ধুলোর সিংহাসন
পর্ব -- সাত
দেবাশিস সাহা
[ পূর্বানুষঙ্গ : এক ছুটির দিনে বইপত্র গোছাতে গিয়ে অশোকের চোখে পড়ে বহু পুরোনো একটি ডায়েরি। 'তোর জন্মকথা' শিরোনামে পঁচিশ বছর আগের রোজনামচা। নিজেরই হাতে লেখা।বর্তমান থেকে মুহূর্তে মন ছুটে যায় ,ফেলে আসা পঁচিশ বছর আগের অতীত দিনগুলিতে। ইতিমধ্যে ফোন আসে বড় শ্যালিকার। উপমার পরীক্ষা শেষ হলে, তারা একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। সম্মতি জানায় অশোক-অলি। তারপর....]
ভোরের রোদ্দুর মাখা সকালটা তিনতলার জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। নতুন জায়গা। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। উঠতেও ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ওই আকাশ,ওই ইতিউতি ভেসে বেড়ানো মেঘ, ওই ভোরের স্নিগ্ধ রোদ্দুরের দিকে চোখ পড়তেই উঠে পড়ল অশোক। বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসে সকালের আলোয় মাখামাখি পুরী শহরটাকে দেখছিল। সত্যি, কী ভীষণ ভালো লাগছে! কত কতদিন পর এমন মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে। ওর শরীরের প্রতিটি কলাকোশ, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন মুক্তির আনন্দে দুহাত তুলে নাচতে চাইছে। ঘুম থেকে উঠেই আজ আর কাউকে মুখস্ত করাতে হচ্ছে না ( a + b )3 = a3 + 3a2b + 3ab2 +b3 কাউকে বোঝাতে হচ্ছে না ' আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া ফুল, / নামুক মহুয়ার গন্ধ।' সমর সেনের 'মহুয়ার দেশ ' কবিতার এই লাইনগুলোর মানে কী। কেউ এসে বিরক্ত করছে না ' স্যার, আমাকে শেক্সপিয়ারের ওথেলোর ক্যারেক্টারটা লিখে দিন। না হলে --- '
' না হলে কী? '
' রত্না আন্টি আজ চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাবে বলেছে।'
মাথাটা যদিও সামান্য ঝিমঝিম করছে। 'শতাব্দী এক্সপ্রেসে' ঘন্টা আষ্টেকের জার্নির হ্যাং-টা এখনও কাটেনি পুরোপুরি। মাথার ভেতর এখনও যেন মাঝে মাঝেই ছুটছে চলন্ত ট্রেনের চাকা,প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার শেষ হুইসল আর মাঝেই মাঝে এসি কামরার জানলার কাঁচ দিয়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে অল্প অল্প সবুজ,ছুটন্ত গাছপালা ,নদী ,ঘরবাড়ি। দেখা যাচ্ছে আদিগন্ত সবুজ ধানক্ষেত,জলাশয়ে সারি সারি বকের ডানামেলা কিংবা বহুদূর বিস্তৃত কাশফুলের মাথা দোলানো। কলকাতায় এমন নিভৃতি কোথায়! খালি ধুলো ধোঁয়া আর দূষণ। যে দিকে তাকাও পিঁপড়ের সারির মতো ওলা, উবের ,ট্যাক্সি, সার সার ট্রাম,বাস মিনি আর মেট্রোর সদম্ভ বিজয় ঘোষণা। নির্জনতা মুখ লুকোতে লুকোতে নিরুদ্দেশ, এ শহর থেকে কোথায় কত দূরে কে জানে!
আর এখানে,এই পুরী শহরে, কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা নির্জনতা যেন নতুনরূপে সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে ওদের হোটেল ' তিমি লজ ' থেকে অল্প দূরে। সমুদ্র ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষায় ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে সব ক্লান্তি, দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার অবসাদ।
' কী ভাবছ অত? এই নাও ---' তাকিয়ে দেখে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে প্রদীপটা এসে হাজির।
' চা খেয়ে যাও বাজার করে আনো,তোমরা যা খাবে,মাছ মাংস যা খুশি কিনে আনো, আমার রান্না করে দিতে কোন আপত্তি নেই।'এক নিঃশ্বাসে বলল প্রদীপদা। সত্যিই প্রদীপদার জবাব নেই। নিজে বড় ক্যাটারিং-এর মালিক। পাঁচ-সাতশো লোককে রান্নাবান্না করে খাওয়ানো ওর কাছে কোনও ব্যাপারই না। সেখানে ওরা তো দলে মাত্র সাত জন। এ সংখ্যাটা ওর কাছে নেহাতই নস্য। সেই তুলনায় অশোক নেহাতই শিশু। অনেক ঘাম ঝরিয়ে হয়তো দু 'মুঠো আলুসিদ্ধ ভাত ফুটিয়ে দিতে পারে। কাজেই প্রদীপদার কথা শোনা ছাড়া কোন উপায় নেই। প্রদীপটা নিজেই বলেছে হেঁসেলের দায়িত্ব আমার। তোমরা ঘোরো ফেরো খাও দাও। মস্তি করো। আমার কাছে পুরী জলভাত। প্রায় ফি বছর আমি পুরী আসি,টুরিস্টদের সঙ্গে।
এমন প্রস্তাব কেউ প্রত্যাখ্যান করে? অনেক ভেবে দেখেছে অলি -অশোক,নিজেরা রান্না করে খেলে পাঁচদিনের পুরী ভ্রমণের খরচ অনেক কম পড়বে। হোটেলে খাওয়া নয় তো, টাকার শ্রাদ্ধ। তার চেয়ে হাঁড়ি কড়াই ভাড়া করে ,নিজেরাই পছন্দমত রান্নাবান্না করে খাও। আর প্রদীপদা যখন সঙ্গে আছে,এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে!
পিছনে তাকিয়ে দেখে অশোক একে একে সবাই এসে হাজির। রিনাদি ,অলি,নিলু, উপমা, গোগোল আর কাশীদা। কাশীদা প্রদীপদার বন্ধু। ফিজিওথেরাপিস্ট। চলতে-ফিরতে শরীরকে চাঙ্গা রাখতে ফিজিওথেরাপি কতটা জরুরি সবাইকে বুঝিয়ে চলেছেন ,হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠা অবধি।এমনকী কাল রাতেও ট্রেনে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে যে অবসাদ এসেছে সবার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, তা কী ভাবে কাটাতে হবে, নিজে অনুশীলন করে হাত পায়ের ব্যায়াম দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অশোক কাশীদার কথা শুনবে কী, ওর চেহারা আর কথা বলার বিশেষ ধরণ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। কাশীদার নাম শুনলেও,অশোক আগে কখনও দেখেনি। এই প্রথম দেখছে। আর প্রথম দেখাতেই মুখস্ত করে নিচ্ছে কাশীদার সর্বাঙ্গ। বেশ নাদুস-নুদুস গোলগাল চেহারা কাশীদার। মাথায় সমুদ্রের মতো বিশাল টাক। কপালের কাছ থেকে শুরু করে মাথার প্রায় শেষ পর্যন্ত গড়ের মাঠ। তবে পিছনে অর্ধচন্দ্রাকৃতি কিছুটা চুলের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে,তিনি একেবারেই কেশবিহীন টেকো নন। তবু সমুদ্রের উপমাটা কেন এল, অশোক বুঝতে পারছে না। হয়তো পুরি এসেছে বলেই। দু'হাত দূরেই তো সমুদ্র।
' চা খাওয়া হয়েছে তো সবার? 'হাঁক পাড়ল প্রদীপদা। প্রদীপদা বেশ রসিক,আমুদে মানুষ। মাঝে মাঝে এমন অঙ্গভঙ্গি করে,আর প্রয়োজনমতো দু'অক্ষর চার অক্ষর ছেড়ে দেয় ,উপস্থিত সবাই হেসে লুটোপুটি খায়। আর পেটে একটু লাল জল পড়লে তো কথাই নেই। কাছে উপমা আছে কি গোগোল দেখাদেখি নেই।সমানে হরিনাম জপ করতে থাকে। গালাগাল দিয়ে অদৃশ্য শত্রু'র চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে।
' হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে '
' শোনো অশোক, তাহলে তুমি রিনা আর অলিকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে যাও। আমি ততক্ষণ টিফিনের বন্দোবস্ত করি। টিফিন সেরে সবাই মিলে সমুদ্রস্নানে যাব।'
' যে আজ্ঞে,হুজুর।' বড় ভায়রার কথায় সম্মতি জানায় অশোক।
পুরী বাজারে ঢুকে অশোকের চোখ ছানাবড়া। কোথায় সুভাষ পার্ক নতুন বাজার আর কোথায় পুরী বাজার! সাত সমুদ্র তের নদী না হোক, বহু দূরের কোনও এক অচেনা বাজারে এসে পড়েছে যেন। কেউ এখানে চেনে না তাকে। এত ভিড় দোকানপাট লোকজন। অথচ সুভাষ পার্ক নতুন বাজারের মতো দেখামাত্রই কোনও মাছ ব্যাপারী চিৎকার করে উঠছে না,' অশোকদা আসুন, আসুন, একেবারে টাটকা ফ্রেস ডায়মন্ডের ইলিশ। ওদিক থেকে গুপি হাঁক পাড়ছে না, ' অশোকদা এদিকে এদিকে,একেবারে জ্যান্ত টেংরা চালানের না,পুকুরের,কম দামে ছেড়ে দিচ্ছি।' পাশ থেকে কোনও ছাত্রের বাবা বলে উঠছে না, ' কি অশোকবাবু,বাজার হল?' ভাবতে কেমন যেন রোমাঞ্চ লাগছে অশোকের।
এদিক ওদিক ঘুরে দেখল, জিনিসপত্রের সব আগুন দর। কলকাতার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। টুরিস্ট স্পট বলে কথা! যত পারো ট্যুরিস্টদের ঘাড় মটকাও। শুধু মাছের দামটা একটু যা সস্তা মনে হল। প্রমাণ সাইজের ভেটকি আড়াইশো টাকা কেজি। পার্শে দুশো টাকা। কলকাতায় এত সস্তা এই মাছ পাওয়া যাবে না। হয়তো সমুদ্র সামনে বলেই। মাংসের দামটাও তুলনামূলকভাবে একটু কম।
' কী গো,কী মাছ নেবে,রিনাদি?'
' ভেটকিই নাও,তাহলে তোমার প্রদীপদাকে বলব দু'চার পিস ফিস ফ্রাই করে দিতে।' আহা! দারুণ হবে । তবে রিনাদি, ভেটকির সাথে কিছু পার্শেও নিস।'
' হাঁ, তা তো নেবই, দু'রকম মাছ না হলে জমবে কী করে? '
' মাংস নেবে না?' অশোক, রিনাদি অলি দু'জনের দিকে তাকায়।
'একদিনে কত খাবে? মাংস আজ থাক,কাল বরং দেখা যাবে।'
বাজার থেকে ফিরে ওরা দেখল প্রদীপদা টিফিন তৈরি করে রেডি। প্লেটে প্লেটে সাজাচ্ছে কাশীদা। মোবাইল ঘাটতে ব্যস্ত গোগোল, উপমা।
' কী টিফিন করলে প্রদীপদা?'
' লুচি আলুর চচ্চড়ি।' সাতজন একত্রিত হয়ে টিফিনপর্ব সেরে নিল চট করে।
'এই নিলু,গোগল,উপমা, তোরা সব রেডি হয়ে নে। এবার আমরা সমুদ্রস্নানে যাব। ' হাঁক পাড়ল প্রদীপদা।
'এক্ষুনি? '
'হ্যাঁ,হ্যাঁ আমার তো আবার এসে লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে নাকি।'
' ঠিক আছে, মা,রিনামাসি তোমরা তৈরি হয়ে নাও। আমি,নিলুদাদা, গোগোলদাদা তৈরি হয়েই আছি।' উৎসাহ উপচে পড়ছে উপমার গলায়।
সমুদ্র? পুরীর সমুদ্র? আজ সত্যি সত্যিই স্বচক্ষে দেখা হবে,অশোক যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এত কাল বন্ধুদের মুখে,পাড়া-প্রতিবেশী যারা পুরী গেছে, তাদের মুখে শুধু শুনেই এসেছে, পুরীর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের কথা। এই প্রথম সমুদ্র দেখার আনন্দ ও উত্তেজনায় ওর সমস্ত মন প্রাণ থরথর করে কাঁপছে। মনে পড়ছে,কোন ছোট বেলায় স্কুলের ইংরাজি essay ' travelling as a part of education ' মুখস্ত করতে গিয়ে পড়েছিল 'the roaring sea of puri is calling me.' কেউ পুরীর গল্প করলেই,এই লাইনটা মনে ভেসে উঠত অশোকের। আর আজ সেই সমুদ্র কত সামনে! আর মাত্র দু'পা। ওই ওই তো শোনা যাচ্ছে ঢেউয়ের শো শো শব্দ। প্রখর রোদ মাথার উপর। এলোমেলো সামুদ্রিক হাওয়া। হাওয়ার দাপট এতটাই বেশি মনে হচ্ছে যেন সামনে এগোতে দেবে না। কিন্তু আজ আর কোনও বাধা মানবে না অশোক। এই ঢেউয়ের কাছে পৌঁছতে সময় লেগে গেল পঞ্চাশ বছর। আর একটা মুহূর্ত নষ্ট করা যাবে না।
হই হই করতে করতে এগোচ্ছে প্রদীপদা ,কাশীদা পিছনে অলি, রিনাদি। তার পিছনে নিলু,গোগোল, উপমা। উৎসাহে ডগমগ। চোখে সানগ্লাস,হাতে মোবাইল। সেলফি তুলে চলেছে অনর্গল।দু'চার পা পিছিয়ে পড়েছে অশোক।ইচ্ছে করেই।পুরো দলের সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা করতে এই মুহূর্তে একদম ভালো লাগছে না ওর। আর কোনও বাধা নেই।সামনে থেকে মুহূর্তে সরে গেল যেন ঘন কুয়াশার আবরণ। ওই ওই তো সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি আর সেই অনন্ত অফুরন্ত ঢেউ -এর মধ্য থেকে ফেনময় দীর্ঘ সাদা ঢেউ একের পর এক প্রচন্ড আশ্লেষে গড়িয়ে এসে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। পাড়ে? না,অশোকের বুকে,বুঝতে পারছে না অশোক। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর চুপটি করে বসে পড়ে একটা বড় পাথরের উপর। নির্নিমেষ দু'চোখ। ওর সমস্ত বোধ,সমস্ত চেতনা চৈতন্য কেমন যেন স্তিমিত হয়ে আসছে। ওর সমস্ত সত্তায় নীরবে নিঃশব্দে ওই সমুদ্র এখন মাথা পেতে শুতে চাইছে। ওর ছোট্ট বুকে ওই বিরাট বিশালকে আশ্রয় দিয়ে,কেমন যেন ধীরে ধীরে নিরাশ্রয় হয়ে পড়ছে অশোক। মনে হচ্ছে,ওর ঘর নেই, বাড়ি নেই, অতীত নেই,ভবিষ্যৎ নেই। জন্ম জন্মান্তর ও যেন এই ঢেউ সামনে রেখে তাকিয়ে আছে, তোমারই দিকে, হে সুন্দর, হে বিরাট বিশাল! তোমার সেই বিরাট বিশালত্বের পরিমাপ করতেই কি পালতোলা 'এরিয়েল 'নৌকো ভাসাতেন ইংরেজ কবি শেলি? তারপর একদিন কূলকিনারা পরিমাপ করতে না পেরে আত্মসমর্পণ করলেন প্রিয় বন্ধু এডোয়ার্ড উইলিয়ামস আর এক কিশোর নাবিককে নিয়ে? ' সমুদ্রের হাওয়া আমার ফুসফুস পুড়িয়ে দিক ' লিখেছিলেন বছর কুড়ির ৱ্যাবো? ' মুক্ত মানুষ তুমি সমুদ্রের জন্য তৃষিত / সমুদ্র তোমার আয়না...' মানুষ ও সমুদ্র ' কবিতায় লিখেছিলেন বোদল্যের? এই নীলাচলেই নীল সমুদ্রকে কৃষ্ণ ভ্রমেই কি অপার প্রেমের সৌন্দর্যে লীন হয়েছিলেন, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু?
মেসো,ও মেসো? 'কে মেসো! কার মেসো! গোগোল ডেকেই চলেছে। অশোকের কানে ঢুকছে না কোনও ডাক। বাকহারা। অপলক। এইবার কাছে এসে ঘাড়ে একটা হাত রেখে গোগোল বলল, ' তুমি তো এখানে বসে আছ, এগুলো ধরো। মা বা অলিমাসি কেউ এলে, তুমি জলে নামবে।'
কিছুটা সংবিৎ ফিরল যেন। অশোক দেখল,ওর কোলের উপর জমে উঠেছে টিমের সবার সানগ্লাস, মোবাইল ,গামছা ,তোয়ালে, সিগারেটের প্যাকেট। পায়ের কাছে স্তূপীকৃত জমেছে সবার চটি জুতো।
গোগোল যেতেই আবার ডুব চিন্তার সমুদ্রে।আমি কি যাব, না আমার বুকের ভেতর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়া সমুদ্রের গায়ে-মাথায় কপালে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে বলব, কতকাল অপেক্ষা করে আছি, ঘুমোও লক্ষীটি ঘুমোও,আমি তোমাকে বিরক্ত করব না। ভাবছে অশোক। পাশে ফেরিওয়ালা হাঁকছে, ' চাই চিড়ে ভাজা ,বাদাম ভাজা গরম গরম।' দু'হাত ভরে পুতির মালা, একটা ছেলে খদ্দের খুঁজছে। চা-ওয়ালা লোকটা হাঁক পাড়ছে, ' চাই গরম চা। পাশে কত লোকজন। কত কোলাহল। হই চই। ওই তো একটু দূরে স্নানরত অজস্র মানুষের বিস্ময় পুলকিত অভিব্যক্তি। কিন্তু অশোক শুনতে পাচ্ছে না এসব কিছু। বুকের ভেতর শুয়ে পড়া সমুদ্রকে যেন বলছে, ' আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে ওই ভাবে আছড়ে পড়ো অনন্তকাল।'
' পাপাই, রিনামাসির স্নান হয়ে গেছে, উপরে যাচ্ছে, রিনামাসির কাছে সবকিছু রেখে,এবার তুমি স্নান করবে, চলে আসো।' চিৎকার করে বলছে উপমা। অশোক লক্ষ করে, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উথালপাতাল স্নানপর্ব সারছে প্রদীপদা ,কাশীদা ,অলি , নিলু,উপমা, গোগোল। আর সবাই ইশারায় অঙ্গভঙ্গি করে ডাকছে ওকে । একসময় রিনাদি উঠে এসে বলল, ' অশোক, এইবার তুমি চাও স্নান করে আসো, আমি ততক্ষণ পাহারা দিচ্ছি।'
এক পা দু'পা করে এগোয় অশোক। রোদ উঠেছে প্রচন্ড। কিন্তু গায়ে লাগছে না ততটা। তেতে উঠেছে বালি। পা দিতেই ছ্যাত করে উঠছে। বেলাভূমিতে আর একটু এগোতেই একটা ঢেউ এসে আলতো করে পা ছুঁয়ে গেল। অশোকের খুব ইচ্ছে করছিল,ঢেউটাকে ধরে রাখতে। ইচ্ছে করছিল বলতে, 'তুমি কেন আমার পা ছোঁবে, তুমি অনন্তের চকিতবার্তা, সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে আবহমান ঢেউয়ে ঢেউয়ে চুম্বন করে যাচ্ছ এই মৃত্তিকা। আমি সামান্য মানুষ, তোমার পায়ে, আমিই জনম জনম আছড়ে পড়ব। আমার ক্ষুদ্রত্ব তুমি ভেঙে চুরমার করে দাও,তোমার বিরাট বিশালত্বে।'
আর একটু নামতেই মনে হল অশোকের, এই ঢেউটাই যেন একটু আগে, যখন ও পাথরের উপর বসেছিল, চুপ করে শুয়ে ছিল ওর বুকের ভেতর। এখন অশোক নামতেই জেগে উঠেছে সে-ও।
কার্যত, এই অশোক আর একটু আগের অশোক যেন আলাদা। এ যেন সেই কলকাতা থেকে আসা ছাপোষা অশোক বোস, তপোবন কোচিং-এর সেই অশোক স্যর নয়, যার মাথার উপর ব্যাংকের তের লাখ টাকার লোনের বোঝা, যে সমুদ্র দেখতে এসেছে পাঁচ হাজার টাকা ২% ইন্টারেস্টে ধার করে, যাকে কেউ ভালবাসে, কেউ উপেক্ষা করে,আবার কেউবা ঘৃণা করে। সে সব ভুলে এই মুহূর্তে সে তার দিকে ছুটে আসা ঢেউগুলোকে আলিঙ্গন করতে চাইছে, বলতে চাইছে, ' আবার কবে আসব জানি না, এই এসেছি ,আমাকে গ্রহণ করো।'
ভেটকি আর পার্শে মাছ দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা জম্পেশ হল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলছে ইয়ার্কি ফাজলামো। এ ওর ফিশ ফ্রাই চুরি। এই আইটেমটা যাচাই নয়,একটা করেই পড়েছে সবার পাতে। খেতেও হয়েছে দারুণ টেস্টি। সত্যি,প্রদীপদার রান্নার জবাব নেই। ' মাছের মাথা দিয়ে ডালটা একঘর হয়েছে মেসো।' উপমা সার্টিফিকেট দিচ্ছে প্রদীপ মেসোকে।' বাবা আর এক পিস ভেটকি দাও না।' গোগোলের আবদার। 'নে না, কত খাবি 'প্রদীপদা দু'পিস তুলে দেয় ছেলের পাতে। 'তোমার আছে তো?' কাশীদা আতঙ্কিত হয়। ' তুমি খাও তো টেকো, আমি তো পরিবেশন করছি।' প্রদীপদার চটজলদি জবাব। কাশীদাও কম যায় না, ' গোগোল রাহুর মতো গিলিস না,একটুবাদেই ঘুরতে যাব, বমি করে মরবি।' আসলে গোগোলের পিছনে না লাগলে,কাশীদার পেটের ভাত হজম হয়না। ' কী রে অলি, তুই খেয়েছিস তো ঠিকঠাক?' রিনাদি জানতে চায়। ' কেন,ঠিক ঠাক খাব না কেন, পদুদার রান্না আমার হেব্বি লাগে। ' সবাই খিলখিল করে হেসে ওঠে, অলির মুখে প্রদীপদার নামের অপভ্রংশ 'পদু ' শুনে। প্রদীপদাও চুপ থাকার মানুষ না,সাথে সাথে উত্তর, ' হা ঘরের মতো আর গিলিস না, গ্যাট হয়ে বসেছে দ্যাখো, যেন এবার পাতাটাও চিবিয়ে খাবে। কেনরে,আমার ভায়রা কি তোকে খেতে দেয় না?' খেতে খেতে চলছে এই রকম হাসি ঠাট্টা তামাশা। আর চলছে নিলু ,গোগোল ,উপমার দেদার ছবি তোলা আর সাথে সাথে ফেসবুকে পোস্ট করা।
'নাও অনেক হয়েছে,এবার যে যার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। বিকেলে সাইটসিন দেখতে যাব।' নির্দেশ প্রদীপদার।
বিকেল গড়াতে না গড়াতেই দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ল ওরা। আপাতত হাঁটছে পুরীর বাজারের ভেতর দিয়ে। দুটো ব্যান্ড এড কিনতে হবে। হাঁটাহাঁটিতে উপমা-রিনাদির পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। এ-গলি, সে-গলি করে এগোচ্ছে ওরা। একটু পিছিয়ে পড়েছে অশোক। চারদিক দেখে নিচ্ছে ভালো করে। চোখে পড়ছে অজস্র দোকানপাট মানুষজন। একটা জিনিস নজরে আসছে অশোকের,পথে-ঘাটে দোকানে বাজারে যত মানুষ দেখা যাচ্ছে,মনে হচ্ছে,তারা বেশিরভাগই কলকাতা থেকে এসেছে। উড়িষ্যাবাসী খুব কম। সত্যি কলকাত্তাইয়া বাঙালির রাজত্ব কোথায় নেই! হোটেলের ঘরে টিভিতে দেখছিল, লন্ডন প্যারিস নিউইয়র্ক দাপিয়ে বাঙালির দুর্গাপুজো কেমন আন্তর্জাতিক চেহারা পাচ্ছে। আর পুরী তো কলকাতা থেকে মাত্রই আট ন'ঘন্টার ট্রেনযাত্রা। অতএব সমুদ্র তোমার নিস্তার নেই,তোমার বুকে আমরা লাফাব। ঝাপাব। কলকাতার দূষণ খানিকটা পরিত্যাগ করব। তুমি সব মুখ বুজে সহ্য করো। আর পুজোর সময় বলেই হয়তো বাঙালির ভিড়টা একটু বেশি। পুজোর ছুটিতে অনেকেই দার্জিলিং, সিমলা নিদেন দিঘা কিংবা পুরী বেরিয়ে পড়ে। যেমন এবার বেরিয়ে পড়েছে চিরকালের গৃহবন্দি অশোকও। পুজোর ছুটিতে এমনিতেই দিন দশেক কোচিং ছুটি দেয়। এবারও দিয়েছে। কামাইয়ের ব্যাপার নেই। ওরা বেরিয়েছে নবমীর দিন আর ফিরবে লক্ষ্মী পূজার আগে, কোচিং খুলবে লক্ষ্মীপূজার পর দিন। অতএব গার্জিয়ানদেরও মুখ ভার করার প্রশ্ন নেই।
' তুমি অত পিছিয়ে পড় কেন?' প্রদীপদার গলা। ' নাও দু'টান মারো ' জ্বলন্ত সিগারেটটা ধরিয়ে দেয় অশোকের হাতে। সিগারেটটা সবে একটা টান দিয়েছে কি দেয়নি, কাশীদা বলে উঠল, ' ওই দ্যাখো স্বর্গদ্বার। ' স্বর্গদ্বার ' কথাটা শুনে চমকে ওঠে অশোক। ' পুরীতে এসে সশরীরে স্বর্গদ্বারে এসে পড়লাম, কী সৌভাগ্য, এবার তাহলে স্বর্গে ঢুকে পড়লেই হল। ' না না, এটা সেই স্বর্গদ্বার নয় ' কাশীদা ভুল ভাঙাল ' আসলে এটা পুরী শ্মশান, মানুষের অন্তিম ঠাঁই। ' মানুষের অন্তিম ঠাঁই ' ফিজিওথেরাপিস্ট কাশীদার মুখে এমন দার্শনিক উচ্চারণ শুনে অবাক হয় অশোক। ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কাঠের চিতা জ্বলছে দু'তিনটে। ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। একটা চিতার কাছাকাছি অশোক লক্ষ করল,বছর আষ্টেকের একটি ছেলে। অঝোরে কাঁদছে। আর চোখ মুছছে। আর মাঝে মাঝে কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার দিকে তাকাচ্ছে।কী খুঁজছে ছেলেটি? ওই ধোঁয়ার মধ্যে? প্রিয়জন কারও মুখ? ছেলেটাকে ভাল করে লক্ষ করে কী জানি কেন অশোকের মনে ' অভাগীর স্বর্গে'র কাঙালীর মুখটা ভেসে উঠল।
স্বর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে,অলি ছুটে এসে অশোকের জামা টেনে ধরে, ' শ্মশানের সামনে এতক্ষণ দাঁড়াতে হবে না। চলো আমরা সমুদ্রতীরে যাই।' শ্মশান আর সমুদ্র এই দুই ' শ '-এর ভয়ানক আকর্ষণে অশোক তখন ভীষণ টালমাটাল। উপমা হাত ধরে টানে, ' চলো আমরা সমুদ্রতীরে যাই '।কাশীদাও বলল, ' হ্যাঁ, তাই চলো,সন্ধের সময় সমুদ্রতীরে বিশাল মেলা বসে। কাশীদাও যে প্রদীপদার মতোই এর আগে বহুবার পুরী চষে বেড়িয়েছে,তা ওর কথাবার্তা থেকেই পরিষ্কার।
এখন মেলার পথে পা বাড়িয়েছে সবাই। স্বর্গদ্বার পেরোতেই অশোকের চোখে পড়ল, একটা দেয়ালে বড় বড় করে লেখা ' হরিদাস ঠাকুরের সমাধি মন্দির ' হরিদাস ঠাকুর! শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ! অবাক হয় অশোক। নিমেষে ওর মনটা ডুব দিতে চাইল পাঁচশো বছর আগেকার ইতিহাসে। হরিদাস ঠাকুর জাতিতে ছিলেন মুসলিম। কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা। খোল করতাল বাজিয়ে ফুলিয়ায় নবদ্বীপে হরিনাম সংকীর্তন করে ফিরতেন। সহ্য হল না কাজির। তিনি সুলতানি শাসকদের কাছে অভিযোগ জানালেন। তলব করা হল হরিদাসকে। জানতে চাওয়া হল,যবন হয়েও কেন তিনি হিন্দু ধর্মাচরণ করে বেড়ান। মনে পড়ল অশোকের, বৃন্দাবন দাসের ' শ্রী চৈতন্য ভাগবত ' বইতে পড়েছে, সেই সময় হরিদাস ঠাকুর তাদের বলেছিলেন-----
শুন,বাপ, সবারই একই ঈশ্বর
নাম-মাত্র ভেদ করে হিন্দুয়ে যবনে।
পরমার্থে এক কহে কোরাণে পুরাণে।।
এক শুদ্ধ নিত্যবস্তু অখণ্ড অব্যয়।
পরিপূর্ণ হইয়া বইসে সবার হৃদয়।।
কিন্তু ওই যে কথায় বলে ' চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি ' শাসকদল বুঝল না,এই কথার মর্মার্থ। শাস্তির বিধান দিল তারা। আদেশ হল বাইশ বাজারে জল্লাদরা নিষ্ঠুরভাবে বেত্রাঘাত করতে করতে প্রাণ কেড়ে নেবেন হরিদাস ঠাকুরের এবং সেটাই হবে বিধর্মীর উপযুক্ত শাস্তি। সেই আদেশ মত জল্লাদরা বাইশ বাজারে হরিদাস ঠাকুরকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করতে লাগল। কিন্তু কী আশ্চর্য! হরিদাস ঠাকুরের শরীরে বিন্দুমাত্র বিকার দেখা গেল না। যেন ভক্ত প্রহ্লাদ। প্রাণ নেওয়া তো দূরের কথা, জল্লাদরা আতঙ্কিত হল, হরিদাসের প্রাণ নিতে না পারলে, তাদের যে প্রাণ সংহার করবেন কাজি। শুনে হরিদাস ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। এই সময় তাঁর শরীরে বিশ্বম্ভরের অধিষ্ঠান হল। শত চেষ্টাতেও জল্লাদরা হরিদাস ঠাকুরকে নড়াতে পারল না। হরিদাস ঠাকুরের পাপ যাতে আরও বৃদ্ধি পায়, তাই কাজি তাকে কবর না দিয়ে, গঙ্গায় নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দিলেন। গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হল হরিদাসকে। কিন্তু তিনি ডুবলেন না। ভেসে রইলেন। যখন বাহ্য দশা ফিরে পেলেন, সাঁতরে পাড়ে উঠে আবারও হরিনাম সংকীর্তন শুরু করলেন। সেই হরিদাস ঠাকুরের সমাধি! রোমাঞ্চিত হয় অশোক।
' দেরি কোরো না, চলো চলো, এগোও। ' ঠেলতে থাকে প্রদীপদা।'একবার মন্দিরে ঢুকি,চলো দেখে আসি।'
' মন্দির এখন বন্ধ ' পাশ থেকে কাশীদা জানায় ' কালকে না হয়, যাওয়া যাবে।'
অগত্যা ভিড় ঠেলে এগোতে থাকে। কিছুটা সামনে রিনাদি, নিলু ,অলি ,গোগোল, উপমা।এত ভিড়! ওদের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। হঠাৎ চোখে পড়ল ' কাকাতুয়া' নামে একটা মিষ্টির দোকান। উপমার বন্ধু শ্রাবণী নাকি বলেছিল,এখান থেকে পুরীর গজা কিনতে। ট্রেনে আসবার সময় উপমা বলেছিল। অবাক হয় অশোক,দোকানের সামনে একটা খাঁচায় সত্যি সত্যিই একটা জ্যান্ত কাকাতোয়া রাখা। দোকানটার নাম এক বর্ণও ভুল নয়।
দেখতে দেখতে এসে গেল সমুদ্রতীরের মেলা। দুপুরে যখন স্নান করতে এসেছিল সবাই, তখন এতটা ভিড় ছিল না।এখন পুরো বিচ একেবারে লোকে লোকারণ্য। অলি নিলু ,উপমা ও গোগোলকে নিয়ে গেল ঘুরে ঘুরে মেলা দেখতে। কাশীদা ,প্রদীপদা ও অশোক একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে বসল একেবারে সমুদ্র সামনে রেখে। ঢেউয়ের দু-একটা ছোবল এসে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। বেশ লাগছে। চিড়ে ভাজা ,পাপড়িচাট , চানাচুর খেতে খেতে গল্প করছে ওরা। অশোক এক-আধ বার মুখে দিচ্ছে আর দু'চোখ ভরে দেখছে রাতের সমুদ্র। ঢেউগুলো এখন আরও উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যেন। এখন কি জোয়ার, না ভাটা? তবে এটা শুক্লপক্ষ। আকাশ নির্মেঘ। চাঁদ উঠেছে। প্রায় গোলাকার। সারা বেলাভূমি জ্যোৎস্নায় থই থই। পরশু লক্ষ্মীপুজো। পূর্ণিমা অমাবস্যায় সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে। অশোকরা পুরী আসবে শুনে, ওর কবি বন্ধু তপন বলেছিল ' যাও,পূর্ণিমায় সমুদ্র দুর্দান্ত লাগবে।' নিলু ঘোরাঘুরি ও কেনাকাটি করতে ব্যস্ত, রিনাদি -উপমার পায়ে ব্যথা। প্রদীপদা, কাশীদা গদ্যভাবাপন্ন। সৌন্দর্য পিপাসা কম। কাল রাতে কেউ না আসুক, হোটেল থেকে চুপিসারে একা এসে, সারারাত সমুদ্র দেখে কাটাব, ভাবছে অশোক।
'অশোক! অশোক!' এখানে, এই অচেনা সমুদ্রতীরে কে ওর নাম ধরে ডাকছে। পিছন ফিরে তাকায় অশোক। দেখে এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সঙ্গে বছর কুড়ি বাইশের একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। উঠে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দেন অশোকের দিকে, ' কী রে,চিনতে পারছিস?'
অশোকের স্মৃতি কাজ করছে না দেখে ভদ্রলোক নিজেই পরিচয় দেন, ' আমি বিজন।'
'বিজন ভট্টাচার্য?' অশোকের সহজাত রসবোধ জেগে ওঠে।
'আরে না, নবান্ন-র বিজন ভট্টাচার্য নয়। তিনি কি আজ বেঁচে আছেন ?
' তা-ও ঠিক। তবে?'
'আমি বিজন পুরকায়স্থ।'
'ও মনে পড়েছে,মনে পড়েছে,অ্যান্ড্রুজ কলেজ?'
'ঠিক তাই।'
আলিঙ্গনাবদ্ধ হয় অশোক-বিজন। উথলে উঠে স্মৃতি। মনে পড়ে যায়,কলেজের প্রথম পরিচয়ের দিনটা। আজকের মতোই সেদিনও একই রকমভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ও বলেছিল, 'আই এম বিজন পুরকায়স্থ। '
'পুরো কায়স্থ? একটুও বাদ না' শুনেই অশোক ওভার বাউন্ডারি হাঁকাতে চেয়েছিল। বিজনও কম যায় না। অশোক যখন প্রত্যুত্তরে বলেছিল 'আই এম অশোক বোস। ' বিজনও পাল্টা সুইপ শট দিয়েছিল, ' সুভাষ বোসের রিলেটিভ নয় তো?'
প্রথম আলাপের পরেই,ওরা নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিয়েছিল পরস্পরের। অশোকের যেটা সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল,সেটা হল,বিজনও ওরই মতো কবিতা অন্তপ্রাণ। ওরও প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। প্রিয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। প্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। তারপর আর গলায় গলায় বন্ধু হতে বেশি দেরি হয়নি। একসঙ্গে কফি হাউস, রেস্টুরেন্ট, একপ্লেট চাওমিন বা বিরিয়ানি ভাগাভাগি করে খাওয়া, সিনেমা, থিয়েটার দেখা ...সবেতেই দুই হরিহর আত্মা । সঙ্গে জুটেছিল ওর বান্ধবী পায়েল শেঠ। কবেকার কথা সে সব! তারপর বিজন সরকারি চাকরি পেয়ে শিলিগুড়ি ট্রান্সফার হল। জীবিকার নিষ্পেষণে ক্ষীণ হয়ে এল যোগাযোগ। বছর পাঁচেক আগে অবশ্য একবার হঠাতই কলেজ স্ট্রিটে দেখা হয়ে গেছিল দু'জনের। কী কাজে এসেছিল যেন বিজন। অশোক গিয়েছিল উপমার বই কিনতে।
বিজনই পরিচয় করিয়ে দিল, 'এই অন্বেষা, আমার একমাত্র কন্যারত্ন।'
' তুমি কী করো মা?'
' আমি ----'
মেয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিজন বলে, 'ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর,এই মাস ছয়েক হল টাটা টেলকোতে জয়েন করেছে।' অশোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অন্বেষা।
'তোর মেয়ে?'
'এইতো এবার বিএ ফাইনাল দিল,আপাতত কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য শিয়ালদার মৌলালিতে একটা কোচিং ক্লাসে ভর্তি করিয়েছি।'
'তা বেশ বেশ,মেয়ে কই?'
'মেলায় কেনাকাটা করছে বোধহয় মায়ের সঙ্গে ।'
'আর তোর সেই পায়েল শেঠ?'
পাশের ভদ্রমহিলাকে ইঙ্গিত করে বিজন বলে, 'ইনিই তিনি।'
তিনজনেই হেসে ওঠে। অন্বেষা মুখ লুকোয়। নমস্কার বিনিময় করে অশোক বলে ,'কেমন আছেন ?'
' ভাল' উত্তরটা দিয়েই ,পায়েলের কৌতূহলী প্রশ্ন , 'এখন কাব্যচর্চা হয়?'
'চর্চা তো হয় কিছুর একটা,তবে কাব্যটা বাদ দিয়ে।'
'কী রকম?'
'বলা যাবে পারে,আছেন তো ক'দিন?'
'সে নয় পরে শোনা যাবে ,কিন্তু অশোক, বন্ধুকে 'তুই' আর বন্ধুর স্ত্রীকে 'আপনি' সম্মোধন ---এটা কীরকম হল, এত শ্রেণিবৈষম্য কেন ?'
হো হো করে হেসে ওঠে অশোক,হাসির দমক থামলে পায়েলের সরাসরি অনুযোগ , 'আগে তো তুই তোকারির কী সহজ সম্পর্ক ছিল আমাদের,দীর্ঘ অসাক্ষাতের প্রমোশন একেবারে আপনিতে পৌঁছে দিল?' ।
হঠাতই বুকের রক্ত চলকে ওঠে অশোকের। এক সময় বিজন -পায়েল -অশোক ত্রিকোণ প্রেমের দ্বন্দ্বও জমে উঠেছিল বেশ। তখনও অলি আসেনি অশোকের জীবনে। পায়েল আর কবিতার নেশায় বুঁদ। রক্তের মধ্যে ঠেলে ঠেলে উঠে কবিতার লাইন ------
' জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার
হৃদয়ে আমার চড়া
চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি
কোথায় ঘোড়সওয়ার।'
কিন্তু ঘোড়সওয়ার নয়, হৃদয়ের চড়ায় পায়েলকে নিয়ে স্বপ্নে -জাগরণে উধাও হচ্ছে অশোক। অবশ্য সে প্রেম জীবনের চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি । বড় বিজনেসম্যানের একমাত্র আদুরে মেয়ে পায়েল অলির মতো ভুলটা করল না। বিজন চাকরি পেতেই,অনায়াসে ত্রিকোণ ভেঙে দ্বিবাহুলগ্না হল বিজনের।
'বাবাই পয়সা দাও ' হঠাৎ কোত্থেকে দৌড়ে এসে উপমা আবদার করল, ' হাওয়াই মিঠাই খাব।'
'একটু দাঁড়া মা ' তারপর বিজন -পায়েলকে লক্ষ করে বলল, 'এই আমার ---'
'কন্যারত্ন ' শেষ করল বিজন -পায়েলই। উপমা ওদের প্রণাম করল।
'থাক বাবা থাক,গড ব্লেস...'
অশোক পয়সা দিতেই উপমা দৌড় লাগাল। 'ভারী মিষ্টি মেয়েটা তোমার!'পায়েল বলল।
'তোরা কোন হোটেলে আছিস?'
' তিমি লজ।'
'আমরা আছি সিগালে। আয় না,কাল সকালে, জমিয়ে আড্ডা হবে।'
'কাল আমাদের প্রোগ্রাম ফিক্সডরে,কাল আমরা পুরীর মন্দিরে পুজো দেব, তারপর কোনারক ধবলগিরি উদয়গিরি খণ্ডগিরি...এই সব দেখব।
'তোরা কবে ফিরছিস?'
'পরশু।'
'কোন ট্রেন?'
'গরিবরথ।'
'তোরা? একই ট্রেন?'
'না,ভুবনেশ্বর থেকে ফ্লাইট।'
'ঠিক আছে দেখছি ,পরশু সকালে দেখা করা যায় কিনা।'
'যায় কিনা টিনা নয়,মেয়েকে দেখলাম, গিন্নিকে তো দেখা হল না,আসতেই হবে কিন্তু।' পায়েল জোর খাটায়।
'আচ্ছা ফোন করব যাওয়ার আগে।'
'ওকে,আমরা কিন্তু আশায় থাকব।'
বিকেলটা ফুরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সন্ধেটাও যায় যায়। কিন্তু অশোকের মন থেকে পায়েলের মুখটা কিছুতেই মুছে যাচ্ছে না। এই সেই পায়েল! সুডৌল স্তন, ঠোঁটের ওপরে একটা ছোট্ট তিল দ্বিগুণ বাড়িয়েছে যেন ওর যৌন আবেদন। আভিজাত্যের ছোঁয়া চলায় বলায়। শারীরিক বিদ্যুৎছটায় যে কোনও যুবক মুহূর্তে কুপোকাত। একদিন ওর রূপের বিভায় ক্লিন বোল্ড হয়েছিল অশোকও। আর আজ যাকে দেখল, সে কোন পায়েল! তোবড়ানো গাল।হাই পাওয়ার চশমা। পাতলা চুল।একটু যেন টেনে টেনে হাঁটছে।বাতে ধরেছে নিশ্চয়ই ওরই মতো।
'বাবাই একটু টেস্ট করো '
'কী রে,হাওয়াই মিঠাই? না ,আমি খাব না।'
'একটু খাও না,কিচ্ছু হবে না।'
মেয়ের জোরাজুরিতে একটুখানি মুখে দেয় অশোক। চিবিয়েই ফেলে দেয়।খুব মিষ্টি। মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল। আর ঠিক এই সময়, কোথা থেকে একটা উৎকট গন্ধ ভেসে এল, কীসের গন্ধ বুঝে উঠতে পারছে না কেউ। হঠাৎ দেখা গেল, ওদের সামনে দিয়ে চলেছে ' মরুভূমির জাহাজ 'উট। উটের গায়ে এত গন্ধ থাকে! এর মধ্যে উপমা এসে বায়না ধরল, 'বাবাই উটে চড়ব ' অশোক না করল না,বলল, ' ঠিক আছে কাল চড়িস, আজ রাত হয়ে গেছে।'
' হ্যাঁ,এবার চলো সবাই,উঠে পড়ে রিনাদি ,কাশীদা প্রদীপদা। খুব দ্রুতই সন্ধেটা ফুরিয়ে গেল। রাত প্রায় দশটা। সাধারণত এরকম সময় কোচিংয়ে থাকে। আর আজ কোথায়! প্রথাগত রুটিন ছেড়ে বেরিয়ে কী যে ভাল লাগছে!পুরীর প্রাসাদোপম হোটেল,রেস্টুরেন্ট ,মানুষজন, পর্যটকদের চোখেমুখে বাঁধভাঙা খুশির উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে যখন লজে পৌঁছল,তখন রাত্তির দশটা গড়িয়েছে।
( আগামী পর্বে )