শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২

লেখা আহ্বান



******************************

স্বরবর্ণ * বারো

দ্বিতীয় বর্ষ *  ষষ্ঠ সংখ্যা

*******************************


প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ ফেব্রুয়ারি  ২০২৩ 

এই সংখ্যার জন্য  লেখা জমা নেওয়া হবে  ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত । 

লেখা পাঠানো যাবে নীচের দুটি নম্বরে। তবে মেলে পাঠালে w/a জানিয়ে দেবেন ।

বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিঙ্কে।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

 


স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ *  ১১ * শীত সংখ্যা * ২০২২  

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ ডিসেম্বরের পর থেকে । 

************************

স্বরবর্ণ * ১২

দ্বিতীয় বর্ষ *  ষষ্ঠ সংখ্যা

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ ফেব্রুয়ারি  ২০২৩ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ জানুয়ারি ২০২৩  এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

* কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরোয়। আগে থেকে লেখা পাঠান। পরিকল্পনার সুবিধার জন্য।লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে ।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা 

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী দিব্যানন্দ



পুণ্যব্রতে পূর্ণযোগী : স্বামী আত্মস্থানন্দ       

স্মৃতিসুধা

স্বামী দিব্যানন্দ     

 ১)

      কবীরের একটি ভজনে আছে - 'গুরু বিনা কৌন বাতাবে বাত' -কিন্তু মানুষ গুরু, ব্যক্তি গুরুর পরিবর্তে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে প্রকৃতপক্ষে 'গুরু মহারাজ' বলতে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে বোঝানো হয়। পরবর্তী গুরুরা সকলে তাঁর সাথে পরিচয় বা যোগাযোগ করিয়ে দেন আগ্রহী ভক্ত শিষ্যদের। আমরা তাঁদের শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিভূ বলে ভাবি। আমাদের সঙ্ঘগুরুরাও নিজেদের গুরু না ভেবে 'আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী' এই ভাব পোষণ করে থাকেন। 

      মঠে যাঁরা সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য যোগ দেয় সঙ্ঘ-গুরুদের ও অন্যান্য গুরুজনদের ভালবাসার ছোঁয়া পেলে মা-বাবাকে ছেড়ে আসার কষ্টটা কমে যায়। আমি সেইরকম সৌভাগ্যের অধিকারী, বড়দের ভালবাসা পেয়েছি, যাঁদের অন্যতম ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের পঞ্চদশ সঙ্ঘগুরু আত্মস্থানন্দজী মহারাজ; ১৯৭৫ থেকে একটানা ৪২ বছর যাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি ভালবাসা পেয়েছি অফুরন্ত ভাবে। সেই সাধু-সঙ্গের কিছু স্মৃতি যা আমার জীবনকে মননকে ছুঁয়ে গেছে তাই ইতস্তুত উল্লেখ করছি এই ভরসায় যে এই মহাজীবন অনুধ্যান আমাদের সকলের কাছে সহায়ক হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে প্রেরণা-স্থল। 

      একবার রহড়া থেকে আশ্রমের অটোতে হাওড়া বিবেকানন্দ আশ্রমে উপনিষদ পাঠ করতে যাওয়ার পথে বালি Fire Brigade-এর নিকটে ব্রেক-ফেল করে অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আমার হাঁটুতে চোট পাই। ৬ মাস পূর্বে রিকশা থেকে পড়ে hip-joint ভাঙে ও সার্জারি হয়েছিল। মহারাজ পরের দিনই ফোনে বললেন, 'কি হে, ন্যাড়া কয়বার বেলতলায় যায়?' অর্থাৎ আর যেন এইরকম টু-হুইলার বা থ্রি-হুইলারে যেন না যাতায়াত করি। বললেন, 'অনেক কাজ করতে হবে শরীরের যত্ন নেবে।' সকলেই তাঁর আন্তরিক স্নেহ-ভালবাসার পরিচয় পেয়েছেন। এক্ষেত্রে আমিও সাক্ষী রইলাম তাঁর কঠোর-মধুর স্নেহ-শাসনে। 

      ওই রহড়া কলেজেই অধ্যক্ষতা করার সময় একটা ঘটনা ঘটল। একদিন কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের বড় অঙ্কের টাকা ব্যারাকপুর ট্রেজারিতে নিয়ে যাওয়ার সময় খোয়া গেল। আশ্রমের সম্পাদক মহারাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। বলেন পুলিশে যোগাযোগ কর। পূজ্যপাদ আত্মস্থানন্দজী মহারাজকে স্বল্প সময় পরেই ফোন করলাম; শুনেই বললেন, 'প্রথম কাজ হবে আশ্রম থেকে ওই পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়ে ট্রেজারিতে জমা দাও; যেন তোমার কলেজের কর্মীরা একদিনের সুদ থেকেও বঞ্চিত না হন।' মহারাজের সুন্দর সমাধানে খুব স্বস্তি পেলাম। সেই দিন বুঝেছিলাম বিপদেও করনীয় কর্তব্য নির্ণয়ে ওঁর অমোঘ পারদর্শিতা। 

      ব্রহ্মচারী ট্রেনিং সেন্টারে ১৯৭৭-৭৮ আমি ম্যানেজার ছিলাম। যখনই কোনও অসুবিধায় পড়তাম, মহারাজের ঘরে গিয়ে পরামর্শ নিতাম। মনের কথা সব খুলে বলতে পারতাম। কখনও মনে হত তিনি কঠোর ব্যক্তি, কিন্তু আপাত কঠোরতার ভিতরে ছিল একটা অদ্ভুত ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয়। ভাল-মন্দ, দুর্বল-সবল সব ছেলেদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অহৈতুক। আবার মাঝে মাঝে এই ভালবাসার জন্য কেউ তাঁকে ভুল বুঝেছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন চিরস্বচ্ছ। তাঁকে সব অবস্থাতেই অবিচল ও শান্তভাবে থাকতে দেখেছি। যেন বাইরের মানুষটি আমাদের সাথে বয়স্য অগ্রজের মতন মিশে যত ফষ্টিনষ্টি করেছেন, কিন্তু ভেতরের আরেক প্রকৃত রসস্বরূপ ঈশ্বর-রসে সর্বদা মজে রয়েছেন আপন মেজাজে।


 ২)

      মনে পড়ে, ব্রহ্মচারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিনি আমাদের স্বামীজীর করা মঠের নিয়মাবলী পড়াতেন। প্রথমদিন ক্লাস নিতে এসে 'সহনাববতু' এই শান্তি-মন্ত্র উচ্চারণের পর ক্লাসের সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন, তিনবার কেন শান্তি বলা হল? উত্তরটি কেউ বলল না, তখন তিনি সুন্দরভাবে তিনরকম জ্বালা বা অশান্তি, তার উৎস বা কারণ, এবং তা থেকে উত্তরণের কথা ব্যাখ্যা করলেন। তাঁর মুখে আধ্যাত্বিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক শান্তির কথা শুনে সেদিন আমরা সকলে মুগ্ধ হয়েছিলাম। 

      গত শতাব্দীর আট এবং নয়-এর দশকে ভক্তদের ও যুবকদের সংগঠিত করে বেলুড় মঠে বেশ কয়েকটি বড় সম্মেলন হয়। ডিসেম্বর ১৯৮২ সারদাপিঠে একটি বড় আবাসিক যুব সম্মেলন হয়। স্বামী সত্যরূপানন্দজী ও আমি শিবির অফিসের দায়িত্বে ছিলাম। প্রথমদিন সব যুবক আসার পর মহারাজ বিদ্যামন্দির ছাত্রাবাসগুলি পরিদর্শন করে, ওদের সাথে কথা বলে, অফিসে এসে আমাদের বললেন, 'অনেক ভাল ভাল যুবক এসেছে, দু-চারজনকে অন্যরকম মনে হল, ওদের সাথে ভালভাবে মিশে ওদের ভাল ভাব দেওয়ার চেষ্টা করো, ওদের মানসিক উত্তরণের চেষ্টা করো।' শিবিরে একদিন মহারাজের তেজোদীপ্ত ভাষণ শুনে যুবকরা খুব অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। আট এবং নয়-এর দশকে সব কয়টি সম্মেলনে মহারাজের ভাষণ যাঁরা শুনেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে তাঁর ওই তেজস্বী, প্রেরণাদায়ী কথা। মঠে ১৯৮০-তে মহাসম্মেলন, ১৯৮২-তে সারদাপিঠে ও ১৯৮৫-তে মঠে যুবসম্মেলন দুটি হয়েছিল। তারপর গ্রামে-গঞ্জে বেশ কিছু যুব-সংগঠন, ভক্তদের সংগঠন বেড়েছে এবং বেশ কিছু যুবক তারপর সঙ্ঘে যোগও দিয়েছে। অনেকেই একথা আজও স্বীকার করেন, -মহারাজের যুবকদের উপর প্রভাব ও টান ছিল খুব বেশি। পূজনীয় মহারাজের দীক্ষার প্রথম ব্যাচে কেবল যুবকরাই স্থান পেয়েছিল। সামান্য কয়েকজন যুবককে প্রথম দিন দীক্ষা দেন। 

      ১৯৮৪-তে ত্রিপুরায় মনু নদীর ভয়াবহ বন্যার পর ওঁর নির্দেশে তাড়াতাড়ি ত্রাণকার্যে যাই। এই যাত্রায় পূজ্যপাদ প্রভানন্দজী মহারাজ আমাদের সাথে ত্রিপুরা যান এবং মুখ্যসচিব, অর্থসচিব ও সরকারি অফিসারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা প্রথম দফায় দুর্গত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সার্ভে করার পর মহারাজকে জানালে, মহারাজ Air India Cargo-র মাধ্যমে তাড়াতাড়ি ত্রাণসামগ্রী সব পাঠিয়ে দেন। কাজ করার সময় আরও দূর্গত মানুষের কথা জানতে পেরে অতিরিক্ত ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর জন্য আত্মস্থানন্দজী মহারাজকে ফোন করি। প্রথমে মহারাজ নারাজ হলেও, আমি যেই বললাম, 'তাহলে এখানে ভিক্ষা করব অর্থবান মানুষের কাছে', পূজনীয় মহারাজ হেসে বললেন, 'পরীক্ষা করলাম তোমাকে। আজই সব জিনিস পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেবা করো মানুষের, আরও ত্রাণসমগ্রী পাঠাব যখনই জানাবে।' ওই সময়ে কৈলাশহর, ধর্মনগর, কমলপুরে ব্যাপক সেবা কাজ হয়। পূজনীয় আত্মস্থানন্দজী মহারাজ বারবার আমাদের খবর নিতেন, -কি করছি, কোথায় আছি, অসুবিধে হচ্ছে কিনা। সেই সময়ে ত্রিপুরার চারিদিকে দেশদ্রোহীদের মাধ্যমে নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। একদিন ত্রাণের কাজে কৈলাশহর থেকে আগরতলা যাওয়ার সময় সরকারি জিপের চালক বললেন যে ঠিক এই সময়ে, এই স্থানে, সিআরপিএফ জোয়ানভর্তি একটি লরিতে জঙ্গিরা বোমা মেরে সাত-আটজনকে মেরে ফেলেছে। আমরা মনে মনে দূর্গা নাম করে, ওই রাস্তাঘাট চলেছি, আমাদের কাজে জঙ্গিরা বাঁধা দেয়নি কখনও।


 ৩)

      স্বামী আত্মস্থানন্দজী মহারাজের অনুরোধে দ্রুত ডাক্তার নিয়ে গিয়েছি মেডিকেল কলেজ ও ট্রপিকাল স্কুল অফ মেডিসিন থেকে, সুন্দরবনের Cyclone Relief-এর সময়। মাঠে মাঠে টার্পোলিনের নিচে মানুষ। তাদের চিকিৎসা করা হল। সেইবার গবাদি-পশু অনেক মারা গিয়েছিল। সেই অবস্থায় খাবার জিনিস ও ঔষধপত্র দিয়ে সেবা হয়। পূজনীয় মহারাজের প্রেরণাতেই মালেকান গুমটিতে একটি বড় বিদ্যালয়ের জন্য বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়। এই ত্রাণসেবার কাজে মহারাজ খুব উৎসাহ দিতেন যার ফলে দুর্গম অঞ্চলে ব্রহ্মচারী ও সাধুরা ঠাকুরের ভাবে কাজ করতে পারে। সেখানে বেশ কয়েকবার মহারাজের নির্দেশে গিয়েছি এবং ত্রাণের কাজে অংশ নিয়েছি। সুন্দরবনেই মালেকান গুমটি অঞ্চলে ত্রাণ কাজ করার পর ডক্টর নিতাই প্রামাণিক এসে পূজনীয় মহারাজকে শিশুদের পুষ্টির অভাব ও তাদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলে, ওদের দুঃখের কথা শুনে মহারাজ কাঁদতে শুরু করেন। নিতাই ডাক্তার নিজে বলার সময় ভাবাবেগে কেঁদেছিল। পূজনীয় মহারাজ আমাকে পরে ফোনে বলেন, 'নিতাই কেমন ডাক্তার! দুর্গত মানুষ, শিশুদের জন্য কাঁদতে পারে!' পরে শুনেছি, মহারাজ নিজে আরও বেশি কেঁদেছিলেন। 

      ২০০০ সালে দীক্ষা দিতে গিয়েছেন ত্রিপুরাতে। সেবার আগরতলায় কয়েকদিন ধরে দীক্ষা হয়। একদিন বললাম, ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে এমন একজন দীক্ষা নেবেন, নাম মাখন চক্রবর্তী। মহারাজ বললেন, 'ওকে পৃথকভাবে দীক্ষা দেব।' দীক্ষার দিন সকালে বললেন, 'আমি ওর বাড়ি যাব।' আমরা ওদের বাড়িতে খবর দিলাম। ভদ্রলোকের বেডরুমের মেঝেতে দেওয়ালের গায়ে ঠাকুর-মা-স্বামীজীর ফটো সাজিয়ে মেঝেতে আসনের উপর বসে মহারাজ মন্ত্র দিলেন। ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী খুব মানসিক শান্তি লাভ করেছিলেন। স্ত্রী পূর্বেই দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। যতদিন ভদ্রলোক বেঁচে ছিলেন, ততদিন মহারাজ ওর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আমাদের কাছে খবর নিয়েছেন। শরীর ত্যাগের পূর্বে ভদ্রলোক একবার বেলুড় মঠে এসে গুরুদর্শন করে যান এবং তারপর আগরতলায় গিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পূজনীয় মহারাজ বাড়ি গিয়ে এইভাবে দীক্ষা দিয়েছেন, এরকমটি পূর্বে আমি শুনিনি। এই ঘটনায় আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল মায়ের ভালবাসা ওঁর মাধ্যমে প্রকাশ পেল এই ঘটনার মাধ্যমে। 

      যখন আমরা ট্রেনিং সেন্টারে তখন মহারাজ তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক স্বামী গম্ভীরানন্দজীকে নিয়ে গিয়েছিলেন অমরনাথ দর্শনে। গম্ভীরানন্দজী সেখানেও দেখেছেন আলো করে বসে আছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। পূজনীয় আত্মস্থানন্দজী মহারাজ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন পূজনীয় গম্ভীরানন্দজীর সেই কাশ্মীর দর্শনের অভিজ্ঞতা শোনার। গম্ভীরানন্দজী মহারাজ প্রথমে বলতে চাননি ওই ঠাকুরকে দেখার কথা, পরে আত্মস্থানন্দজীর বারবার অনুরোধে সেই দিব্যদর্শনের কথা আমাদের বলেছিলেন। আমরা সবাই খুব আনন্দ পেয়েছিলাম মহারাজের ওই অলৌকিক দর্শনের কথা শুনে। কিন্তু নেপথ্যে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন স্বয়ং সত্যকৃষ্ণ মহারাজ। 

      সারদাপীঠের একটি অঙ্গ 'সমাজ সেবক শিক্ষণ মন্দির' পূজনীয় মহারাজের উৎসাহে গড়ে উঠেছিল। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য মহারাজ প্রথম অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন, যেটি মঠে জমা আছে এবং তার সুদ থেকেই অনেক অর্থ আজও আমরা পেয়ে আসছি। মহারাজ বরাবর এই কেন্দ্রটি কেমন চলছে খবর নিতেন ও যথাসাধ্য এর উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সাহায্য করতেন। মহারাজের বিশেষ আশীর্বাদধন্য এই প্রতিষ্ঠানটি।


 ৪)

      ১৯৭৮ সালে হাওড়া ও হুগলি অঞ্চলে ব্যাপক ত্রাণ-সেবার কাজ হয়, মহারাজের নেতৃত্বে। আরামবাগ সংলগ্ন বালি দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে একটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করে দেওয়া হয়। মহারাজ তদানীন্তন ম্যানেজার ভরত মহারাজকেও ওই কাজ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি বিদ্যালয় উদ্বোধনের দিন গিয়েছিলাম। বিদ্যালয়ের মেয়েরা 'শ্রীরামকৃষ্ণ' নাটক মঞ্চস্থ করে। তাদের অভিনয়ে দেখে সবাই মুগ্ধ। বালি-দেওয়ানগঞ্জ, কামারপুকুর, জয়রামবাটির গরীব মেয়েদের স্বনির্ভর করার জন্য পল্লীমঙ্গল স্থাপন, মহারাজের উদ্যোগে হয়েছিল। এই কাজে গুজরাট থেকে কান্তিভাই শ্রফ্ ও ইন্দিরাবেন প্যাটেল, এঁরা এসেছিলেন মহারাজের অনুরোধে বেশ কয়েকবার। বালি-মাটিতে চাষ ভাল কিভাবে হয়, মেয়েরা যেন স্বনির্ভর হয়, এই ছিল মহারাজের একান্ত ইচ্ছা। মহারাজ এই কাজে সফল হয়েছেন তাঁরই উদ্যোগে কামারপুকুরে মিনি জুট মিল-এ মাটি পরীক্ষা কেন্দ্র (Soil-testing laboratory) তৈরি হয়। ভারত ও ভারতবর্ষের বাইরের মানুষও এই কাজগুলির উচ্চ প্রশংসা করেছেন। পূজনীয় মহারাজের নির্দেশে প্রতি বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাধুরা গিয়েছেন বালি দেওয়ানগঞ্জ, আমিও একবার গিয়েছিলাম দোল-পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যার একটি অনুষ্ঠানে। 

      ১৫ ই মার্চ ২০১৭ গোলপার্কে, বিবেকানন্দ হলে 'চৈতন্য প্রসঙ্গ' বলার জন্য গিয়ে জানলাম বক্তৃতাটি পূজ্যপাদ আত্মস্থানন্দজীর ধর্মপ্রাণ পিতা-মাতা -রাম নারায়ণ তর্কতীর্থ ও ননীবালা দেবী স্মারক বক্তৃতা। খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন ওঁদের কথা জেনে। সেদিন জেনেছিলাম ওঁর বাবা আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৩৮-এ অন্যতম বক্তা ছিলেন। সেদিন তিনি মঠের উৎসবে ভাগবত পাঠ করেছিলেন। 

      ১৯৭৮-এর ব্রহ্মচর্য দীক্ষার পর পুরী গিয়েছিলাম স্নানযাত্রা উপলক্ষে। পুরী থেকে ফিরে মঠে পূজনীয় মহারাজকে প্রণাম করলে প্রথম প্রশ্ন, 'কয়েকদিন দেখিনি, কোথায় যাওয়া হয়েছিল?' পুরী-তীর্থ গিয়েছি শুনেই মহারাজজী বললেন, 'জান, আমি কখনও ছুটি নিয়ে তীর্থে যাইনি। তোমার কর্মক্ষেত্রই তোমার তীর্থ, কাজটি হল পূজা। এখন অল্প বয়স, ঠাকুরের সব কাজ পূজা-ভাব নিয়ে করবে।' সেদিন আরও অনেক কথা হয়েছিল যার প্রায় সব ব্যক্তিগত। আসবার সময় মহারাজকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছিলাম, উনিও খুব আদর করেছিলেন ওই দিন। কিন্তু আরেকদিনের কথা সবশেষে উল্লেখ করব। 

      আমাদের তিনি স্বামীজীর শিষ্য কেদারবাবার কথা বলতেন, বিরাজানন্দজীর কথা বলতেন প্রায়শই। একদিন একান্তে তাঁর স্বগতোক্তি শুনেছি -'আমি মহাপুরুষ বিজ্ঞানানন্দজীর নিকট মন্ত্র পেয়েছি, স্বামী বিরজানন্দের সেবা করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি কিছুকেই তোয়াক্কা করি না, কোনও কিছুর ভয় নেই আমার।' আপাতভাবে অহংকার মনে হলেও, এইটি গুরুভক্তি ও গুরুর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের লক্ষণ ভিন্ন আর কিছু নয়। 

      আমার খুব বিশ্বাস ছিল মহারাজজী শতায়ু হবেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছা দেখি অন্যরকম। হাসপাতালেই ছিলেন অনেকদিন। বারবার দেখতে গিয়েছি, কখনও চোখে মুখে ব্যাধিজনিত কষ্টবোধ করছেন, এমনটি মনে হয়নি। জুনের ১৭ তারিখ সন্ধ্যায় দেখে এলাম; ১৮ তে সংকটজনক অবস্থা শুনে যখন যাত্রা করছি, তখনই দেহান্তের সংবাদ পেলাম; হাসপাতালে গেলাম শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। পরেরদিন রাতে বেলুড় মঠের সমাধিপীঠে তাঁর দেহটি নিয়মমত ভস্মীভূত হয়ে গেল। কিন্তু সূক্ষ্মশরীরে গুরুশক্তিরূপে তিনি ভক্তদের নিকটে থাকবেন, আমাদের সকলকে আশীর্বাদ করবেন, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর প্রতি আমার হৃদয়ের ভালবাসা প্রণতি জানিয়ে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য শেষ করছি একটি কবিতায় :


      স্মৃতিসুধা

      আমি তো দেখেছি আর্ত-সেবায়     তোমার চোখের জল।

      প্রতিজ্ঞার কঠিন অঙ্কে ‌‌                  স্নেহসুধা অবিরল।

      দেখেছি আমি দৃপ্ত মুষ্টি                  আনত ষষ্টি ভারে,

      সকলে গিয়েছে নেচেছে সেথায়     তোমারই কথার সুরে।

      সেদিনের কথা মনে রেখো 'কাল'   স্মৃতি তর্পনে আজি

      আত্মস্থ সে পুরুষ প্রবর                  আনন্দধাম ত্যাজি

      এসেছিল হেথা বিরজা-সেবায়       হরিপ্রসন্ন তনয়

      ধরেছিল এক ঋজু, নির্ভীক           অমল জীবন কায়

      কায়হীন নয় রামকৃষ্ণ প্রতিভূ         সত্যকৃষ্ণ স্বামী

      সঙ্ঘ-শরীরে নিত্য বিরাজে            মোদের প্রেরণা তুমি॥

      

      সমাপ্ত

***********************************************************************************

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * সমর সেন



এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ / ১১ সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন সমর সেন|


মহুয়ার দেশ 

সমর সেন











মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে 

অলস সূর্য দেয় এঁকে 

গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ, 

আর আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনার। 

সেই উজ্জ্বল স্তব্ধতার 

ধোঁয়ার বঙ্কিম নিশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে  

শীতের দু:স্বপ্নের মতো। 

অনেক অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ, 

সমস্তক্ষণ সেখানে পথের দু'ধারে ছায়া ফেলে দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য,

আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস 

রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে। 

আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া ফুল ,

নামক মহুয়ার গন্ধ 


২ 

এখানে অসহ্য, নিবিড় অন্ধকারে 

মাঝে মাঝে শুনি--- 

মহুয়া বনের ধারে কয়লার খনির 

গভীর,বিশাল শব্দ, 

আর শিশির-ভেজা সবুজ সকালে, 

অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক 

ধূমহীন তাদের চোখে হানা দেয় 

কিসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন ।


**********************************************************************************************


সমর সেন


**********************************************************************************************


পাঠ প্রতিক্রিয়া



নানা সুর ও স্বরের প্রবন্ধবিচিত্রা 

তন্ময় রায়


প্রবন্ধ সাহিত্যে অশোক সাহা একটি পরিচিত নাম। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বহু প্রবন্ধ ছোট বড় নানা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। তাঁর মননঋদ্ধ  আলোচনা আমাদের সমৃদ্ধ করে। সম্প্রতি তাঁর একটি প্রবন্ধগ্রন্থ আমাদের হাতে এসেছে। 


প্রাবন্ধিক অশোক কুমার সাহা লিখিত 'প্রবন্ধ সংকলন ও বৃহত্তর চাঁদপাড়ার নাট্যচর্চার ইতিহাস' একটি মূল্যবান বই। বইটিতে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ৩১ টি প্রবন্ধ আর বৃহত্তর চাঁদপাড়ার নাট্যচর্চার ইতিহাস। এবং সেই সঙ্গে 'সুভাষ তুমি' নামে একটি প্রতিবেদন ভিত্তিক সাক্ষাৎকার। বইটির মূল বিশেষত্ব এই, প্রবন্ধ গুলি আয়তনে ছোট হলেও, লেখকের বর্ণনাগুণে, তথ্য পরিবেশনে, দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে সুখ্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে। বিষয়ে প্রবন্ধগুলি বহুগামী বিচিত্র পথের অনুসারী। ভ্রমণ, শিক্ষা, রাজনীতি,ও সমাজ জীবনের নানাদিক এবং অবশ্যই নাট্যচর্চার ইতিহাস অনুসন্ধান। সৃষ্টিশীল মানুষের প্রধান ঐশ্বর্য তার কল্পনাশক্তি । শুধু বই পড়া জ্ঞান কুয়োর ব্যাঙের মতো হতে পারে । কিন্তু সেই জ্ঞান যখন লেখক এর কল্পনা শক্তি ও বোধের দ্বারা জারিত হয়, তখন তা আর শুষ্ক পুথি জ্ঞান থাকেনা,  হয়ে ওঠে সাহিত্য 

রসাশ্রিত অমৃত, যা এই প্রবন্ধগ্রন্থটিতে আমরা পাই। '১৪২১ বঙ্গাব্দেও যদি কবিগুরু থাকতেন' 'পথ ও নিসর্গ প্রকৃতির সূত্রে গ্রথিত চাঁদের পাহাড়' কিংবা 'বই ও বোধ বুদ্ধি' 'বাজিয়ে রবি তোমার বীণে' 'এক যে ছিল বিদ্যাসাগর' 'সাহিত্যে হাওলার' প্রভৃতি প্রবন্ধ গুলি নিঃসন্দেহে এই গোত্রের।

তথ্যসমৃদ্ধ রচনাগুলিও সমান আকর্ষণীয়। যেমন 'নোবেল নেপথ্যে' ' নৈতিক, রাজনৈতিক ও রবীন্দ্রনাথ' 'মুখের ভাষা ও লেখার ভাষা' বাংলা গীতাঞ্জলি এবং ইংরাজি গীতাঞ্জলি (Gitanjali--Songs offerings)- এর মধ্যকার পার্থক্য, নোবেল পুরস্কার কী  বিশদে তথ্যসহ আলোচনা করেছেন। 

'বাংলা পদ্য, কবিতা ও আবৃত্তি' এই গ্রন্থের অন্যতম একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রচনা। যেখানে লেখক 'পদ্য, কবিতা ও আবৃত্তি'র মধ্যকার সম্পর্ক বা সূক্ষ্ম পার্থক্য গুলির সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

বইটির প্রচ্ছদ আর একটু আকর্ষণীয় এবং মুদ্রণ প্রমাদ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী ছিল।

পরিশেষে বইটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি।


প্রবন্ধ সংকলন ও বৃহত্তর চাঁদপাড়ার নাট্যচর্চার ইতিহাস 

অশোক কুমার সাহা

প্রকাশক: অশোক কুমার সাহা  

চাঁদপাড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা। 

মূল্য ১২০ টাকা



অশোক কুমার সাহা


উপন্যাস * দীপংকর রায়



[ 'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৮   

দীপংকর রায়


ভাসানের সেই মেলা, টাবুরের ছোই-এর ভেতর শুয়ে শুয়ে মেলা দেখবো আমি। এরা নিচেয় নামবে সকলে। ততক্ষন আমি মাঝির সঙ্গেই থাকবো, কথা হলো সেটাই। এত মানুষের হইহট্টগোল। নবগঙ্গার শান্ত রূপ তবুও সান্ধ্য-জলে। কেন জানি না ,আমার হঠাৎ সে কি কান্না এলো ! মাঝি জিজ্ঞাসা করছে , কী হলো গো তোমার ? ব্যথা কি খুব করতিসে ভাইডি? আহা গো, ছেলে মানুষ, এই পুজোগণ্ডার দিনি নিচেয় নামতি পারতিছে না ; এই দ্যাহো , তোমার জন্যি এই ছেমরিডাও যাতি পারলো না ; শান্ত হও গো, ও মামনি, দ্যাহো তো, ও ভাইডি কী কয় ?

           কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য সকলেই টাবুরেতে ফিরে এলো । এখানে আমি ঠিক একা ছিলাম না মাঝির সঙ্গে । নারান মামার বড় মেয়েটাও ছিল আমার সঙ্গে নৌকোয় । সে কেন যে নিচেয় নামেনি তা জানি না । এর পরে এরা ফিরে এসেও সকলেই নানা উৎকন্ঠায় ছিল যেন আমাকে নিয়ে । হয়তো সেই কারণেই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে । আমার ব্যথায় কাতরানোর কারণেই তার মনটা হয়তো সায় দিয়েছিল না আমাকে ফেলে সকলের সঙ্গে নিচেয় নামতে । দিদিমা এদের সকলের সঙ্গে নিচের থেকে ঘুরে এসে যখন দেখলো ব্যথায় কাতরাচ্ছি আরো বেশি, তখন তার বিলাপ করা শুরু হয়ে গেলো ---- এই জন্যি তো কইছিলাম রসিকদারে, আমার আর যাইয়ে কাজ কি, এহনে দ্যাহো , এই মণি , ওর কী হলো রে ......?

          বেবি পড়েছে মহা সমস্যায় ; সে ভাবছে হয়তো কেনই বা সে নিচেয় নামলো না ! কীই বা এখন বলে সে ; তাও বলতে লাগলো , ' এই তো‌, দাদা তো কিছুক্ষন আগেও ভালোই ছিল , আমার সঙ্গে কথাও কচ্ছিলো, মাঝি দাদুর সঙ্গেও ; এর মধ্যি কী যে হলো ,তা কিডা কবে , বুঝতি তো পারতিছি না গো রাঙাদি ; ব্যথার জন্যি তো ঠিক না মনে হয় , শোনো দেহি তুমি, কী হলো গো , কও তো আমাগের একটু ----

          তার আর তখন কতোই বা বয়স ! কীই বা বোঝে ! ও তো আমার জন্যেই যাইনি । এ কথা তো সব চেয়ে বড় সত্যি , সকলে যখন নেমে যাচ্ছে নিচেয় তখনই ও বললো শুনলাম, না না, দাদার একা থায়ে কাজ নেই , আমি নৌকোতেই রইছি , এহেনেই থাকপানে , ও রাঙাদি , আমি নিচেয় যাবোনানে , আমার যাতি ইচ্ছে করতিছে না , তোমরা সকলেই যাও , আমি এহেনেই থাকপানে ।

          এই ঘটনার কথা মনে পড়ার কারণ আর কিছু না , মনে হয় এই যে আজ নবমীর দিন , এই সন্ধ্যাবেলায় সকলে যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে নতুন জুতো জামাকাপড় পরে গটমট আওয়াজ করতে করতে চলে যাচ্ছে এদিক ওদিক, এ পাড়ায় সে পাড়ায় অথচ আমি একা একা বারান্দায় বসে আছি। বসে বসে কীই বা এত ভাবছি ! কেনই বা আমার ভেতরে এই সব উৎসবের দিনগুলোতে এমন হাহাকার ওঠে , কীসেরই বা এত বিষাদ জাগে ?

          কাজের দিদিও ফচনের ঠাকুমার সঙ্গে পাড়ার ঠাকুর দেখতে গেছে । মা দিদিদের সঙ্গে নাতিকে নিয়ে রিক্সায় করে ঠাকুর দেখতে গেছে । আমিও তো সেই সঙ্গে যেতে পারতাম , অথচ যাইনি । কারো সঙ্গই নিই নি । মনে মনে ভাবছি শুধু , আমার এই শূন্যতা বোধের কথাগুলিই কি ! শঙ্কর ডেকে গেছে । ফচনও বলেছে , কি রে , বেরোবি না ?

           সকলকেই না বলে দিয়েছি ।

           সকালবেলায় একবার অলোকদের বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করে এসেছি । এরপর বাড়িতেই । 

           এই সন্ধ্যাবেলায় সকলে যখন পুজোর শেষ আনন্দটুকু নিতে বাইরের দিকে ছুটছে , তখন আমি কেন একা একা সেই ফেলে আসা কোন কালের একটি পুজোর ভাসানের দিনের কথা নিয়ে এত কথা মনে করে বেড়াচ্ছি তা কে জানে !

           এসবের মধ্যে আবার মনে পড়ছে, জানি না ভাইটা এখন কী করে বেড়াচ্ছে ! দিদিমা কি ওর জন্যে এবারের ভাসানের মেলায় টাবুরে ভাড়া করে শত্তিজাতপুরীর আড়ঙে যাবে নে নাকি ?


            ‌ এইসব নানা কথার আকাশ পাতাল একা একা বারান্দায় যখন বসে বসে ভেবে বেড়াচ্ছি এমন সময় অলোকের ছোটো বোন মলি এসে ঢুকলো আমাদের বেড়ার  সদর দরজা খুলে । বারান্দায় এসে জিজ্ঞাসা করলো , কি রে , তুই এখানে একা একা ভূতের মতোন বসে আছিস কেন ? কী করছিস কি তাই বল তো ? আমি দাদারে জিজ্ঞাসা করলাম তোকে ডেকেছে নাকি । সে বললো , কই , তাকে তো একবার সকালের দিকে দেখেছিলাম এদিকে , তারপরে তো আর তাকে দেখিনি । দেখ, শঙ্কর ওদের সঙ্গে বেরিয়েছে নাকি ; তাই তো এলাম খোঁজ করতে । 

                তাকে মুখে কিছু না বলে ইশারায় বসতে বললাম পাশের মোড়াটি ঠেলে দিয়ে । 

                সে না বসে বলতে লাগলো , আচ্ছা তুই কেমন রে তাই বল তো ! চল , আমার সঙ্গে চল তো । 

                বললাম , না রে , তা তুই আমার খোঁজে এলি কেন ? তোদের বাড়িতে এত মানুষজন , এত ব্যাস্ততা , তা থুয়ে তুই আমার খোঁজ করতি আলি ক্যান, তাই ক তো ! 

                ‌সে খানিকটা হেসে ফেললো যেন , হাসতে হাসতে বললো , ও তো তুই বুঝিস নে , চল‌ , নে নে দুয়োরে তালা দে , চল আমার সঙ্গে।

                কাজের দিদির গলা পাওয়া গেল । সে আসার পরে মলিরও আর তাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবার তাড়া থাকলো না । কাজের দিদি স্টোভ জ্বেলে চা বসাতে গেল । চা হয়ে গেলে মলিকেও দিলো । সেও আজ তার জন্যেও চা করে নিয়ে এসে আমাদের পাশেই বসলো ।

                 এ কথা সে কথার মধ্যে মলির এই উপস্থিতির কথাটা মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না । কেবলই ভাবছি ওর এ কথা সে কথার মধ্যে থেকেও একটাই কথা --- সে কেন এমন সময় তাদের বাড়ির এত আনন্দ উৎসবের ভেতরে থেকেও আমার কথা ভেবে এ বাড়িতে এলো কেন ?

                আমার সেদিনের সেই বিষাদময়তা কাটিয়ে দিল সে এসেই যেন ,  আমাকে সঙ্গ দিয়ে ?

              যদিও আমি তার ভেতরে তার সেই অনুসন্ধিৎসু মনটার কোনো খোঁজ নিতেই একটুখানি বেশি তলিয়েও ভাবতে গেলাম না আর । কত সময় যে মানুষ তার নিজের স্বভাবদোষে অন্যের কোনো সময়েরই মূল্য দেয় না , সে কথা আমি অনেক কাল অবধি বুঝতে চাই নি যে, সে কথাটাই সব চেয়ে বড় সত্যি । এরকম ঘটনা , সব ক্ষেত্রেই যখন ঠিক মতো বুঝতে গেছি, তখন সবটারই সময় কাল অতিক্রম করে গেছে  ।

                  মন যাকে খুঁজে বেড়ায় না বুঝে , মন যার বিষাদময়তায় ক্লান্ত হয় , তার খোঁজ যেন মন নিজেই জানে না ঠিক সময় , সঠিকভাবে ।


                 সময় এমনই । সময় এভাবেই বয়ে যায় তার আপন ছন্দে । তাকে যে তার সময়েই বুঝতে হয় ; তা না হলে সে যে না বোঝার মধ্যেই রেখে দেয় তার আপন রহস্যের আনন্দ ; নিজেই মেতে ওঠে হয়তো একা একা কখনো সখনো  ; আর এ কথা যে কত বড় সত্য তা সেই সব দিন ছাড়িয়ে এসে আজ যখন সময়ের হাতে ধরা দিয়ে ক্লান্ত হই , তখন কত কথাই না মনে পড়ে ; আর সেই দমচাপা হা হুতাশ এতটা পথ ফেলে এসেও, কতটা বা প্রকাশ করতে পেরেছি বা পারবো কি আদোও এমন কোনো ভাষা দিয়ে , যাতে নিজেকে অপরাধী ভাববো না একবারও !

                 সে সবের কোনো অন্তই কোনোদিনও খুঁজে পাওয়া যায় না যে এটাই সবচেতে বড় সত্য ।

                জোরজার করে জামাকাপড় পরিয়ে ওরা আমাকে সকলে মিলে  ঠেলেঠুলে  তুলে দিয়েছিল বিসর্জনের লরিতে । তার আগে শিবানী মলির সমবয়সীরা ও ওদের বড়দির মেয়েও এলো মামা মামা করতে করতে, আমাকে অনুরোধ করতে। আমি যাই যেন তাদের সকলের সঙ্গে লরিতে।

                 অলোকদের বাড়ির লম্বা মোজাইক করা বারান্দার এক কোণে সিদ্ধি বাটা হচ্ছে দেখলাম । মনেমনে ভাবলাম এ বস্তুটি দেখতে তো ভাঙপাতার মতোন , যা সেবারে মাঠ থেকে তুলে এনে শুকিয়ে সুভাষ কলকেয় পুরে আমাকে খুব করে টানিয়ে ছিল ওখানে থাকতে । এ তো সেরকমই, ভাঙপাতার মতোনই দেখতে। অলোককে বললামও , হ্যাঁ রে, এরে‌ ভাঙের পাতা কয় না ?

                 ‌সে বললো , না রে‌ না ,  এ তার থেকেও আরো অন্য আর একটা জিনিস ; তোদের সে ভাঙের পাতা এখানে কোথা থেকে মিলবে রে ভাই ! একে সিদ্ধি বলে , বাবার প্রসাদ , খাওয়ার পরে তুই আর তুই থাকবি নে , দেখিস খানে কী মজাই না আছে এতে ! 

                বিসর্জনের লরি ছাড়বার আগে এরা সকলে এক এক গেলাস করে সেই সিদ্ধি বাটা সরবত সকলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল । অলোক মলির হাত দিয়ে আমার জন্যেও পাঠিয়ে দিল । এবং পরম যত্ন সহকারে ওরা সকলেই পান করার পরে আমি গেলাস হাতে নিতে ইতস্তত করছিলাম দেখে মলি ও ওদের ভাগ্নি , পারলে দুজনে মিলেই , আমার হাতের থেকে নিয়ে গেলাসটা মুখের কাছে তুলে ধরে বললো , নে ধর , এবার চো চো করে মেরে দে তো দেখি ; 

              ওদের সাথে না পেরে উঠে বললাম , আচ্ছা আচ্ছা হাতটা ছাড়বি তো , দেহিস ভাই , কোনো অসুবিধা হবে নানে  তো , শেষে উল্টে না পড়ি দেহিস কিন্তু।

               ভাগ্নি বলল, তুমি তো আচ্ছা ভীতু রে বাবা! আমরা সব দু দু গেলাস মেরে দিলাম , আর এক গেলাস খেতেই এত টিপ টিপ, মেরে দাও তো, জয় ভোলে বাবা বলে ;-----

              সিদ্ধি পেটে পড়ার পরই ওরা লরিতে তুলে দিয়েছিল জোরজার করে, আর আমিও দেখলাম সব জারিজুরি খসিয়ে সুবোধ বালকের মতো ওদের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে ওদেরই কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম !

               সেন্টের গন্ধ , ঘামের গন্ধ সব মিলেমিশে নারী শরীরের লাবন্য যেন চারদিকে ঠিকরে বেড়াতে লাগলো ; চোখমুখ সরিয়ে নেব কীভাবে? সেই বয়স তো আর সেই টান, সেই মুগ্ধতার হাত থেকে সহজে রেহাই পেতে পারে না। তথাপি লরি চলা শুরু করলে ডালা ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আলোর ঝলকানি , বক্সের আওয়াজ , এ সবের মাঝেই আমার দ্বিধা-দ্বন্দ, সঙ্কোচ বোধ , ভীরুতা কখন যে কোথায় উধাও হয়ে গিয়ে কলকাতার বিসর্জনের হুল্লোড়ের মধ্যে দুহাত তুলে নাচতে নাচতে চললো , তখন আর আমার সেই স্বভাবের কোনো জড়তাকেই আর খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও।

                 লরি গঙ্গার ঘাটে পৌঁছলে আমি যে কখন তাল হারা হয়ে কাদের সঙ্গে নাচতে নাচতে আলাদা হয়ে চলে গেছি কোথায় ! আর কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না । 

                নিজেকে পরিচিত জনদের মধ্যে খুঁজে না পেয়ে কিছুটা যেন তালহারা হয়ে এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি , একা একা ঘামছি শুধু ; এমন সময় সেই মলি  আর অলোকই আমাকে খুঁজে বার করলো। এবং সেই থেকে ওরা আর আমার হাত ছাড়তে চাইছে না যেন । ওদের ভাগ্নিও একিভাবে  আমাকে আগলাতে লাগলো । সিদ্ধির নেশা তখনো অবধি ছিলো কি? তবে সকলকে খুঁজে পেয়ে বেশ ভালো লাগছিল । পাড়ার মানুষগুলোই তখন ঘরের মানুষ। আপন জন যেন, অতি আপন জন ! 

                 এই হুল্লোড়ের ভেতরে মনে হলো আমি বেশ খানিকটা ভাগ্যবানই বটে ! সেই বয়সের মুগ্ধতা, আন্তরিক টান, সব এমন ভাবে এসে ঝুঁকে পড়ছিল মুখচোখের উপর , তাতে যৌবনের দোলাচলকে অস্বীকার করি কিভাবে ! আমি যেন কখন সেই উত্তাল ঢেউয়ের জলে হাত পেতে দিয়েছি নির্দিধায় ।

                বেশ রাতে ফিরেছিলাম। পথে একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে নানারকমের খাওয়া দাওয়া হলো একচোট। এরপর লরি এসে পাড়ায় পৌঁছলে সকলে একে একে নেমে পড়ার পরে অলোক বললো, কী রে , যাবো নাকি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসতে ?


               বললাম, না না, একাই পারবো এটুকু, তোরা যা ।

                মলি এবং ওদের ভাগ্নি এ কথা সে কথা বলতে বলতে সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটতে লাগলো দেখলাম । শেষে বাড়ি পর্যন্ত এলোও তারা। কাজের দিদিকে ডেকেও তুললো ।

                এমনভাবেই পুজো কাটলো । পুজোর শেষের দিকটায় সাহা বাড়ির পুজোর বিসর্জনে আমার একটুখানি গুরুত্ব পাওয়ার কারণে ফোচোনের টিপ্পুনি কেটে দু' এক কথা শোনানোর হাত থেকে রেহাই পেলাম না । আমার ওদের বাড়ির পুজোর বিসর্জনের লরিতে যাওয়া নিয়ে এত বিচার বিবেচনার মধ্যে পড়লাম কেন তা আমিও বুঝে উঠতে পারলাম না । বললাম তোদেরও তো অলোক যেতে বলেছিল । তোরা গেলি না কেন, তাও তো বুঝতে পারলাম না। 

                ‌বুঝলাম এদের ভেতরে কোথাও একটা আভিজাত্যের সমস্যা আছে একে অন্যদের সঙ্গে । তবে সত্যি সত্যিই বুঝলাম না বিভাজন রেখাটি ঠিক কী দিয়ে আলাদা করলো এদের ! 

                ফোচন অবশ্য বিষয়টা এড়িয়ে গেল এই বলে , না না , আমি যাব কী করে , আমার তো ক্লাবের দায়িত্ব ছিলো বিসর্জনে । যাক , আমাদের এটাই ভালো লাগলো যে তুই বেশ মধ্যমণি হয়ে ঘুরে এলি । কোথাও তো বেরোতে চাস না , ওদের বাড়ির মানুষজন পেরেছে সেটা । এটাই আনন্দের ।

                 ওর কথা শেষ হলে আর কোনো কথা বাড়ানোর ইচ্ছা হলো না । বেশ খানিকক্ষণ চুপ করেই ছিলাম। পরে মনে হলো না , কিছু একটা বলা উচিত এদেরকে। তা না হলে এর পরেও এমন কোনো ঘটনা ওদের সঙ্গ ছাড়া ঘটলে , ওরা সেটার জন্যে এভাবেই কথা শোনাতে ছাড়বে না। তাই বললাম , ক্যান বেরোই না , যাই না বলে কি আমি যেতে জানি নে বলে মনে হয় তোগের ? তোগের ধারণায় আমি কি তোগের থে আলাদা মানুষ?

 ------ না না , আলাদা হবি কেন ? মানুষই বা হবি না কেন ? অবশ্যই মানুষ । কিন্তু সেদিন তোর এই যে কোথাও যেতে হলে , কিছু করতে হলে একটা জড়তা ভাব , সেদিন তার কিছুই আমরা লক্ষ্য করতে পারলাম না, তাই বললাম। ভালো লাগলো তো। বেশ অন্যরকমভাবে তোকে দেখতে পেলাম । তুই শুধু শুধুই ভুল মানে করছিস নিজের ভেতরে নিজেই ।

------ ও..... এই কথা .... , আমি যেটা বুঝতি পারলাম, হঠাৎ আমার এতটাই রকমফের তোগের চোখিতি ধরা পড়লো কিভাবে ? আচ্ছা ধরলাম ,  আমার না হয় একটু জড়সড় ভাব আছেই ---- তাই বলে কি ইডাই যে আমি কিছুই পারতি পারি নে ?

                 শংকর চুপ করেই থাকলো দেখলাম । তবে ফোচনের কথায় তারও যে সমর্থন রয়েছে সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারা গেল।

                 আমিও এই প্রথম নাগরিক জটিলতার প্রথম অধ্যায়ের পাঠ আয়ত্ব করলাম যেন। এবং খোঁচা খেয়ে ফোঁস করাটাও বেশ দক্ষতার সঙ্গে শিখে গেছি যে , সেটাও বুঝতে পেরে বেশ যেন একটা ভেতরে ভেতরে  গৌরববোধই হলো ।

                পুজো মিটে গেলেই ভিসা পাসপোর্ট সব কিছু ঠিক করে নিয়ে মা চলে গেল ওদেশে, ভাইকে আনার জন্যে।

                লক্ষীপুজোর পরপরই মা রওনা হলো । যাবার আগে জানিয়ে গেল, সম্ভব হলে সে একেবারে কালীপুজো হয়ে গেলে সঙ্গে দিদিমাকেও নিয়ে আসবে এবারেই। সেই মতো দিদিমাকে আগে থেকেই চিঠি লিখে জানিয়েও দিয়েছিল। সে যেন পাসপোর্ট ভিসা সব করিয়ে রাখে ।


                মা ওদেশে যাবার পর আমার কাজও বেড়ে গেছে আর একটা। সেটা হলো এত দিন যে রিক্সাওয়ালাটি গোরুর খড় দানা ভুষি এনে দিয়ে যেত সেখানে আমার যাওয়ার প্রোয়োজন হতো না। টাকাপয়সা দেওয়া নেওয়াটা মা তার হাত দিয়ে অথবা অফিস থেকে ফেরার পথেই করতো । এবার সেখানে যাবার দায়িত্বটা আমার ঘাড়েই পড়লো । তাছাড়াও থাকলো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাজার সদাই । সেটাও তো করতে হবে এই ক'দিন !

             সেই প্রথম শিখে নিলাম, বাজার করাটা কেমন করে করতে হয় ।

              সবই যেন যখন যেমন যেভাবে চলছে চলুক , এমন একটা ভাব; যা ইচ্ছা তাই জানা-বোঝাতে কোনো বাধা নেই। এটা ওটা পড়াশোনা করতেও কোনো বাধা নেই। এই যেমন ধরি না কেন, যে কোনো ম্যাগাজিন , কোনো মাথামুন্ডু জানার দরকার নেই আগুপিছু কি তার ইতিহাস , হলেই হলো। কুড়োও এবং দেখো। বোঝা না বোঝারও বালাই নেই। ভালো লাগলে ভালো, না নাগলে থাকলো ; এমনই একটা ভাব। এ বিষয়ে মনে পড়ে, আগে তো ওদেশে থাকতে এটাও জানতাম না, খবরের কাগজটিও পড়ে কীভাবে এ পাতা ও পাতা উলটে? কারণ ওদেশে থাকতে তো সে বালাই ছিলোই না। ওই প্রত্যন্ত গ্রামে খবরের কাগজ আর পাবে কোথায়? হয় মাগুরা , না হলে বাজারঘাটে । বাজার ঘাটে গেলে হয়তো আগের দিনের কাগজটা মিলতো ।শত্রুজিৎপুর বাজারে সব সময় তো আর যাওয়া হতো না। আর সেখানে ওই যে বললাম না , আগের দিনের কাগজ আসতো পরের দিনে। কখনো সখনো হয়তো হাটবাজারে দিন হলে তবেই গিয়ে একটুখানি সুধির দাদুর চা মিষ্টির দোকানে বসা । সেখানে হয়তো ভাগাভাগি করে লোকজনকে খবরের কাগজ পড়তে দেখতাম। তবে সেই কাগজের অংশ আমাদের মতো অল্প বয়সিদের পর্যন্ত পৌঁছোতে পৌঁছোতে কাগজের জানপ্রাণ আর থাকতো না ! যদিও বা কালে ভদ্রে নাগালে এসে পৌঁছাতো; তখন আর আমার কাগজ পড়ার অভ্যাস তৈরি করার ইচ্ছাটাই আমাকে ছেড়ে দৌড় লাগিয়েছে । তাই খবরের কাগজ পড়া এদেশে এসেই আয়ত্ব করেছি । আর অন্য খবরাখবর বলতে রেডিও । 

               ইদানিং দিদির বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় গেলে টেলিভিশনে খবর হতে দেখলাম । রোজ তো যেতাম না , যেদিন যেতাম সেদিনই দেখতাম । বেশি টান ছিলো সিনেমার ওপরে । সাদা কালো টেলিভিশনে সিনেমা দেখতাম । তখন রঙিন টি ভি আর কোথায় ! অন্য কোনোখানে ছিলো কি না তা জানি না । 

              বাকি সময়টা একমাত্র বই-ই ছিল হাতের কাছে। সব সময় তো আর বই পড়তে ভালো লাগে না। তার মধ্যে যে কদিন ছুটিছাটার দিনে বা তৈরি করা ছুটির দিনে ওরা এ বাড়িতে আড্ডা জমাতে আসতো। তার মধ্যে আমার সাহিত্য শিল্পের প্রসঙ্গ উঠলে ওদের সকলের জ্ঞানের প্রভাবেই প্রভাবিত হতে হতো বেশি করে । শঙ্কর বলতো , শুধু শরৎচন্দ্র পড়লেই হবে না বাবা ----- রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে । মাইকেল মধুসূদন পড়তে হবে । বঙ্কিমচন্দ্রও জানাটা বিশেষ প্রয়োজন । বিবেকানন্দের যোগগুলো একবার পড়ে দেখো । আমাদের দেশে বড় বড় দার্শনিকেরা আছেন ।তাদের বইপত্রগুলো পড়ো একবার । ওগুলো আবার বাঙলাতে সব পাওয়া যাবে না । তুই তো আবার ইংরাজীটা জানিস না, তাই তো ? এই জন্যেই তো বললাম কত করে, শক্তিসঙ্ঘের লাইব্রেরীতে ভর্তিটাও তো হলি না । টাকা পয়সা জমা রাখলে বই বাড়িতেও  আনতে পারবি । গুরুত্ব দিলি না । তুই তো ওমুখোই আর হলি না ! এরকম করলে কি হবে ? কত তুমি কিনে পড়বে বাবা বলো একবার। সব কি আর কিনে পড়া যায় ?

        

              সবার কথাই খুব মনোযোগ সহকারে শুনি । কখনোই আমি বেশি জানি বা ও আমাকে ছোটো করছে এমন কিছু ভাবতাম না । কারণ, আমি জানতাম, এরা আমার থেকে এসব অনেক বেশি জানতে পেরেছে ইতিমধ্যেই । বয়সে হয়তো আমার ভাইএর বয়সি, কিন্তু এদের জানা-শোনাটা খুব নিয়মমাফিক ও ধারাবাহিকভাবে হয়েছে । বিশেষ করে শংকরের । 

             ওর বাবা কর্পরেশনের উচ্চ পদে চাকরি করে । এ ছাড়াও ফাঁকে কিভাবে কিভাবে বুঝি না ওকালতিও করে । ওর দিদি আমার দিদির বন্ধু । বয়সে সে আমার থেকে দু' এক বছরের বড়োই হবে । সেও ল পড়ছে । ওর আরও এক ভাই ছিল । ওদেশ থেকে ফিরে এসে শুনলাম, সে নেই । 

               একাত্তরেও দেখেছি তাকে। আমার ভাই-এর সঙ্গে  সব সময় থাকতো । ভীষণ বন্ধুত্ব ছিলো । কিসে যে তার মৃত্যু হলো , তা শংকরের কাছে জিজ্ঞাসা করিনি কখনো । কারণ আজও পর্যন্ত তার অভাবটা ওদের পরিবারে একটা বিষণ্ণতার ছায়া ফেলে দেয় সে প্রসঙ্গ কেউ কখনো আলোচনা করতে গেলেই। কথায় কথায় যখনই ওর মা আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতো, কথা বলতে বলতে ছোটো ছেলের প্রসঙ্গ উঠলেই ওর মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের চোখটাও ঝাপসা হয়ে যেত দেখতে পেতাম ।

                 আশিসের পরে ওদের আর একটি ছোটো বোন আছে । সে সবে প্রাইমারি উতরে হাইস্কুলে উঠেছে । তাই সবটা মিলে ওদের পরিবারে লেখাপড়ার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে । এখন তার সঙ্গে শিল্পসাহিত্যের কতটা যোগ আছে কি নেই তা জানি না । তবু প্রথাবদ্ধ যোগ-এর গুরুত্বই তো সকলের আগে ! তবে এই জানা ও শোনার সঙ্গে দুটিরই যে খুব একটা আলাদা বা পার্থক্য আছে তেমন ধারণাও পোষোন করে না শঙ্কর। অন্তত তাই বলেই মনে হয় আমার । মুখে কোনোদিন সেই প্রসঙ্গে আলোচনা না করলেও ও জানে মনে মনে কিভাবে যেন একটা বোঝাবুঝি হয়ে গেছে ওর সঙ্গে যে, এই ধারণার পথকে আমি এড়িয়েই চলি । স্বীকার করি না, সব কিছুই নিয়মমাফিক হলেই খুব উৎকৃষ্ট কিছু হবে । বরঞ্চ নিয়মের বাইরেই যে আমি চলেছি, এলোমেলো, তা ওরা জেনেও কখনো আমার ধারণাকে ভাঙতে চায় না ওদের ধারাবাহিক জীবনের প্রভাবে। আর এখানেই সখ্যতা তৈরির একটা অন্তরালের বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে ওদের সঙ্গে আমার ।

                তবে ওর কথাবার্তা শুনে মাঝে মাঝে ভাবতাম , সত্যিই তো , এত সব জানবো কেমন করে?

কত দিনেই বা? সব কিছু সংগ্রহ করে সত্যিই কি জেনে ওঠা সম্ভব? সে ক্ষমতা কত টুকু হবে জানিনে। মাথাটা ঘুরতে থাকতো ভাবতে গেলেই । তখন মনে মনে রসিক দাদুর বলা সেই কথাটাই ভাবতাম বেশি করে । মনে মনে পথ হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকতাম , কই , শিক্ষে গুরুর দেখা আমি পেলাম কই ! এখনও তো তেমন কারোর সন্ধান পাইনি ! যে মানুষটি আমায় সত্যটা, সঠিকটা ধরিয়ে দেবে ! তাহলে কি শংকরকে দিয়েই শুরু হলো আমার শিক্ষেগুরুর দেখা পাওয়া ! শিক্ষেগুরু কি আলাদা আলাদা পথে আলাদা আলাদা রূপে দেখা দেবেন এই ভাবেই ? তাই যেই কিছু বলতে আসতো, খুব মন দিয়ে শুনতাম । সঠিক কি ভুল তখনই তার বিচারে যেতাম না । নিজের মনে ভেবে নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত নিতাম আমার গ্রহনযোগ্য কতটুকু ; তার দেওয়া এই পথের খোঁজ খবরের।

           ইদানিং বেশ কিছু কবিতা লিখেছি। সেগুলোকে কি কবিতাই বলে ! না, সে দাবিও করি না কারো কাছে। কেউ শুনতে চায়লে একের পর এক পড়ে যাই। শংকর গম্ভীর হয়ে পড়ার পরে বলে, ঐ যে তোকে বলেছি না, এসব বিষয়ে তোকে বিষদভাবে জানতে হবে। দার্শনিকতা কই? আরও গভীরে ঢুকতে হবে, তবেই না; জানতে হবে অনেক কিছু। তাহলেই দেখতে পাবে লেখার ধরনটা কাকে বলে; দেখবে জানার গভীরতা যত বাড়ছে লেখাও পাল্টে যাচ্ছে তত। তোর কথা শুনে সবটাতেই যে খুব খুশি হয় তা না। কোথাও যেন মনে হয় জানতে তো হবে, এই জানার কি শেষ আছে? কিন্তু আমার এই মুহূর্তের জানাশোনার ও তো একটা মূল্য আছে। এই চেতনার কি কোন অর্থই নেই? তার তো একটা অর্থ আছে ; সে তো সবটুকুই বাতাস নির্ভর নয় শুধু !

              মনে মনে এই কথাটাই আওড়াই আর ভাবি আজকের এই পর্বের লেখাগুলির কোনো অর্থই নেই নাকি ! সেগুলিও তো একটা অভিনিবেশের ফল !

              সবটাই মনে মনে । মুখে কাউকে কিছু বলা না। চুপ করে শোনা শুধুই সকলের কথা ।

               ফচন বিড়ি ধরায় । মনের আনন্দে বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দেয় ওরা । 

                আমি তখন উঠে গেছি কাজের দিদির সঙ্গে গোরু বাছুরের পরিচর্যায় । ওদের সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতেও হয়তো ফাঁকে ফাঁকে উঠে যেয়ে ভালো করে লক্ষ্য করি গোরুগুলি এগারোটার গুড়ের সরবত পেলো কি না। তার আগে তাদের একচোট স্নানধান করার একটা হুরদাম পর্ব তো ছিলোই। কল থেকে দিদির সঙ্গে সঙ্গে জল তুলে দেওয়া এবং স্নান করাতে করাতে ওদের ঘরের মেঝেগুলি পরিষ্কার করে দেওয়ায়ও একটু বেশি মনোনিবেশ দেওয়া বেড়েছে ; সরবত খাওয়া হলে ওরা যখন মহা আরামে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটা শুরু করে তখন আমারও স্নান টান করা এবং কেউ না থাকলে সেই বারান্দার কোণাটায় বসে বসে একা একা জাবর কাটাই যেন শুরু করা ! আর কী যে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকা ! কাজের দিদি তখন এক কাপ চা করে দিয়ে রেখে যায় নিঃশব্দে । তারপর সে সংসারের কাজকর্মে ব্যাস্ত হয়ে যায় । আমি তখন একেবারে একা । মনে মনে কতবার কতদিকে কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়াই তার  কোনো সীমারেখা টানার কেউ নেই চারপাশে । যার মধ্যে বেশির ভাগটাই ফেলে আসা ওদেশের নানা সময়ের সঙ্গে ছোটাছুটিটাই বেশি। সেখানে কখনও আসে মলন মলার হুড়োহুড়ি তো কখনও থাকে ফসলের মাঠের ভেতর এ মাথা থেকে ও মাথা ফসলের ক্ষেতের ভেতর থেকে ফসল কাটা হয়ে যাবার পরে এ মাথায় ও মাথায়  ঘুরে ঘুরে ফসলের ভাগ বুঝে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠের হাওয়া বাতাসে মন খুলে ঘোরাঘুরি। কখনো পাট বন থেকে পাট কেটে নেবার পরে পাটের গাদা দেওয়া এক একটা অংশ থেকে গুনে গুনে ভাগ বুঝে নেওয়া । আবার কখনো পাট বন থেকে ঘাস কেটে আনতে যেয়ে ক্ষেতের পাশের আলের উপর বসে থেকে হাওয়া খাওয়া । কিম্বা কল্যাণীর সঙ্গে চারদিক বৃষ্টির জলে ভেসে যাওয়া অবস্থায় ছাতা মাথায় দিয়ে নৌকোর দুই মাথায় দুজনের মাছ ধরতে বসে থাকার অপেক্ষার সময়গুলোর কথা ভাবতে থাকা ।

             এসবের মধ্যেই কখন বেলা গড়িয়ে যেত, হয়তো কাজের দিদি কয়েকবার বলেওছে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার কথা , তাতে কোনো হুঁশই নেই যেন ।

               তখন মনে হতো সদ্য পড়ে ওঠা শরৎচন্দ্রের বড় দিদি উপন্যাসের সেই শুরুর কথাগুলো : যেভাবে তিনি বলছেন , '' এ পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আছে , তাহারা যেন খড়ের আগুন । দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেও পারে , আবার খপ্ করিয়া নিভিয়া যাইতেও পারে । তাহাদিগের পিছনে সদা সর্বদা একজন লোক থাকা প্রয়োজন--- সে যেন আবশ্যক অনুসারে খড় জোগাইয়া দেয়।

                গৃহস্থ কন্যারা মাটির দীপ সাজাইবার সময় যেমন তৈল দেয় । প্রদীপের ক্ষুদ্র কাঠিটির তখন বড় প্রয়োজন -- উসকাইয়া দিতে হয় , না হইলে তৈল এবং সলিতা সত্ত্বেও প্রদীপের জ্বলা চলে না ।

              সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃতিও কতকটা এইরূপ । বল , বুদ্ধি , ভরসা তাহার সব আছে , তবু সে কোনো কাজ সম্পূর্ণ করিতে পারে না । খানিকটা কাজ যেমন সে উৎসাহের সহিত করিতে পারে , বাকিটুকু সে তেমন নীরব আলস্যভরে ছাড়িয়া দিয়া চুপ করিয়া থাকিতে পারে । তখনই একজন লোকের প্রয়োজন --- সে উস্কাইয়া দিবে । ''

               কদিন আগে পড়ে ওঠা শরৎচন্দ্রের বড় দিদি উপন্যাসটির সুরেন্দ্রনাথ চরিত্রটির মধ্যে নিজেকেই যেন খুঁজে পেলাম বলে মনে হলো ।এই কথাগুলি যেন আমার স্বভাবের সঙ্গে কোথায় যেন মিলেমিশে মুখলুকোতে চাইছে বুঝি । শরৎচন্দ্রের এই কাহিনীর সত্য যেন আমাকে মিলিয়ে-মিশিয়ে ফেলিয়ে একটি সুরে আ...আ.. করে উঠলো খানিকটা দীর্ঘলয়ে । মনে হলো কে যেন বা খুব সকালে উঠে গলা সাধতে বসেছে ।

             মনে পড়ছিলো তাঁর লেখাটি :  ' শুধুমাত্র উস্কাইয়া দেবার মানুষটি যেখানে দেখা দিয়াছে .....' সেখানেই তা খানিকটা হয়তো বাস্তবায়িত হয়েছে বাকি টা সেই কালের গহ্বরে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে থেকেছেই শুধু ---- কাল তো কারো অপেক্ষায় বসে থাকে না কখনোও ; সে তো তার আপন ছন্দে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়েই চলবে ! তুমি তার ফেনা টুকুও আঁজলা ভরে তুলে না রাখতে পারলে সে তো তার এই মুহূর্তের ঢেউকে আর ফিরিয়ে পাঠাবে না তোমায় , কখন তুমি তীরে এসে দাঁড়াবে তাই বলে কি সে সুদূরে মেলাবে না !

                   আজ কদিন রসিক দাদুকে একখানা চিঠি লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়ে ওঠে নি । সেই সঙ্গে দিদিমা কেও । অথচ ক মাস তো হয়ে গেলো এসেছি যে।এও কি সেই বড় দিদি উপন্যাসের সুরেন্দ্রনাথ চরিত্রের মতো ?

                অথচ যাদের কথা ভেবে ভেবে প্রত্যেকটা দিনই তো কাবার করে দিই ! 

                 তবু এইটুকু কি কেউ আমার কাছে আশা করতে পারে না ?


                তাহলে আর বলছি কেন , এই আমি যে আমিকে নিয়ে এত ভাবছে , সেই আমি কি শুধুই একা একটা আমি ? তার সঙ্গে আরো কত আমির যে সমারোহ ! তাতে যারা যারা যারা প্রতিনিধিত্ব করে ছিল সময়ে অসময়ে , তাদের বাদ দিয়ে এই আমি কি সত্যিই সম্পূর্ণ ?

                আর তা যদি না হবে তাহলে সময়ে সময়ে এই সমস্ত কর্তব্যবোধ থেকে এই আমি কেন এমন ভাবে পিছিয়ে পড়ে !

              এখন শুধু সে কথাটাই মনে হয় । সমস্ত জীবন ধরে জিজ্ঞাসা করেও কি তার দায়ভার নেওয়ার লোক কেউকে পেয়েছি ? কোই সে নিষ্ঠার সঙ্গে দেখা হলো কোই ?

                 হয়তো কেউ কেউ আসতে গেছিলো । কেউ কেউ এসেছিলো ও হয়তো ;  কিন্তু তাতেও কি সবটা ছিলো ? 

               না , ছিলো না ।অর্থাৎ ভার কেউই নিতে আসে না । অথচ আমিও অবিবেচকের মতো শুধু দুহাত পেতে বসেই থাকলাম শুধু , সেটুকুই পেতে !

             কোথায়ই বা সম্পূর্ণতা পায় এমন স্বভাব , যার অমনযোগী আরাদ্ধ পথে হোমকুণ্ডু জ্বালাবার জন্যেই প্রকৃত অর্থে এগিয়ে এসেছিল কেউ!  তাদের অন্য কোনো প্রয়োজন কি সত্যিই ছিলো না !


***********************************************************************************************

আগামী পর্বে

***********************************************************************************************


হামিদুল ইসলাম



হামিদুল ইসলাম / দু'টি কবিতা

কথা 








সব কথা ছুড়ে দিই দূরে 

তবু কিছু কথা থেকে যায় বুকের ভেতর 

কথাসব আত্মময় ।


কখনো কখনো চালান হয়ে যায় 

দুপুরের ঝড় 

বিকেলের কথাগুলো বর্ষা পায়ে ফিরে আসে বুকের ভেতর  

অনঘ হিমের অক্ষরে লেখি প্রচ্ছন্ন আঁধার ।


অদূরে নীলাঞ্জনা স্রোত 

বিষণ্ণ চিলের হাঁকডাক 

আমার বুকের ভেতর ঋতুমতী প্রিয় সকাল 

ভালোবাসার একগুচ্ছ ক্লোরোফিল ।


এখনো বাতাস ভারি 

একাকীত্বের পসরায় গালিচা পাতি 

ঠুনকো কথাগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ে অনিকেত উচ্চারণে।


রিক্তহস্তে কুড়িয়ে রাখি সব কথা 

বিবর্ণ রোজনামচায় আত্মময় হয়ে ওঠে কথার উৎসব ।










রক্ত গোলাপ 

আজও ভাতগাছে চাঁদমাখা দিন 

দলিত উবাচ গন্ধ বণিক 

আজও আঁচল পেতে কুড়িয়ে রাখি অনশ্বর স্মৃতির শৈশব ।


জেব্রা ক্রসিংয়ে রাতের ব্রেক আপ 

ডাউন ট্রেণে বিলাস যাপন 


কাকতাড়ুয়া জীবন ভেঙে দেখি আমিও এক দুরন্ত ট্রেন  ।


জীবন অথৈ সংগ্রাম 

রোদ ঘাম জলে জেগে ওঠে পৌরুষ 


আজও লক আপ গেট ভাঙে হাজার হাজার নিরন্ন শ্রমিক ।


জনস্রোতে ভিজে যায় শহর 

ভেজে বিক্ষোভ ত্রাস 


পদতলে লাল লাল পিঁপড়ে। লাল আবির মেখে হাসে রক্ত গোলাপ ।

নাবাল রক্তে সন্ধ‍্যে নামে রোজ 

উড়ে যায় মিথুন হাঁস 


বলেছিলাম আমাদেরও একদিন দেখা হবে বিমূর্ত কবিতায়।


*********************************************************************************************************



হামিদুল ইসলাম

জন্ম পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। ছোটোবেলা থেকেই লেখালেখি। স্কুলের একটি ম‍্যাগাজিনে প্রথম কবিতা প্রকাশ। কলেজ লাইফে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অনিয়মিত লেখালেখি। স্নাতকোত্তর শেষে একটা ছোটো কাজ। লেখা নেশা। রক্তের সাথে মিশে আছে । এ যাবৎ এগারোটি একক কাব‍্যগ্রন্থ---- @ হৃদয়ে তুমি @ প্রথম কদম ফুল। @ কেষ্টপুরের কেয়া মল্লিক। @ এই সময় অস্থির সময়। @ রমা রায়। @ শব্দে সাজাই কবিতা।@ বেলাভূমি। @ ঈশ্বরের হৃদয়ে জলের শব্দ। @ নীল সমুদ্র। @ অতল জলের বসত। @ বলয় গ্রাস। 
তিনটি ই কাব‍্যগ্রন্থ। @ এখানে আকাশ।@ হৃদয়ভূমি @ আরশিনগর। এছাড়া আছে বেশ কিছু অপ্রকাশিত নাটক ও উপন‍্যাস। 

গল্প * মল্লিকা রায়



বুধবার ! দুপুর 2.38 

মল্লিকা রায় 


তখনো টিপ টিপ বৃষ্টি সাইড ব্যাগ থেকে ছাতাটা টেনে বার করে খুলে ধরে মাথার ওপর। ছোটবেলা থেকেই প্রত্যয়ী,আত্মবিশ্বাসী বিদেশি সংস্থায় কর্মরত কেয়া।বাবা, ছোট ভাই আর ঠাম্মির সংসারের হাঁ'মুখ গুলো দিনান্তে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকেই। ক্লাশ ফোরের মংলু গোটা পরিবারের দায় সম্পর্কে এখনও অজ্ঞ। সময় মতো খাবারটুকের আশায় মুখিয়ে থাকা বিরাশির বাবার চোখের কোনে চিকচিকে অশ্রুর ফোটা দেখলেই ওড়না দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে কেয়া। মাথা নেড়ে বোঝাতে চায় - না বাবা এসব করতে নেই। দিনের তিনভাগ কাটে ঠাম্মির ঠাকুর দেবতার ঘরে। তাদের জাগানো,বিছানা গোছানো,থাল্ বাসন ধোওয়া,সিংহাসন পরিস্কার করা,জামা কাপড় ধোওয়া,ফুল তুলসি সংগ্রহ, ঘর ধোঁওয়া মোছা কত কি, ভোর পাঁচটা থেকেই শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম-ছোটকাল্ থেকেই ঝিম্ মেরে শুনত বিছানাতেই। মা তখন রান্নাঘরে আটায় ময়াম দিতে ব্যাস্ত। দশ দশটা পাত্। ঢেউ খেলানো কাঁসার বাটিতে গুনে গুনে মেট্রোর দুধ আর তিনটে করে রুটি সাজিয়ে রাখা খাবার টেবিল। চেঁচিয়ে বলতেন জাম্ বাটিরটা রাখিস ওর শোবার ঘরের টেবিলে অর্থাৎ ওর বাবা, গটগটে তেত্রিশ। স্যুট বুটের পদস্থ সরকারি অফিসার। তার প্রাত:রাশ থাকত শুধুমাত্র রবিবার। রান্না ঘর থেকে ভেসে আসত অদ্ভুত ভাতের গন্ধ। সেই গন্ধ আজ আর পায়না কেয়া। প্রসবাসন্ন মা হাঁটতেন ওকে ভর করে। ক্লাশ নাইনের ও জানত না বিষয় আষয়, সংসার ধর্মের গুরুত্ব। মাছ নিয়ে তখনো রাগারাগি। ল্যাজাটা,মুড়োটা কেন বাড়ির পুরুষেরা খাবে। ওর তো ইচ্ছে হয়। তিন কাকা জেঠুর একত্রিত বিশাল পরিবারে হৈ হল্লা আনন্দ মজা সে-কি কম কথা। ভাই বোন খেলা ধূলো কাকা জেঠুর কাছে বায়না আবদার - সে এক অন্যরকম ব্যাবস্থা। ধীরে ধীরে ভেঙে গেল সব চোখের সামনে।দু'দিনের সামান্য জ্বরে দাদাই বিদায় নেবার পর বিয়ের দু'মাসের মাথায় মেজ্'কা শিফ্ট করল শ্বশুরের দেওয়া নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে। ছোট'কা ভাড়া বাসায়। গাড়িতে উঠে বিদায় জানাতে সে কি দুরবস্থা। কেউ কারুর হাত ছাড়ে না। টেনে পৃথক করা হয়েছিল ওদের ভাইবোন তন্ত্র। আর জেঠু অর্থাৎ কেয়ার বাবা জমি জায়গা সব বেঁচে কেনে ভাইদের দেনা শোধ করে একফালি ঘর বারান্দা আর একরাশ অশ্রু নিয়ে আজো ছলছল্ করে থাকে। বোঝেন না বিষয় সম্পত্তি কি নিদারুণ জিনিস। কেয়ার রাগ হয় খুব। ভাই বোন নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া লোকটার পরিবার তন্ত্র নিয়ে এত হা' পিত্যেশ করার কারণটা কি? যখন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে সম্পর্ক নামক জটিলতার শেকড়ে মুড়িয়ে অসম্মাণ,বেদনা ছাড়া কোন প্রাপ্তি শূণ্য যেখানে, এই বৃদ্ধ কবেকার সেই রদ্দি মাটিতেই গ্রোথিত করে রেখেছে যাবতীয় পারিবারিক মূল্যবৃদ্ধি। কেন বোঝেন না শিশুকাল প্রাণীর একটি নিয়মমাত্র - সময়ের সাথে সাথে যা লুপ্ত হয় নৈমিত্তিক চেতনাবোধের সঙ্গে। বুঝতেই চান না বৃদ্ধ। পেছন থেকে এসে জাপটে ধরা চোখ সেই ফুটফুটে নাতি ধুতির কোঁচ খুলে দিয়ে সিঁড়ির তলায় লুকোনো। চেঁচিয়ে বলতেন "ওরে শয়তান আমি তোর প্যান্টালুন দেখতে পাচ্ছি,

"না না বৌমা, ওকে খেলতে দাও" ওর মায়ের হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে সে কি দৌড়াদৌড়ি। নাতিতে দাদুতে সে এক সাঙ্ঘাতিক মঞ্চায়ন। 

হয়তো সেই দিনটার কথাই -।

"সাবধানে দিদি" ! পাশ ঘেঁষে বেড়িয়ে যায় একটা ছোট মারুতি। বর্ষাকাল,জমা জল কাদা কাপড়ে ছিটে একাকার পাশে চোখ পড়তেই।

"হ্যাঁ দিদি আর একটু হলেই - "

"হ্যাঁ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম - আজ আর অফিস যাওয়া হল না অগত্যা, আপনাকে তো ঠিক -"

"চিনলেন না তাইতো "

হ্যন্ডসাম না হলেও চলন বলনে বেশ একরকম মিষ্টতা আছে। চেনা লাগছে খুব -

সাহিত্যিক ঋষভ সেন! প্রবাসে থাকি। 

"রোদ্দুর" উপন্যাসের জন্য সেরা জীবনানন্দ এওয়ার্ড পেয়েছেন শীর্ষে এসেছেন সম্প্রতি। এখানে কেন, জানতে চাইলে -

"এমনিই"

হাত নেড়ে একগাল হেসে উত্তর দিলেন।

"আরে না না, এসেছি একটা কাজে, সপ্তাহখানেক লাগবে,দেখলাম আপনি বেশ অন্যমনস্ক একটু হলেই পড়তেন গাড়ির তলায়"।

"উপন্যাসটি পড়ে ফ্যান হয়ে গেছি আপনার। উ: কি সাঙ্ঘাতিক মহিলা দর্শন। উদ্বুদ্ধ হলাম "।

পাঁচ ফর্মায় ক্লিপিংস করা, একটা শুকনো গোলাপ তাতে -

" এই দেখুন "

একথা সত্যি, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীদের পার্সেন্টেজ চালু হলেও উপকৃত হয়নি এক চতুর্থাংশ। অদ্ভুত এক সামাজিক বেড়াজাল তৈরী করে তাদেরকে রাখা হয়েছে ব্রাত্য করে। সবথেকে দু:খের বিষয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কৃত সাফল্যকেও ! একদল স্বার্থান্বেষী পুরুষ নিজেদের সুবিধার্থে এদেরকে প্রচারে আনতে অপারগ। বেনো জল ঢুকে গেছে পরিচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থায় "। 

"আপনি একথা ভাবেন জানি এবং গভীরভাবেই, কি আশ্চর্য দেখুন ! একদল নারী ঘাম রক্ত ঝরিয়ে কি কঠিনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে নিজের পরিস্থিতি, অপরদিকে আর একদল নারী হয়েও _ উচ্ছসিত কেয়া।

"আর প্রকৃতপক্ষে এরাই সমাজ,সংসারের প্রকৃত শত্রু, উন্নয়ন বিমুখ সহজলভ্যে অভ্যস্ত,কর্মবিমুখ এরাই আপনাদের উন্নতির প্রধান অন্তরায় - এ্যম আই রাইট !

ঋষভ আর দৃষ্টিতে বুঝে নেয় কেয়ার মানসিক পরিস্থিতি - বেশ উজ্জল চেহারায় দুর্দান্ত আভিজাত্য,একরাশ জলকাদা মাখা এ অবস্থা যদিও প্রেমালাপের পক্ষে মোটেই সঠিক পরিস্থিতি নয়। তথাপি পরিবেশটা অনেকটা রোমান্টিক লাগছে ঋষভের। আকাশে সাদাকালো হালকা মেঘের আস্তরণ, নামবো নামবো করেও সময় নিচ্ছে বৃষ্টি। স্নানসিক্ত প্রকৃতি ঘন, কচি সবুজে পরিপূর্ণ। লাল,হলুদ,গাঢ় নীল ফুলের রাশি ছড়িয়ে উদ্বেলিত করে চলেছে আকাশি আমন্ত্রণকে। পথ ঘাটে এতটুক ধূলা ময়লা নেই। ঘনিষ্ঠ হয়ে প্রেম জমাবার এইতো সঠিক মুহূর্ত। দু' কলি গুনগুনিয়ে ওঠে আপন মনে। 

" মন মোর মেঘের সঙ্গী - আপনি গানও জানেন? মুচকি হেসে ওর দিকে তাকায় কেয়া।

হুম্ - জানি মানে ফাটাফাটি "

"একগোছা টকটকে গোলাপ দিন না আঙ্কেল " রাস্তার একপাশে অন্ধ ফুলওয়ালার দিকে হাত বাড়ায় ঋষভ। রজনী, হাস্নুহেনা, বিবিধ ফুলের সমাহার চলতি শহরটাকে যেন মনে করিয়ে দেয়, ফুলের মত স্বচ্ছ পবিত্রতা আর কোথাও নেই। সত্যিই তাই। প্রায় প্রতিদিন ওর ভাসে টাটকা ফুলের তোড়া না থাকলে মন ভালো থাকেনা ঋষভের। জানে বাড়ির সকলে। ওর ভুল হলেও ভুল হয়না বেনু কাকার। বাজার থেকেই চলে আসে বিনা লিস্টিতে।

চমৎকার লাগছে ' হালকা খোপায় টকটকে আধফোটা কুড়ি অনেকটা সেই রবীন্দ্র না জীবনান্দ -

"তোমার চুলে যে রোদ- মেঘের মতন চুলে তোমার চোখে যে রোদ- সেও যে মেঘের মতো চোখ কেমন বৃষ্টি ঝরে- মধুর বৃষ্টি ঝরে ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে- রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ - "

জীবনানন্দ - আমার ফেভারিট উচ্ছসিত কেয়া, থমকে দাঁড়ায় দু'জনা। খুব কাছাকাছি। টিপটিপ বৃষ্টি গুড়ো বরফ হয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে প্রেম বর্ষণ। আধো অন্ধকার ঋতু ঘটায় আচ্ছন্ন দু'টি মানুষ মানুষী।

থাক না " চেপে ধরে ডান হাতটা কেয়ার। বার করা হয়না ছাতা ব্যাগেই রয়ে যায়।


ঐ যে ফেরার পথ ! বুধবার ! দুপুর 2.38 হাত ঘড়ি দেখে নেয় কেয়া।












************************************************************************************************



মল্লিকা রায়

স্কুল ম্যাগাজিন থেকেই লেখালেখি শুরু। পরে বিবিধ পত্র পত্রিকায় ছোট গল্প,কবিতা এবং শুকতারায় লেখা প্রকাশিত হয়। পরে সাহিত্যের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। দুটি কবিতা সংকলন "ভালোবাসা ও কবিতা সংকলন" এবং তিনটি উপন্যাস সহ "একের ভেতর তিন " অনলাইন শপিজেন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় 2021 সালে। অনলাইনে লেখালেখিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাংলা কবিতা আসরে 2000 কবিতা আছে। প্রতিলিপি সাইটে গল্প উপন্যাসসহ বহু লেখালেখি সংরক্ষিত রয়েছে। আর্থিক পরিস্থিতি উন্নত না হলে খরচ বহন করা সম্ভব নয়।


গল্প * দেবাংশু সরকার

 



ফিরে  পাওয়া  

দেবাংশু সরকার 

                         

                           এক

   

ইয়ার প্লাগটা কানে গুঁজে নিজের মনে গান শুনতে শুনতে হেঁটে চলেছে কুন্তল। শুধু গান শুনছে না, সেই সঙ্গে শিষ দিতে দিতে চলেছে সে।

 "কুন্তল দাঁড়াও। কুন্তল। মিস্টার হ্যামলিন। ও বাঁশরিয়া, দাঁড়াও।" চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসছে সাথী। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে কুন্তলের হাতটা ধরে। ঘুরে তাকায় কুন্তল। কান থেকে ইয়ার প্লাগটা খুলে পকেটে রাখে।

  - থামলে কেন আমার কেষ্ট ঠাকুর? বাজাও তোমার বাঁশি।

  - কি হবে বাঁশি বাজিয়ে! সামনে যমুনাও নেই, কদম গাছও নেই।

   - কে বলেছে নেই? আছে, আছে, সব আছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো। আমার কাজল কালো চোখে তোমার যমুনার কালো জলকে ঠিক খুঁজে পাবে। দেখো, একেবার তাকিয়ে দেখো।

      - ওগো কাজল নয়না হরিণী, যমুনাতো দেখালে, কিন্তু কদম গাছ?

      - সেটাও আছে। মনের চোখ দিয়ে দেখো, ঠিক খুঁজে পাবে।

     - সে না হয় আছে। কিন্তু সমস্যা যে অন্য জায়গায়!

      - কি সমস্যা?

      - রাধাটা যে ছিটিয়াল! কখন কি করে বসবে কেউ জানে না। একেবারে আনপ্রেডিক্টেবেল!

      - এই আমাকে রাগানোর চেষ্টা করবে না। তাহলে আমি বাড়ি ফিরে যাবো।

      - বাড়ি যাবে? চলো আমিও যাবো। এখনো কাকু কাকিমার সঙ্গে আমার আলাপ হলো না।

      কোনো উত্তর না দিয়ে চলতে চলতে কথা থামিয়ে সাথী গান ধরে,

      "সখী ভাবনা কাহারে বলে,

      সখী যাতনা কাহারে বলে...।"

      চমৎকার গানের গলা সাথীর। গেয়ে চলেছে সে,

       "...সখী ভালোবাসা কারে কয়..."

      গলা মেলায় কুন্তল,

      "সেতো অ্যাড্রিনালিন ক্ষয়।"

      গান থামিয়ে লাফ দিয়ে দু ফুট সরে যায় সাথী। তর্জনী তুলে গর্জন করে, "চুপ করো, শব্দহীন হও।" পরক্ষণেই আবার কুন্তলকে বলে, "একটা গান গাও। প্রেমের গান, ভালোবাসার গান। কাছে টানার গান।"

      - গান গাইতে গেলামতো। তুমি থামিয়ে দিলে কেন?

      - ইয়ার্কি মেরো না। গাও একটা গান। তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো, একবার গান গেয়ে বুঝিয়ে দাও।

      গান ধরে কুন্তল,

      "তোমায় কি কোনো দিন বলেছি,

       ভালোবাসি আমি তোমাকে?

       কেন তুমি ভেবে নিলে,

      তোমার প্রেমিক আমাকে?..."

      কুন্তলের গান শেষ হতেই, সাথী গান ধরে। একই সুরে, একই ছন্দে, একই লয়ে। কিন্তু ভিন্ন কথায়।

      "মোট, কজনকে তুমি বলেছো,

      ভালোবাসি আমি তোমাকে?

      এখন দেখি, সুযোগ বুঝে,

      লেঙ্গি মারছো আমাকে।"

      এবার কুন্তল চেঁচামেচি জুড়ে দেয়, "এই না, না, একদম বিলো দ্য বেল্ট হিট করবে না।"

      "কেন? তুমি দশ হাজার বার ম্যাসেজ করে জানিয়েছো আমাকে ভালোবাসো। দশ লাখ বার হোয়াটস অ্যাপে লিখেছো আমাকে ভালোবাসো।  দশ কোটি বার আমার কানে কানে বলেছো আমাকে ভালোবাসো। আর এখন উল্টো সুর গাইছো! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা!" পাল্টা ধমকানি দেয় সাথী।

      - ঠিক আছে, আর একটা ভালোবাসার  গান গাইছি। একটু পুরানো গান। তবে খুব হিট গান।

      "তুমি এসেছিলে পরশু,

      কাল কেন আআসোওওনি?..."

      গানের সাথে শরীর দোলাতে থাকে কুন্তল। সাথী হাত পা ছুঁড়ে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে।

      তপ্ত দুপুরে, নির্জন রাস্তায়, বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন দুজন, নিজেদের মধ্যে একাত্ম হয়ে হেঁটে চলেছে। কিছু হাসি, কিছু গান, কিছু রাগ, কিছু অনুরাগ, কিছু এলোমেলো কথাকে সঙ্গী করে। একেই কি বলে প্রেম? 


                          দুই 

    

       পাড়ার লোকজন বলাবলি করে রজত বাবু জীবনে কিছু করতে পারুক বা না পারুক ছেলে দুটোকে মানুষের মত মানুষ করেছেন। বড় ছেলে কল্যাণ  এম, এ, পাশ করে একটা কলেজের লেকচারার। সেই সঙ্গে প্রচুর ছাত্র ছাত্রীকে প্রাইভেটে পড়ায়। কল্যাণের ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়ে তাদের বাড়ি সকাল সন্ধ্যায় গমগম করে। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সে বেশ জনপ্রিয়। সেটা কেবল মাত্র ভালো পড়ানোর জন্য নয়। প্রতি বছর সে ছাত্র ছাত্রীদের কাছে পিঠে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায়, সম্পূর্ণ নিজের খরচায়।

      অন্যদিকে রজত বাবুর ছোট ছেলে কুন্তল আই আই টি খড়্গপুরের ছাত্র। তার পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। এরমধ্যে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে। পড়াশোনা শেষ হলেই সে পাড়ি দেবে আমেরিকায়। বেশির ভাগ সময়েই তাকে খড়্গপুরে থাকতে হয়। অবশ্য মাসে দু এক দিনের জন্য সে বাড়িতে আসে। তখন সে হৈচৈ করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে। মিশুকে স্বভাবের ছেলে কুন্তল তার দাদার ছাত্রদের সঙ্গে মিলে মিশে আড্ডা দেয়। এমন একদিন কুন্তলের সঙ্গে দেখা হয় সাথীর। কলেজ পড়ুয়া সাথী কিছু দিন হলো কল্যাণের কাছে পড়তে এসেছে। দৃষ্টি বিনিময় হয় দুজনের। কল্যাণের আরো অনেক ছাত্রীর সঙ্গে কুন্তলের আগে আলাপ পরিচয় হয়েছে। তাদের সঙ্গে সে কথা বলেছে, মজা করেছে। কিন্তু আজ কেমন যেন অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে তার। কি রকম সে নিজেও বুঝতে পারছে না। তার চোখ আটকে গেছে সাথীর চোখে। দুজনেই চুপ করে আছে। কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। যেন দুজনের স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে অজানা কোনো শ্রোত বয়ে চলেছে। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মত। কেউ এগিয়ে আসতে পারছে না। আবার পিছিয়ে যেতেও পারছে না। অর্থাৎ দুজনেই আক্রান্ত হয়েছে প্রেম রোগে। অবশেষে দুজনের সম্বিত ফেরে অনান্য ছাত্রদের কোলাহলে। এরপর যখনই কুন্তল বাড়িতে আসে, দুজনকে একত্রে দেখা যায় কোনো পার্কে, কোনো নির্জন রাস্তায়।

      প্রতি বছরের মত এবারেও কল্যাণ ব্যবস্থা করেছে তার ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে বাৎসরিক ভ্রমণের। এবার তারা যাবে পুরুলিয়া। কুন্তলও এবার যাবে বলেছে। আগে কোনো বার না গেলেও, এবারে সে ভীষণ আগ্রহী এই ভ্রমণের ব্যাপারে। আসল কারন অন্য হলেও, মুখে বলছে, সামনের বছর সে বিদেশে চলে যাবে। আবার কত বছর পর সে দেশে ফিরবে তার ঠিক নেই। সেই জন্য সে এই দু দিন ওদের সঙ্গে আনন্দ করতে চায়।

      বেশ সকালেই বাস ছেড়েছে। যেতে হবে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটারের মত। ছাত্র ছাত্রীরা গান গেয়ে, হৈচৈ করে মাতিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে কুন্তলও গান গাইছে। ক্রমশ সহর, সহরতলী ছেড়ে বাস এগিয়ে চলেছে লাল মাটির দিকে। লক্ষ বড়ন্তি লেক হয়ে গড় পঞ্চকোট। সেখানের এক রিসর্টে রাত কাটিয়ে পরের দিন ফেরা। ছুটে চলেছে বাস, ক্রমশ মাটির রং পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে আকাশের রং। একটা দুটো করে দেখা মিলছে পলাশ গাছের। যত এগিয়ে আসছে বড়ন্তি লেক, তত বাড়ছে পলাশ গাছের সংখ্যা। বাস দাঁড়ালো বড়ন্তির কাছে। শয়ে শয়ে পলাশ গাছ লালে লাল হয়ে উঠেছে। পলাশ রাঙা প্রকৃতি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। পলাশের রূপ দেখে বিমোহিত হয়ে উঠেছে সবাই।উচ্ছ্বসিত সাথী কুন্তলকে প্রশ্ন করে, "হোলি কবে?"

 - এখনো সাত দিন দেরি আছে।

- কিন্তু ওখানেতো হোলি খেলা শুরু হয়ে গেছে।

- কোথায়?

      - ঐতো ওখানে। দেখো, দেখো, ভালো করে দেখো পলাশের থেকে আবির নিয়ে মেঘ বালিকারা রং খেলছে আকাশ গঙ্গায়। যাবে, ওখানে যাবে? ওদের সঙ্গে রং খেলতে?

      - কি ভাবে যাবে?

     - চলো না যাই দুজনে। সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে। পলাশ রাঙা, রঙের বন্যায় আমার মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। তুমি যাবে?

     - সাথী তোমার ব্যাগে জলের বোতল আছে?

     - পিপাসা পেয়েছে?

     - না, পিপাসা পায় নি। তবে তোমার বকম বকম শুনে খুব পেট কামড়াচ্ছে। দেখি যদি জল খেলে কমে!

     - ধ্যাৎ!


                         তিন

 

দেখতে দেখতে দিন এসে গেল কুন্তলের আমেরিকা যাওয়ার। উজ্জ্বল ভবিষ্যত তাকে হাতছানি দিচ্ছে। বাড়ির সবাই খুব আনন্দিত।কেবল কুন্তলের মা কিছুটা মন মরা। কুন্তল তার মাকে বোঝায় যে পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজ। ফোন করলেই তার সঙ্গে কথা বলা যাবে।   এমনকি তাকে দেখাও যাবে। তাছাড়া বড়দিনের ছুটিতে সে বাড়ি আসবে। আরো একজনের মন খারাপ। মাঝে মাঝেই কয়েক ফোঁটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে নেমে আসে। এতো দুরে যাচ্ছে কুন্তল! তাকে ভুলে যাবে নাতো? অন্য কেউ এসে যাবে নাতো কুন্তলের জীবনে? 

     কুন্তল সাথীকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। বলে, "চলো না আমার সঙ্গে। একটা নতুন দেশে গেলে তোমার ভালো লাগবে। আমারো ভালো লাগবে। ভয়ের কিছু নেই। ওখানে অনেক ভারতীয় আছে। এমনকি বাঙালীও আছে। যাবে?"

      - আমার গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট হতে দাও। তারপর না হয় পরের বছর দেখা যাবে।

     লাগেজ গুছিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে কুন্তল। শুরু হয় তার কর্মজীবন। কুন্তলের মনে হয় বড় অদ্ভুত এই দেশ। কাজ, কাজ, আর কাজ। সবাই ব্যস্ত কাজ নিয়ে। গল্প, আড্ডা, ঘোরা বেড়ানোর সুযোগ যে নেই তা নয়। তবে সব কিছু কাজের পরে। অলসতার কোনো জায়গা নেই এখানে। হয়তো সেই জন্যই দেশটা এত উন্নতি করেছে। কাজের মধ্যে থেকে সময় যে কখন কেটে যায় সে বুঝতেই পারে না।

      প্রায় পৌনে দুবছর চাকরি করার পর বড় দিনের এক মাসের ছুটিতে দেশে ফেরে কুন্তল। হৈ হুল্লোড়ে মেতে ওঠে। সাথীর সঙ্গে চলে গল্প, আড্ডা, বেহিসেবি ঘুরে বেড়ানো। আনন্দের দিনগুলো যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। সময় এসে যায় তার কর্মস্থলে ফেরার। এবারেও সে সাথীকে বলে, "চলোনা সাথী আমার সঙ্গে। খুব সুন্দর জায়গা। এখানের থেকে অনেক ফাঁকা, নিরিবিলি। প্রচুর বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়ে গেছে। সেখানে গেলে যেমন উন্নত জীবন যাত্রা পাবে, তেমন বাঙালি পরিবেশ পাবে।"

      "না। বিদেশে যেতে ইচ্ছা করছে না। শুনেছি, বিদেশের এয়ারপোর্টে চেকিংয়ের নামে বিশ্রিভাবে গায়ে দেয়। শুনেই লজ্জায় আমার চোখ, কান বন্ধ হয়ে আসছে। যাবো কি করে? না, না, বাবা ওসবে আমি নেই। তার চেয়ে ভালো তুমি ফিরে এসো। এদেশে কি চাকরি নেই? নাকি এদেশের লোকজনরা কাজকর্ম করে না। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ওখানে আয় বেশি। তেমনি খরচও বেশি। তার চেয়ে ভালো পাকাপাকি ভাবে দেশে ফিরে এখানেই কিছু করো।" উত্তর দেয় সাথী।

     কিছুতেই রাজি হয় না সাথী। অগত্যা কুন্তল আবার একাই ফিরে যায়। আমেরিকা থেকে সে মাঝে মাঝে বাড়িতে এবং সাথীকে ফোন করে। তবে এবার যেন সাথীকে কুন্তলের ফোন করাটা ক্রমশ কমে আসছে। আগে যেখানে সপ্তাহে দু-তিন বার ফোন করতো। এখন সেখানে মাসে দু- একবার করে। দিনের পর দিন ফোন আসছে না দেখে ধৈর্য হারিয়ে একদিন সাথীই ফোন করে।

     - কি খবরগো তোমার? দু সপ্তাহ হয়ে গেল ফোন করছো না! কি করছো এখন? 

     - কিছুই করছি না। এখন এখানে সন্ধ্যা। অফিস থেকে ফিরে, খাওয়া দাওয়া সেরে, বিছানায় শুয়ে তোমার কথা ভাবছি। তোমার কথা ভাবতে ভাবতে রাত কেটে যায়। সারা রাত ঘুম হয় না। সকালে অফিসে গেলে ঝিমুনি আসে। বসের কাছে ঝাড় খেয়ে ঝিমুনি কাটে। মাসের পর মাস একা থাকতে আর ভালো লাগছে না। এক্ষুনিতো আর সব কিছু ছেড়ে দেশে ফিরতে পারছি না। জানিনা এভাবে কতদিন চলবে!

     সামান্য কিছু কথা বার্তার পর ফোন ছেড়ে দেয় সাথী। তার মনে হয় কুন্তল যেন কথা বলতে চাইছে না। তার মধ্যে যেন সেই আবেগ, উচ্ছ্বাস আর  নেই। কেমন যেন দায় সারা ভাব। 

     বেশ কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধের পর হঠাৎ একদিন কুন্তলের ফোন এলো। ফোনটার উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো সাথী।

     - কি করছো সাথী? কেমন আছো?

     - কি আর করবো! পড়াশোনা শেষ করে ঘরে বসে আছি। ভাবছি কবে তোমার ফোন আসবে।

     - হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। এখনতো সব কিছুই ফোনে বা কম্পিউটারে। ভালোলাগা, ভালোবাসা, মন দেওয়া নেওয়া সব কিছুইতো অন লাইনে। কিন্তু সাথী তার পরেওতো কিছু থাকে। তারজন্য দুজনকে কাছে আসতে হয়, ঘনিষ্ঠ হতে হয়। শরীরের চাহিদাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না। সব কাজ অন লাইনে হয় না সাথী, কিছু কাজ পড়ে থাকে অফ লাইনের জন্য। এরমধ্যে আমি একটা কাজ করেছি। একজন লম্বা চওড়া, হেলদি মেম সাহেবকে বিয়ে করেছি। খুব সুন্দর চেহারা। তোমরা যাকে বল হাইলি সে...। যাকগে ওসব কথা ছাড়ো। তবে তুমি চিন্তা কোরো না, তুমিই আমার একমাত্র প্রেম। ঐ জায়গাটা স্রেফ তোমার জন্য। কথা শেষ করেই স্বভাব গায়ক কুন্তল গেয়ে ওঠে,

     "তুমি আমার প্রেম,

      চৈত্র দিনের পাতা ঝরার সময়,

      মুকুল ফোঁটার প্রত্যাশা,

      তুমি আজ আমার মনের

      অনন্ত আশা।"

      কয়েক কলি গেয়ে চুপ করে যায় কুন্তল। অপেক্ষা করতে থাকে সাথীর প্রতিক্রিয়ার জন্য। চুপ করে থাকে সাথীও। কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না তার দিক থেকে। অন্য সময় হলে পুরো গানটা শোনানোর জন্য বায়না করতো। কিন্তু এই সাথী যেন মানুষ নয়। ভাবলেশহীন এক পাষাণ প্রতিমা। কোনো কথা, কোনো সুর, কোনো ছন্দ তার মনকে ছুঁতে পারছে না। কোনো কথা বলতে পারছে না সে। কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। ফোনটা ছাড়তে পারছে না। আবার ধরে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!

     সাথীকে চুপ করে থাকতে দেখে কুন্তল বলে ওঠে, "ঐ মোটাসোটা হেলদি মেম সাহেবের প্রতি আমার মনে কোনো প্রেম ভালোবাসা নেই। স্রেফ ঐ যাকে বলে অফ লাইন জবের জন্য বিয়ে করেছি।"

      কথাগুলো শুনে সারা শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে সাথীর। সে ভাবে, মানুষ এতো নির্লজ্জ হতে পারে! সারাক্ষণ শরীর শরীর করে গেল! কি আছে শরীরে? কি থাকবে শেষের সেদিন? একমুঠো ছাই আর ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাওয়া কিছুটা কার্বন ছাড়া? এরজন্য কুন্তল সাথীকে ভুলে গেল! অতীতের স্মৃতিগুলো সব মুছে গেল! ভালোলাগা, ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, মন দেওয়া নেওয়া সব মিথ্যে হয়ে গেল! আর ভাবতে পারছে না সে।

      সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছে সাথী। সারাদিন ঘরেই থাকে। কোথাও যায় না। একবার ভাবে কুন্তলকে ফোন করে দেখবে। আবার ভাবে, কি লাভ! ফোনটাকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে রেখে দেয়। বেশ কিছুদিন পর, হঠাৎ একদিন আসে কুন্তলের ফোন। কিছুটা দোটানায় পড়ে যায় সাথী। ভাবতে থাকে ফোনটা ধরবে কিনা। দেরিতে হলেও ফোনটা ধরে।

      - সাথী, একবার এদেশে আসবে? তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো, অথচ আমি কেমন সংসার করছি একবার দেখবে না? একবার এসো প্লীজ। অন্তত কয়েক দিনের জন্য। আমি আমার কাজ করবো, তোমরা দুই সখীতে গল্প করবে, ঘুরে বেড়াবে। মেম সাহেব এখন কিছুটা বাংলা বলতে, বুঝতে পারে। ওর টেনে টেনে বলা বাংলা শুনলে তুমি মজা পাবে।

      - সখী! কে সখী? কার সখী? এই সব বাজে কথা বলার জন্য আর আমাকে ফোন করবে না।

      কলটা কেটে দেয় সাথী। তার দুচোখ দিয়ে নেমে আসে জলের ধারা। ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নেয় সাথী। বাড়িতেও কারো সাথে খুব একটা কথা বলে না। সারাদিন ঘরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে ফোনটা নিয়ে নাড়া চাড়া করে।   হয়তো অপেক্ষা করে থাকে একটা বিশেষ কলের জন্য। সে ভেবে পায় না সবকিছু যখন শেষ হয় গেছে, তার পরেও সে কেন তাকিয়ে থাকে ফোনটার দিকে? আবার কলটা এলেও তার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে তার আকাঙ্ক্ষিত কলটা আসে। তখন সে ভেবে পায় না কি করবে? ধরবে, নাকি কেটে দেবে! ইতস্তত করতে করতে কলটা ধরে। কথা বলে কম, শোনে বেশি। আজও এসেছে কলটা। অপর দিকে সেই চেনা কণ্ঠস্বর।

      - সাথী, পুরানো দিনের স্মৃতিগুলো বারে বারে এসে আমাকে যেন রাঙিয়ে দিয়ে যায়। তোমার মনে পড়ে সেই সব দিনগুলোর কথা? কত মাঠে, ঘাটে, রাস্তায়, পার্কে আমরা আড্ডা মারতাম, গল্প করতাম! কত রেস্টুরেন্টে আমরা খেতে গেছি। তুমিতো কিছুই খেতে না, কেবল ডবল ডিমের অমলেট ছিল তোমার পছন্দ। রেস্টুরেন্টের সেই ছেলেটাকে মনে পড়ে, যে অমলেট কে মামলেট বলতো? শুনে তুমি হেসে গড়িয়ে পড়তে।

      - সব মনে আছে আমার। তবে তোমার মনে আছে দেখে অবাক হচ্ছি! 

      - এতে অবাক হওয়ার কি আছে? এটা ঠিক যে আমি বিয়ে করেছি। কিন্তু বিয়ে আর ভালোবাসাতো এক নয়। তুমি আমার ওয়ান অ্যান্ড অনলি লাভ। দেখবে একদিন ঠিক তোমার কাছে ফিরে যাবো। তবে তোমার ডবল ডিমের অমলেটের মত, এখন আমার জীবনে আর একটা ডবল এসেছে। মানে আমার ডবল বাচ্চা হয়েছে। মানে টুইন বেবি। প্লীজ কনগ্র্যাজুলেট মি।

      মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না সাথীর। কোনো রকমে ফোনটা ছাড়ে। ক্রমশ যেন জীবন্ত মৃত দেহে পরিণত হচ্ছে সে। তার বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। তারা সাথীকে বারে বারে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বলেন। অন্যত্র বিয়ে করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে বলেন। তা না হলে তারাও যে শান্তিতে মরতে পারবেন না।

      অনেক বোঝানোর পর বয়স্ক বাবা মায়ের দুশ্চিন্তার কথা ভেবে সম্মতি দেয় সাথী।  সে ভাবে যা ঘটে গেছে সেটাকে সে একটা  দুঃস্বপ্ন ভাববে। অতীতকে ভুলে সে এবার সামনের দিকে তাকাবে। সে ভাবে যদি তার জীবনে প্রেম না আসতো, কুন্তল না আসতো, কি তফাৎ হত? আর পাঁচটা মেয়ের মত দেখা শোনা করে তার বিয়ে হত, সংসার হত। সেভাবেই সে ভাববে এবার থেকে। কোনো পিছুটান রাখবে না।


                         চার


      শুরু হল দেখাশোনা। নির্বাচিত হল পাত্র। বিদেশে চাকরি করতো, কিছু দিন হল দেশে ফিরেছে। এবার দেশে থেকেই সফটওয়্যারের ব্যবসা করবে। কয়েক বছর বিদেশে চাকরি করে পুঁজির ব্যবস্থা করেছে। বিদেশে থাকাকালীন বেশ কিছু ক্লায়েন্ট, কাস্টমারের ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। পাত্র পক্ষ নাকি আগে কোথাও সাথীকে দেখেছে, তাই আর ঘটা করে পাত্রী দেখতে আসবে না। এগোতে থাকে কথাবার্তা।

      সাথীর মা একদিন সাথীকে বললেন, "বিয়ে হচ্ছে সারা জীবনের ব্যাপার। তাই বলছি পাত্রের সঙ্গে একবার কথাবার্তা বলে নিবি? একটু চিনে বুঝে নিলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধে হবে।"

      "তিন চার বছরেই একজনকে চিনতে পারলাম না! কয়েক মিনিটে আর কি চিনবো? ওসবের দরকার নেই।" প্রায় আর্তনাদের মত শোনায় সাথীর কথাগুলো।

      একদিন সাথীর বন্ধু মিমি এসে সাথীকে পাত্রের একটা ফটো দেখিয়ে বললো, "দ্যাখ দ্যাখ কি সুন্দর দেখতে। কি সুন্দর লম্বা লম্বা দাড়ি! রাস্তার পাগলদেরও এত বড়, এত ঘন দাড়ি দেখা যায় না। দ্যাখ একবার দ্যাখ।"

      "তুই আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিস না। যা এখান থেকে।" বলতে গেলে ধাক্কা দিয়ে মিমিকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

      দরজার বাইরে থেকে মিমি বারে বারে বলতে থাকে, "রাগ করিস না, দরজা খোল। একবার দেখ, ফটোটা একবার দেখ।" কিন্তু মিমির কথায় কান দেয় না সাথী। বন্ধ দরজা বন্ধই থেকে যায়। এর পরেও মিমি সাথীকে কয়েক বার ফোন করে, কিন্তু প্রতিবার সাথী ফোন কেটে দেয়।

      বিয়ের দিন সন্ধ্যায়, মুখে পান পাতা চাপা দেওয়া, পিঁড়িতে বসা সাথীকে হাজির করা হল বরের সামনে। আস্তে আস্তে নামলো পান পাতা, খুললো চোখ। একি! কাকে দেখছে সে! দাড়ির জঙ্গলে মুখ ঢেকে গেলেও, এই চোখতো সাথীর চেনা। হাজার চেষ্টা করলেও এই চোখ সে ভুলতে পারবে না। বিস্ফারিত হয়ে ওঠে সাথীর চোখ জোড়া। মুখ থেকে অস্ফুটে বের হয়, "তুমি!"

      পাশ থেকে মিমি ফিসফিস করে বলে ওঠে, "সেদিন অত করে ফটোটা দেখতে বললাম দেখলি না, তাই আজ তোকে চমকাতে হল। ওসব মেম সাহেব টেম সাহেব সব মিথ্যে কথা। তোর বর একটা পাক্কা ঢপবাজ। আমাকে বলেছে ওর শখ হল অন্যকে মুরগি করা। সামনে অনেক লোকজন আছে। এখন চেপে যা। পরে সুযোগ বুঝে আচ্ছা করে কড়কানি দিবি।"

      - বলছিস?

      - হ্যাঁ।

      বিয়ের পর্বে সাথী আর কোনো কথা বলে নি।

      বর কনেকে এনে বসানো হল বাসর ঘরে। সঙ্গে চলতে থাকে মিমি অ্যান্ড কোম্পানীর কিচির মিচির।

      তারমধ্যে কুন্তল সাথীকে প্রশ্ন করে, "কেমন আছো সাথী?"

      সাথীর মনের মধ্যে এখন কাল বৈশাখীর ঝড় বয়ে চলেছে। রাগ, কপট রাগ, হারিয়ে ফেলা অনেক কিছু ফিরে পাওয়ার চাপা আনন্দ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সাথীর মধ্যে। কুন্তলের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চড়া গলায় সে বলে, "একদম আমার সঙ্গে কথা বলবে না। একটা মিথ্যেবাদী, জালি মাল কোথাকার!"

      - কেন? আমি কি করেছি?

      - মেম সাহেব, ডবল বাচ্চা। কি এগুলো?

      - এই জন্য রাগ করেছো! আমার ছোট  থেকে স্বপ্ন ছিল একটা তাগড়া মেম সাহেবকে বিয়ে করবো। কিন্তু সে রাস্তাতো অনেক দিন আগে বিড়ালে কেটে দিয়েছে! সে স্বপ্ন আর সফল হবে না। কিন্তু মনের মধ্যে জমে থাকা স্বপ্ন মাঝে মাঝে মুখে চলে আসে। কি আর করা যাবে!

      - আর ডবল বাচ্চা?

      - ওটাতো তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। তুমি বরাবর অঙ্কে কাঁচা। দেখছিলাম তোমার উন্নতি হয়েছে কিনা।

      - মানে?

      - তোমাকে জুন মাসে বললাম বিয়ে করেছি। আর নভেম্বরে বাচ্চা হয়ে গেল! হয় হিসেব করতে পারোনি, নয়তো...।

      - নয়তো কি?

      - মোবাইল ফোনে ফাষ্ট চার্জার চালু হয়েছে জানি। কিন্তু মানুষের মধ্যে ...! আমার জানা নেই। তুমি এ ব্যাপারে কিছু জানো?

      - চুপ করো। সব সময়ে মুখে আজে বাজে কথা। একটা বাজে, মর্কট মার্কা ছেলে। না বলে কয়ে চলে এসেছে বিয়ে করতে।

      - কেন? সবাইতো জানে। মিমিরা জানে, তোমার বাবা মা জানে, আমার বাড়ির সবাই জানে। তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না, আমার খবর রাখো না। তাই জানো না যে আজ আমার বিয়ে।

      - এই বেরোওতো এখান থেকে। আমি আর বদার করতে পারছি না। আমার মাথায় আগুন জ্বলছে।

      - শান্ত হন দেবী। ক্রোধ সংবরণ করুন। মিষ্ট বাক্য প্রয়োগ দ্বারা পতি দেবতার মনোরঞ্জন করুন। পতি দেবতার পাদোদক পান করিয়া পুণ্য অর্জন করুন।

      - উঁ! পাদোদক! তোমার সেক্সি মেম সাহেবকে খাওয়াও।

      - অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ হইতে বিরত থাকুন দেবী।

      - সব বুঝি আমি। লিকপিকে ভেতো বাঙালি, সেক্সি মেম সাহেবের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে চাকরি বাকরি সব ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।

      দুজনের কথার মাঝে আচমকাই মিমি ঢুকে পড়ে। সে বলে, "জানো কুন্তলদা, সাথীর এখন বিদেশিনী সখী জুটেছে। তাই আমাদের আর পাত্তা দেয় না। একদিন দেখা করতে এসেছিলাম, আমাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিয়ে, দরজা বন্ধ করে দিল। আর দরজা খুললোই না!"

      মিমি থামতে সাথী আবার কথার ছুরি চালাতে থাকে, "জুটেছেতো, আমেরিকান সখী জুটেছে। তার সঙ্গে কত কথা হয়! একদিন জিজ্ঞাসা করলাম  - তোমার হাবি এখন কি করছে? কি বললো জানিস? বললো - হাবি এখন খাবি খাচ্ছে।"

      দুকানে আঙুল দিয়ে কুন্তল বলে, "পুণঃ পুনঃ অশ্লীল বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার কর্ণ যুগল কলুষিত হইতেছে।"

      - বুঝতে পেরেছি সাধু ভাষায় কথা বলার এই স্টাইল মেম সাহেব শিখিয়ে দিয়েছে। ঠিক আছে বৌভাতের ঝামেলাটা যাক, তারপরে দেখবো সেক্সি মেম সাহেবের সঙ্গে অফ লাইন জব করা ডবল বাচ্চার বাপের কত দম! 

      - বারংবার অশ্লীল মন্তব্য শুনিতে শুনিতে আমার হৃদ স্পন্দন বহুগুন বর্দ্ধিত হইয়াছে, মনে হয় অবিলম্বে এক সশব্দ বিস্ফোরণ ঘটিবে।

      - এবার থামতো তুই। অনেকক্ষন ধরে প্যাঁক প্যাঁক করে চলেছিস!

      "পতি দেবতাকে 'তুই' সম্বোধন! হায়, হায়, একি শুনিলাম! না, না,আর নয়! আর এই স্থানে আমি অবস্থান করিবো  না! ধরণী দ্বিধা হও। আমি অবিলম্বে পাতাল প্রবেশ করিবো।" কুন্তল কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলতে শুরু করলো, "ধরনী দ্বিধা হইলো না! আমাকে অবজ্ঞা করিলো! উত্তম, অতি উত্তম। আমি স্বয়ং খনন কার্য সম্পন্ন করিয়া পাতালে প্রবেশ করিবো। দেবীর সখীগণ আপনারা অনতি বিলম্বে কুড়ুল,  কোদাল সংগ্রহ করিয়া আনুন। এই বাসর গৃহ হইতেই আমি খনন কার্য আরম্ভ করিবো। সেই খনন কার্য হইতে বারিধারা নির্গত হইলে, আমি সলিল সমাধি গ্রহন করিবো। সেই স্থান হইতে অগ্নুৎপাত হইলে, আমি অগ্নি সমাধি গ্রহন করিবো। কোনো কিছু নির্গত না হইলে ঐ খনন ক্ষেত্রে আপনারা পাতাল রেল চালাইবেন। আমি বিনা টিকিটে ভ্রমণ করিবো। তথাপি ধরাধামে প্রত্যাবর্তন করিবো না।"

      - থাম, থাম। অনেক ভাট বকেছিস। একটা দুনম্বরি, ছ্যাঁচ্চোড়, জালি মাল কোথাকার!

      - জালি বলো বা দুনম্বরি বলো, আমার স্ট্যান্ড পয়েন্ট ক্লিয়ার।

      - তোর আবার স্ট্যান্ড পয়েন্ট! কি সেটা?

        - ভালোবাসি।


**********************************************************************************************



দেবাংশু সরকার 

পেশা মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ। স্কুলের পত্রিকায় নিয়মিত লেখার অভ্যাস থাকলেও, তারপর দীর্ঘ বিরতি। লকডাউনের প্রথম বছরটা কেটে যায় টিভিতে রামায়ণ মহাভারত দেখে। দ্বিতীয় লকডাউনের  অখন্ড অবসরে আবার আবার লেখার দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু।

সাম্প্রতিক লেখা  - প্রজাপতি সাহিত্য পত্রিকা /সৃজন সাহিত্য পত্রিকা/ রংমিলন্তি প্রকাশনা/ কারুলিপি অনুগল্প সংকলন/ অবেক্ষন/ ড্যাস সাহিত্য পত্রিকা/ লেখা ঘর সাহিত্য পত্রিকা/ সমন্বয় পত্রিকা/ মৌনমুখর সাহিত্য পত্রিকা/ তুলি কলম আকাশ/ ঘোড়সওয়ার/ স্নিগ্ধা প্রকাশনী/ নীরব আলো পত্রিকা/ সর্বজয়া পত্রিকা এবং স্বরবর্ণ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে।