বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

অণুগল্প * শর্মিষ্ঠা ঘোষ




ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প  আমরা পড়ছি, শর্মিষ্ঠা ঘোষ -এর কলমে -----


বয়ড়া লতা

শর্মিষ্ঠা ঘোষ

কথা ছিল তোর সাথে একটা শীতের সন্ধ্যে কাটাব আমার গ্রামের বাড়িতে। বেলা ১১:৪২ এর ট্রেন। স্বপ্নপুর স্টেশন। তারপর ভ্যানরিক্সায় চেপে দুখীনদীর ধারে মায়াপীঠ। মায়াপীঠ আমাদের বাড়ির নাম। গ্রামের লোকেদের দেওয়া। মিনিট চল্লিশের পথ। তোকে নামাবে ভাঙা শিবমন্দিরের সামনে। পাশে কদম গাছ। ফেলে কয়েক কদম এগোলেই বেড়ার দরজা। 

আমার নাম ধরে ডাকবি কি ডাকবি না ভাবতে ভাবতে আশপাশে তাকাবি। বাড়ির দুপাশের গাছগুলোর মধ্যে বেশ স্বেচ্ছাচারিতা আছে। চেনার মধ্যে দুটো পেয়ারা গাছ, একটা নিমগাছ। কেউ এখানে থাকে! মনে হচ্ছে না তো। তারপর দেখবি রাস্তার ওপারে। সাজানো ধানজমি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আগন্তুকের দিকে, তোর দিকে। পথে কেউ কোত্থাও নেই। এমনকি হাঁস-মুরগীও না। শেষ প্রাণী বলতে ভ্যানওয়ালা। কেন জানি ভয়ে ভয়ে শহুরে টানে বলবে, 'দিদি একটু দাঁড়াই। আপনি ঘুরে আসুন। আবার স্টেশনে পৌঁছে দেব।' নির্দ্বিধায় বলে দিবি, 'না না, ঠিক আছে। ভোররাতে ট্রেন। ততক্ষণ এখানে থাকব, বন্ধুর সাথে।' ভ্যানওয়ালা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তখন বিকেল ০৫:০৬। বেড়ার দরজা খুলে ঢুকে পড়বি। চার পাঁচটা ভাঙা ভাঙা মাটির ঘর, অগোছালো উড়ে যাওয়া চালা। অবাক হয়ে ভাববি, এখানে কীভাবে মানুষ থাকে! 

এতক্ষণে হঠাৎ সন্ধ্যে। ইতস্ততভাবে আমার নাম ধরে ডাকবি একবার। সাড়া পাবি না।  কিছুক্ষণ থেমে আরও দুবার।  শরিকি মাটির ঘরগুলো থেকে কটি লিকলিকে নানান সাইজের মানুষ বেরিয়ে আসবে আদিম অনার্যের মতো। পরণে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। শরীরের আউটলাইনে যতটা আন্দাজ করা যাবে। ওদের চোখে প্রশ্ন, মুখে নয়। নামটা আরেকবার শুনে হাত দিয়ে একটা দূরের দরজা দেখিয়ে মুহূর্তে উধাও হয়ে যাবে।

শেফালী কামিনীর গন্ধ জড়ানো থকথকে অন্ধকার ভেদ করে কৃষ্ণ-চতুর্দশী পেরনো প্রথম জিরাফের গলার মতো দীঘল জ্যোৎস্না।সামনে হিমেল বাতাসের আঢাকা বেহুঁশ পথে হেঁটে যাওয়ার অগত্যা উপায়। দ্বিধা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে নামগোত্রহীন গেঁয়ো গন্ধরা তোর মন আর গায়ের দুপাশে ভিড় জমাবে। মাঝে কাঁঠালগাছের একটা নীচু ডাল। সাবধান। এবার তুই ভীষণ বিরক্ত। এইজন্যই বলে গেঁয়ো, সঙ্গে একজন আসবে এমন ভদ্রতাই জানে না কেউ।ভেবে পেছনদিকে তাকাবি। দেখবি, ভাঙা চালাঘরগুলোয় জ্বলছে কুপি। আর তার কাঁপা আলো যেন তোকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যাবি না। ওরা সব মৃত। অজানা এক স্নায়ুর ভয় তোর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। ভয় আর সাহস দুটোই সঙ্গী করে আমার ঘর পানে হাঁটা শুরু করবি। ততক্ষণে আমার দরজায় একজন হ্যারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাঙাকাকু। বাড়ির একমাত্র জীবিত সদস্য। তোকে দরজা দেখিয়ে চলে যাবে। চাঁদের আলোয় ভালো ঠাহর হবে না।  মোবাইলের টর্চ জ্বালবি।

দরজায় কাঠ চোখে পড়বে না। পুরু শ্যাওলা। দরজার আশপাশ দিয়ে অসংখ্য নিঃসংকোচ বয়ড়ালতা নিঃশব্দে এলোমেলো ভাবে নিজেদের মেলে ধরেছে। একমাত্র অতিথিকে অতীতের যাপনকথা শোনানোর জন্য যেন উন্মুখ। কান্না পাচ্ছে?! তবুও অসম্ভব কৌতূহল আর আতঙ্কে দরজাটা ঠেলবি। প্রথমে মোচড়ের আওয়াজে তোর খুব শীত করবে। আবার ঠেলবি। ভেঙে পড়বে। ভাঙা মাটির খোলের ভেতর হাঁ করা আলতা-অন্ধকার। এই সময় দূর থেকে রাঙাকাকুর হেঁড়ে গলা, 'দোরের ওপারে কিসু লাই গ। বুকন গলায় দরি দিবার পর ভেঙি দিচি ঘর। দোরখান রই গেসে।'

চালচুলোহীন অলক্ষ্মীপানা মেয়ে বিয়ের রাতে যেমন স্তব্ধ শব্দ  হয়, এখন তেমনই তোর শরীর, আমার অশরীর আর আমাদের উদ্দাম প্রেম। আত্মহারা নির্জনতা। ক্রমশ স্থিতপ্রজ্ঞ কুয়াশায় ক্রমাগত ম্লান পূর্ণিমা রাত। কাঁদতে চাইছিস। অথচ গলা দিয়ে বমির ওয়াক ওয়াক শব্দ তোকে হাঁপিয়ে তুলবে। কালো কালো ঝোপঝাড় পেরিয়ে মুহূর্ত এগোবে। তখন রাত ০৩: ৪৮। দূরের ভ্যানরিক্সার আওয়াজে হুঁশ আসবে তোর। নিজের বাড়ির মানুষদের জন্য মনকেমন করে উঠবে। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবি মায়াপীঠের বাইরে। তখনও তোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে এক অশরীরী শীত, তুই যার একমাত্র উষ্ণতা...







*****************************************************************************************************



 শর্মিষ্ঠা ঘোষ

জন্ম কলকাতায়। বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি শখ। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায়। দৈনন্দিন জীবনের যন্ত্রণা, প্রেম, পাল্টে যাওয়া রঙ লাগে কবিতায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন