বুধবার ! দুপুর 2.38
মল্লিকা রায়
তখনো টিপ টিপ বৃষ্টি সাইড ব্যাগ থেকে ছাতাটা টেনে বার করে খুলে ধরে মাথার ওপর। ছোটবেলা থেকেই প্রত্যয়ী,আত্মবিশ্বাসী বিদেশি সংস্থায় কর্মরত কেয়া।বাবা, ছোট ভাই আর ঠাম্মির সংসারের হাঁ'মুখ গুলো দিনান্তে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকেই। ক্লাশ ফোরের মংলু গোটা পরিবারের দায় সম্পর্কে এখনও অজ্ঞ। সময় মতো খাবারটুকের আশায় মুখিয়ে থাকা বিরাশির বাবার চোখের কোনে চিকচিকে অশ্রুর ফোটা দেখলেই ওড়না দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে কেয়া। মাথা নেড়ে বোঝাতে চায় - না বাবা এসব করতে নেই। দিনের তিনভাগ কাটে ঠাম্মির ঠাকুর দেবতার ঘরে। তাদের জাগানো,বিছানা গোছানো,থাল্ বাসন ধোওয়া,সিংহাসন পরিস্কার করা,জামা কাপড় ধোওয়া,ফুল তুলসি সংগ্রহ, ঘর ধোঁওয়া মোছা কত কি, ভোর পাঁচটা থেকেই শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম-ছোটকাল্ থেকেই ঝিম্ মেরে শুনত বিছানাতেই। মা তখন রান্নাঘরে আটায় ময়াম দিতে ব্যাস্ত। দশ দশটা পাত্। ঢেউ খেলানো কাঁসার বাটিতে গুনে গুনে মেট্রোর দুধ আর তিনটে করে রুটি সাজিয়ে রাখা খাবার টেবিল। চেঁচিয়ে বলতেন জাম্ বাটিরটা রাখিস ওর শোবার ঘরের টেবিলে অর্থাৎ ওর বাবা, গটগটে তেত্রিশ। স্যুট বুটের পদস্থ সরকারি অফিসার। তার প্রাত:রাশ থাকত শুধুমাত্র রবিবার। রান্না ঘর থেকে ভেসে আসত অদ্ভুত ভাতের গন্ধ। সেই গন্ধ আজ আর পায়না কেয়া। প্রসবাসন্ন মা হাঁটতেন ওকে ভর করে। ক্লাশ নাইনের ও জানত না বিষয় আষয়, সংসার ধর্মের গুরুত্ব। মাছ নিয়ে তখনো রাগারাগি। ল্যাজাটা,মুড়োটা কেন বাড়ির পুরুষেরা খাবে। ওর তো ইচ্ছে হয়। তিন কাকা জেঠুর একত্রিত বিশাল পরিবারে হৈ হল্লা আনন্দ মজা সে-কি কম কথা। ভাই বোন খেলা ধূলো কাকা জেঠুর কাছে বায়না আবদার - সে এক অন্যরকম ব্যাবস্থা। ধীরে ধীরে ভেঙে গেল সব চোখের সামনে।দু'দিনের সামান্য জ্বরে দাদাই বিদায় নেবার পর বিয়ের দু'মাসের মাথায় মেজ্'কা শিফ্ট করল শ্বশুরের দেওয়া নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে। ছোট'কা ভাড়া বাসায়। গাড়িতে উঠে বিদায় জানাতে সে কি দুরবস্থা। কেউ কারুর হাত ছাড়ে না। টেনে পৃথক করা হয়েছিল ওদের ভাইবোন তন্ত্র। আর জেঠু অর্থাৎ কেয়ার বাবা জমি জায়গা সব বেঁচে কেনে ভাইদের দেনা শোধ করে একফালি ঘর বারান্দা আর একরাশ অশ্রু নিয়ে আজো ছলছল্ করে থাকে। বোঝেন না বিষয় সম্পত্তি কি নিদারুণ জিনিস। কেয়ার রাগ হয় খুব। ভাই বোন নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া লোকটার পরিবার তন্ত্র নিয়ে এত হা' পিত্যেশ করার কারণটা কি? যখন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে সম্পর্ক নামক জটিলতার শেকড়ে মুড়িয়ে অসম্মাণ,বেদনা ছাড়া কোন প্রাপ্তি শূণ্য যেখানে, এই বৃদ্ধ কবেকার সেই রদ্দি মাটিতেই গ্রোথিত করে রেখেছে যাবতীয় পারিবারিক মূল্যবৃদ্ধি। কেন বোঝেন না শিশুকাল প্রাণীর একটি নিয়মমাত্র - সময়ের সাথে সাথে যা লুপ্ত হয় নৈমিত্তিক চেতনাবোধের সঙ্গে। বুঝতেই চান না বৃদ্ধ। পেছন থেকে এসে জাপটে ধরা চোখ সেই ফুটফুটে নাতি ধুতির কোঁচ খুলে দিয়ে সিঁড়ির তলায় লুকোনো। চেঁচিয়ে বলতেন "ওরে শয়তান আমি তোর প্যান্টালুন দেখতে পাচ্ছি,
"না না বৌমা, ওকে খেলতে দাও" ওর মায়ের হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে সে কি দৌড়াদৌড়ি। নাতিতে দাদুতে সে এক সাঙ্ঘাতিক মঞ্চায়ন।
হয়তো সেই দিনটার কথাই -।
"সাবধানে দিদি" ! পাশ ঘেঁষে বেড়িয়ে যায় একটা ছোট মারুতি। বর্ষাকাল,জমা জল কাদা কাপড়ে ছিটে একাকার পাশে চোখ পড়তেই।
"হ্যাঁ দিদি আর একটু হলেই - "
"হ্যাঁ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম - আজ আর অফিস যাওয়া হল না অগত্যা, আপনাকে তো ঠিক -"
"চিনলেন না তাইতো "
হ্যন্ডসাম না হলেও চলন বলনে বেশ একরকম মিষ্টতা আছে। চেনা লাগছে খুব -
সাহিত্যিক ঋষভ সেন! প্রবাসে থাকি।
"রোদ্দুর" উপন্যাসের জন্য সেরা জীবনানন্দ এওয়ার্ড পেয়েছেন শীর্ষে এসেছেন সম্প্রতি। এখানে কেন, জানতে চাইলে -
"এমনিই"
হাত নেড়ে একগাল হেসে উত্তর দিলেন।
"আরে না না, এসেছি একটা কাজে, সপ্তাহখানেক লাগবে,দেখলাম আপনি বেশ অন্যমনস্ক একটু হলেই পড়তেন গাড়ির তলায়"।
"উপন্যাসটি পড়ে ফ্যান হয়ে গেছি আপনার। উ: কি সাঙ্ঘাতিক মহিলা দর্শন। উদ্বুদ্ধ হলাম "।
পাঁচ ফর্মায় ক্লিপিংস করা, একটা শুকনো গোলাপ তাতে -
" এই দেখুন "
একথা সত্যি, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীদের পার্সেন্টেজ চালু হলেও উপকৃত হয়নি এক চতুর্থাংশ। অদ্ভুত এক সামাজিক বেড়াজাল তৈরী করে তাদেরকে রাখা হয়েছে ব্রাত্য করে। সবথেকে দু:খের বিষয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কৃত সাফল্যকেও ! একদল স্বার্থান্বেষী পুরুষ নিজেদের সুবিধার্থে এদেরকে প্রচারে আনতে অপারগ। বেনো জল ঢুকে গেছে পরিচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থায় "।
"আপনি একথা ভাবেন জানি এবং গভীরভাবেই, কি আশ্চর্য দেখুন ! একদল নারী ঘাম রক্ত ঝরিয়ে কি কঠিনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে নিজের পরিস্থিতি, অপরদিকে আর একদল নারী হয়েও _ উচ্ছসিত কেয়া।
"আর প্রকৃতপক্ষে এরাই সমাজ,সংসারের প্রকৃত শত্রু, উন্নয়ন বিমুখ সহজলভ্যে অভ্যস্ত,কর্মবিমুখ এরাই আপনাদের উন্নতির প্রধান অন্তরায় - এ্যম আই রাইট !
ঋষভ আর দৃষ্টিতে বুঝে নেয় কেয়ার মানসিক পরিস্থিতি - বেশ উজ্জল চেহারায় দুর্দান্ত আভিজাত্য,একরাশ জলকাদা মাখা এ অবস্থা যদিও প্রেমালাপের পক্ষে মোটেই সঠিক পরিস্থিতি নয়। তথাপি পরিবেশটা অনেকটা রোমান্টিক লাগছে ঋষভের। আকাশে সাদাকালো হালকা মেঘের আস্তরণ, নামবো নামবো করেও সময় নিচ্ছে বৃষ্টি। স্নানসিক্ত প্রকৃতি ঘন, কচি সবুজে পরিপূর্ণ। লাল,হলুদ,গাঢ় নীল ফুলের রাশি ছড়িয়ে উদ্বেলিত করে চলেছে আকাশি আমন্ত্রণকে। পথ ঘাটে এতটুক ধূলা ময়লা নেই। ঘনিষ্ঠ হয়ে প্রেম জমাবার এইতো সঠিক মুহূর্ত। দু' কলি গুনগুনিয়ে ওঠে আপন মনে।
" মন মোর মেঘের সঙ্গী - আপনি গানও জানেন? মুচকি হেসে ওর দিকে তাকায় কেয়া।
হুম্ - জানি মানে ফাটাফাটি "
"একগোছা টকটকে গোলাপ দিন না আঙ্কেল " রাস্তার একপাশে অন্ধ ফুলওয়ালার দিকে হাত বাড়ায় ঋষভ। রজনী, হাস্নুহেনা, বিবিধ ফুলের সমাহার চলতি শহরটাকে যেন মনে করিয়ে দেয়, ফুলের মত স্বচ্ছ পবিত্রতা আর কোথাও নেই। সত্যিই তাই। প্রায় প্রতিদিন ওর ভাসে টাটকা ফুলের তোড়া না থাকলে মন ভালো থাকেনা ঋষভের। জানে বাড়ির সকলে। ওর ভুল হলেও ভুল হয়না বেনু কাকার। বাজার থেকেই চলে আসে বিনা লিস্টিতে।
চমৎকার লাগছে ' হালকা খোপায় টকটকে আধফোটা কুড়ি অনেকটা সেই রবীন্দ্র না জীবনান্দ -
"তোমার চুলে যে রোদ- মেঘের মতন চুলে তোমার চোখে যে রোদ- সেও যে মেঘের মতো চোখ কেমন বৃষ্টি ঝরে- মধুর বৃষ্টি ঝরে ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে- রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ - "
জীবনানন্দ - আমার ফেভারিট উচ্ছসিত কেয়া, থমকে দাঁড়ায় দু'জনা। খুব কাছাকাছি। টিপটিপ বৃষ্টি গুড়ো বরফ হয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে প্রেম বর্ষণ। আধো অন্ধকার ঋতু ঘটায় আচ্ছন্ন দু'টি মানুষ মানুষী।
থাক না " চেপে ধরে ডান হাতটা কেয়ার। বার করা হয়না ছাতা ব্যাগেই রয়ে যায়।
ঐ যে ফেরার পথ ! বুধবার ! দুপুর 2.38 হাত ঘড়ি দেখে নেয় কেয়া।
************************************************************************************************
স্কুল ম্যাগাজিন থেকেই লেখালেখি শুরু। পরে বিবিধ পত্র পত্রিকায় ছোট গল্প,কবিতা এবং শুকতারায় লেখা প্রকাশিত হয়। পরে সাহিত্যের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। দুটি কবিতা সংকলন "ভালোবাসা ও কবিতা সংকলন" এবং তিনটি উপন্যাস সহ "একের ভেতর তিন " অনলাইন শপিজেন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় 2021 সালে। অনলাইনে লেখালেখিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাংলা কবিতা আসরে 2000 কবিতা আছে। প্রতিলিপি সাইটে গল্প উপন্যাসসহ বহু লেখালেখি সংরক্ষিত রয়েছে। আর্থিক পরিস্থিতি উন্নত না হলে খরচ বহন করা সম্ভব নয়।



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন