বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

গল্প * রাহুল দাশগুপ্ত



ক্রুশবিদ্ধ

রাহুল দাশগুপ্ত


বিপাসাদের বাড়ির সামনে দামি গাড়িটা এসে দাঁড়াল। সেই গাড়ি থেকে নামলেন অজিত কর। গোলগাল, মোটাসোটা চেহারা। কুচকুচে কালো গায়ের রং। মাথায় কোঁকরা চুল। মিলিটারিদের মতো গোঁফ দুপাশে ঝুলে আছে। 

অজিতকে দেখেই দৌড়ে এল বিপাসা। এই শহরের সেরা সুন্দরী। ফর্সা বললে কম বলা হয়। দুধে–আলতা গায়ের রং। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ–মুখ। ছটফটে স্বভাবের। তাঁর দু'চোখে মুগ্ধতা। অজিতের দিকে হাত বাড়িয়ে সে বলে উঠল, আসুন স্যার। আমরা সবাই আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। 

চতুরভাবে হাসলেন অজিত। তারপর জানতে চাইলেন, কেন, অপেক্ষা করছিলে কেন? 

করব না? আপনি এই যুগের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। আমাদের সময়ে এত বড়ো ভাস্কর আর কেউ জন্মেছেন নাকি? 

শুধু এই? আর কিছু নয়? অজিত আবার জানতে চাইলেন। তিনি যেন বাজিয়ে দেখতে চান বিপাসাকে। 

বিপাসার চোখ–মুখও এবার বদলে গেল। সে বলল, আমার কাছে আপনি সবসময়ই স্পেশাল, স্যার। আপনার মতো হ্যাণ্ডসাম পুরুষ আর কে আছে? 

হো হো করে হেসে উঠলেন অজিত। বিপাসা ওর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই হাত ধরে প্রায় হ্যাঁচকা টানে ওকে নিজের দিকে টেনে নিলেন অজিত। বিপাসা অজিতের বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। তারপর মৃদু অনুযোগের সুরে বলল, স্যার, আপনি না, একদম যা তা...

আবার হো হো করে হেসে উঠলেন অজিত। তারপর বিপাসার কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, আজ রাতে তোমাকে নিয়ে ফরেস্টে যাবো...

বিপাসা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, হীরের নেকলেসটা এনেছেন...

এনেছি।

বাংলোটা সাফসুতরো আছে তো? 

ওই নিয়ে তুমি চিন্তা করো না...

বেশ। প্রেস কনফারেন্সটা হয়ে যাক আগে...

তোমার পছন্দের গাড়িটাই আসবে...

সবদিকে খেয়াল আছে আপনার...

অনেকদিন তোমাকে দেখি না বিপাসা। 

আপনি এত ব্যস্ত...

তোমার গায়ে একটা সুতোও আজ আমি সহ্য করতে পারবো না...

আবার খিলখিল করে হেসে উঠল বিপাসা। তারপর একটু শান্ত হয়ে বলল, তার বদলে আমি কী পাবো? 

ওই গাড়িটা তোমার। হীরের নেকলেসটাও। আর ওই বাংলোটাও। সমস্ত লেখাপড়া হয়ে গেছে...

আচ্ছা। বিপাসা বলল। এখন ভিতরে আসুন।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির ভিতরটা ঝলমল করছে। কিন্তু ঢোকার মুখটায় একটু অন্ধকার। একটা থামের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল আনন্দ। সমস্ত কথাই শুনতে পাচ্ছিল সে। তার বুকের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছিল। মুখটা যেন ভেঙেচুড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। বিপাসাকে সে ভালোবাসে। একবার শুধু মুখ ফুটে বলতে পেরেছিল। বিপাসা সপাটে একটা চড় কষিয়েছিল ওর গালে। তারপর বলেছিল, চাল নেই, চুলো নেই, ভিখিরি কোথাকার! সুন্দরী মেয়ে দেখে তার আবার পীরিত করার শখ! 

সেদিনই বিপাসাদের দল ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা ভেবেছিল আনন্দ। ওইটুকু আত্মসম্মানবোধ তার আছে। পারেনি যে, তার কারণ সুনন্দবাবু। সুনন্দ মিত্রের অনুরোধেই সে শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। কিন্তু সুনন্দের কাছে সে জানতে চাইছিল, এই মেয়েগুলো এরকম হয় কেন কাকু? আমরা ওদের দেবী বলে পুজো করি। ওদের সৌন্দর্য হয়ে ওঠে আমাদের শিল্পের প্রেরণা। আর আমাদের ওরা এভাবে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করে। চোখ রাঙায়। দম্ভ দেখায়...

সুনন্দ মৃদু হেসে বলেছিলেন, যেদিন তোমার টাকা হবে, নাম–যশ হবে, অর্থ–ক্ষমতা–প্রতিপত্তি হবে, সেদিন ওরা তোমার পায়েই এসে লুটিয়ে পড়বে...

আনন্দ বলেছিল, এরা এত লোভী হয় কেন কাকু? কেন মেধা, প্রতিভা বা যোগ্যতার দাম দেয় না? 

এই গরিব দেশে ওসবের কোনও দাম নেই। এই মেয়েগুলো চায় আরাম–ভোগ–স্বস্তি–নিরাপত্তা–বিলাসিতা। এসবের এত অভাব এদেশে! যে ওদের এসব দেবে, লোভীর মতো তার জন্যই এরা ছুকছুক করবে। 

তাই বলে অজিত কর? সত্তর বছরের কুৎসিত চেহারার একটা লোক! ডিভোর্সের পর ওঁর প্রাক্তন স্ত্রী কী বলেননি, লোকটা কতটা বিকৃতমনস্ক? ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে কী কী করিয়ে নিত লোকটা? বাইশ বছরের বিপাসা ওই বুড়ো লোকটাকে বিছানায় সহ্য করে কী করে? 

সুনন্দ চুপ করে থেকেছিলেন। তাঁর চোখ দু'টো ধক করে জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু উত্তরটা দিয়েছিল তাপস। পাশ থেকে বলে উঠেছিল, টাকা আর ক্ষমতা থাকলে, ভোগ, আরাম আর বিলাসিতার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে, এই মেয়েগুলো রাস্তার কুকুরের সঙ্গেও শুতে পারে। তুই এদের চিনিস না...

অজিত করের গাড়ি থেকে এতক্ষণে মূর্তিটা নামানো হয়ে গেছে। বড়ো–সড়ো মূর্তি। তিন–চারজন বেয়াড়া ছুটে গেছিল। কিন্তু ওদের মধ্যে থেকেই কে একজন বলে উঠল, তেমন কিছু ভারি নয় রে...

তাই নাকি? 

হ্যাঁ রে, দেখে যা মনে হচ্ছে তেমন নয়। বেশ হাল্কা। দুজনেই হয়ে যাবে। 

মূর্তিটার সর্বাঙ্গ লাল কাপড়ে মোড়া। এই রংটা বিপাসার খুব পছন্দ। একটা হলঘরে আনা হল মূর্তিটাকে। মূর্তিটাকে ঘিরে এখন রীতিমতো ভিড়। 

অজিত কর হেসে হেসে বলছিলেন, আজ সকালেই শেষ করলাম। 

বিপাসা বলল, চলো, এবার দেখা যাক...

লাল কাপড়টা খুলে ফেলা হল। এক উলঙ্গ নারী। তীব্র লাস্যময়ী। এই মূর্তি দেখলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। শরীর গরম হয়ে যায়। শিরা–উপশিরা দিয়ে যেন লাভাস্রোত বয়ে যেতে থাকে। এই নারীর চোখের তাকানো, মুখের গঠন, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, যৌনাঙ্গগুলির সংস্থাপন, সবকিছুর মধ্যে যেন রয়েছে তীব্র নাটকীয়তা। দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। উত্তেজনা হয়। কামনা জাগে। বিধ্বংসী একটা ভাব জেগে ওঠে মনে। একজন পুরুষের চোখে এই মূর্তি খুবই বিপজ্জনক। একজন নারীর চোখে এই মূর্তি দারুণ ইশারাময়। যৌনতা এখন আর কোনও বিমূর্ত ব্যাপার নয়। অজিত কর তাঁকে গড়েপিটে নিয়ে এসেছেন, নিজের হাতে করে। 

বিপাসা চেঁচিয়ে উঠল, ওয়াও! কী দুর্দান্ত, স্যার! কী বানিয়েছেন আপনি! 

দীপা বলে একটি মেয়ে বলে উঠল, ওয়াট আ সারপ্রাইজ! কী বিরাট প্রতিভা! 

চারদিক থেকে প্রশংসার বন্যা বয়ে যেতে লাগল। অজিত মিটিমিটি হাসছেন। এই ধরনের প্রশস্তি শুনতে তিনি অভ্যস্ত। কী ধরনের মূর্তি বানালে বা কাজ করলে মানুষের তারিফ পাওয়া যায়, তিনি তা বুঝে গেছেন। এই বাজারটাকে তিনি নিজের হাতের তালুর মতোই চেনেন। দর্শকদের মন, তাদের রুচি, পছন্দ–অপছন্দ, এই সবই তাঁর জানা হয়ে গেছে। 

বিপাসাকে একবার তিনি বলেছিলেন, ধরো, তুমি একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেছ। আমি সেই রেস্তোরাঁর মালিক। আমাকে জানতে হবে না, তুমি কী খেতে ভালোবাসো? সেই অনুযায়ী আমাকে নানা ধরনের সুস্বাদু পদ তৈরি রাখতে হবে না? আমি যদি এইটুকু না বুঝতে পারি, তাহলে আমার ব্যবসা চলবে কী করে? একটা রেস্তোরাঁ কখন লোকের চোখে দামি হয়ে ওঠে? কখন চালু হয়ে ওঠে? 

বিপাসা হাসতে হাসতে বলেছিল, স্যার, আপনি এত বড়ো শিল্পী। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো ব্যবসায়ী...

যেসব শিল্পী বড়ো ব্যবসায়ী হতে পেরেছেন, তাদেরই লোকে চিনেছে গো সুন্দরী...

আর যারা পারেননি? 

ভিখারির মতো জীবন কাটিয়েছেন। সুনন্দকে দেখছ না? 

কথাটা বলেই হো হো করে হেসে উঠেছিলেন অজিত। 

বিপাসা আদুরে গলায় বলে উঠেছিল, সত্যি স্যার, আপনি শিল্পী, ব্যবসায়ী, আর সবচেয়ে বড়ো কথা কী জানেন, আপনার মতো প্রেমিক আমি জীবনে কখনও...

কথাটা সে শেষ করতে পারেনি। উঃ, বলে থমকে গেছিল। অজিত ততোক্ষণে তার স্তনবৃন্তে একটা তীব্র কামড় বসিয়েছেন। 

ঢোকার মুখটায় একটা হইচই শোনা গেল। একদল সাংবাদিক, সঙ্গে তাঁদের ক্যামেরাম্যান, হুড়মুড় করে ঘরের ভিতরে এসে ঢুকলেন। অজিতের সামনে তখন অনেকগুলো মাইক। বিপাসার সামনেই। ক্যামেরাম্যানটা নানা অ্যাঙ্গেল থেকে পটাপট নারীমূর্তিটির ছবি তুলে চলেছেন। 

একটু পরে এসে ঢুকলেন দেবাংশু মিত্র। তিনি একজন প্রসিদ্ধ আর্ট ক্রিটিক। তাঁকেও ছেঁকে ধরলেন সাংবাদিকেরা। দেবাংশু বললেন, আমাকে একটু সময় দিন। অজিতের সঙ্গে তাঁর অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়ে গেল। তিনি মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর খুব মন দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। 

তারপর হঠাৎ, কারো দিকে না তাকিয়ে, নাটকীয়ভাবে এগিয়ে এসে তিনি অজিতকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ দুচোখ দিয়ে তখন দরদর করে জলের ধারা গড়িয়ে নামছে। তিনি বলতে লাগলেন, এ কী করেছো অজিত! আমি যে চোখ ফেরাতে পারছি না! এ যে মহৎ কীর্তি! 

একজন সাংবাদিক জানতে চাইলেন, কেমন দেখলেন,স্যার? 

দাঁড়ান, আগে রবিনসনকে খবর দিই। 

কে স্যার? 

কিথ রবিনসন। বিশ্বখ্যাত আর্ট ক্রিটিক। লণ্ডনে থাকেন। 

তিনি পরপর বেশ কয়েকটা সুইচ টিপলেন। স্পিকার অন করলেন। কথাবার্তা শুরু হল। রবিনসনকে বললেন, অজিত যে আবার বোমা ফাটিয়েছে, কিথ...

কিছুটা শুনেই রবিনসন বললেন, দাঁড়াও, জিম ট্রাম্পকে ধরি...

পাশ থেকে আবার সাংবাদিকটি জানতে চাইলেন, কে স্যার? 

আরে, জিম ট্রাম্প। নিউ ইয়র্কে থাকেন। ইনিও আর্ট ক্রিটিক, ওয়র্ল্ড ফেমাস...

সাংবাদিকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন দেবাংশু, কেন যে এসব মুখ্যুদের পাঠায়...

বিপাসা শুনতে পেয়েছিল। সে খিলখিল করে হেসে উঠল। 

কিছুক্ষণ ধরে কনফারেন্স কল চলল। দেবাংশু বলছিলেন, এ এক মহৎ কীর্তি। নারীদেহে যে এত যৌনতা, লাস্য আর আকর্ষণ থাকতে পারে, এ মূর্তি না দেখলে বোঝাই যেত না...

কিথ বললেন, মূর্তিটা লণ্ডন মিউজিয়ামে পাঠানোর ব্যবস্থা করো...

জিম বললেন, না, না, আমি বরং ওটাকে নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করছি...

এবার এগিয়ে এলেন অজিত। বললেন, ধুর, ওসব লণ্ডন–নিউ ইয়র্ক আমার বহু দেখা আছে। তোমরা ভিয়েনা মিউজিয়ামে ব্যবস্থা করতে পারবে? আমি একবার ভিয়েনা ঘুরে আসতে চাই...

দেবাংশু বললেন, কার্ল শুম্যানকে একবার ফোন করে দেখি তবে...

অজিত বললেন, দেখো। অবশ্য আমি একা যাবো না। বিপাসাও সঙ্গে যাবে...

বিপাসা অজিতের গলা জড়িয়ে ধরে আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। 

ঠিক এই সময় ঢোকার মুখটায় আবার হইচই শোনা গেল। দেবাংশু মুখ তুলে বললেন, ওই যে, জ্যোতিষ্ক এসে গেছেন...

জ্যোতিষ্ক বসু একটি বাংলা আর্ট ম্যাগাজিনের জাঁদরেল সম্পাদক। মস্ত তাঁর ভুঁড়ি। সেই ভুঁড়িতে সুন্দরী মেয়েদের তিনি বসতে দেন। তারপর ভুঁড়ি দুলিয়ে দুলিয়ে তাদের তিনি আরাম দেন। আর মেয়েগুলি খিলখিল করে হাসতে থাকে। 

ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে আসতে জ্যোতিষ্ক বলছিলেন, কোথায়? কোথায় সেই মহান সৃষ্টি?   

দেবাংশু এগিয়ে এসে গদগদ হয়ে বললেন, এই যে, এদিকে এসো...

জ্যোতিষ্ক কিছুক্ষণ থম মেরে মূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, এ যে বিস্ময়কর কাজ! অজিত ছাড়া আর কেউ পারবে নাকি? অজিত, আজ শ্যাম্পেন হয়ে যাক...

অজিত এগিয়ে এসে বলল, শ্যাম্পেন পরে হবে। কার্ল শুম্যান তোমার বন্ধু না? আগে ওঁকে ফোন করো। বিপাসাকে নিয়ে আমি একবার ভিয়েনা আর জুরিখটা ঘুরে আসতে চাই। 

জ্যোতিষ্ক একটু থতমত খেয়ে গেছিলেন। বললেন, বিপাসাকে নিয়ে তুমি কার্লের ওখানে যাবে? কার্লকে তুমি চেনো না? বিপাসাকে আর ধরে রাখতে পারবে? 

অজিতের চোখ দপ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু বিপাসা আর কোনও ঝুঁকি নিল না। অজিতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, তুমিই আমার সব। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাবো? 

অজিত শান্ত হল। বিপাসার গালে একটা টুসকি মেরে বলল, মাই গার্ল। মাই গার্ল। 

বিপাসা আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। জ্যোতিষ্ককে এখন ঘিরে ধরেছে সাংবাদিকেরা। তাঁর মুখের সামনে অনেকগুলো মাইক। 

একজন প্রবীণ সাংবাদিক জানতে চাইলেন, কেমন দেখছেন স্যার? 

এ তো এক কালজয়ী কাজ! জ্যোতিষ্ক বললেন। 

পিছন থেকে এক তরুণ সাংবাদিক জানতে চাইলেন, কী বলছেন উনি। 

প্রবীণ সাংবাদিকটি কায়দা করে বললেন, আ মাস্টারপিস! 

তরুণ সাংবাদিকটি চেঁচিয়ে উঠলেন, এই টুকে নাও। 

তারপর শুরু হল টোকাটুকি। সবাই মিলে টুকছে। ভিড়ের মধ্যে এ ওকে খোঁচা দিচ্ছে। ও একে চিমটি কাটছে।  এক মহিলা সাংবাদিকের পিছনে এক প্রবীণ সাংবাদিক চিমটি কাটতেই মহিলাটি মিষ্টি হেসে বলল, অসভ্য! 

ভালো লেগেছে? প্রবীণ সাংবাদিক জানতে চাইলেন। 

নাঃ! আগে বলুন, কী টুকতে হবে...

বলব। কিন্তু তারপর একটু হাত বুলিয়ে দেব। রাজি তো? 

মহিলা আবার মিষ্টি করে হাসলেন। তাঁর গজ দাঁত বেরিয়ে পড়ল। তিনি বললেন, কেউ যেন দেখতে না পায়...

প্রবীণ সাংবাদিকটি বললেন, আপনি কী এরকমই? 

মানে? 

মানে, সারাজীবনই টুকে পাশ করেছেন? 

সারাজীবন। 

আপনার বডিটা এত অ্যাকটিভ। মগজটা অমন ইনঅ্যাকটিভ কেন? 

মহিলা মিষ্টি করে আবার হেসে বললেন, মগজটাকে নেগলেক্ট করেছি। শরীরটা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম না...

ঠিক সেই সময় জ্যোতিষ্ক চিৎকার করে বলছেন, কালকের কাগজে আপনারা লিখবেন, হ্যাঁ, আপনাদের লিখতেই হবে...

সুনন্দ আর আনন্দ ওই ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। ফাঁকা, নিরিবিলি রাস্তা। দু'ধারে বড়ো বড়ো গাছ। ছিমছাম পরিবেশ। আনন্দ জানতে চাইল, কেমন দেখলেন, কাকু? 

সুনন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, এই, অজিতের কাজ যেমন হয় আর কী! 

তার মানে? 

স্রেফ একটা নারী শরীর। গরম তাওয়া থেকে সদ্য নামানো। যেন ফুটছে। কোনও প্রাণ নেই। আত্মা নেই। হৃদয় নেই। 

এটা কী আর্ট? না পর্ণোগ্রাফি? 

মাস্টারপিস। হো হো করে হেসে উঠলেন সুনন্দ। চারপাশের নির্জনতা যেন চমকে উঠল। তারপর বললেন, সবটাই মিথ্যা। কৃত্রিম। ভাণ। নাটক। অভিনয়। ও দারুণ অভিনেতা। প্রতারক। প্রবঞ্চক। শিল্পের নামে লোক ঠকানোই ওর ব্যবসা। 

একদম বিপাসার মতো দেখতে, কাকু। 

সুনন্দ বললেন, বিপাসাকে নিজের মন থেকে মুছে ফেলো, আনন্দ। ও সুন্দরী হতে পারে। কিন্তু খুব সস্তা। তুমি এমন কাউকে খুঁজে নাও, যার দাম আছে। ওজন আছে। গুণ আছে। 

আপনি অজিত বাবুকে ঈর্ষা করেন কাকু?

করি। 

কেন কাকু? আপনি ওঁর চেয়ে অনেক বড়ো শিল্পী। 

লোকে কী বলে? 

আপনি ওঁর জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা করেন তাহলে? 

করব না? ও সস্তার জিনিস চড়া দরে বিক্রি করছে। আর আমি দামি জিনিস নিয়ে দেউলিয়া হয়ে বসে আছি। কেউ আমাকে চেনে? কেউ আমার কাজের দিকে ফিরেও তাকায়? আমার কষ্ট হবে না? আমার বুক ফেটে যায়, আনন্দ...

আনন্দ বলল, কাকু, অজিত বাবু একজন ব্যবসায়ী। আপনি একজন শিল্পী। তফাত থাকবে না? বুকের কষ্ট নিংড়ে আপনি মূর্তিগুলো বানান। জীবনের গভীর ক্রাইসিস থেকে উঠে আসে আপনার শিল্প। আর অজিত বাবু জানেন, কোন জিনিস বাজারে খাবে, সস্তায় বিকোবে। এমন কেউ কী আপনার ঈর্ষার যোগ্য? 

তবু ওকে আমার ঈর্ষা হয়, আনন্দ। মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, জীবনে ও সব পেয়েছে। সুন্দরী নারী, দামি মদ, বিদেশ যাত্রা, পুরস্কার উপচে পড়ছে ওর জীবনে। আর আমি? ভিখিরির মতো অবস্থা আমার। লোকের করুণার পাত্র! মানুষ দামি জিনিসের মূল্য বোঝে না? সস্তার জিনিসকে দামি করে তোলে? কেন আনন্দ? কেন এই অবিচার হয় প্রকৃত শিল্পীদের প্রতি? 

সুনন্দর বাংলো টাইপের বাড়ির সামনে ওরা চলে এসেছিল। ছোটোখাটো, ছিমছাম বাড়ি। সামনে একটা বাগান। সুনন্দ বললেন, আমার যৎসামান্য আয়ে এর চেয়ে ভালোভাবে আর থাকা যায় না আনন্দ। 

আনন্দ বলল, ভেতরে আর যাবো না, কাকু। মায়ের বয়স হয়েছে। বাড়িতে অপেক্ষা করে আছেন। 

এক কাপ চা খেয়ে যাও। সুনন্দ বললেন। তাছাড়া, একটু দ্বিধা নিয়েই যেন যোগ করলেন, একটা নতুন কাজ করেছি। দেখে যাবে না? 

আনন্দের আর সঙ্কোচ রইল না। সুনন্দ মিত্রের নতুন কাজ? আকুল পিপাসা জেগে উঠল আনন্দের মনে। সে গরিব হতে পারে। কিন্তু শিল্পের ঝুনো সমঝদার! আর এটা বোঝার জন্য তার নিজের ভেতরের আত্মবিশ্বাসই যথেষ্ট। কারো সার্টিফিকেটের দরকার নেই। 

সুনন্দর স্টুডিওটা বাড়ির ছাদে। ছোটো একটা স্টুডিও। অজিত করের স্টুডিও এর চেয়ে আকারে দশগুণ বড়ো। সেখানে কত দামি দামি উপকরণ। সুন্দরী মেয়েদের ভিড়। তার সঙ্গে এই দীনহীন স্টুডিওর যেন কোনও তুলনাই চলে না! 

কিন্তু এ কী বানিয়েছেন সুনন্দ মিত্র? আনন্দ যেন দিশাহারা হয়ে গেল। এও এক নগ্ন নারীমূর্তি। কিন্তু এর শরীরটা যেন নিছকই বাহুল্য। মেধা, বোধ, প্রজ্ঞার দীপ্তি যেন ঝলসে উঠছে এর সর্বাঙ্গ দিয়ে! সুনন্দ যেন এই নারীর আত্মাকে, তার প্রাণকেই বার করে এনেছেন। তাকে দৃশ্যমান করে তুলেছেন। তাকে গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন। এ যে অসাধ্যসাধন! 

মাস্টারপিস! আনন্দ অস্ফুটে বলে উঠল। কী করে পারলেন কাকু? 

চিনতে পারছ? সংক্ষেপে জানতে চাইলেন সুনন্দ। 

এ তো কাকু সেই প্রাচীন লোকদেবী। বনবিবির একটা বিরল রূপ। জঙ্গলের ভিতর সেই প্রাচীন মন্দির। তার দেওয়ালের গায়ে আঁকা ছিল...

তোমার মনে আছে তাহলে! মলিন একটা হাসি ফুটে উঠল সুনন্দর মুখে। 

আপনি সেই লোকদেবীকে জীবন্ত করে তুলেছেন! মনে হচ্ছে, কথা বলা যায়। হ্যাঁ, দেবী যেন এক্ষুণি কথা বলে উঠবেন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত চোখের দীপ্তি দিয়ে বিদ্ধ করবেন আমাকে। 

খুব পরিশ্রম হয়েছে জানো। সুনন্দ বললেন। গত সাত মাস ধরে দিনরাত এক করে খেটে চলেছি। জঙ্গলের ভিতরে এক বিশেষ ধরনের মাটি পাওয়া যায়। দিনের পর দিন সেই মাটি বয়ে এনেছি। বাইরে থেকে আনিয়েছি এক বিশেষ ধরনের পাথর। তাতেও অনেক খরচ হয়েছে। ওই মাটি আর পাথর ছাড়া এই মূর্তি তৈরিই করা যেত না...

আপনি একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকতে পারেন  না কাকু? 

একজনও আসবে না। কে চেনে আমায়? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সুনন্দর। মুখটা কালো হয়ে এল আনন্দের। বলল, এই সমাজে খাঁটি শিল্পীদের তাহলে কোনও স্বীকৃতি নেই? 

সমাজটাকে দেখো, আনন্দ। মানুষের মেধা, রুচি, সমর্থন কোথায় নেমে গেছে! সস্তা জিনিসকে দামি জিনিস বলে বাজারে ছাড়ো। তবেই না প্রফিট হবে! আর যত বেশি প্রফিট হবে, ততো বড়ো ব্যবসায়ী তুমি। ব্যবসা না করে এই সমাজে কেউ টিঁকে থাকতে পারে? শুধু শিল্পীর কোনও দাম আছে কোথাও? কিন্তু শিল্পী হিসাবে আপনার সঙ্গে তো অজিত করের কোনও তুলনাই হয় না...

কাকে বোঝাবে তুমি সে কথা? সবাই ওকেই চায়। মিথ্যের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত কিছু! গোটা সভ্যতা! আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না...

শেষের দিকে ম্লান হয়ে এল সুনন্দর গলা। ভেতরের ঘরে গেলেন তিনি। ঠিক সেই সময় ঘরে এসে ঢুকেছিল তাপস। প্রবলভাবে ঘামছে সে। 

প্রেস কনফারেন্স শেষ হয়ে গেছে? 

হুম। গম্ভীর হয়ে গেল তাপস। বলল, আর তারপর যা কাণ্ড! কোমর থেকে আধাআধি ভেঙে পড়ল মূর্তি! সে এক কেলেঙ্কারী! এত ভঙ্গুর সেই কাজ! 

মাস্টারিপস কীনা! কালজয়ী! মহৎ! 

এখন সেই মূর্তির মেরামতি চলছে। অবশ্য খুবই গোপনে। বিপাসাও হাত লাগিয়েছে...

মেরামত করা যাবে? 

কেন যাবে না? সস্তার কাজ। এদিকে দাম ঠিক করা হয়েছে, কয়েক কোটি টাকা...

ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতর থেকে একটা গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। তাপস ছুটে গেল সেদিকে। 

আনন্দ যেন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার গাল বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে নামছে। রীতিমতো গরম সেই জল। সে প্রায় প্রলাপের মতো করে বলতে লাগল, এ কী করলেন কাকু? কেন কাকু? কার জন্য করলেন? আর সহ্য করতে পারলেন না? এমন একজনের জন্য, যে আপনার যোগ্যই ছিল না? একটা বামনকে ওরা দানব বানিয়ে দিয়েছে, আর সমাজের সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলেন আপনি? এইভাবে আত্মোৎসর্গ করলেন, অকারণে? 

তাপস বেরিয়ে এল ঘর থেকে। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে সে। ঘামছে। 

কী দেখলি তাপস? খুব ক্লান্ত শোনালো আনন্দের গলা।

উনি ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন। ফিসফিস করে বলল তাপস। তারপর মাথা নিচু করল।


***********************************************************************************************



রাহুল দাশগুপ্ত

বিশ্ব সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের অলিগলি তাঁর নখদর্পণে। গল্প , কবিতা , উপন্যাস --- সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর  স্বচ্ছন্দ  বিহার। কবিতা ও উপন্যাসের উপর আলোচনা গ্রন্থও রয়েছে রাহুলের | তাঁর সুসম্পাদনায় ' চিন্তা ' সাময়িকপত্রটি ইতিমধ্যেই সাহিত্যমোদীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন