মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর, ২০২১

উপন্যাস * দীপংকর রায়




'স্বরবর্ণে'র বর্তমান সংখ্যা থেকে শুরু হচ্ছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।




কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে


দীপংকর রায় 



নীল আকাশ থেকে ডানা মেলা কত স্বপ্ন-কল্প পৃথিবীর কথারা কাটা ঘুড়ির মতন ছিঁড়ে পড়ল! কত দূরে ছিটকে পড়ল সে ঘুড়ি? কোথায়ই বা গেল চিলে ওড়া সেইসব নাম- ধাম ?কার হাতেই বা সে ধরা দিল, কেই বা খুঁজে পেল, কেই বা ছুটতে ছুটতে হারিয়ে গেল কোন বাড়ির ছাদের মাথায় , না হলে গাছে গাছে, হয়তো বা কোনো ঝোপ-ঝাড়ের মাথায় আটকে পড়ল সেই কাটা ঘুড়ি ; যাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না কোনোদিনও !


      সে কি সত্যিই সামান্য একটি ঘুঁড়ি , নাকি অতি সামান্য হয়েও সে অতি সামান্য না? যে বালকের হাত থেকে সে ছিঁড়ে যায়, যে কিশোরের হাত থেকে সে ছিটকে পড়ে, কিম্বা যে যুবকের হাত থেকে সে সুতো ছিঁড়ে চলে যায়, সেই জানে তার ব্যর্থতার ,পরাজয়ের এই কাটাকাটি খেলায় সে কত বড়ো ভূমিকা রেখেছিল! 


      প্রথম বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া এমনই একটি বিকেল ছিল সে দিন ; প্রথম হাহুতাশ করা বুকের ভেতরটায় এমনই একটি মোচড়ামুচড়ি হয়ে যাবার পর মনে পড়লো , আসল সত্য তো ওই ঘুঁড়িটার কেটে পড়ে যাওয়া নয় , আসল সত্য তো একটি আকাশ ছিঁড়ে চলে গেল--- ওই ঘুড়িটার সাথে সাথে অন্য  আকাশের আড়ালে। যাকে হারিয়ে ফেলে আজ প্রথম মনখারাপ করা বিকেল নিয়ে ঘরে ফেরা প্রথম দিনের কলকাতার জীবন। 


     সন্ধ্যাবেলার কয়লার উনুনের ধোঁয়া ধোঁয়া চারদিকটা, কেমন যেন আবছা ঘোর হয়ে গেছে। কতকাল পরে আবার সেই কয়লার উনুনের ধোঁয়ার গন্ধে ম ম করা এই নিচু শহরতলীর জীবনযাপন ঘেরা সান্ধ্যকাল ! কতকাল পরে আবার তার কাছে ফিরে আসা ? কতকাল পরে আবার তার ভালোয়-মন্দয় মিশতে চাইছিল একটা মন? আর তাই কি ফিরে আসা? 


      অথচ ফিরে এসেও যে ফেরা যায় না ! ফেরা যেন কেবলই ফেরাফিরির  অন্ধকারে তলিয়ে হাত-পা ছোঁড়ে ,  দমবন্ধ করা এক চেতনার গভীরে ডুব দিয়ে;  নাক-মুখ ঝাড়ি দিয়ে উঠতে চায় কেবলই জলের উপরে যেন। কিন্তু সে উপর কোথায়? সে তলদেশের হাত থেকে রেহাই কোথায়? এক একটা ডুবের এক এক স্বরূপ নিয়ে সে যে কেবলই চুবিয়ে ধরে গভীর সেই জলের ভেতরে। যেন এই ডুবের হাত থেকে রেহাই নেই কোথাও। জল পিছু ছাড়েনি কোনোদিনও । তার আবহ জুড়ে ডুবিয়ে রেখেছে। সে যেখানেই যাই,  যত দূরেই ছুটি না কেন। 


        সমস্ত বাড়িটায় উঠোন নেই বললেই চলে। ঘাস-জঙ্গল আর জল ছপছপে চারদিক। বাড়িতে ঢুকতে হলে ইটের উপর পা ফেলে ফেলে এগোতে হয়। ঘরের সামনের অংশে খানিকটা জায়গা উনুনের ছাই রাবিশ  ফেলে যেটুকু উঠোন মনে হয়, সেটুকুতেই শুধু হাত-পা ছোঁড়ার নাড়াচাড়া করবার জায়গা। ডানদিকের ডোবাটায় ভরে আছে জলকলমি আর পানাতে ।যেদিন এসেছি সেদিনই জানতে পেরেছি কিছু কোই -ল্যাঠা মাছ আছে নাকি। ছিপ ফেললেই ধরে দুই- একটা । বাঁ- হাতের মিটার ঘরে জ্যাকি নেই। তার যে কী হলো শেষটায় তা শোনা হয়ে ওঠেনি কারোকাছেই। 

       

      ডোবার এ পাশে কলতলা । তার  ও পাশে বাথরুম পায়খানা। মুরগির ঘরে এখন আর কিছুই নেই  । দিদির বিয়ের পরে সেসব পাট উঠে গেছে। সবটাই লোক অভাব। কালো দিদি বলে সব সময়ের রান্নাবান্নার একজন মানুষ আছেন। মা বলেছে তাকে দিদি বলে ডাকতে। আর মায়ের লেখা চিঠিতে জানা গেছিল কালো গোরুটির কথা। সে আছে। তার থাকার জায়গা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, মুরগির ঘরে মুলিবাঁশের বেড়ায় তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল যে একতলা ঘর মুরগিদের জন্যে, তারই নিচের তলাটার সেই মাচা খুলে দেওয়া হয়েছে তার থাকবার জন্যে। মাটিতে ইট পেতে সলিং বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে পাকা করে তার শোয়া বসা দাঁড়ানোর জন্য। সেখানেই থাকে সে একরকম দিনের সমস্ত দিন।


      মাঝে মাঝে কালো দিদি দুধ দোহানোর  সময় তাকে দড়ি খুলে এনে বারান্দার পিলারের সঙ্গে বেঁধে দেয়। যাইহোক এর আগে এত বড়ো গোরু দেখিনি। প্রথম যেদিন দেখি সেদিন তো বেশ ভয়ে ভয়েই কেটেছিল। তার কাছে ঘেঁষিনি । এই দুদিনে বুঝে গেছি দেখতে বড়ো হলে কি হবে আসলে সে খুবই শান্ত। গায়ে হাত বুলিয়ে দেখেছি, মুখ নিয়ে আসে কাছে। পারলে চেটে দেয়। তার বাচ্চা নেই। তবে দুধ দেয় বেশ খানিকটা। দুবেলা গোয়ালা এসে দুধ দুয়ে দিয়ে যায়। আর তখনি তাকে একটি কাঠের বড়ো পাত্রে খড়বিচালি দানাভুসি মেখে দিতে হয়। গোয়ালা দুধ দোহায় তার আর সে মনের আনন্দে খায় খড়বিচালি দানাভুসি। অভিনব এই ধরণ দেখে প্রথম দিনটায় বড়ো অবাক হয়েছিলাম। কারণ দিদিমার ওখানে যেসব গোরু দেখেছি তারা তো খাবার সময় খাবার খেত, আর দুধ দেবার সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দুধ দুইতে দিত। দিদিমা একটি বালতি দুই হাঁটুর মাঝখানে চেপে ধরে তাইতে তাইতে দুধ দুইতে বসতো । গোরুর  বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াত আর তার মুখের ভেতর হাত দিয়ে তার মায়ের বান থেকে মুখটিকে আলগা করে নিত। এইরকম করতে করতে একসময় তার মায়ের সামনে বাচ্চাটাকে বেঁধে দিত। মা-গোরুটি তখন তার বাচ্চাটাকে চাটতো মনের আনন্দে। আর তখনই  দিদিমা বালতিতে দুধ দুইতে বসতো। 

      

       এখানে কি তাহলে এই গোরুটির বাচ্চা নেই বলে তাকে তার মন ভোলাতে এরকম দানাভুসি মেখে দিয়ে তাকে মন ভোলানো হয় তার? যাইহোক যেভাবেই হোক সকাল সন্ধ্যা সে জাবনা খায় আর দুধ দেয়। কালো দিদি সন্ধ্যাবেলার রান্না করতে করতে এইসব জোগাড়যাতি করে দেয়। আমাকে বলে, ' ও দাদাভাই, বালতিটায় থালাটা  চাপা দিয়ে রেখে দেও। মানুষজন আসলে দুধ দিয়ে দেব। মিছিমিছি পোকামাকড় পড়তে পারে তো.....  '।


       দুধ দুইবার আগে -পরে পাড়ার দু-চারজন আসে শিশি-বোতল নিয়ে। কেউ বা স্টিলের ক্যান। তাদের একটি এলুমনিয়ামের পাত্রে কালো দিদি দুধ মেপে দেয় তাদের। এটাকে বলে নাকি পোকার মাপ। পোয়া মানে কি সেচের পোয়া? দুধ তাহলে সেচের মাপেই মানুষজন কেনে? 


     এসে পর্যন্ত এসব আমি বারান্দায় একটি মোড়া পেতে বসে বসে দেখি। কিন্তু এখনো তাকে বড়ো কোনো সহায়তা করতে পারি না। মা বাড়ি ফিরলে সে তার কাছে খোঁজ খবর নেয়, সকলে দুধ নিয়ে গেছে কি না। কিম্বা আজ কতটুকু দুধ হলো। 


       কালো দিদি মাকে চা করে সামনে এগিয়ে দিতে দিতে সমস্ত দিনের কথা টানা একরকম বলতে থাকে। এমনকি এ অভিযোগও জানায়, আমি যে কিছুই খাওয়া-দাওয়া করছি না তেমন একটা। 'এভাবে না খেতে পারলে চলবে কী করে মা? ভাই তো কিছুই মুখে দিতে পারছে না! কেবলই বলছে, ভালো লাগে না যে। কী করি তাই বলো তো? '


       এই দুদিনের মধ্যেই এই মানুষটি আমাকে ভীষণ আপন করে নিয়েছে যেন। তার এত যত্নে আমিই হাঁপিয়ে উঠছি যেন। আর মনে মনে ভাবছি, এই তো, কদিন আগেও তো এই মানুষটিকে আমি চিনতাম বা জানতাম কি? জানতাম না তার বিষয়ে কিছু। কিন্তু দেখ এর মধ্যেই কেমন আপন করে নিল আমায়! 


      দুপুরবেলাটায় ভীষণ মনখারাপ হয়ে যায়। যখন পিছনের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকি ঘরের পিছনের বাগানটির দিকে। বাঁশবনের  ভেতরে একটি ছোট্ট ডোব -পুকুর মতো আছে সেখানে। খুব বেশি জল নেই। জল অল্পই  । চারদিকে ঝোপ-জঙ্গল। কোথায় যেন হারিয়ে যাই। ভীষণ মন খারাপ করে। ডাহুক পাখিগুলি ডেকে ওঠে ,  বেলা পড়ে আসার আগে  আগেই। তার একটু আগেই ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একে একে। তারপর কী যেন খোঁজে লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে। আর তাদের এই চলাচলের অতি সন্তর্পিত পা ফেলার ভেতর এইটুকু ঝোপ-জঙ্গলের বাঁশবনের ভেতর আমি যেন বারবার ভেসে যাই এই কদিন আগেই ফেলে আসা গ্রামটার আবহ। মনে মনে ভাবি ,কিন্তু সে তো অনেকটা বড়ো জায়গা, কত বড়ো বড়ো জঙ্গল, বাগান, মাঠ , নদী ;----- সে সবের সঙ্গে এই একটুখানি  ছোট্ট ডোবাটার  কী এমন সাদৃশ্যই বা ,যা আমার মনখারাপ বাড়িয়ে দেয় ?

 

      বাঁশ-জঙ্গলের ভেতর থেকে কখনো কখনো জানলা দিয়ে দুএকটা শালিক ঢুকে পড়ে নাচতে নাচতে। তাছাড়া আর আছে চড়াই। সে তো এ পাশ ও পাশ দিয়ে ঢুকে সামনের দরজা দিয়ে বারান্দায় ফুড়ুত ফুড়ুত করে উড়ে যায়ই ---- তাদের দৌড়াত্ব ছুটোছুটি কিচিরমিচির ডাক সর্বত্র। কালো দিদি বিরক্ত হয়ে কখনো কখনো পেছনের জানাটা বন্ধ করে দেয়। আর পান চিবোতে চিবোতে বলে, ' দেখেছ ভাই, দ্যাখো, একটুও তিষ্টতে দেয় না। এদের জন্যে যে কী করি! যত শালিক চড়াই কইয়ো এসবের উৎপাত যতো এখানে! '


      আমি কখনো কখনো তার কথার উত্তর না দিয়ে পারি না। কখনো কখনো চুপ করে থাকি। চেয়ে থাকি তার মুখের দিকে। আবার তার বিরক্তি কাটলে, সে একটু এদিক ওদিক গেলেই জানলাটা খুলে দিয়ে চেয়ে থাকি। কেন যে চেয়ে থাকি?  কী যে পাই ওই ডোবাটির ঝুপসি অন্ধকারের ভেতরে, তা আমি নিজেও কি সেটা বুঝি? 


     ওই যে তলাতলের কথাটি বলছিলাম না, ওই যে ডুবোডুবির কথাটি, এসব সব তো একা একার জিনিস । এসব তো নিজে নিজের একান্ত ধন, এর তো কোনো দোসর নেই! এর তো কোনো ভাগাভাগি নেই! এর আছে একখণ্ড নীল - কালো আকাশ ,এর আছে ভাসা ভাসা মেঘে মেঘে ওড়াউড়ি  যেন !আর আছে এমনই সব সাদৃশ্য কথোপকথন, যা সবই মনে মনে! 


      যাক, সেসব যা আছে থাক। এখন কেন আমি আর এই দিদিই একমাত্র এই বাড়িটায় সমস্ত দিন, কেন, এ কথা সে কথা  বলাবলি করে কাটিয়ে দি সে কথাটা বলতে গেলেই একটু আগে পরে মিলিয়ে বলতে হয়। একমাত্র দিদির বিবাহ হয়ে গেছে। ছোটো ভাই আমি যেদিন আসি, তার দুদিন বাদেই কাইলে মামার পেছন পেছন দু একটা জামাকাপড় একটি হাতব্যাগে ভরে নিয়ে চলে গ্যাছে ওদেশে যাবে বলে নাছোড় হয়ে। আমি  অনেক দূর অবধি  তার পেছনে পেছনে যেয়েও তাকে ফেরাতে পারিনি। কাইলে মামাও তাকে সঙ্গে নিতে চাইনি। দেশের এই মুহূর্তের পরিস্থিতি ঠিক কেমন তা নিয়ে আমরা সকলেই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। আমরা যেদিন বর্ডার পার হয়ে আসি, তা পরের দিন ই  সকলের রেডিওর খবরে জানা গেল, মুজিবর রহমানকে স্বপরিবারে মেরে ফেলা হয়েছে। কিছু বিদ্রোহী সেনা অফিসার মিলিত হয়ে কেন যে তাকে এভাবে নৃসংশভাবে হত্যা করা হলো, তার কিছুই এই মুহুর্তে বিস্তারিত জানা যাচ্ছে না। শুধু জানা গেছে তাঁর দুই মেয়ে এইমুহূর্তে বিদেশে থাকার কারণে তারাই বেঁচে রইলো ।তাছাড়া তাঁর পরিবারে আর এমন কেউই থাকলে না আর বেঁচে।


     দেশ তখন কী অবস্থায় সে কথা ভেবেই কাইলে মামার রাতের ঘুম ছুটলো । তারপরে এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে যাতায়াত করায় এখন কত না বিপদের আশঙ্কা ! তার মধ্যে আবার এদেশের একটি সদ্য কিশোর ছেলেকে নিয়ে সে কীভাবে যে এই সীমানা পার হবে সেটাই ভাবছে। অথচ ভাইও নাছোড়। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েও মা পারলো না। পারলো না কেউই। তবু একবার মনে হয়েছিল হয়তো মামার সঙ্গে শেষপর্যন্ত তার মুখে শুনে-মেলে সব কিছু পথের কথা-টথা, খানিক বেলা হলে হয়তো ফিরে আসবে। অথচ কোথায় কী। সেদিন গেল। পরদিন ও গেল । তার ফেরার তো আর কোনো কথা আসছে না! তবুও মা বিশেষ ভাবিত হলো না দেখলাম। একবার শুধু বললো, কাইলে পারিনি বুঝিয়ে-বাঝিয়ে থামাতে, হয়তো ভেবেছে একা একা যাবে, যাক গে থাক না হয়, যা হয় তাই হবে, তবু তো একজন থাকলো সঙ্গে  !


       আমার তো দুশ্চিন্তা যায় না , কেন না আমি তো জানি এই দীর্ঘ পথটার কথা! কেবলই মনে হতে লাগলো এই সময়টায় যদি ও থাকতো, তাহলে কী ভালোই না হতো, এই যে একা একা থাকার মনখারাপ করাটা সেটা তো খানিকটা পূরণ হতো!  অথচ দেখ আমি এখানে আসতে না আসতে ও কেমন উতলা হয়ে উঠলো এই পরিস্থিতির ভেতরে ওদেশে যাবার জন্যে! এইটা কি যাবার সময় হলো একটা! আচ্ছা, সে যা হবার তা তো হয়েছে, এখন চিন্তা হচ্ছে ,সত্যিই কি যেতে পারলো আদেও ? নাকি বর্ডারে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেল? কোনো একটা খবর পাবার তো উপায় নেই তেমন । শুধু  মাঝে মাঝে আমার এতটা দুশ্চিন্তা করা দেখে মা নিজে না ভেঙ্গে পড়ে, সেই আমায় উল্টে বুঝচ্ছে , শোন, কোন সমস্যা হলে এতদিন খবর চলে আসতো কখন ----!

  

     বললাম , আমি তো এটাই বুঝতি পারতিছিনে ,সে কি সত্যি সত্যিই যাতি যাতি পারলো, নাকি মাঝ পথে অন্য কোনো খানে হাঁটা লাগলো, কাইলে মামার সঙ্গে  গন্ডগোল বাধায় দিয়ে? এসব কি একবার ও ভাইবে দেহিছ কি ---?আমার তো নানা আকথা কুকথা মনে আসতিছে ...কী করি সেডা কও তো দেহিনি! 


      মা বললো, কাইলে কি এতটাই অবিবেচক, দেখিস নিরাপদেই পৌঁছেছে। আমার বিশ্বাস, তা না হলে মন আকথা- কুকথা বলে উঠত ঠিকই--আমার গুরুর জোর আছে, তিনি ঠিকই মঙ্গল করবেন ....।


 আমি বললাম, তাও এতটা নিশ্চিন্তি হতি পারা কি ঠিক হচ্ছে --- তার চাইতি চলো না যাই একবার, কমল দিদিরা তো রইছে ওহেনে এহনে ,হতিও তো পারে কল্পির ওহেনে একদিন থায়ে হয়তো ওরা গ্যাছে ও দেশে ---- ! কাইলে মামার মুহির কথাই তো কচ্ছি ,কচ্ছিল কিন্ত ওহেনে যাওয়ার কথা একবার; চলো না, চলো না একবার ঘুরে আসি ---- যাহোক এট্টা কিছু তো জানতি পাবানে ! মা বললো তাই শুনে, তুই কি চিনয়ে নিয়ে যাতি পারবেনে ? আসার দিন তো রাত্তিরটুকুন ছিলি  ওখানে! 


       বললাম, যায়েই  দ্যাখপা  তো, দেহই না পারি কিনা, যতই রাত্তির হোক ,  আইছিলাম তো ভোরের বেলায় , দেহই না পারি কি না, ঠিকই পারবানে দেহ..... 


      ---- আচ্ছা, তয় চল ,তোর কথা মতোন যাইয়েই দেখা যাক ---- 

     ----- হ্যা --- তাহলি নিশ্চিন্তি হাত পারি তো! চলো তালি কাইলই যাই, দেহে আসিগে ;


      বিষয়টা শুনে কালো দিদিরও  উচ্ছ্বাস আর ধরে না! সেও যেন একটা পথের হদিশ পেল খুঁজে এতক্ষণে ,এমনি একটা ভাব তার চোখে-মুখে!  বেশ খানিকটা বিস্ময় জাগলো যেন, কারণ তার শুনেছি খুব একটা বনে না ভাইএর সঙ্গে। অথচ তার খোঁজ পাওয়ার জন্যে সেও ব্যাকুল! কালো দিদি বলতে একদম ভালো লাগছে না, এখন থেকে তার চাইতে তাকে কাজের দিদি বলি। এমনিতে  তো  দিদিই বলি ।


      মোটামুটি গতকালের দিনটা যেভাবে কেটেছে ; গত পরশু ও গ্যালো তো মনমরা একটা ভাবের মধ্যেই। আজকের দিনটাও তাই। এইবার মনে হলো একটু নাড়াচাড়া পরেছে। তাছাড়া তো কোনো হেলদোলই ছিল না! আমারই ভেতরটা কেবল উতলা হয়ে উঠছে। তাই দুদিন শুধু এই বাড়িটা র মধ্যেই ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দিলাম। শুধুই একটা অস্থিরতা। বারবারই সেই পথের কথা মনে হচ্ছিল। কীভাবে এখানে এসে যে পৌঁছেছি, কীভাবে যে মেহেরপুরে নামবার পরের থেকে আতঙ্কে আতঙ্কে বর্ডার পেরলাম দৌরোতে দৌরোতে! বলা যায় ছুটতে ছুটতেই বেতার বাজারে এসে উঠেছিলাম একটা বেশ বড়সড় মাঠ পাড়ি দিয়ে! এরপর খানিকটা নিশ্চিন্তি এলো, কাইলে মামার মামাশ্বশুরের মনহারি দোকানের সামনে বসে সিঙ্গাড়া জিলিপি রসগোল্লা যখন খাচ্ছিলাম। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম, আর আমাদের কোনো ভয় নেই। এবারে বাস ধরে কৃষ্ণনগর স্টেশন। তারপর ট্রেনে উঠে কলকাতা।


( আগামী পর্বে )




1 টি মন্তব্য:

  1. জীবন যে কত কষ্টের, কত সংগ্রামময় তাই এখানে এসে বোঝা যায়। উপলব্ধির কাছে ভাষা হারিয়ে যায়।

    উত্তরমুছুন