কবিতাগুচ্ছ * শিবালোক দাস
হাওয়া
প্লাটফর্ম ছেড়ে যায় শেষ ট্রেন,
কিছু ধুলো পড়ে থাকে,
কিছু পদশব্দ ডুকরে কাঁদে,
হাত ভুলেছে নিজস্ব অভিমুখ।
এখন হাওয়ার কথা ঠিক বুঝতে পারি না।
প্রতিরাতে শুতে যাবার আগে তুলে নিই
কবিতার পচে যাওয়া লাশ।
ওতে শুঁয়োপোকা ধরে যায়।
স্নায়ু বড় দুর্বল। সাড়া দেয় না ঠিক মতো।
তাই সাবধানে পেতেছি তালু,
পূর্বজন্মের গান আবার আমি ফিরে পেতে চাই।
এখন হাওয়া বড্ড অবাধ্য হয়েছে। মানে না শাসন।
কতদিন এভাবে আরো নীচু করবো মাথা ?
জ্বলবে প্রদীপ, আরও কুঁকড়ে যাবে শরীর ?
এ যাপন ঠিক অরণ্যের মতন নয়।
প্রাণভোমরা বন্দী থাকে পুকুর জলে
বাস করা মাছের মধ্যে, রূপকথা !
হাওয়াও আজকাল আমার মতোই বাঁচে,
স্বপ্ন দেখে রোজ মধ্যরাতে,
সেই স্বপ্নে ফিরে যায় শেষ ট্রেন
এবং দুটি পাতা উড়তে উড়তে
এসে তার দৃষ্টি ঢেকে দেয় সযত্নে।
শিরোনাম
রাস্তারা শিরোনাম পেতে চায়,
আকাশ তাদের মাথায় রেখেছে
টিনের তরবারি; শিভালরি পন্থায়...
রাস্তারা শিরোনাম পেতে চায়।
ম্যানহোলের বিরাট মুখে প্রবেশ
করে সারি সারি পিঁপড়ের দল,
আর্কাইভে ছড়ানোর ছেটানো রং,
হারিয়েছে কোথাও একটি ছোট্ট সৌরবিন্দু।
ভালো ছিলাম এর চেয়ে কনকপুরে।
সাদাতে অদৃশ্য পায়ের ধুলো,
অজস্র ছোটাছুটি, খানা খন্দ,
রাস্তারা শিরোনাম পেতে চেয়ে
বাইসনের চোখে রাখে লাল কাপড়...
নিঃশব্দ টোকা কখনও দরজায়,
তর্জনী জানে নিয়ম মাফিক মাপ,
কখনও কখনও বঁড়শিতে গেঁথে
তুলে আনি বকের গলা থেকে মাছ !
কিউবিক ধাঁধার বেপরোয়া ওলট পালট,
শিভালরির তরবারিতে কেটে যাক মাথা,
রাস্তাদের চোখে শিরোনাম লেগে থাকুক !
রাত্রি
মাঝ আকাশে ত্রিশঙ্কুর মতন
ঝুলে থাকতে থাকতে ভাবি,
টিনের চালে বৃষ্টির তেজ কেমন।
এক পক্ষের অমীমাংসিত বিরহ,
উড়ালপুল একা; নীচে গঙ্গার সঙ্গে
বলতে চায় একটু কথা, প্রমাদ গোনে।
নিঝুম রাত্রি এতটাও স্নিগ্ধ নয়....
কখনও করতল ছুঁয়ে দেখেছো ?
শিকড় বাড়ে, দিগন্ত মিশে যায়---
ঘরে তখন ধুপ জ্বলে, মেয়েটা
জানেনা ধুপের তাপ নিতে নিতে
সে নিজস্ব উত্তাপ হারিয়ে ফেলেছে !
কখনও ছুঁয়ে দেখেছো তার মুখশ্রী ?
কড়িকাঠ চুরি করেছে সুদূর আহ্বান।
মাঠে বসে এক বুড়ো আগুন পোহায়,
আগুন না, বিস্মরণ; চামড়ায় জন্মদাগ,
পায়ে পায়ে ঘোরে সংসার, অর্ধ জাগরন,
তুমি তো চেয়েছিলে তোমার করপুটে জল !
আলে রয়েছে জল, নষ্ট হয় নলকূপের জল,
অতল, অতল, ভুল ভেবে হাত বাড়ালে তৃষ্ণায় !
রাত্রি কেড়ে নিল একটি প্রতিশ্রুতি, এক লহমায় !
অপ্রাসঙ্গিক
ফিরিয়েছি; তবু আসে শিশির
ডাক আসে কারোর কথা রাখবার
শূন্যের ভেতর খুঁজি বিন্দু; দৃষ্টিভ্রম।
এসেছে আজ্ঞাবহ; পদ্যে মাখানো ছাই
সুন্দরের এ এক অন্যরকম আহ্বান
নাভিকুণ্ড পড়ে থাকে মাঝ বারান্দায়...
নদীর জলে কৃষ্ণগহ্বর, আমি জানলার
কাছে এসে ভাবি এ কেমন বিমূঢ়তা ?
শিহরণ জাগে আঙুলে। বিস্মৃত স্তব্ধতা।
গাছের হাড়কঙ্কালে সহস্র রাঙা পদাঘাত
নারীসঙ্গ চায়নি সে, তবু অভিশাপ পেল
ও কৃষ্ণ ! সে যে সুন্দরকে ভালবেসেছিল !
চা না শেষ করেই আমি খাতার কাছে আসি
পক্ষীডানায় ক্ষত; সাঁকোয় চিড়, মৃতের মিছিল...
আমার এক লাইনও লেখা হয় না আর, সত্যিই !
পদশব্দে ফিরে আসে আমার হৃৎস্পন্দন
লুটিয়ে লুটিয়ে কেউ হয় রেণু, প্রোথিত পাতালে
আমি এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কি বা করতে পারি ?
আমি ভাবতাম কবিতাই সুন্দরের প্রতিবিম্ব
তার আলাদা পরিচয় কোনোদিন জানতাম না
সুন্দরকে ভালবাসলে বুঝি পৃথিবী ঈর্ষান্বিত হয় ?
সেফটিপিন
কয়েক বছর আগে তোমার আঁচল থেকে
একটা সেফটিপিন খুলে পড়ে গেছিল আমার
পায়ের কাছে, মা !
এখনও সেটায় কিন্তু জং ধরেনি।
জামার মধ্যে অসহিষ্ণুতা, হাতে উদ্ধত ছুরি,
এখনও মাটি তুলে আনি সমাধিস্থল থেকে,
গাছকৌটোতে কাচের টুকরো অনেকদিনের
জমানো আছে, তোমার চোখ হয়তো এড়িয়ে
যায়নি মা ! আমি তো শুধু এক টুকরো রুটি
চেয়েছিলাম রাত্রির কাছে কিছু কবিতার জন্য।
ওরা লাশ ফেলেছে, হাত তুলে নিয়েছি যখন,
শিকড়ে মিশেছিল ক্ষতের দাগ, কি যন্ত্রণা !
তুমি তখন জামার বোতামের ঘাঁটিতে সেফটিপিন
আটকে বলেছিলে মা, তোর জামায় এত রক্ত
মাংসের উগ্রতা ছড়িয়ে যাচ্ছে কেন ?
তখনই এসেছিল জিজীবিষায় নতুন মোড়।
সেফটিপিনটায় এখনও জং ধরেনি কিন্তু।
ছেনি দিয়ে রাস্তা কাটি, শিস দিই যখন তখন
জীবন রাস্তা, রাস্তাই জীবন, বকি আবোল তাবোল
এমনই এক হাভাতের কাছে সেফটিপিন আর কি ?
সন্ধ্যার সময় তখনও দেখি, তোমার ঐ সেফটিপিন
চকচক করছে মা, যেমন তোমার চুমু আমার কপালে
সারাদিন সোনার মতো জ্বলজ্বল করতো !
আমার কাছে তোমার চিহ্ন, তোমার মমতা ওটাই।
একলা ঘর, একলা বোতাম
প্রতিধ্বনি চলে গেলে আর ফিরে আসে না,
তাই সেগুলোকে বোতামেই আটকে রাখি।
একলা ঘরে আর কতটুকু পাথর জমা হয় ?
ড্রিলের শব্দ নিয়ে আসে এক অন্য সকাল,
চা জুড়িয়ে গেছে, নিস্পন্দ হৃদয়ের মতো।
ঠিকানাহীন। বেদুইন আমার এই শহর,
একলা ঘরে আজকাল আর কেউ আসে না।
একলা বোতাম আর কতটুকুই বা সঞ্চয় করে ?
বেণীআসহকলায় মেশে কিছু প্রতিধ্বনি।
দেওয়ালে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া অভ্যেস,
হাহাকার, বিলাপ, সবার রঙ কিন্তু এক।
বাঁধা সুতোয় থাকলে তারা বেশ শান্তি পায়।
তারা আর এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় না।
এই একলা ঘর, জামার একলা বোতাম
সবাই আয়না মিশে গেলে প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে।
***************************************************************************************************
তরুণ কবি শিবালোক দাস-এর শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি শহরে। বর্তমানে কলকাতার আই.পি.জি.এম.ই.আর. এবং এস.এস.কে.এম. হাসপাতালে এম.বি.বি.এস এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ক্লাস এইট থেকে কবিতা চর্চা শুরু। সাহিত্যকে ভালোবাসেন এবং আলাদা আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এখনও পর্যন্ত কোনও প্রকাশিত গ্রন্থ নেই।




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন