জীবন যেরকম
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
বন্ধুর অনুরোধে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসান দেখতে যাওয়া।সারা রাত জেগে জনগণের আনন্দ উদ্দীপনা হাত পেতে চেটেপুটে খাওয়া। বড়ো সুখ সারা বুক জুড়ে। সকালে একটু বিশ্রাম ও খাওয়াদাওয়া করে বাড়ির পথে।
ষ্টেশন একটু ফাঁকাই আছে। জনতার ঢল আগেই বয়ে গেছে নদীর মতো আগের বর্ধমান লোকালের কামরায়, বোঝা গেল।তাই ফাঁকা ব্যান্ডেল লোকালে উঠতে যাবো , হঠাৎ পিছনের পায়ে একটা লোহার কিছুর জোরে চাপ।পা জ্বালা করে উঠলো। বুঝলাম, চামড়া কেটেছে। বিরক্তিতে পিছনে তাকাতেই দেখলাম, এক বয়স্ক ভদ্রলোক হাতের লাঠি দিয়ে ঠেলছেন কামরায় ওঠার জায়গা ফাঁকা করতে। ওনার পিছনে একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার হাত শক্ত করে ধরে আছেন। বুঝলাম সব।তখনও লোক নামছে।একটু পিছিয়ে এসে ওনাদের জায়গা করে দিলাম ওঠার।সকলের নামা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক ওঠার মরিয়া চেষ্টা করছেন। ওনার পা সায় দিচ্ছে না। কোমড়ে একটু ঠেলা দিয়ে ওনাদের তুলে দিলাম কামরায়। পিছনে অসহিষ্ণু আওয়াজ। গাড়ি ছাড়ার হর্ন বাজছে। অনেকেই দাঁড়িয়ে তখনও প্ল্যাটফর্মে। তাড়াহুড়ো চললো।
গাড়ি ছাড়তে বয়স্ক মানুষদুটিকে ফাঁকা সিটে বসিয়ে দিলাম। দুজনেই তখনও কাঁপছেন।শরীরে ধকল গেছে বোঝা গেল। ওনাদের উল্টোদিকের সিটে বসলাম।
কথা বলতে ইচ্ছা করছিল ওনাদের সাথে।একটু সময় দিলাম ওদের। দুটো ষ্টেশন যাবার পর ভদ্রলোক মুখ তুলে মুচকি হাসলেন। বুঝলাম কৌতুহল মেটানোর এটাই সেরা সময়। প্রশ্ন করে বসলাম : " সঙ্গে আর কেউ নেই? এই ভিড়ে বয়স্ক দুজন বেড়িয়েছেন?"
প্রশ্ন শুনে একটু বিরক্ত হলেন মনে হল। আস্তে আস্তে কপালের কুঞ্চন উধাও হলে বলে উঠলেন :" আমাদের আর কেউ নেই।তাই এভাবেই দুজনকে বেরতে হয়"। ওনার কথার সুরে বুকের ভেতর কেমন যেন ধাক্কা লাগল। ওনার গলার আওয়াজে লুকিয়ে যেন চাপা কান্নার সুর। ভদ্রমহিলা জানালার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলে উঠলেন : " যার কেউ নেই , তার ঈশ্বর আছেন।এই দেখুন না , ঈশ্বর কেমন আপনার রূপ ধরে আমাদের সাহায্য করলেন। প্রতিবারই এটা হয়।তাই আর ভয় পাই না। বেড়িয়ে পড়ি দুই বুড়োবুড়িতে।আর কদিনই বা আছি....! "
ভদ্রমহিলার শেষের কথায় জীবনের শেষ সত্যর দর্শন। ওনার চোখের দিকে তাকালাম। কান্না লুকাতে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন উনি জানালার দিকে। আমাদের ঘিরে থাকা নীরবতায় শুধু রেলের চাকার আওয়াজ।এই আওয়াজ শুনলেই বড়ো মন কেমন করে ! মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। খুব বেড়াতে ভালোবাসতেন মা। কিন্তু অস্টিও আর্থারাইটিসের কারণে বিছানায় শয্যাশায়ী মাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া যেতো না। পুরো শরীর কুঁকড়ে এতোটুকু হয়ে গেছিল !
হঠাৎ ভদ্রলোক আমার হাতদুটোকে আঁকড়ে ধরলেন। কাঁপা গলায় বলে উঠলেন : " ধন্যবাদ তোমাকে। আসলে আমাদের একটা ছেলে ছিল। তোমারই বয়সী।ও বিদেশে পড়তে গিয়ে আর দেশে ফিরলো না। ওখানেই থেকে গেল। ফিরবে না বলে দিয়েছে। প্রথম দিকে কষ্ট হতো খুব।এখন মানিয়ে নিয়েছি।নাতিটাকে এবয়সে কাছে পেতে খুব ইচ্ছা করে। "
ওনার শেষের কথাগুলো শুনতে শুনতে ওনার মুঠোয় ধরা আমার হাতে সারা শরীরের কাঁপন বলে দিচ্ছিল কতো অজানা কষ্টের গল্প !
*********************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন