পুণ্যব্রতে পূর্ণযোগী : স্বামী আত্মস্থানন্দ
স্মৃতিসুধা
স্বামী দিব্যানন্দ
১)
কবীরের একটি ভজনে আছে - 'গুরু বিনা কৌন বাতাবে বাত' -কিন্তু মানুষ গুরু, ব্যক্তি গুরুর পরিবর্তে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে প্রকৃতপক্ষে 'গুরু মহারাজ' বলতে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে বোঝানো হয়। পরবর্তী গুরুরা সকলে তাঁর সাথে পরিচয় বা যোগাযোগ করিয়ে দেন আগ্রহী ভক্ত শিষ্যদের। আমরা তাঁদের শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিভূ বলে ভাবি। আমাদের সঙ্ঘগুরুরাও নিজেদের গুরু না ভেবে 'আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী' এই ভাব পোষণ করে থাকেন।
মঠে যাঁরা সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য যোগ দেয় সঙ্ঘ-গুরুদের ও অন্যান্য গুরুজনদের ভালবাসার ছোঁয়া পেলে মা-বাবাকে ছেড়ে আসার কষ্টটা কমে যায়। আমি সেইরকম সৌভাগ্যের অধিকারী, বড়দের ভালবাসা পেয়েছি, যাঁদের অন্যতম ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের পঞ্চদশ সঙ্ঘগুরু আত্মস্থানন্দজী মহারাজ; ১৯৭৫ থেকে একটানা ৪২ বছর যাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি ভালবাসা পেয়েছি অফুরন্ত ভাবে। সেই সাধু-সঙ্গের কিছু স্মৃতি যা আমার জীবনকে মননকে ছুঁয়ে গেছে তাই ইতস্তুত উল্লেখ করছি এই ভরসায় যে এই মহাজীবন অনুধ্যান আমাদের সকলের কাছে সহায়ক হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে প্রেরণা-স্থল।
একবার রহড়া থেকে আশ্রমের অটোতে হাওড়া বিবেকানন্দ আশ্রমে উপনিষদ পাঠ করতে যাওয়ার পথে বালি Fire Brigade-এর নিকটে ব্রেক-ফেল করে অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আমার হাঁটুতে চোট পাই। ৬ মাস পূর্বে রিকশা থেকে পড়ে hip-joint ভাঙে ও সার্জারি হয়েছিল। মহারাজ পরের দিনই ফোনে বললেন, 'কি হে, ন্যাড়া কয়বার বেলতলায় যায়?' অর্থাৎ আর যেন এইরকম টু-হুইলার বা থ্রি-হুইলারে যেন না যাতায়াত করি। বললেন, 'অনেক কাজ করতে হবে শরীরের যত্ন নেবে।' সকলেই তাঁর আন্তরিক স্নেহ-ভালবাসার পরিচয় পেয়েছেন। এক্ষেত্রে আমিও সাক্ষী রইলাম তাঁর কঠোর-মধুর স্নেহ-শাসনে।
ওই রহড়া কলেজেই অধ্যক্ষতা করার সময় একটা ঘটনা ঘটল। একদিন কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের বড় অঙ্কের টাকা ব্যারাকপুর ট্রেজারিতে নিয়ে যাওয়ার সময় খোয়া গেল। আশ্রমের সম্পাদক মহারাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। বলেন পুলিশে যোগাযোগ কর। পূজ্যপাদ আত্মস্থানন্দজী মহারাজকে স্বল্প সময় পরেই ফোন করলাম; শুনেই বললেন, 'প্রথম কাজ হবে আশ্রম থেকে ওই পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়ে ট্রেজারিতে জমা দাও; যেন তোমার কলেজের কর্মীরা একদিনের সুদ থেকেও বঞ্চিত না হন।' মহারাজের সুন্দর সমাধানে খুব স্বস্তি পেলাম। সেই দিন বুঝেছিলাম বিপদেও করনীয় কর্তব্য নির্ণয়ে ওঁর অমোঘ পারদর্শিতা।
ব্রহ্মচারী ট্রেনিং সেন্টারে ১৯৭৭-৭৮ আমি ম্যানেজার ছিলাম। যখনই কোনও অসুবিধায় পড়তাম, মহারাজের ঘরে গিয়ে পরামর্শ নিতাম। মনের কথা সব খুলে বলতে পারতাম। কখনও মনে হত তিনি কঠোর ব্যক্তি, কিন্তু আপাত কঠোরতার ভিতরে ছিল একটা অদ্ভুত ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয়। ভাল-মন্দ, দুর্বল-সবল সব ছেলেদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অহৈতুক। আবার মাঝে মাঝে এই ভালবাসার জন্য কেউ তাঁকে ভুল বুঝেছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন চিরস্বচ্ছ। তাঁকে সব অবস্থাতেই অবিচল ও শান্তভাবে থাকতে দেখেছি। যেন বাইরের মানুষটি আমাদের সাথে বয়স্য অগ্রজের মতন মিশে যত ফষ্টিনষ্টি করেছেন, কিন্তু ভেতরের আরেক প্রকৃত রসস্বরূপ ঈশ্বর-রসে সর্বদা মজে রয়েছেন আপন মেজাজে।
২)
মনে পড়ে, ব্রহ্মচারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিনি আমাদের স্বামীজীর করা মঠের নিয়মাবলী পড়াতেন। প্রথমদিন ক্লাস নিতে এসে 'সহনাববতু' এই শান্তি-মন্ত্র উচ্চারণের পর ক্লাসের সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন, তিনবার কেন শান্তি বলা হল? উত্তরটি কেউ বলল না, তখন তিনি সুন্দরভাবে তিনরকম জ্বালা বা অশান্তি, তার উৎস বা কারণ, এবং তা থেকে উত্তরণের কথা ব্যাখ্যা করলেন। তাঁর মুখে আধ্যাত্বিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক শান্তির কথা শুনে সেদিন আমরা সকলে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
গত শতাব্দীর আট এবং নয়-এর দশকে ভক্তদের ও যুবকদের সংগঠিত করে বেলুড় মঠে বেশ কয়েকটি বড় সম্মেলন হয়। ডিসেম্বর ১৯৮২ সারদাপিঠে একটি বড় আবাসিক যুব সম্মেলন হয়। স্বামী সত্যরূপানন্দজী ও আমি শিবির অফিসের দায়িত্বে ছিলাম। প্রথমদিন সব যুবক আসার পর মহারাজ বিদ্যামন্দির ছাত্রাবাসগুলি পরিদর্শন করে, ওদের সাথে কথা বলে, অফিসে এসে আমাদের বললেন, 'অনেক ভাল ভাল যুবক এসেছে, দু-চারজনকে অন্যরকম মনে হল, ওদের সাথে ভালভাবে মিশে ওদের ভাল ভাব দেওয়ার চেষ্টা করো, ওদের মানসিক উত্তরণের চেষ্টা করো।' শিবিরে একদিন মহারাজের তেজোদীপ্ত ভাষণ শুনে যুবকরা খুব অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। আট এবং নয়-এর দশকে সব কয়টি সম্মেলনে মহারাজের ভাষণ যাঁরা শুনেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে তাঁর ওই তেজস্বী, প্রেরণাদায়ী কথা। মঠে ১৯৮০-তে মহাসম্মেলন, ১৯৮২-তে সারদাপিঠে ও ১৯৮৫-তে মঠে যুবসম্মেলন দুটি হয়েছিল। তারপর গ্রামে-গঞ্জে বেশ কিছু যুব-সংগঠন, ভক্তদের সংগঠন বেড়েছে এবং বেশ কিছু যুবক তারপর সঙ্ঘে যোগও দিয়েছে। অনেকেই একথা আজও স্বীকার করেন, -মহারাজের যুবকদের উপর প্রভাব ও টান ছিল খুব বেশি। পূজনীয় মহারাজের দীক্ষার প্রথম ব্যাচে কেবল যুবকরাই স্থান পেয়েছিল। সামান্য কয়েকজন যুবককে প্রথম দিন দীক্ষা দেন।
১৯৮৪-তে ত্রিপুরায় মনু নদীর ভয়াবহ বন্যার পর ওঁর নির্দেশে তাড়াতাড়ি ত্রাণকার্যে যাই। এই যাত্রায় পূজ্যপাদ প্রভানন্দজী মহারাজ আমাদের সাথে ত্রিপুরা যান এবং মুখ্যসচিব, অর্থসচিব ও সরকারি অফিসারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা প্রথম দফায় দুর্গত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সার্ভে করার পর মহারাজকে জানালে, মহারাজ Air India Cargo-র মাধ্যমে তাড়াতাড়ি ত্রাণসামগ্রী সব পাঠিয়ে দেন। কাজ করার সময় আরও দূর্গত মানুষের কথা জানতে পেরে অতিরিক্ত ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর জন্য আত্মস্থানন্দজী মহারাজকে ফোন করি। প্রথমে মহারাজ নারাজ হলেও, আমি যেই বললাম, 'তাহলে এখানে ভিক্ষা করব অর্থবান মানুষের কাছে', পূজনীয় মহারাজ হেসে বললেন, 'পরীক্ষা করলাম তোমাকে। আজই সব জিনিস পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেবা করো মানুষের, আরও ত্রাণসমগ্রী পাঠাব যখনই জানাবে।' ওই সময়ে কৈলাশহর, ধর্মনগর, কমলপুরে ব্যাপক সেবা কাজ হয়। পূজনীয় আত্মস্থানন্দজী মহারাজ বারবার আমাদের খবর নিতেন, -কি করছি, কোথায় আছি, অসুবিধে হচ্ছে কিনা। সেই সময়ে ত্রিপুরার চারিদিকে দেশদ্রোহীদের মাধ্যমে নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। একদিন ত্রাণের কাজে কৈলাশহর থেকে আগরতলা যাওয়ার সময় সরকারি জিপের চালক বললেন যে ঠিক এই সময়ে, এই স্থানে, সিআরপিএফ জোয়ানভর্তি একটি লরিতে জঙ্গিরা বোমা মেরে সাত-আটজনকে মেরে ফেলেছে। আমরা মনে মনে দূর্গা নাম করে, ওই রাস্তাঘাট চলেছি, আমাদের কাজে জঙ্গিরা বাঁধা দেয়নি কখনও।
৩)
স্বামী আত্মস্থানন্দজী মহারাজের অনুরোধে দ্রুত ডাক্তার নিয়ে গিয়েছি মেডিকেল কলেজ ও ট্রপিকাল স্কুল অফ মেডিসিন থেকে, সুন্দরবনের Cyclone Relief-এর সময়। মাঠে মাঠে টার্পোলিনের নিচে মানুষ। তাদের চিকিৎসা করা হল। সেইবার গবাদি-পশু অনেক মারা গিয়েছিল। সেই অবস্থায় খাবার জিনিস ও ঔষধপত্র দিয়ে সেবা হয়। পূজনীয় মহারাজের প্রেরণাতেই মালেকান গুমটিতে একটি বড় বিদ্যালয়ের জন্য বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়। এই ত্রাণসেবার কাজে মহারাজ খুব উৎসাহ দিতেন যার ফলে দুর্গম অঞ্চলে ব্রহ্মচারী ও সাধুরা ঠাকুরের ভাবে কাজ করতে পারে। সেখানে বেশ কয়েকবার মহারাজের নির্দেশে গিয়েছি এবং ত্রাণের কাজে অংশ নিয়েছি। সুন্দরবনেই মালেকান গুমটি অঞ্চলে ত্রাণ কাজ করার পর ডক্টর নিতাই প্রামাণিক এসে পূজনীয় মহারাজকে শিশুদের পুষ্টির অভাব ও তাদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলে, ওদের দুঃখের কথা শুনে মহারাজ কাঁদতে শুরু করেন। নিতাই ডাক্তার নিজে বলার সময় ভাবাবেগে কেঁদেছিল। পূজনীয় মহারাজ আমাকে পরে ফোনে বলেন, 'নিতাই কেমন ডাক্তার! দুর্গত মানুষ, শিশুদের জন্য কাঁদতে পারে!' পরে শুনেছি, মহারাজ নিজে আরও বেশি কেঁদেছিলেন।
২০০০ সালে দীক্ষা দিতে গিয়েছেন ত্রিপুরাতে। সেবার আগরতলায় কয়েকদিন ধরে দীক্ষা হয়। একদিন বললাম, ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে এমন একজন দীক্ষা নেবেন, নাম মাখন চক্রবর্তী। মহারাজ বললেন, 'ওকে পৃথকভাবে দীক্ষা দেব।' দীক্ষার দিন সকালে বললেন, 'আমি ওর বাড়ি যাব।' আমরা ওদের বাড়িতে খবর দিলাম। ভদ্রলোকের বেডরুমের মেঝেতে দেওয়ালের গায়ে ঠাকুর-মা-স্বামীজীর ফটো সাজিয়ে মেঝেতে আসনের উপর বসে মহারাজ মন্ত্র দিলেন। ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী খুব মানসিক শান্তি লাভ করেছিলেন। স্ত্রী পূর্বেই দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। যতদিন ভদ্রলোক বেঁচে ছিলেন, ততদিন মহারাজ ওর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আমাদের কাছে খবর নিয়েছেন। শরীর ত্যাগের পূর্বে ভদ্রলোক একবার বেলুড় মঠে এসে গুরুদর্শন করে যান এবং তারপর আগরতলায় গিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পূজনীয় মহারাজ বাড়ি গিয়ে এইভাবে দীক্ষা দিয়েছেন, এরকমটি পূর্বে আমি শুনিনি। এই ঘটনায় আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল মায়ের ভালবাসা ওঁর মাধ্যমে প্রকাশ পেল এই ঘটনার মাধ্যমে।
যখন আমরা ট্রেনিং সেন্টারে তখন মহারাজ তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক স্বামী গম্ভীরানন্দজীকে নিয়ে গিয়েছিলেন অমরনাথ দর্শনে। গম্ভীরানন্দজী সেখানেও দেখেছেন আলো করে বসে আছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। পূজনীয় আত্মস্থানন্দজী মহারাজ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন পূজনীয় গম্ভীরানন্দজীর সেই কাশ্মীর দর্শনের অভিজ্ঞতা শোনার। গম্ভীরানন্দজী মহারাজ প্রথমে বলতে চাননি ওই ঠাকুরকে দেখার কথা, পরে আত্মস্থানন্দজীর বারবার অনুরোধে সেই দিব্যদর্শনের কথা আমাদের বলেছিলেন। আমরা সবাই খুব আনন্দ পেয়েছিলাম মহারাজের ওই অলৌকিক দর্শনের কথা শুনে। কিন্তু নেপথ্যে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন স্বয়ং সত্যকৃষ্ণ মহারাজ।
সারদাপীঠের একটি অঙ্গ 'সমাজ সেবক শিক্ষণ মন্দির' পূজনীয় মহারাজের উৎসাহে গড়ে উঠেছিল। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য মহারাজ প্রথম অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন, যেটি মঠে জমা আছে এবং তার সুদ থেকেই অনেক অর্থ আজও আমরা পেয়ে আসছি। মহারাজ বরাবর এই কেন্দ্রটি কেমন চলছে খবর নিতেন ও যথাসাধ্য এর উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সাহায্য করতেন। মহারাজের বিশেষ আশীর্বাদধন্য এই প্রতিষ্ঠানটি।
৪)
১৯৭৮ সালে হাওড়া ও হুগলি অঞ্চলে ব্যাপক ত্রাণ-সেবার কাজ হয়, মহারাজের নেতৃত্বে। আরামবাগ সংলগ্ন বালি দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে একটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করে দেওয়া হয়। মহারাজ তদানীন্তন ম্যানেজার ভরত মহারাজকেও ওই কাজ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি বিদ্যালয় উদ্বোধনের দিন গিয়েছিলাম। বিদ্যালয়ের মেয়েরা 'শ্রীরামকৃষ্ণ' নাটক মঞ্চস্থ করে। তাদের অভিনয়ে দেখে সবাই মুগ্ধ। বালি-দেওয়ানগঞ্জ, কামারপুকুর, জয়রামবাটির গরীব মেয়েদের স্বনির্ভর করার জন্য পল্লীমঙ্গল স্থাপন, মহারাজের উদ্যোগে হয়েছিল। এই কাজে গুজরাট থেকে কান্তিভাই শ্রফ্ ও ইন্দিরাবেন প্যাটেল, এঁরা এসেছিলেন মহারাজের অনুরোধে বেশ কয়েকবার। বালি-মাটিতে চাষ ভাল কিভাবে হয়, মেয়েরা যেন স্বনির্ভর হয়, এই ছিল মহারাজের একান্ত ইচ্ছা। মহারাজ এই কাজে সফল হয়েছেন তাঁরই উদ্যোগে কামারপুকুরে মিনি জুট মিল-এ মাটি পরীক্ষা কেন্দ্র (Soil-testing laboratory) তৈরি হয়। ভারত ও ভারতবর্ষের বাইরের মানুষও এই কাজগুলির উচ্চ প্রশংসা করেছেন। পূজনীয় মহারাজের নির্দেশে প্রতি বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাধুরা গিয়েছেন বালি দেওয়ানগঞ্জ, আমিও একবার গিয়েছিলাম দোল-পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যার একটি অনুষ্ঠানে।
১৫ ই মার্চ ২০১৭ গোলপার্কে, বিবেকানন্দ হলে 'চৈতন্য প্রসঙ্গ' বলার জন্য গিয়ে জানলাম বক্তৃতাটি পূজ্যপাদ আত্মস্থানন্দজীর ধর্মপ্রাণ পিতা-মাতা -রাম নারায়ণ তর্কতীর্থ ও ননীবালা দেবী স্মারক বক্তৃতা। খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন ওঁদের কথা জেনে। সেদিন জেনেছিলাম ওঁর বাবা আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৩৮-এ অন্যতম বক্তা ছিলেন। সেদিন তিনি মঠের উৎসবে ভাগবত পাঠ করেছিলেন।
১৯৭৮-এর ব্রহ্মচর্য দীক্ষার পর পুরী গিয়েছিলাম স্নানযাত্রা উপলক্ষে। পুরী থেকে ফিরে মঠে পূজনীয় মহারাজকে প্রণাম করলে প্রথম প্রশ্ন, 'কয়েকদিন দেখিনি, কোথায় যাওয়া হয়েছিল?' পুরী-তীর্থ গিয়েছি শুনেই মহারাজজী বললেন, 'জান, আমি কখনও ছুটি নিয়ে তীর্থে যাইনি। তোমার কর্মক্ষেত্রই তোমার তীর্থ, কাজটি হল পূজা। এখন অল্প বয়স, ঠাকুরের সব কাজ পূজা-ভাব নিয়ে করবে।' সেদিন আরও অনেক কথা হয়েছিল যার প্রায় সব ব্যক্তিগত। আসবার সময় মহারাজকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছিলাম, উনিও খুব আদর করেছিলেন ওই দিন। কিন্তু আরেকদিনের কথা সবশেষে উল্লেখ করব।
আমাদের তিনি স্বামীজীর শিষ্য কেদারবাবার কথা বলতেন, বিরাজানন্দজীর কথা বলতেন প্রায়শই। একদিন একান্তে তাঁর স্বগতোক্তি শুনেছি -'আমি মহাপুরুষ বিজ্ঞানানন্দজীর নিকট মন্ত্র পেয়েছি, স্বামী বিরজানন্দের সেবা করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি কিছুকেই তোয়াক্কা করি না, কোনও কিছুর ভয় নেই আমার।' আপাতভাবে অহংকার মনে হলেও, এইটি গুরুভক্তি ও গুরুর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের লক্ষণ ভিন্ন আর কিছু নয়।
আমার খুব বিশ্বাস ছিল মহারাজজী শতায়ু হবেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছা দেখি অন্যরকম। হাসপাতালেই ছিলেন অনেকদিন। বারবার দেখতে গিয়েছি, কখনও চোখে মুখে ব্যাধিজনিত কষ্টবোধ করছেন, এমনটি মনে হয়নি। জুনের ১৭ তারিখ সন্ধ্যায় দেখে এলাম; ১৮ তে সংকটজনক অবস্থা শুনে যখন যাত্রা করছি, তখনই দেহান্তের সংবাদ পেলাম; হাসপাতালে গেলাম শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। পরেরদিন রাতে বেলুড় মঠের সমাধিপীঠে তাঁর দেহটি নিয়মমত ভস্মীভূত হয়ে গেল। কিন্তু সূক্ষ্মশরীরে গুরুশক্তিরূপে তিনি ভক্তদের নিকটে থাকবেন, আমাদের সকলকে আশীর্বাদ করবেন, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর প্রতি আমার হৃদয়ের ভালবাসা প্রণতি জানিয়ে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য শেষ করছি একটি কবিতায় :
স্মৃতিসুধা
আমি তো দেখেছি আর্ত-সেবায় তোমার চোখের জল।
প্রতিজ্ঞার কঠিন অঙ্কে স্নেহসুধা অবিরল।
দেখেছি আমি দৃপ্ত মুষ্টি আনত ষষ্টি ভারে,
সকলে গিয়েছে নেচেছে সেথায় তোমারই কথার সুরে।
সেদিনের কথা মনে রেখো 'কাল' স্মৃতি তর্পনে আজি
আত্মস্থ সে পুরুষ প্রবর আনন্দধাম ত্যাজি
এসেছিল হেথা বিরজা-সেবায় হরিপ্রসন্ন তনয়
ধরেছিল এক ঋজু, নির্ভীক অমল জীবন কায়
কায়হীন নয় রামকৃষ্ণ প্রতিভূ সত্যকৃষ্ণ স্বামী
সঙ্ঘ-শরীরে নিত্য বিরাজে মোদের প্রেরণা তুমি॥
সমাপ্ত
***********************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন