অবশ্যম্ভাবী হরপ্পা কিংম্বা হিরোশিমা এবং অবনী
স্বপন নাথ
মহাকালের রথচক্রের চাকা কোন সুদূর অতীত থেকে চলমান তা প্রত্ন - গবেষণা সাপেক্ষ । কিন্তু একথা স্বতঃসিদ্ধ যে এই আবর্তনে উপরতল ও নিচেরতল ক্রমাবর্তন করেছে পর্যায়ক্রমে। আর ততবারই চিন্তা চেতনার বহুস্তরীয় ভাবনার সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এবং পট পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
এই পট পরিবর্তনে কখনো ভালোর পাল্লা ভারী হয়ে স্থিতধী কালব্যাপী সহিষ্ণুতার অবয়ব রচনা করেছে। এবং তার স্বতঃপ্রণোদিত চর্চার বিকাশ পরের আবর্তনেও শাখায়িত হয়ে দুকূলপ্লাবী সিদ্ধি দিয়েছে। আবার কখনো-বা মন্দের পাল্লা ভারী হয়ে অসহিষ্ণুতার লুঠতরাজ কায়েম করেছে। অকালে ধ্বংস হয়েছে। আবার ভুল শুধরে অসীমের দ্যোৎনা রচনা করেছে কেউ।
এভাবে এক অস্ত্রের ঝনঝনানি থামাতে অন্য অস্ত্রের ঝনঝনানি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো কিংম্বা হিরোশিমা নাগাসাকি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। কত না রাজ্য রাজধানীর শেষ সূর্য অস্তমিত হয়েছে । আর সেই ধ্বংসস্তূপের জীর্ণ আবিলতা ধূয়ে নবোদিত সূর্যের কিরণবাহার নতুন পতাকায় আকাশ মাতিয়েছে।
কিন্তু প্রতি উত্থান পতনের সন্ধিলগ্নে যে গ্রহন বর্জন, যে মানস-দ্বন্ধ , যে বিবেক দংশন , তার মুহূর্তকালের গর্ভযন্ত্রনাটা কেমন ?
সেই মুহূর্ত মানস প্রকৃতিটি কী ধ্বজদণ্ডহীন ? নাকি কীটাণুর মতো অন্ধভাব সমপন্ন ? নাকি নুব্জ অলীকের কাছে আত্মসমর্পণ ? নাকি কবি প্রণবকান্তি মুখোপাধ্যায়ের "মানুষেরা এসো "র সেই বিখ্যাত সারার্থ ' দশটা পাঁচটা ভোঁ বাজে/মানুষগুলো হাঁপায়,পড়ে/পড়তে পড়তে এসে ঢোকে/যে যার খোঁয়াড়ের মধ্যে/ তারপর পোকার শরীরের উপর পোকা / পোকায় পোকায় কিলবিল করে সমস্থ কোলকাতা শহরটা (দুনিয়াটা) ?
স্নায়ুহীন সেইসব পরম্পরা আমি যেভাবে দেখি কবিতার অবয়বে ; তার একটি ছোট্ট প্রয়াস 'পাথর এবং মানুষ ' :
সাদামাটা বারো পংকতির ছোট্ট একটি কবিতা। সম্পূর্ণ দিলাম নিচে--
পাথর এবং মানুষ
" একটা সময় আসে
যখন পাথর এবং মানুষ
একই অর্থে বিলীন।
ভিনদেশি কোন যুবা , ও-মন
কোন নিকেতন যাবি ?
থমকে দাঁড়ায় পাথর এবং
আমি তালাচাবি।
খুলতে পারি
খুলতে পারি না
দু-খান হয়ে মরি !
হা ঈশ্বর সন্তাপে তোর
দু-খান পায়ে পড়ি ।
কবিতাটিতে স্পষ্ট সময়ের গর্ভে মানুষ স্তব্ধ অচল পাথর। কবি শঙ্খ ঘোষের "জলই পাষাণ হয়ে আছে " কাব্যগ্রন্থের পাষাণবৎ মানুষ। যেন সে স্নায়ুহীন। তাই অনুভবহীন। অসাড়।
বর্তমান সময় সারণীতে আমরা কী দেখছি ? না, খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান , শিক্ষা , স্বাস্থ্য সর্বত্রই ভুরি ভুরি অপকর্ম সম্পৃক্ত। অথচ সব চুপ। স্বেচ্ছাচারিতার চরম বৈরাগ্যে খুলে পড়ছে সকল লজ্জাস্থান। কিন্তু বিদ্বজনের মুখে কুলুপ। চোখে স্বার্থের ঠুলি। চামড়ার স্থাপক বিভাজনে গরম গরম ফুলঝুরি বুলি।
পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত মিথ্যাচার । মিথ্যাচার ! মিথ্যাচার ! মিথ্যাচার ! সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয় শিরোমণি। নশো কোটির সম্পদ বাহান্ন জনের তখত সীমায় গচ্ছিত রেখে , মুখে রক্ত সঞ্চালনকেই বলছে স্বাস্থ্যের উন্নতি । মানুষকে নিজের পায়ে হাঁটতে না দিয়ে "আমরাই চালিয়ে নিয়ে যাবো"গোচের মেরুদণ্ড ভাঙার সুকৌশলী ভিক্ষেপ্রকল্প গছিয়ে বলছে প্রগতি ! প্রগতি ! প্রগতি !
আর মাজাভাঙ্গা জনাদেশ হাতজোড় ভঙ্গিমায় ঈশ্বর আল্লা গড ---ঈশ্বর আল্লা গড বলে আচরণসর্বস্ব ধর্মের
রোশনাইয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে ষাঁড়ের পৃথিবী ।
আর পায়ে ঠেকে ভোট যন্ত্রের টানা বিপ বিপ স্বৈরতন্ত্র আওয়াজ বেহালায় যোজনা তুলে নিচ্ছে নীরোর বাৎসল্য প্রীতি। তখনও পাথরচুপ : মানুষপাথর !
এই আবহাওয়ায় কোনটা গ্রহন করবে বিবেক ? কোন পথে প্রবেশ করবে মন ? তাই হতভম্ব । কবিতা অনুসারে "একটা সময় আসে যখন/পাথর এবং মানুষ/ একই অর্থে বিলীন।" বিশ্বাস করতে পারছে না প্রতিবেশ। পরিবেশ। এমনকি নিজেকেই ! তাই কবিতার অবয়বে চমকপ্রদ প্রয়োগ '' ভিনদেশী" শব্দটি । তাই সংগত প্রশ্ন '' ও মন,কোন নিকেতন যাবি ? "যেন সে বোধির হয়ে যাচ্ছে। দিশা খুঁজে পাচ্ছে না । অথচ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব সে । সকল ও সমস্থকে নিজের ভোগের উপকরণে পরিণত করেছে ।
সেই তো সকল শুলুক সন্ধাণের চাবিকাঠি। সকল বন্ধ দরজার চাবি খুলেছে সে। এখনো সে সমান পারঙ্গম। অথচ অক্ষম। "খুলতে পারি/খুলতে পারি না/দু-খান হয়ে মরি।"
কি এক অদৃশ্য শক্তি ! ভয় ? নাকি শাসকের চোখরাঙানি ? দমিয়ে দিচ্ছে তাকে । মেনে নিতে পারচ্ছেন না হয়তো । নিজেকেই নিজে মারছেন । খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছেন হয়তো-বা। সম্পৃতি দিচ্ছেন - " হা-ঈশ্বর সন্তাপে তোর দু-খান পায়ে পড়ি " পংকতিতে।
আর , এখানেই যেন ফুটে ওঠে আর এক দাসত্বের ছবি। যেন বিবেক চাবিগুলোই দাসত্বে বন্দী। দাসত্ব করছে শাসকের ? নাকি বিবেককে জাগাতে জাগাতে সাড়া না পেয়ে সঙ্গর অভাব বোধ থেকে ঘুমিয়ে পড়েছে বিবেক। নিরাশার অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে নিজের বিবেকও কী উধাও তাহলে ?
মনে পড়ে যাচ্ছে কবি শক্তির "অবনী বাড়ী আছো " --কবিতাটি :
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া
অবনী বাড়ী আছো ?
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরান্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে
অবনী বাড়ী আছো ?
আধেকলীন হৃদয় দূরগামী
ব্যাথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
অবনী বাড়ী আছো ?
বিবেকের মূর্ত প্রতীক " অবনী "। দেশ কাল সমাজ গঠনের রূপকারদের হৃদিতন্ত্রে বেহালার ছড় লাগিয়ে জাগিয়ে রাখেন তিনি । সেই "অবনী" এ- দোর, ও -দোর , সে-দোর ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ফেরে আরো আরো অবনীর একত্র সম্মিলনের প্রত্যাশায়। । তাই তার অন্বেষণ সূচক ধাক্কা " অবনী বাড়ী আছো ? " কিন্তু বিফল। "দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া।" ঝাঁপ বন্ধ । অন্দরমহলের এবং অন্তরমহলের।
এই স্তব্ধতা ভয়ের নাকি ভক্তির ?
বলা নেই । সত্যিই কী বলা নেই ? দেখুন , "আধেকলীন" শব্দটির ব্যবহারে। এখানে বলা হয়েছে বিবেকের মূর্ত প্রতীক অবনী ; যে ফিরছিল আরো আরো অবনীর অন্বেষণে। কিন্তু না পেয়ে , না পেয়ে , তার নিজের ভিতরের অবনীই আধেকলীন অর্থাৎ আর্ধেক হাওয়া। অর্থাৎ তিনি নিজেও আর পূর্ণ সোচ্চার নন। সুতরাং এই নিরুচ্চার যে ভক্তিতে নয় তা আর বোঝার অগম্য থাকে না।
কাজেই দেশ কাল সমাজ গঠনের নিরিখে যে অবনী ব্রত নিয়েছিল অন্য অবনীদের একত্র সম্মিলনে সামিল করাতে ; তৃতীয় ও অষ্টম পংকতির "অবনী বাড়ী আছো ?"তে যার প্রকাশ। সেই তিনিই শাসকের করাতে দু-খাদি। দ্বাদশ পংকতিতে এসে সেই তিনিই নিজের মধ্যেই খুঁজছেন "অবনী বাড়ী আছো ?" অর্থাৎ নিজেই আজ নিজের মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ ।
তাই প্রথমোক্ত "পাথর এবং মানুষ" কবিতার " দু-খান হয়ে মরি " পংকতিটি আধেকলীনতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে বলা যায়। এবং সত্য হয়ে ওঠে যে এভাবেই সুশীল সমাজের মধ্যে থাকা সেই অবনীরাও যেন শাসকের মারের সাগর পার করতে পারবে না বলেই দাসত্বশৃঙ্খল পরে নিয়েছে নিজেই।
এমনি এক দ্বিখণ্ডিত সত্ত্বার মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলায় তলিয়ে যাচ্ছি দিন দিন। নিঃষ্প্রাণ পাথর এবং মানুষ সমার্থক হয়ে যাচ্ছে। পতন আটকানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। সামাজিক মানবিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সর্বস্তরেই সমূহ পতন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে মূল্যবোধহীন ভিক্ষের ফুটো কাঁসর। টেনে তোলার একজন অবনীকেও (ব্যতিক্রম: অভিজিৎ গাঙ্গুলী,চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ) দেখছি না , যিনি এই কবওয়েবের বাইরে আছেন নিশ্চিন্ত।
ফলত সব তালার চাবিই কুহকে আক্রান্ত।। এই কুহক নিশি জড়ানো। নিশি মানে রাত্রি। রাত্রি মানে অন্ধকার। অন্ধকার মানে স্বতশ্চল দৃষ্টি অচলন। দৃষ্টি চলে না । কারণ নীতি নির্ধারণের যুক্তি পরম্পরাগুলো বৈধ্যতায় মিলমিশ খায় না। মানে ধর্মে সয় না।
সংকীর্তণে ধর্মের ব্যাখ্যায় বলছে "ধর্ম" স্বরভক্তিতে ধরম। উচ্চারণভেদে ধরমো। বাচ্যান্তরে ধরমোরে। অর্থাৎ " ধর্ম" বলতে বোঝাচ্ছে মোকে ধর বা আমাকে ধর। অর্থাৎ মানুষকে ধর । অর্থাৎ মানুষের ধর্ম সজ্ঞাত আয়নায় নিজেকে দেখা । এবং নিজের মধ্যে অন্যের উপস্থিতি অনুধাবন করা।। কিন্তু এই আবহাওয়ায় 'মানুষের ধর্ম' যোজন যোজন দূরত্বে ভেসে গেছে । তাই দৃষ্টি স্বতঃশ্চলে অক্ষম।
আবার দৃষ্টি স্বতঃশ্চলে অক্ষম যদি কার্যকরণের ফল হয় , তবে তার কারণ অবশ্যই অন্ধকার। এই আঁধারও আবার দ্ব্যার্থ ভাব আনে। কেননা এমনও আঁধার আছে যে আঁধার আলোর অধিক । যে আঁধারে ঘটে অন্তরাত্মার জাগরণ। আর অন্তরাত্মার জাগরণ মানেই সত্য উচ্চারণ। কিন্তু এই আবহাওয়ায়( দ্বিখণ্ডিত সত্ত্বায়) সত্য উচ্চারণ সম্ভব ! কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন "কে চায় সুন্দর কথা আরো/দু একটি সত্য শুধু বলো।"
এখন প্রশ্ন সত্য কী ? সবইতো আপেক্ষিক। ব্যাপকতায় যদি নাও যাই তবে সীমায়িত ক্ষেত্রে তা কাকে অঙ্গীকার করে ? সবইতো দলের কায়েম।।
তারই মধ্যে যেটুকু ' মহাজন গতঃ স্য পন্থা ' তা -- দয়া মায়া প্রেম প্রীতি ভালোবাসা ; কিন্তু ওসবে আর কোনো চাবি খুলছে কী ? শুধুই হিংসা ক্রোধ গুয়ার্তুমি ছড়ি ঘোরানোর গণ্ড মুর্খামি স্বেচ্ছাচার আর হাতে না মেরে ভাতে মারার হীনষড়যন্ত্রের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বদ্ধভূমিতে নিয়ে এসে ফেলা । এই আবহাওয়ায় ন
যোজ্য ন তৌস্য অবস্থা।
ফলে ঈশ্বর আল্লা গডের সুউচ্চ প্রাচীর ---তাকেই মান্যতা দেওয়া । অর্থাৎ প্রথমোক্ত কবিতার উচাচারণ "হা-ঈশ্বর সন্তাপে তোর দু-খান পায়ে পড়ি ।" সাযুজ্য দিয়ে গেল। এই আকাশে লাটাই (তুমি আমি) এবং ঘুড়ি( আধেকলীন হৃদয়) সূতোয়( স্বেচ্ছাচারী রাজনীতির) পরবশ। আর তখনি বাগ্ময় হয়ে ওঠে কবি জগদ্বীশ ভট্টাচার্যের সেই কবিতা পংকতি
" একবার ঝরে গেলে মন/সে ফুল কুড়োবার /নেই অবসর/ তখন জীবনের মুখের উপর/ প্রখর সূর্যের প্রকোপ/তখন জীবন শুধু /পৃথিবীর আহ্নিক জীবন।"
কাজেই মন বলছে আর একটা হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো কিংম্বা দিকে দিকে হিরোশিমা নাগাসাকি আহ্নিক বিবর্তনে ধেয়ে আসছে ক্রমাগত।
*********************************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন