীরতা দেবলীনা কি ঠিকমতো মেনে নেবে অয়নের বাবাকে ?অয়নের চিন্তা ও আপত্তির কারণ এখানেই। অভীকের ইচ্ছা,এই বেড়ানোর সুযোগে যদি দেবলীনা ও অয়নের পরিবারকে এক জায়গায় করে দেওয়া যায়। পাশাপাশি রুমের ব্যবস্থাও করেছে অভীক এই কারণেই।হোটেলের ঘর থেকে নদীর সৌন্দর্য যদি মন দূর্বল করে একটু।নরম মন ভালোবাসা ভেজা হতে আর কতক্ষন !

হইহই করে সকলে ভলবো বাসে চললো ডায়মন্ডহারবার। পৌঁছেই স্বাগত সকলে  ফলের জুস দিয়ে। বিশাল রিসর্টে থাকা খাওয়া দেখে সব অবাক।হোটেলের ফাঁকা মাঠটায় বাচ্চা গুলো দৌড়াচ্ছে। মহিলারা কখনো দোলনা , কখনো নদীর ধারে সেলফিতে মগ্ন। বেশি লোকের ভিড় সুইমিং পুলের পাশে।নীল জলের মায়ায় মোহময় চোখ সকলের। কয়েকজন নেমে পড়লো জলে প্রাতঃরাশ সেরে।অভীক ব্যালকনি থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। ভালো লাগছে খুব ওর। সকলের মুখের ত্রিকোণমিতিতে আনন্দ ভৈরবী! মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে ওর। মাকে মাসির কাছে রেখে এসেছে । অস্টিওআর্থ্রাইটিসে পঙ্গু মাকে আজকাল আর কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। মাকে এই ব্যালকনিতে বসিয়ে দিলে নদীর শোভা দেখতে দেখতে খুব মজা পেতো মা,  নিশ্চিত।

দুপুরে রাজকীয় খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে একটু বিশ্রাম। সেমিনার  চারটে থেকে ছটা। তারপর নদীর বুকে রিসর্টের নিজস্ব স্ক্রুজে সন্ধ্যায় নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো। আলোর মালায় সজ্জিত স্ক্রুজে সত্যিই যেন এক মায়াময় পরিবেশ! আমুদী মাছ ভাজা, চিকেন প্যাটিস, শিক কাবাব, চিপস্,কফি ও কোল্ড ড্রিংকসের আয়োজন যেন আমোদ ঠাসা। অন্ধকারে নদীর জলে স্ক্রুজের আলোয় এক মায়াবী পরিবেশ। বাচ্চারা, মহিলারা আনন্দে উচ্ছল।শব্দের প্রাবল্যে তারা যেন মেলে ধরছে নিজেদের।সকলেই যেন ঐ মূহুর্তটাকে সঞ্চয় করে রাখতে চায় মনের মণিকোঠায়।

স্ক্রুজের ছেলেগুলো মিউজিক চালিয়ে দিল ।সুরের আবেশে সকলের কোমর একটু একটু করে দুলছে,বুঝল অভীক। নীচের ডেকে নেমে এলো।অয়নের বাবার পাশে ফাঁকা চেয়ারটায় বসলো।ওর বাবার মুখে মুচকি হাসি বুঝিয়ে দিল উনিও এখন আনন্দযজ্ঞে আপন নিমন্ত্রণে। বাচ্চাগুলো নামছে। মহিলারা অল্প অল্প কোমর দোলাতে শুরু করেছে।

হঠাৎ অভীকের প্রিয় কিশোরকুমারের গানটা বেজে উঠল রিমিক্সে।তুমি ভি চলো,হাম ভি চলে/ চলতে রহে জিন্দেগী।গানটা কতোবার মাউথঅর্গানে ও বাজিয়েছে তার হিসাব নেই।এক সময় কোনো অনুষ্ঠানে বাজাতে গেলেই এই গানটা শ্রোতাদের অনুরোধে বাজাতেই হোতো।একটু আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল ও। হঠাৎ দেখে অয়নের বাবা লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাচ্চাগুলোর সাথে কোমর দোলাতে শুরু করেছে। মহিলারা মূহুর্তের মধ্যে এক বলয় তৈরি করে ফেললো। ভদ্রলোক সকলকে নাচতে উৎসাহিত করছেন। জোরে জোরে বলে চলেছেন :"আনন্দ ! আনন্দ !"সকল মহিলারা প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে স্বমহিমায়।  সহকর্মীরাও বউদের সাথে যোগ দিয়েছে ইতিমধ্যে।এক ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে যেন স্ক্রুজের ডেকে। অভাবনীয় এক সন্ধ্যা আলো হয়ে যেন সকলের বুকে বাসা বেঁধেছে।সদ্য হাঁটু বদলানো এক বৃদ্ধ জীবনকে উপভোগ করছেন আপন মনের আবেশে।এ আয়োজন সার্থক!অয়ন বাবাকে নিষেধ করতে গেলে অভীক ওকে হাত ধরে টেনে নিলো কাছে। দেবলীনা দূর থেকে অয়নের দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে। অভীক অয়নের কানে কানে বলে উঠলো :" এই তো সময় অয়ন।এই তো সময় ! " অয়ন প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে একছুটে দেবলীনার হাত ধরে দোলা শুরু করলো। দেবলীনার সারা চোখে মুখে হাজার ঝাড়বাতির আলো। দেবলীনার বাবা মার মুখেও  সম্মতির হাসি। ভারমুক্ত লাগছে অভীকের। মায়ের কথা মনে পড়লো ওর।মা থাকলে এক্ষুণি রবীন্দ্রনাথের কোন গান গুনগুনিয়ে উঠতেন। ডেকের চেয়ারে বসে একদৃষ্টে অভীক সাক্ষী হতে থাকলো আর এক একমুখ-দাড়ি বৃদ্ধের আনন্দ উৎযাপনে  !













************************************************************************************************


 

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 


  রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..

                

২টি মন্তব্য:

  1. তোমার সব কটা লেখাই ধনাত্মক ভঙ্গিতে লেখা। তাই পড়তে খুব ভালো লাগে। আর দেখো না, অনেক দিন ধরেই ভাবছি ব্লগে লিখবো রসায়ন। তুমি ই হাতেখড়ি দিয়ে দিলে। এত ই তোমার লেখার জোর।

    উত্তরমুছুন