[ 'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ৮
দীপংকর রায়

ভাসানের সেই মেলা, টাবুরের ছোই-এর ভেতর শুয়ে শুয়ে মেলা দেখবো আমি। এরা নিচেয় নামবে সকলে। ততক্ষন আমি মাঝির সঙ্গেই থাকবো, কথা হলো সেটাই। এত মানুষের হইহট্টগোল। নবগঙ্গার শান্ত রূপ তবুও সান্ধ্য-জলে। কেন জানি না ,আমার হঠাৎ সে কি কান্না এলো ! মাঝি জিজ্ঞাসা করছে , কী হলো গো তোমার ? ব্যথা কি খুব করতিসে ভাইডি? আহা গো, ছেলে মানুষ, এই পুজোগণ্ডার দিনি নিচেয় নামতি পারতিছে না ; এই দ্যাহো , তোমার জন্যি এই ছেমরিডাও যাতি পারলো না ; শান্ত হও গো, ও মামনি, দ্যাহো তো, ও ভাইডি কী কয় ?
কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য সকলেই টাবুরেতে ফিরে এলো । এখানে আমি ঠিক একা ছিলাম না মাঝির সঙ্গে । নারান মামার বড় মেয়েটাও ছিল আমার সঙ্গে নৌকোয় । সে কেন যে নিচেয় নামেনি তা জানি না । এর পরে এরা ফিরে এসেও সকলেই নানা উৎকন্ঠায় ছিল যেন আমাকে নিয়ে । হয়তো সেই কারণেই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে । আমার ব্যথায় কাতরানোর কারণেই তার মনটা হয়তো সায় দিয়েছিল না আমাকে ফেলে সকলের সঙ্গে নিচেয় নামতে । দিদিমা এদের সকলের সঙ্গে নিচের থেকে ঘুরে এসে যখন দেখলো ব্যথায় কাতরাচ্ছি আরো বেশি, তখন তার বিলাপ করা শুরু হয়ে গেলো ---- এই জন্যি তো কইছিলাম রসিকদারে, আমার আর যাইয়ে কাজ কি, এহনে দ্যাহো , এই মণি , ওর কী হলো রে ......?
বেবি পড়েছে মহা সমস্যায় ; সে ভাবছে হয়তো কেনই বা সে নিচেয় নামলো না ! কীই বা এখন বলে সে ; তাও বলতে লাগলো , ' এই তো, দাদা তো কিছুক্ষন আগেও ভালোই ছিল , আমার সঙ্গে কথাও কচ্ছিলো, মাঝি দাদুর সঙ্গেও ; এর মধ্যি কী যে হলো ,তা কিডা কবে , বুঝতি তো পারতিছি না গো রাঙাদি ; ব্যথার জন্যি তো ঠিক না মনে হয় , শোনো দেহি তুমি, কী হলো গো , কও তো আমাগের একটু ----
তার আর তখন কতোই বা বয়স ! কীই বা বোঝে ! ও তো আমার জন্যেই যাইনি । এ কথা তো সব চেয়ে বড় সত্যি , সকলে যখন নেমে যাচ্ছে নিচেয় তখনই ও বললো শুনলাম, না না, দাদার একা থায়ে কাজ নেই , আমি নৌকোতেই রইছি , এহেনেই থাকপানে , ও রাঙাদি , আমি নিচেয় যাবোনানে , আমার যাতি ইচ্ছে করতিছে না , তোমরা সকলেই যাও , আমি এহেনেই থাকপানে ।
এই ঘটনার কথা মনে পড়ার কারণ আর কিছু না , মনে হয় এই যে আজ নবমীর দিন , এই সন্ধ্যাবেলায় সকলে যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে নতুন জুতো জামাকাপড় পরে গটমট আওয়াজ করতে করতে চলে যাচ্ছে এদিক ওদিক, এ পাড়ায় সে পাড়ায় অথচ আমি একা একা বারান্দায় বসে আছি। বসে বসে কীই বা এত ভাবছি ! কেনই বা আমার ভেতরে এই সব উৎসবের দিনগুলোতে এমন হাহাকার ওঠে , কীসেরই বা এত বিষাদ জাগে ?
কাজের দিদিও ফচনের ঠাকুমার সঙ্গে পাড়ার ঠাকুর দেখতে গেছে । মা দিদিদের সঙ্গে নাতিকে নিয়ে রিক্সায় করে ঠাকুর দেখতে গেছে । আমিও তো সেই সঙ্গে যেতে পারতাম , অথচ যাইনি । কারো সঙ্গই নিই নি । মনে মনে ভাবছি শুধু , আমার এই শূন্যতা বোধের কথাগুলিই কি ! শঙ্কর ডেকে গেছে । ফচনও বলেছে , কি রে , বেরোবি না ?
সকলকেই না বলে দিয়েছি ।
সকালবেলায় একবার অলোকদের বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করে এসেছি । এরপর বাড়িতেই ।
এই সন্ধ্যাবেলায় সকলে যখন পুজোর শেষ আনন্দটুকু নিতে বাইরের দিকে ছুটছে , তখন আমি কেন একা একা সেই ফেলে আসা কোন কালের একটি পুজোর ভাসানের দিনের কথা নিয়ে এত কথা মনে করে বেড়াচ্ছি তা কে জানে !
এসবের মধ্যে আবার মনে পড়ছে, জানি না ভাইটা এখন কী করে বেড়াচ্ছে ! দিদিমা কি ওর জন্যে এবারের ভাসানের মেলায় টাবুরে ভাড়া করে শত্তিজাতপুরীর আড়ঙে যাবে নে নাকি ?
এইসব নানা কথার আকাশ পাতাল একা একা বারান্দায় যখন বসে বসে ভেবে বেড়াচ্ছি এমন সময় অলোকের ছোটো বোন মলি এসে ঢুকলো আমাদের বেড়ার সদর দরজা খুলে । বারান্দায় এসে জিজ্ঞাসা করলো , কি রে , তুই এখানে একা একা ভূতের মতোন বসে আছিস কেন ? কী করছিস কি তাই বল তো ? আমি দাদারে জিজ্ঞাসা করলাম তোকে ডেকেছে নাকি । সে বললো , কই , তাকে তো একবার সকালের দিকে দেখেছিলাম এদিকে , তারপরে তো আর তাকে দেখিনি । দেখ, শঙ্কর ওদের সঙ্গে বেরিয়েছে নাকি ; তাই তো এলাম খোঁজ করতে ।
তাকে মুখে কিছু না বলে ইশারায় বসতে বললাম পাশের মোড়াটি ঠেলে দিয়ে ।
সে না বসে বলতে লাগলো , আচ্ছা তুই কেমন রে তাই বল তো ! চল , আমার সঙ্গে চল তো ।
বললাম , না রে , তা তুই আমার খোঁজে এলি কেন ? তোদের বাড়িতে এত মানুষজন , এত ব্যাস্ততা , তা থুয়ে তুই আমার খোঁজ করতি আলি ক্যান, তাই ক তো !
সে খানিকটা হেসে ফেললো যেন , হাসতে হাসতে বললো , ও তো তুই বুঝিস নে , চল , নে নে দুয়োরে তালা দে , চল আমার সঙ্গে।
কাজের দিদির গলা পাওয়া গেল । সে আসার পরে মলিরও আর তাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবার তাড়া থাকলো না । কাজের দিদি স্টোভ জ্বেলে চা বসাতে গেল । চা হয়ে গেলে মলিকেও দিলো । সেও আজ তার জন্যেও চা করে নিয়ে এসে আমাদের পাশেই বসলো ।
এ কথা সে কথার মধ্যে মলির এই উপস্থিতির কথাটা মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না । কেবলই ভাবছি ওর এ কথা সে কথার মধ্যে থেকেও একটাই কথা --- সে কেন এমন সময় তাদের বাড়ির এত আনন্দ উৎসবের ভেতরে থেকেও আমার কথা ভেবে এ বাড়িতে এলো কেন ?
আমার সেদিনের সেই বিষাদময়তা কাটিয়ে দিল সে এসেই যেন , আমাকে সঙ্গ দিয়ে ?
যদিও আমি তার ভেতরে তার সেই অনুসন্ধিৎসু মনটার কোনো খোঁজ নিতেই একটুখানি বেশি তলিয়েও ভাবতে গেলাম না আর । কত সময় যে মানুষ তার নিজের স্বভাবদোষে অন্যের কোনো সময়েরই মূল্য দেয় না , সে কথা আমি অনেক কাল অবধি বুঝতে চাই নি যে, সে কথাটাই সব চেয়ে বড় সত্যি । এরকম ঘটনা , সব ক্ষেত্রেই যখন ঠিক মতো বুঝতে গেছি, তখন সবটারই সময় কাল অতিক্রম করে গেছে ।
মন যাকে খুঁজে বেড়ায় না বুঝে , মন যার বিষাদময়তায় ক্লান্ত হয় , তার খোঁজ যেন মন নিজেই জানে না ঠিক সময় , সঠিকভাবে ।
সময় এমনই । সময় এভাবেই বয়ে যায় তার আপন ছন্দে । তাকে যে তার সময়েই বুঝতে হয় ; তা না হলে সে যে না বোঝার মধ্যেই রেখে দেয় তার আপন রহস্যের আনন্দ ; নিজেই মেতে ওঠে হয়তো একা একা কখনো সখনো ; আর এ কথা যে কত বড় সত্য তা সেই সব দিন ছাড়িয়ে এসে আজ যখন সময়ের হাতে ধরা দিয়ে ক্লান্ত হই , তখন কত কথাই না মনে পড়ে ; আর সেই দমচাপা হা হুতাশ এতটা পথ ফেলে এসেও, কতটা বা প্রকাশ করতে পেরেছি বা পারবো কি আদোও এমন কোনো ভাষা দিয়ে , যাতে নিজেকে অপরাধী ভাববো না একবারও !
সে সবের কোনো অন্তই কোনোদিনও খুঁজে পাওয়া যায় না যে এটাই সবচেতে বড় সত্য ।
জোরজার করে জামাকাপড় পরিয়ে ওরা আমাকে সকলে মিলে ঠেলেঠুলে তুলে দিয়েছিল বিসর্জনের লরিতে । তার আগে শিবানী মলির সমবয়সীরা ও ওদের বড়দির মেয়েও এলো মামা মামা করতে করতে, আমাকে অনুরোধ করতে। আমি যাই যেন তাদের সকলের সঙ্গে লরিতে।
অলোকদের বাড়ির লম্বা মোজাইক করা বারান্দার এক কোণে সিদ্ধি বাটা হচ্ছে দেখলাম । মনেমনে ভাবলাম এ বস্তুটি দেখতে তো ভাঙপাতার মতোন , যা সেবারে মাঠ থেকে তুলে এনে শুকিয়ে সুভাষ কলকেয় পুরে আমাকে খুব করে টানিয়ে ছিল ওখানে থাকতে । এ তো সেরকমই, ভাঙপাতার মতোনই দেখতে। অলোককে বললামও , হ্যাঁ রে, এরে ভাঙের পাতা কয় না ?
সে বললো , না রে না , এ তার থেকেও আরো অন্য আর একটা জিনিস ; তোদের সে ভাঙের পাতা এখানে কোথা থেকে মিলবে রে ভাই ! একে সিদ্ধি বলে , বাবার প্রসাদ , খাওয়ার পরে তুই আর তুই থাকবি নে , দেখিস খানে কী মজাই না আছে এতে !
বিসর্জনের লরি ছাড়বার আগে এরা সকলে এক এক গেলাস করে সেই সিদ্ধি বাটা সরবত সকলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল । অলোক মলির হাত দিয়ে আমার জন্যেও পাঠিয়ে দিল । এবং পরম যত্ন সহকারে ওরা সকলেই পান করার পরে আমি গেলাস হাতে নিতে ইতস্তত করছিলাম দেখে মলি ও ওদের ভাগ্নি , পারলে দুজনে মিলেই , আমার হাতের থেকে নিয়ে গেলাসটা মুখের কাছে তুলে ধরে বললো , নে ধর , এবার চো চো করে মেরে দে তো দেখি ;
ওদের সাথে না পেরে উঠে বললাম , আচ্ছা আচ্ছা হাতটা ছাড়বি তো , দেহিস ভাই , কোনো অসুবিধা হবে নানে তো , শেষে উল্টে না পড়ি দেহিস কিন্তু।
ভাগ্নি বলল, তুমি তো আচ্ছা ভীতু রে বাবা! আমরা সব দু দু গেলাস মেরে দিলাম , আর এক গেলাস খেতেই এত টিপ টিপ, মেরে দাও তো, জয় ভোলে বাবা বলে ;-----
সিদ্ধি পেটে পড়ার পরই ওরা লরিতে তুলে দিয়েছিল জোরজার করে, আর আমিও দেখলাম সব জারিজুরি খসিয়ে সুবোধ বালকের মতো ওদের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে ওদেরই কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম !
সেন্টের গন্ধ , ঘামের গন্ধ সব মিলেমিশে নারী শরীরের লাবন্য যেন চারদিকে ঠিকরে বেড়াতে লাগলো ; চোখমুখ সরিয়ে নেব কীভাবে? সেই বয়স তো আর সেই টান, সেই মুগ্ধতার হাত থেকে সহজে রেহাই পেতে পারে না। তথাপি লরি চলা শুরু করলে ডালা ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আলোর ঝলকানি , বক্সের আওয়াজ , এ সবের মাঝেই আমার দ্বিধা-দ্বন্দ, সঙ্কোচ বোধ , ভীরুতা কখন যে কোথায় উধাও হয়ে গিয়ে কলকাতার বিসর্জনের হুল্লোড়ের মধ্যে দুহাত তুলে নাচতে নাচতে চললো , তখন আর আমার সেই স্বভাবের কোনো জড়তাকেই আর খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও।
লরি গঙ্গার ঘাটে পৌঁছলে আমি যে কখন তাল হারা হয়ে কাদের সঙ্গে নাচতে নাচতে আলাদা হয়ে চলে গেছি কোথায় ! আর কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না ।
নিজেকে পরিচিত জনদের মধ্যে খুঁজে না পেয়ে কিছুটা যেন তালহারা হয়ে এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি , একা একা ঘামছি শুধু ; এমন সময় সেই মলি আর অলোকই আমাকে খুঁজে বার করলো। এবং সেই থেকে ওরা আর আমার হাত ছাড়তে চাইছে না যেন । ওদের ভাগ্নিও একিভাবে আমাকে আগলাতে লাগলো । সিদ্ধির নেশা তখনো অবধি ছিলো কি? তবে সকলকে খুঁজে পেয়ে বেশ ভালো লাগছিল । পাড়ার মানুষগুলোই তখন ঘরের মানুষ। আপন জন যেন, অতি আপন জন !
এই হুল্লোড়ের ভেতরে মনে হলো আমি বেশ খানিকটা ভাগ্যবানই বটে ! সেই বয়সের মুগ্ধতা, আন্তরিক টান, সব এমন ভাবে এসে ঝুঁকে পড়ছিল মুখচোখের উপর , তাতে যৌবনের দোলাচলকে অস্বীকার করি কিভাবে ! আমি যেন কখন সেই উত্তাল ঢেউয়ের জলে হাত পেতে দিয়েছি নির্দিধায় ।
বেশ রাতে ফিরেছিলাম। পথে একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে নানারকমের খাওয়া দাওয়া হলো একচোট। এরপর লরি এসে পাড়ায় পৌঁছলে সকলে একে একে নেমে পড়ার পরে অলোক বললো, কী রে , যাবো নাকি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসতে ?
বললাম, না না, একাই পারবো এটুকু, তোরা যা ।
মলি এবং ওদের ভাগ্নি এ কথা সে কথা বলতে বলতে সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটতে লাগলো দেখলাম । শেষে বাড়ি পর্যন্ত এলোও তারা। কাজের দিদিকে ডেকেও তুললো ।
এমনভাবেই পুজো কাটলো । পুজোর শেষের দিকটায় সাহা বাড়ির পুজোর বিসর্জনে আমার একটুখানি গুরুত্ব পাওয়ার কারণে ফোচোনের টিপ্পুনি কেটে দু' এক কথা শোনানোর হাত থেকে রেহাই পেলাম না । আমার ওদের বাড়ির পুজোর বিসর্জনের লরিতে যাওয়া নিয়ে এত বিচার বিবেচনার মধ্যে পড়লাম কেন তা আমিও বুঝে উঠতে পারলাম না । বললাম তোদেরও তো অলোক যেতে বলেছিল । তোরা গেলি না কেন, তাও তো বুঝতে পারলাম না।
বুঝলাম এদের ভেতরে কোথাও একটা আভিজাত্যের সমস্যা আছে একে অন্যদের সঙ্গে । তবে সত্যি সত্যিই বুঝলাম না বিভাজন রেখাটি ঠিক কী দিয়ে আলাদা করলো এদের !
ফোচন অবশ্য বিষয়টা এড়িয়ে গেল এই বলে , না না , আমি যাব কী করে , আমার তো ক্লাবের দায়িত্ব ছিলো বিসর্জনে । যাক , আমাদের এটাই ভালো লাগলো যে তুই বেশ মধ্যমণি হয়ে ঘুরে এলি । কোথাও তো বেরোতে চাস না , ওদের বাড়ির মানুষজন পেরেছে সেটা । এটাই আনন্দের ।
ওর কথা শেষ হলে আর কোনো কথা বাড়ানোর ইচ্ছা হলো না । বেশ খানিকক্ষণ চুপ করেই ছিলাম। পরে মনে হলো না , কিছু একটা বলা উচিত এদেরকে। তা না হলে এর পরেও এমন কোনো ঘটনা ওদের সঙ্গ ছাড়া ঘটলে , ওরা সেটার জন্যে এভাবেই কথা শোনাতে ছাড়বে না। তাই বললাম , ক্যান বেরোই না , যাই না বলে কি আমি যেতে জানি নে বলে মনে হয় তোগের ? তোগের ধারণায় আমি কি তোগের থে আলাদা মানুষ?
------ না না , আলাদা হবি কেন ? মানুষই বা হবি না কেন ? অবশ্যই মানুষ । কিন্তু সেদিন তোর এই যে কোথাও যেতে হলে , কিছু করতে হলে একটা জড়তা ভাব , সেদিন তার কিছুই আমরা লক্ষ্য করতে পারলাম না, তাই বললাম। ভালো লাগলো তো। বেশ অন্যরকমভাবে তোকে দেখতে পেলাম । তুই শুধু শুধুই ভুল মানে করছিস নিজের ভেতরে নিজেই ।
------ ও..... এই কথা .... , আমি যেটা বুঝতি পারলাম, হঠাৎ আমার এতটাই রকমফের তোগের চোখিতি ধরা পড়লো কিভাবে ? আচ্ছা ধরলাম , আমার না হয় একটু জড়সড় ভাব আছেই ---- তাই বলে কি ইডাই যে আমি কিছুই পারতি পারি নে ?
শংকর চুপ করেই থাকলো দেখলাম । তবে ফোচনের কথায় তারও যে সমর্থন রয়েছে সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারা গেল।
আমিও এই প্রথম নাগরিক জটিলতার প্রথম অধ্যায়ের পাঠ আয়ত্ব করলাম যেন। এবং খোঁচা খেয়ে ফোঁস করাটাও বেশ দক্ষতার সঙ্গে শিখে গেছি যে , সেটাও বুঝতে পেরে বেশ যেন একটা ভেতরে ভেতরে গৌরববোধই হলো ।
পুজো মিটে গেলেই ভিসা পাসপোর্ট সব কিছু ঠিক করে নিয়ে মা চলে গেল ওদেশে, ভাইকে আনার জন্যে।
লক্ষীপুজোর পরপরই মা রওনা হলো । যাবার আগে জানিয়ে গেল, সম্ভব হলে সে একেবারে কালীপুজো হয়ে গেলে সঙ্গে দিদিমাকেও নিয়ে আসবে এবারেই। সেই মতো দিদিমাকে আগে থেকেই চিঠি লিখে জানিয়েও দিয়েছিল। সে যেন পাসপোর্ট ভিসা সব করিয়ে রাখে ।
মা ওদেশে যাবার পর আমার কাজও বেড়ে গেছে আর একটা। সেটা হলো এত দিন যে রিক্সাওয়ালাটি গোরুর খড় দানা ভুষি এনে দিয়ে যেত সেখানে আমার যাওয়ার প্রোয়োজন হতো না। টাকাপয়সা দেওয়া নেওয়াটা মা তার হাত দিয়ে অথবা অফিস থেকে ফেরার পথেই করতো । এবার সেখানে যাবার দায়িত্বটা আমার ঘাড়েই পড়লো । তাছাড়াও থাকলো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাজার সদাই । সেটাও তো করতে হবে এই ক'দিন !
সেই প্রথম শিখে নিলাম, বাজার করাটা কেমন করে করতে হয় ।
সবই যেন যখন যেমন যেভাবে চলছে চলুক , এমন একটা ভাব; যা ইচ্ছা তাই জানা-বোঝাতে কোনো বাধা নেই। এটা ওটা পড়াশোনা করতেও কোনো বাধা নেই। এই যেমন ধরি না কেন, যে কোনো ম্যাগাজিন , কোনো মাথামুন্ডু জানার দরকার নেই আগুপিছু কি তার ইতিহাস , হলেই হলো। কুড়োও এবং দেখো। বোঝা না বোঝারও বালাই নেই। ভালো লাগলে ভালো, না নাগলে থাকলো ; এমনই একটা ভাব। এ বিষয়ে মনে পড়ে, আগে তো ওদেশে থাকতে এটাও জানতাম না, খবরের কাগজটিও পড়ে কীভাবে এ পাতা ও পাতা উলটে? কারণ ওদেশে থাকতে তো সে বালাই ছিলোই না। ওই প্রত্যন্ত গ্রামে খবরের কাগজ আর পাবে কোথায়? হয় মাগুরা , না হলে বাজারঘাটে । বাজার ঘাটে গেলে হয়তো আগের দিনের কাগজটা মিলতো ।শত্রুজিৎপুর বাজারে সব সময় তো আর যাওয়া হতো না। আর সেখানে ওই যে বললাম না , আগের দিনের কাগজ আসতো পরের দিনে। কখনো সখনো হয়তো হাটবাজারে দিন হলে তবেই গিয়ে একটুখানি সুধির দাদুর চা মিষ্টির দোকানে বসা । সেখানে হয়তো ভাগাভাগি করে লোকজনকে খবরের কাগজ পড়তে দেখতাম। তবে সেই কাগজের অংশ আমাদের মতো অল্প বয়সিদের পর্যন্ত পৌঁছোতে পৌঁছোতে কাগজের জানপ্রাণ আর থাকতো না ! যদিও বা কালে ভদ্রে নাগালে এসে পৌঁছাতো; তখন আর আমার কাগজ পড়ার অভ্যাস তৈরি করার ইচ্ছাটাই আমাকে ছেড়ে দৌড় লাগিয়েছে । তাই খবরের কাগজ পড়া এদেশে এসেই আয়ত্ব করেছি । আর অন্য খবরাখবর বলতে রেডিও ।
ইদানিং দিদির বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় গেলে টেলিভিশনে খবর হতে দেখলাম । রোজ তো যেতাম না , যেদিন যেতাম সেদিনই দেখতাম । বেশি টান ছিলো সিনেমার ওপরে । সাদা কালো টেলিভিশনে সিনেমা দেখতাম । তখন রঙিন টি ভি আর কোথায় ! অন্য কোনোখানে ছিলো কি না তা জানি না ।
বাকি সময়টা একমাত্র বই-ই ছিল হাতের কাছে। সব সময় তো আর বই পড়তে ভালো লাগে না। তার মধ্যে যে কদিন ছুটিছাটার দিনে বা তৈরি করা ছুটির দিনে ওরা এ বাড়িতে আড্ডা জমাতে আসতো। তার মধ্যে আমার সাহিত্য শিল্পের প্রসঙ্গ উঠলে ওদের সকলের জ্ঞানের প্রভাবেই প্রভাবিত হতে হতো বেশি করে । শঙ্কর বলতো , শুধু শরৎচন্দ্র পড়লেই হবে না বাবা ----- রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে । মাইকেল মধুসূদন পড়তে হবে । বঙ্কিমচন্দ্রও জানাটা বিশেষ প্রয়োজন । বিবেকানন্দের যোগগুলো একবার পড়ে দেখো । আমাদের দেশে বড় বড় দার্শনিকেরা আছেন ।তাদের বইপত্রগুলো পড়ো একবার । ওগুলো আবার বাঙলাতে সব পাওয়া যাবে না । তুই তো আবার ইংরাজীটা জানিস না, তাই তো ? এই জন্যেই তো বললাম কত করে, শক্তিসঙ্ঘের লাইব্রেরীতে ভর্তিটাও তো হলি না । টাকা পয়সা জমা রাখলে বই বাড়িতেও আনতে পারবি । গুরুত্ব দিলি না । তুই তো ওমুখোই আর হলি না ! এরকম করলে কি হবে ? কত তুমি কিনে পড়বে বাবা বলো একবার। সব কি আর কিনে পড়া যায় ?
সবার কথাই খুব মনোযোগ সহকারে শুনি । কখনোই আমি বেশি জানি বা ও আমাকে ছোটো করছে এমন কিছু ভাবতাম না । কারণ, আমি জানতাম, এরা আমার থেকে এসব অনেক বেশি জানতে পেরেছে ইতিমধ্যেই । বয়সে হয়তো আমার ভাইএর বয়সি, কিন্তু এদের জানা-শোনাটা খুব নিয়মমাফিক ও ধারাবাহিকভাবে হয়েছে । বিশেষ করে শংকরের ।
ওর বাবা কর্পরেশনের উচ্চ পদে চাকরি করে । এ ছাড়াও ফাঁকে কিভাবে কিভাবে বুঝি না ওকালতিও করে । ওর দিদি আমার দিদির বন্ধু । বয়সে সে আমার থেকে দু' এক বছরের বড়োই হবে । সেও ল পড়ছে । ওর আরও এক ভাই ছিল । ওদেশ থেকে ফিরে এসে শুনলাম, সে নেই ।
একাত্তরেও দেখেছি তাকে। আমার ভাই-এর সঙ্গে সব সময় থাকতো । ভীষণ বন্ধুত্ব ছিলো । কিসে যে তার মৃত্যু হলো , তা শংকরের কাছে জিজ্ঞাসা করিনি কখনো । কারণ আজও পর্যন্ত তার অভাবটা ওদের পরিবারে একটা বিষণ্ণতার ছায়া ফেলে দেয় সে প্রসঙ্গ কেউ কখনো আলোচনা করতে গেলেই। কথায় কথায় যখনই ওর মা আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতো, কথা বলতে বলতে ছোটো ছেলের প্রসঙ্গ উঠলেই ওর মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের চোখটাও ঝাপসা হয়ে যেত দেখতে পেতাম ।
আশিসের পরে ওদের আর একটি ছোটো বোন আছে । সে সবে প্রাইমারি উতরে হাইস্কুলে উঠেছে । তাই সবটা মিলে ওদের পরিবারে লেখাপড়ার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে । এখন তার সঙ্গে শিল্পসাহিত্যের কতটা যোগ আছে কি নেই তা জানি না । তবু প্রথাবদ্ধ যোগ-এর গুরুত্বই তো সকলের আগে ! তবে এই জানা ও শোনার সঙ্গে দুটিরই যে খুব একটা আলাদা বা পার্থক্য আছে তেমন ধারণাও পোষোন করে না শঙ্কর। অন্তত তাই বলেই মনে হয় আমার । মুখে কোনোদিন সেই প্রসঙ্গে আলোচনা না করলেও ও জানে মনে মনে কিভাবে যেন একটা বোঝাবুঝি হয়ে গেছে ওর সঙ্গে যে, এই ধারণার পথকে আমি এড়িয়েই চলি । স্বীকার করি না, সব কিছুই নিয়মমাফিক হলেই খুব উৎকৃষ্ট কিছু হবে । বরঞ্চ নিয়মের বাইরেই যে আমি চলেছি, এলোমেলো, তা ওরা জেনেও কখনো আমার ধারণাকে ভাঙতে চায় না ওদের ধারাবাহিক জীবনের প্রভাবে। আর এখানেই সখ্যতা তৈরির একটা অন্তরালের বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে ওদের সঙ্গে আমার ।
তবে ওর কথাবার্তা শুনে মাঝে মাঝে ভাবতাম , সত্যিই তো , এত সব জানবো কেমন করে?
কত দিনেই বা? সব কিছু সংগ্রহ করে সত্যিই কি জেনে ওঠা সম্ভব? সে ক্ষমতা কত টুকু হবে জানিনে। মাথাটা ঘুরতে থাকতো ভাবতে গেলেই । তখন মনে মনে রসিক দাদুর বলা সেই কথাটাই ভাবতাম বেশি করে । মনে মনে পথ হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকতাম , কই , শিক্ষে গুরুর দেখা আমি পেলাম কই ! এখনও তো তেমন কারোর সন্ধান পাইনি ! যে মানুষটি আমায় সত্যটা, সঠিকটা ধরিয়ে দেবে ! তাহলে কি শংকরকে দিয়েই শুরু হলো আমার শিক্ষেগুরুর দেখা পাওয়া ! শিক্ষেগুরু কি আলাদা আলাদা পথে আলাদা আলাদা রূপে দেখা দেবেন এই ভাবেই ? তাই যেই কিছু বলতে আসতো, খুব মন দিয়ে শুনতাম । সঠিক কি ভুল তখনই তার বিচারে যেতাম না । নিজের মনে ভেবে নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত নিতাম আমার গ্রহনযোগ্য কতটুকু ; তার দেওয়া এই পথের খোঁজ খবরের।
ইদানিং বেশ কিছু কবিতা লিখেছি। সেগুলোকে কি কবিতাই বলে ! না, সে দাবিও করি না কারো কাছে। কেউ শুনতে চায়লে একের পর এক পড়ে যাই। শংকর গম্ভীর হয়ে পড়ার পরে বলে, ঐ যে তোকে বলেছি না, এসব বিষয়ে তোকে বিষদভাবে জানতে হবে। দার্শনিকতা কই? আরও গভীরে ঢুকতে হবে, তবেই না; জানতে হবে অনেক কিছু। তাহলেই দেখতে পাবে লেখার ধরনটা কাকে বলে; দেখবে জানার গভীরতা যত বাড়ছে লেখাও পাল্টে যাচ্ছে তত। তোর কথা শুনে সবটাতেই যে খুব খুশি হয় তা না। কোথাও যেন মনে হয় জানতে তো হবে, এই জানার কি শেষ আছে? কিন্তু আমার এই মুহূর্তের জানাশোনার ও তো একটা মূল্য আছে। এই চেতনার কি কোন অর্থই নেই? তার তো একটা অর্থ আছে ; সে তো সবটুকুই বাতাস নির্ভর নয় শুধু !
মনে মনে এই কথাটাই আওড়াই আর ভাবি আজকের এই পর্বের লেখাগুলির কোনো অর্থই নেই নাকি ! সেগুলিও তো একটা অভিনিবেশের ফল !
সবটাই মনে মনে । মুখে কাউকে কিছু বলা না। চুপ করে শোনা শুধুই সকলের কথা ।
ফচন বিড়ি ধরায় । মনের আনন্দে বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দেয় ওরা ।
আমি তখন উঠে গেছি কাজের দিদির সঙ্গে গোরু বাছুরের পরিচর্যায় । ওদের সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতেও হয়তো ফাঁকে ফাঁকে উঠে যেয়ে ভালো করে লক্ষ্য করি গোরুগুলি এগারোটার গুড়ের সরবত পেলো কি না। তার আগে তাদের একচোট স্নানধান করার একটা হুরদাম পর্ব তো ছিলোই। কল থেকে দিদির সঙ্গে সঙ্গে জল তুলে দেওয়া এবং স্নান করাতে করাতে ওদের ঘরের মেঝেগুলি পরিষ্কার করে দেওয়ায়ও একটু বেশি মনোনিবেশ দেওয়া বেড়েছে ; সরবত খাওয়া হলে ওরা যখন মহা আরামে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটা শুরু করে তখন আমারও স্নান টান করা এবং কেউ না থাকলে সেই বারান্দার কোণাটায় বসে বসে একা একা জাবর কাটাই যেন শুরু করা ! আর কী যে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকা ! কাজের দিদি তখন এক কাপ চা করে দিয়ে রেখে যায় নিঃশব্দে । তারপর সে সংসারের কাজকর্মে ব্যাস্ত হয়ে যায় । আমি তখন একেবারে একা । মনে মনে কতবার কতদিকে কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়াই তার কোনো সীমারেখা টানার কেউ নেই চারপাশে । যার মধ্যে বেশির ভাগটাই ফেলে আসা ওদেশের নানা সময়ের সঙ্গে ছোটাছুটিটাই বেশি। সেখানে কখনও আসে মলন মলার হুড়োহুড়ি তো কখনও থাকে ফসলের মাঠের ভেতর এ মাথা থেকে ও মাথা ফসলের ক্ষেতের ভেতর থেকে ফসল কাটা হয়ে যাবার পরে এ মাথায় ও মাথায় ঘুরে ঘুরে ফসলের ভাগ বুঝে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠের হাওয়া বাতাসে মন খুলে ঘোরাঘুরি। কখনো পাট বন থেকে পাট কেটে নেবার পরে পাটের গাদা দেওয়া এক একটা অংশ থেকে গুনে গুনে ভাগ বুঝে নেওয়া । আবার কখনো পাট বন থেকে ঘাস কেটে আনতে যেয়ে ক্ষেতের পাশের আলের উপর বসে থেকে হাওয়া খাওয়া । কিম্বা কল্যাণীর সঙ্গে চারদিক বৃষ্টির জলে ভেসে যাওয়া অবস্থায় ছাতা মাথায় দিয়ে নৌকোর দুই মাথায় দুজনের মাছ ধরতে বসে থাকার অপেক্ষার সময়গুলোর কথা ভাবতে থাকা ।
এসবের মধ্যেই কখন বেলা গড়িয়ে যেত, হয়তো কাজের দিদি কয়েকবার বলেওছে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার কথা , তাতে কোনো হুঁশই নেই যেন ।
তখন মনে হতো সদ্য পড়ে ওঠা শরৎচন্দ্রের বড় দিদি উপন্যাসের সেই শুরুর কথাগুলো : যেভাবে তিনি বলছেন , '' এ পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আছে , তাহারা যেন খড়ের আগুন । দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেও পারে , আবার খপ্ করিয়া নিভিয়া যাইতেও পারে । তাহাদিগের পিছনে সদা সর্বদা একজন লোক থাকা প্রয়োজন--- সে যেন আবশ্যক অনুসারে খড় জোগাইয়া দেয়।
গৃহস্থ কন্যারা মাটির দীপ সাজাইবার সময় যেমন তৈল দেয় । প্রদীপের ক্ষুদ্র কাঠিটির তখন বড় প্রয়োজন -- উসকাইয়া দিতে হয় , না হইলে তৈল এবং সলিতা সত্ত্বেও প্রদীপের জ্বলা চলে না ।
সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃতিও কতকটা এইরূপ । বল , বুদ্ধি , ভরসা তাহার সব আছে , তবু সে কোনো কাজ সম্পূর্ণ করিতে পারে না । খানিকটা কাজ যেমন সে উৎসাহের সহিত করিতে পারে , বাকিটুকু সে তেমন নীরব আলস্যভরে ছাড়িয়া দিয়া চুপ করিয়া থাকিতে পারে । তখনই একজন লোকের প্রয়োজন --- সে উস্কাইয়া দিবে । ''
কদিন আগে পড়ে ওঠা শরৎচন্দ্রের বড় দিদি উপন্যাসটির সুরেন্দ্রনাথ চরিত্রটির মধ্যে নিজেকেই যেন খুঁজে পেলাম বলে মনে হলো ।এই কথাগুলি যেন আমার স্বভাবের সঙ্গে কোথায় যেন মিলেমিশে মুখলুকোতে চাইছে বুঝি । শরৎচন্দ্রের এই কাহিনীর সত্য যেন আমাকে মিলিয়ে-মিশিয়ে ফেলিয়ে একটি সুরে আ...আ.. করে উঠলো খানিকটা দীর্ঘলয়ে । মনে হলো কে যেন বা খুব সকালে উঠে গলা সাধতে বসেছে ।
মনে পড়ছিলো তাঁর লেখাটি : ' শুধুমাত্র উস্কাইয়া দেবার মানুষটি যেখানে দেখা দিয়াছে .....' সেখানেই তা খানিকটা হয়তো বাস্তবায়িত হয়েছে বাকি টা সেই কালের গহ্বরে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে থেকেছেই শুধু ---- কাল তো কারো অপেক্ষায় বসে থাকে না কখনোও ; সে তো তার আপন ছন্দে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়েই চলবে ! তুমি তার ফেনা টুকুও আঁজলা ভরে তুলে না রাখতে পারলে সে তো তার এই মুহূর্তের ঢেউকে আর ফিরিয়ে পাঠাবে না তোমায় , কখন তুমি তীরে এসে দাঁড়াবে তাই বলে কি সে সুদূরে মেলাবে না !
আজ কদিন রসিক দাদুকে একখানা চিঠি লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়ে ওঠে নি । সেই সঙ্গে দিদিমা কেও । অথচ ক মাস তো হয়ে গেলো এসেছি যে।এও কি সেই বড় দিদি উপন্যাসের সুরেন্দ্রনাথ চরিত্রের মতো ?
অথচ যাদের কথা ভেবে ভেবে প্রত্যেকটা দিনই তো কাবার করে দিই !
তবু এইটুকু কি কেউ আমার কাছে আশা করতে পারে না ?
তাহলে আর বলছি কেন , এই আমি যে আমিকে নিয়ে এত ভাবছে , সেই আমি কি শুধুই একা একটা আমি ? তার সঙ্গে আরো কত আমির যে সমারোহ ! তাতে যারা যারা যারা প্রতিনিধিত্ব করে ছিল সময়ে অসময়ে , তাদের বাদ দিয়ে এই আমি কি সত্যিই সম্পূর্ণ ?
আর তা যদি না হবে তাহলে সময়ে সময়ে এই সমস্ত কর্তব্যবোধ থেকে এই আমি কেন এমন ভাবে পিছিয়ে পড়ে !
এখন শুধু সে কথাটাই মনে হয় । সমস্ত জীবন ধরে জিজ্ঞাসা করেও কি তার দায়ভার নেওয়ার লোক কেউকে পেয়েছি ? কোই সে নিষ্ঠার সঙ্গে দেখা হলো কোই ?
হয়তো কেউ কেউ আসতে গেছিলো । কেউ কেউ এসেছিলো ও হয়তো ; কিন্তু তাতেও কি সবটা ছিলো ?
না , ছিলো না ।অর্থাৎ ভার কেউই নিতে আসে না । অথচ আমিও অবিবেচকের মতো শুধু দুহাত পেতে বসেই থাকলাম শুধু , সেটুকুই পেতে !
কোথায়ই বা সম্পূর্ণতা পায় এমন স্বভাব , যার অমনযোগী আরাদ্ধ পথে হোমকুণ্ডু জ্বালাবার জন্যেই প্রকৃত অর্থে এগিয়ে এসেছিল কেউ! তাদের অন্য কোনো প্রয়োজন কি সত্যিই ছিলো না !
***********************************************************************************************
আগামী পর্বে
***********************************************************************************************