কুয়াশাবলয় : দুই
সুধাংশুরঞ্জন সাহা
একদিন কেটে যায় জীবনের মেঘ,
মনের আলোয় ভাসে সঘন আবেগ।
হারানো দিনের খোঁজ রাখে সদা মন,
রাত্তির ঘুমিয়ে কাদা হেলায় সমন।
অর্ধেক জীবন কাটে মোহ হিংসা লোভে,
বাকিটা বিনষ্ট হয় অভাবের ক্ষোভে।
এ-জীবন নিয়ে আমি কোন দেশে যাই,
মাটি মাটি করে পাই মাটিতেই ঠাঁই।
পাগল পাগল লাগে মাথা সর্বক্ষণ,
অসময়ে ঘটে থাকে যত অঘটন।
মাটিকে আমি মা বলে চিরকাল মানি,
শ্রীহীন মাটির মাকে সবটুকু জানি!
মা আর মাটির কথা আমাদের ভাষা,
মাতৃভাষা নিয়ে তবু মাটি হয় আশা।
সময় থেকে জীবন রোজ কিছু শেখে,
বেলা থেকে অবেলায় দিন যায় বেঁকে।
এভাবে ফুরোয় দিন রাতের কোটরে,
পথের কাছেই পথ মাথা কুটে মরে।
না বলা কথার ঢেউ আমি লিখে রাখি,
অচেনা পথের কাছে ধরা পড়ে ফাঁকি।
ডুবতে ডুবতে আর ভাসতে ভাসতে,
কোথায় এলাম নদীকে ভালোবাসতে!
নদীর সম্মতি ছিল? আজও জানি না,
সংরাগ ও দাহ নিয়ে পেতেছি বিছানা।
মনখারাপ গাছের ভাষা আমি চিনি,
আর জানি কান্নাভেজা নদীর কাহিনি।
ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত পথঘাট বাড়ি,
এ কেমন যাত্রাপথ দিতে হবে পাড়ি।
বসন্তেই নরনারী প্রেম নিয়ে ভাবে,
শীতকাল কেটে যায় নানান অভাবে।
চুপচাপ ছিল যারা সারাটা জীবন,
তাদের কথাই আজ ছুঁয়ে যায় মন।
পাখির কথাই ধরো মুখে নিয়ে কুটো,
যত্নে বোনে খাসা বাসা স্বপ্ন এক মুঠো।
এসব বিষয় নিয়ে কথার কোলাজ,
ঝরাপাতার সংসারে নাই তার সাজ।
অচেনা পথের বাঁকে মেঘ ছুটে আসে,
ছোট ছোট চারাগাছ মিটি মিটি হাসে।
হারানো পথের শেষে ভিন্ন পথ আসে,
পথের ছায়ায় নাকি রূপকথা ভাসে।
শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে গ্রাম,
আগাছায় ঢাকা পড়ে শহরের নাম।
ফুটপাতের আদা-চা গল্প বলে কত,
মানুষের অলিখিত স্বভাবের মতো।
মানিক, জীবনানন্দ পড়ে কেউ কেউ,
গলা ছেড়ে গানে তারা তোলে কিছু ঢেউ।
জীবন ফুরিয়ে যায় নানাবিধ চাপে,
বিরোধিতা ছিল মনে অঘোষিত ধাপে।
যারা যারা ছিল কাছে, ছিল দরকারে,
সংসার সীমান্তে এসে বুঝি হাড়ে হাড়ে।
যে কথা বলিনি আগে আজ বলি তবে,
জীবনের বাকি কথা কবে বলা হবে?
গ্রাম ফুসলিয়ে এনে এ-শহর বাড়ে,
নৈশ অন্ধকার এসে কোন আলো মারে?
হৃদয়ে রাখলে হাত নানা প্রশ্ন ওঠে,
মাঝে মাঝে সরোবরে পদ্ম ফুল ফোটে।
মধ্যবর্তী শূন্যতাকে বারেবারে ছুঁই,
অভাবী নদীর মতো ভালোবাসি ভুঁই।
সেই সব বোবাযুদ্ধে আছে নানা দিক,
সহজ বিশ্বাসে ভরা হৃদয় অধিক!
নষ্টরাত ঘিরে শুধু কুয়াশার বৃত্ত,
অকারণ নীরবতা ছন্দ সুরে তৃপ্ত।
আদি নেই অন্ত নেই অন্ধকার পথ,
পথিক ভুলেছে বুঝি আলোর সপথ।
মৃত্যু আর যুদ্ধ ছাড়া সব অভিনয়,
মিডিয়া আর জংশন প্ররোচনাময়।
একদিন এইসব মিথ্যা পুড়ে যাবে,
ফুরোবে অপেক্ষা যত আপন স্বভাবে।
তবু কিছু কথা থাক ভাবনায় মিশে,
বিনিদ্র রাতের গান চোখের নিমিষে।
বর্ষার মেঘের মতো ইতিহাস থাক,
শিরদাঁড়া নিয়ে আজ মানুষ সজাগ।
সাদা ক্যানভাস জুড়ে থাক অপরাধ...
ঠোঁটের সহজ রঙে আকাশ অবাধ।
অবাক কাজল চোখে শরৎ আকাশ,
অনুভবে মিশে থাকে নির্মল বাতাস।
কিংবা উন্মাদের পাঠে অন্তহীন গান।
গানের ভুবন নাকি সমুদ্র সমান।
ফিরে ফিরে আসে যদি সেই গানপাখি,
আগুনের বর্ণমালা তুলে ধরে ফাঁকি।
ফুঁসে ওঠা রাতকথা জানে অন্ধকার,
কত ফাঁক থেকে যায় এই অজ্ঞতার।
দিনান্তের সান্ধ্যভাষা কাছে কাছে রাখি,
অলৌকিক ভোরে আসে আগুনের পাখি।
মনে কিছু শান্তি আনে মায়াবী পোশাক,
অঘোষিত ভালোবাসা ভাষা খুঁজে পাক।
শিল্পিত বাঁচার কথা কিছু লোক ভাবে,
জীবন কাটায় তাঁরা নানাবিধ চাপে।
জীবনের জলাশয়ে অনন্ত সাঁতার,
আচরণে মূল্যবোধ, দায় শূন্যতার।
ঘরে ঘরে দমবন্ধ শুধু অন্ধকার,
অলীক কফিন ঘিরে ওঠে হাহাকার।
দলিল তথ্য প্রমাণ দায়শূন্য নাকি,
মৃত্যুর হদিস কেন থেকে যায় বাকি?
ছায়ার শরীর নিয়ে পৃথিবীর ক্ষত,
চাঁদের পাহাড়ে কারা কাটাছেঁড়া রত?
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেউ মিথ্যে স্বপ্ন দেখে,
স্বপ্ন ডানা ঝাপটায় রাত জেগে জেগে।
শব্দের অরণ্যে থাকে জীবনের ক্ষত
শূন্যের ভিতর শূন্য অফুরান ব্রত।
******************************************************************************************************
জন্ম ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৭। বেড়ে ওঠা পূর্ব কলকাতায়। ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক।আটের দশক থেকে লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লিখেই তার যাবতীয় পরিচিতি । কবিতা ছাড়াও গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ এবং বিদেশি কবিতা অনুবাদ করতে ভালোবাসেন। সম্পাদনা করেন একটি অনিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন 'অন্যসাম্পান' । প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ১৬, গল্পগ্রন্থ : ২, ছড়াগ্রন্থ : ২ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : অপহৃত রাত্রির চর্যাকথা * নিরুত্তর তারার স্বপ্ন * পূর্বাভাস * পাগল চাকা ঘুরছে অবিরাম * একা দুপুর * শ্রেষ্ঠ প্রেমের পদ্য * সময়ের এস্রাজে বেজে যায় অবুঝ দুপুর * বেলুনের কোন জন্মদিন নেই * নির্বাচিত কবিতা ১০০ ইত্যাদি।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন