মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২২

 লেখা আহ্বান 







**********************

স্বরবর্ণ * আট  * ২০২২  

দ্বিতীয় বর্ষ * দ্বিতীয় সংখ্যা 

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ জুন  ২০২ 

* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ মে ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন,এই নম্বরে --- 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরো আগে থেকে লেখা পাঠানপরিকল্পনার সুবিধার জন্যলেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 

বিস্তারিত তথ্যের জন্য উপরের লিংক টাচ করুন 

রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২

পাঠকের মতামত

পাঠকের চোখে  স্বরবর্ণ * সাত * ১৪২৯ 










 ' স্বরবর্ণ * সাত ' সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন । আবার ব্লগে সড়গড় না হওয়ায়, অনেকে সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মতামত জানিয়েছেন। ফোনেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ সংখ্যার কবি-লেখকেরা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব ওয়ালে সংশ্লিষ্ট লেখাটি শেয়ার করেছেন। সেখানেও অনেকে মতামত দিয়েছেন। সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য সকল পাঠককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

পাঠকের মতামত শিরোধার্য করে আমরা ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ করব । আজ পাঠ প্রতিক্রিয়ার প্রথম পর্ব  -----


চন্দন রায়ের কবিতা সম্পর্কে তন্ময় রায় লিখছেন  'মশারির কোণা গুঁজে স্বপ্ন এবং দর্শনের / ভাসমান পাণ্ডুলিপির কাছে জিজ্ঞেস করো / ভোর হতে আর কত বাকি---' বোধের এমন প্রগাঢ় প্রত্যয়ে স্নিগ্ধ হয় কবিতা পাঠের আনন্দ।

উমা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা পড়ে স্মৃতি শেখর মিত্র লিখছেন দুটি কবিতাই খুব সুন্দর। সংবেদনশীল মনের গভীর আর্তি ছুঁয়ে যায় মনের আনাচে কানাচে ।

শতদল মিত্রের গল্প পড়ে প্রবীর মজুমদার লিখেছেন  ওহ!চমৎকার একটা গল্প ।

গৌরীশঙ্কর দে-এর কবিতা সম্পর্কে স্বপ্নদীপ রায় লিখেছেন  আপনার ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে কথনছন্দের লালিত‍্য!যে ছন্দে সহজেই সম্পৃক্ত হয় পাঠকমন। 

পঙ্কজ মান্নার কবিতা সম্পর্ক কল্পোত্তম ( উত্তম মাহাত ) জানাচ্ছেন  কবিতাগুলো পরিনত মনের চিহ্ন বহন করে। বেদনাকে আড়ালে রেখে তোয়াক্কা না করার একটা প্রবনতা ফুটে উঠেছে এই কবিতাগুলোতে।

অরিত্র চ্যাটার্জির কবিতা পড়ে  বনানী ভট্টাচার্য লিখেছেন  চিরন্তন সত্য। সহজ প্রকাশ। কবিতা ২।

জয়া মিত্র লিখেছেন নিমাই জানা-র কবিতা পড়ে  শব্দ চয়নের নতুনত্ব কবিতা তার স্বতন্ত্রতা সৃষ্টি করে চলেছে। 

প্রদীপ ঘোষ এর কবিতা সম্পর্কে  জবা ভট্টাচার্য  লিখছেন  সবগুলোই  খুব  সুন্দর।  ইমনকল্যাণ  অসাধারণ  লাগল। 

সুজয় যশ স্বপ্নদীপ রায়ের কবিতা পড়ে জানাচ্ছেন  আহা, ভীষণ সুন্দর করে লেখা প্রতিটি কবিতা । বড়ো যত্নে লালিত্যে বেড়ে উঠেছে এই ভাবনারা ।

শীলা দাশ কয়েকজন কবি ও লেখক সম্পর্কে নিবিড় পাঠ প্রতিক্রিয়ায় জানাচ্ছেন -----   

দেবাশিস সাহার ধারাবাহিক উপন্যাস 'ধুলোর‌ সিংহাসনের' এই পর্বে পুরী ভ্রমণের নিখুঁত বর্ণনা সাবলীল হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের সাথে প্রথম দেখার আবেদন অনেকটাই কাব্যিক। টান‌টান‌ লেখা তরতর করে এগিয়েছে। এভাবেই এগিয়ে চলুক। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকবো।

সম্রাট মুখোপাধ্যায়ের  রচনা 'একটি দুপুরের প্রচ্ছদ' আশ্চর্য সুন্দর।

কবি তৈমুর খানের গুচ্ছ কবিতা অতি সুন্দর।আর দীর্ঘ কবিতা 'মানব বাগান'কে আশ্চর্য কবিতা বা অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। কবিকে আন্তরিক অভিনন্দন।

দেবাংশু সরকারের ছোটো গল্প 'নীলা' দু:খী দোলাচল জীবনের মধ্যে শেষ পর্যন্ত আশাবাদের রঙএঁকে দেয়। চমক আছে।

আগামী পর্বে 


পাঠকের চোখে  স্বরবর্ণ * সাত * ১৪২৯ 









স্বরবর্ণ * সাত ' সম্পর্কে পাঠকের মতামতের দ্বিতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হল।  স্বরবর্ণ *৮- এ লেখা পাঠানোর মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৫ মে । স্বরবর্ণ * ৮ প্রকাশ পাবে ১৫ জুন ২০২২  । 


শতদল মিত্র সামগ্রিকভাবে স্বরবর্ণ *৭ -এর মূল্যায়ন করেছেন এভাবে ----

প্রথমেই ভরসা জাগায় সম্পাদকীয়, সে অক্ষরে যুদ্ধের নামে অন্ধসভ্যতার নির্লজ্জ অহঙ্কার থেকে উত্তরণের আলোসন্ধান। তারপরেই উল্লেখ করি আমার প্রিয় বিভাগ অনুবাদ কবিতার। রূপায়ন ঘোষের অনুবাদে বিনোদ কুমার শুল্ক-র কবিতাগুচ্ছ জীবনের প্রতি গভীর মায়া জাগায়। গল্প বিভাগে কিন্নর রায়ের গল্পে অতিমারিকালে লকডাউন, সে কারণে নির্মম নিঃসঙ্গতা কীভাবে মানুষের মনে মুনিয়ারঙা মৃত্যুচেতনা ছায়া ফেলে, তারই নির্মোহ ভাষ্য। দেবাংশু সরকারের গল্পটি মিথের অনুসঙ্গে ঘর আর ঘাটের অনবদ্য টানাপোড়েন। পার্থপ্রতিম গোস্বামীর অণুগল্পে মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়ার খেলায় প্রাকৃত ও মানব মাতৃসত্তা একীভূত। দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্পটি মানুষের আপাত চাপা পড়া শাশ্বত মানবিক যাপন ফুটিয়ে তোলে। আবার গৌতম ভট্টাচার্যের অনুগল্পে মানুষের নিজের মানসতলারই সন্ধান যেন। কবিতা বিভাগটি প্রতিবারের মতই যথাযথ। সুন্দর সম্পাদিত একটি পত্রিকা উপহার দেওয়ার জন্য সম্পাদককে অভিনন্দন জানাই।

বিকাশ চন্দ-এর কবিতা পড়ে  স্বপ্নদীপ রায় লিখছেন  গভীর জীবনবোধ প্রশান্তি আনে মনে ,যার সঙ্গে কবির অন্তরাত্মার অনাদিযোগ খুঁজে পাই 

অর্ণব মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে উদয় ভানু চক্রবর্তী লিখছেন  খুব সুন্দর দুটো লেখাই। 

সুজয় যশ স্বপ্নদীপ রায়ের কবিতা পড়ে জানাচ্ছেন   আহা, ভীষণ সুন্দর করে লেখা প্রতিটি কবিতা । বড়ো যত্নে লালিত্যে বেড়ে উঠেছে এই ভাবনারা ।

সুদীপ দাসের কবিতা পড়ে নাম জানাননি এমন একজন পাঠক  লিখছেন   ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটা চলুক সুদীপ। লিখে চলো।

সুজয় যশ সব্যসাচী মজুমদারের কবিতা পড়ে লিখছেন  কিছু লেখা থেকে যায় মনে । আপনার লেখা পড়লেই একটা আলাদা পাওনা ।

মানসী কবিরাজ-এর লেখা পড়ে নাম জানাননি এমন একজন  পাঠক লিখছেন  শেষ দুই চরণ গেঁথে গেল। লিখে চলুন। পড়তে থাকি।

ইন্দ্রজিৎ রানা পার্থপ্রতিম গোস্বামীর গল্প পড়ে জানাচ্ছেন   মা তো মাকে জানে / বিভিন্নরূপে আগমনে/ দুঃখসুখের পারে/ ছোট-বড় প্রতিটি ঘরে/ হাত ধরে বলে /হেথা নয় হেথা নয় /অন্য কোনোখানে।

সুদেষ্ণা ব্যানার্জীর কবিতা পড়ে সুজয় যশ লিখছেন  অপূর্ব দুটি কবিতা । ইচ্ছেরা পাখি হয়, গাছেদের জল দেয় ..... দারুণ এই কথাগুলো

স্বপন নাগ দেবাশিস সাহার ধারাবাহিক উপন্যাস 'ধুলোর সিংহাসন' পর্ব *৭ পড়ে লিখছেন ----অশোক, তার মধ্যবিত্ত ভাবনা-আবেগ বড় সুন্দর আঁকা হয়েছে এ পর্বে। সমুদ্রসমীপে একজন কবির আত্মসমর্পণ , অন্তর্গত ভাবনার অশান্ত ঢেউয়ে নিজেকে ভাঙা... বিস্তারিত বিবরণ চরিত্রচিত্রনের পক্ষে যথাযথ। একটি উপন্যাস, দুটি পর্বের মধ্যবর্তী সময়ের দীর্ঘতা যেকোনও পাঠকের কাছেই বেশ অস্বস্তিকর। বিশেষত আগের পর্বের সঙ্গে এখনকার পর্বটির যোগসূত্র ছিঁড়ে যাবার একটি সম্ভাবনা থেকেই যায়। তবু বলব, গদ্যটি এত সাবলীল ও ঝরঝরে যে, শেষ অব্দি পড়িয়ে নেবার জোর উপন্যাসকারের কলমে আছে।


বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

 




স্বরবর্ণ * সাত * ২০২২   সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ এপ্রিলের পর থেকে । 


**********************

স্বরবর্ণ * আট  * ২০২২  

দ্বিতীয় বর্ষ

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ জুন  ২০২ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ মে ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরো আগে থেকে লেখা পাঠানপরিকল্পনার সুবিধার জন্যলেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

 ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা  

স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই

 



স্বপন চক্রবর্তী বহু অবিস্মরণীয়  গ্রন্থের প্রণেতা |

 তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ ----


মিথ্যার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি * লৌকিক মাঘোৎসব * আত্মপ্রতিকৃতি * গীতবিতানের হাট 

যে কুসুম নিজের নাম না -জেনেই ফুটে আছে * স্মৃতি স্বপ্ন কান্না দরবারি *

হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্নের ডাক ইত্যাদি |




শুভঙ্কর দে  সম্পাদিত 

Health has a History Revisiting Bengal

বিজ্ঞানের ইতিহাস ভবিষ্যতের সন্ধান 

ভারতের সামাজিক ইতিহাস  









দীপংকর রায় 

কবিতার বই  *  

অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *   অপ্রচলিত 

আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 



         



কবিতা উপন্যাস

অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে *

গল্পগ্রন্থইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না    আত্মজৈবনিক  উপন্যাস কোথাকার অতিথি আমি  

 





আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ



মাধুরী দাশগুপ্ত

বাতাসে কার কান্না


 

শুভজিৎ গুপ্ত  

পাখিদের আহিরভৈরব 


দেবাশিস সাহা 

    কবিতার বই 

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী নির্বাণানন্দ



অধ্যাত্ম প্রসঙ্গ  

স্বামী নির্বাণানন্দ

(১)

বহু জন্মের সাধনার পুণ্য-ফলে এই মনুষ্যজন্ম। এই মনুষ্যজন্মের একমাত্র উদ্দেশ্য ভগবানলাভ। সকলের মধ্যে ভগবান বা আমাদের পূর্ণ-সত্তা রয়েছেন। স্বামীজী বলেছেন, -'Each soul is potentially divine. The goal is to manifest this Divinity within by controlling nature, external and internal. Do this either by work, or worship, or psychic control, or philosophy by one, or more, or all of these -and be free.' -জীবমাত্রই অন্তর্নিহিত স্বরূপের দিক থেকে ঈশ্বর। বহিঃপ্রকৃতি এবং অন্তঃপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এই অন্তর্নিহিত ঈশ্বরভাবকে ব্যক্ত বা প্রকাশ করাই জীবনের পরম লক্ষ্য। কর্ম অথবা উপাসনা অথবা মনঃসংযম অথবা জ্ঞান -এদের মধ্যে এক, একাধিক অথবা সবগুলির মাধ্যমে ঐ প্রকাশ ঘটাও এবং মুক্ত হও।

     ‎ স্বামীজী বলেছেন, যে যেভাবে পারবে, সেভাবেই ঈশ্বরকে বিকাশ করাকেই একমাত্র লক্ষ্য জ্ঞান করবে। 'যে যেভাবে পারবে' -কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকলের জন্য এক পদ্ধতি, এক পথ বলা হচ্ছে না। রুচি অনুসারে, শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য এবং প্রবণতা অনুসারে যার যে ভাবটি suit করে, যার যেটি উপযোগী, ঠাকুরের ভাষায় -'যার পেটে যা সয়', সেই ভাব বা পথ ধরে চলতে হবে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের শাস্ত্রকারগণ, আচার্যগণ শুধু মানুষের মনস্তত্ত্বকেই যে পূর্ণভাবে বুঝতেন তাই নয়, তাঁরা মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য গভীর গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্নও ছিলেন। ঋকবেদে বলা হয়েছে, -'একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি' -এক সত্যকে ঋষিরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বেদে যা কিছু পাই সেই সবই ঋষিদের অনুভব। পথ ও পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য এক। লক্ষ্য হল দেবত্বের বিকাশ। সেই লক্ষ্য থেকে যেন ভ্রষ্ট না হই। 'নট কহে, সুন নটী, তাল-ভঙ্গ না পাই।' যেভাবে খুশি নাচ, কিন্তু তাল যেন ঠিক থাকে -যেন বেতালে পা না পড়ে।


(২)

লীলা ধরে ধরে নিত্যে পৌঁছাতে হয়। সূর্যরশ্মি ধরে ধরে সূর্যে পৌঁছাতে হয়। নিত্য ও লীলার মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। নিত্য-লীলা অভেদ সম্বন্ধ। নিত্যে পৌঁছালে লীলা নিত্যে লয় হয়। স্থূল, - সূক্ষ্ম, - কারণ। কারণ মহাকারণে লয় হয়। লীলা মিথ্যা -একথা ঠাকুর বলছেন না। অনুভবের পর ঠাকুর লীলাকেও সত্য বলছেন। সুতরাং নিত্য আর লীলা দুটো জিনিস নয়। লীলা ও নিত্যের সম্বন্ধ হচ্ছে Relative Truth থেকে Absolute Truth. নিত্যে পৌঁছালে 'আমি'ই যে থাকছে না, ফলে কে বলবে?‌ কাকেই বা বলবে? কিন্তু লীলাতে যখন রয়েছি তখন তাকে স্বীকার করতে হবে। তুমি কলকাতার উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর থেকে রওনা হলে; পথে উত্তরপাড়া, বালী, হাওড়া পড়ল। তুমি তো লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে এগুলিকে অস্বীকার করতে পারনা। তবে নিত্য অনুভব করে লীলাতে নেমে আসলেও মন সাধারণ লোকের মত নিচে নামতে পারে না। ঠাকুর নিত্য থেকে লীলায় নামবার সময় বিভিন্ন স্তর বা sphere থেকে বলবার চেষ্টা করেছেন। যখন নিত্য থেকে লীলাতে একশো ধাপ নেমে আসছেন, তখন শুধু ওঁ, ওঁ বলছেন। মহারাজ বলতেন, -'ঠাকুর যখন সমাধির পর নামতেন তখন তিনি বিড়বিড় করে কত কথা বলতেন। সেগুলি কিছুই বোঝা যেত না। অনেক পরে তাঁর কথা স্পষ্ট হত।'

     ‎ একবার স্বামীজীর শিষ্য শুকুল মহারাজ (স্বামী আত্মানন্দ) মহারাজকে কতকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন। মহারাজকে তামাক সেজে দেওয়া হয়েছে, আমি যখন গিয়েছি, তখন অনেক কথা হয়ে গিয়েছে। কেবল মহারাজের কথাটি শুনতে পেলাম। মহারাজ বলছেন, -'দেখ শুকুল, দেখতে পাচ্ছি নিত্য আর লীলার মাঝে যেন একটা fine কাঁচের পর্দা দেওয়া আছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ওটা ভেঙে নিত্যে মিশে যাই। কিন্তু ঠাকুর দিচ্ছেন না।'

     ‎ নিত্য মানে অদ্বৈত। অদ্বৈতভূমি মানে চুড়ান্তভূমি।  ঐ ভূমিতে যাওয়া দুরূহ। তাই অদ্বৈতবাদের অধিকারী অতি অল্প। তাই বলে কি আমরা চেষ্টা করব না? জীবনে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বড় বড় কথা বা বক্তৃতাতে কাজ হবেনা। আচার্য শঙ্করের অদ্বৈতবাদ highly intellectual -তা বুঝবার বা অনুশীলন করবার মত লোক খুব কমই আছে। মহারাজ বলতেন, -'তোমাদের উদ্দেশ্য তোমার বড় বক্তা বা বড় philosopher হওয়া নয়। ব্রহ্মজ্ঞান এবং তারপরে কি হয় -এসব বড় বড় কথা না বললে অনেকের মনে ধরে না। জীবনে কি করতে হবে, সেদিকে লক্ষ্য নেই, শুধু বড় বড় কথা! অধিকাংশ মানুষ ভক্তিবাদী, নাহয় জ্ঞানমিশ্রা ভক্তিবাদী। অনেকের ধারণা, অদ্বৈত বাদ গ্রহণ করলে নিয়ম-বিধি কিছুই মানবার দরকার নেই। যথেচ্ছাচার করা যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অদৈতবাদীর আচরণ অনুকরণ করা খুবই কঠিন। সর্বত্র সে শুদ্ধ ব্রহ্মকে দেখবে। তাই ঠাকুর বলতেন, -'অদ্বৈতজ্ঞান তো শেষের কথা।'

    

(৩)

ঠাকুর তাঁর সন্তানদের মধ্যে এক স্বামীজীকে ছাড়া আর সবাইকে ভক্তিমার্গের উপদেশ দিয়েছিলেন। স্বামীজীকে অদ্বৈত শিক্ষা দিয়েছেন। কিছুটা অদ্বৈত শিক্ষা অবশ্য তুরীয়ানন্দ মহারাজ এবং অভেদানন্দ মহারাজকেও দিয়েছেন। তাঁর সন্তানরা প্রত্যেকেই এক-একজন কত বড় বড় আধার, তবুও অদ্বৈত-শিক্ষা তিনি সকলকে দিলেন না। আর স্বামীজীকে শুধুই যে অদ্বৈত শিক্ষা দিয়েছিলেন তাও নয়, লীলাও মানিয়েছেন।

     ‎ মহারাজ বলতেন, -'গুরুবাক্য ধরে সাধন করে গেলে ক্রমে মন যত শুদ্ধ হবে তত বুঝতে পারবে, কি করা উচিৎ। কারও মনে আঘাত দিতে পারবে না। দিলেও অনুতাপ করবে। ঠাকুর হাজরাকে বকেছেন; রাত্রে কষ্ট হচ্ছে, তখনই গিয়ে হাজরার সঙ্গে কথা কয়ে এলেন।' আমরা তো গুরুকে সবসময় সাক্ষাতে পাব না। মন শুদ্ধ হলে, সেই মন থেকেই গুরুর নির্দেশ পাব। সেই শুদ্ধ মনই গুরুর কাজ করবে, আর ঠাকুরই হলেন গুরু। মন হচ্ছে দর্পণ। হৃদয়ে জ্যোতিস্বরূপ, চৈতন্যস্বরূপ হয়ে বসে আছেন ঠাকুর। দর্পণ স্বচ্ছ হলে তাঁর আকার পরিস্কার দেখা যাবে, নির্দেশও পাওয়া যাবে। মন যত অস্বচ্ছ হবে ঠাকুরও তত অস্পষ্ট হয়ে যাবেন।

     ‎ মনের ওপর আহারাদির একটা ভূমিকা আছে। তবে আহারাদি সম্বন্ধে কড়াকড়ির কোন নির্দেশ নেই ঠাকুরের। শুধু লক্ষ্য ঠিক রেখে চলতে হবে। ঠাকুর বলতেন, -'শূকরের মংস খেয়ে যদি ভগবানে মন থাকে তবে সে ধন্য, আর যদি হবিষ্যান্ন খেয়ে সংসারে মন যায় তবে তাকে ধিক্।' এর অর্থ আহারে যথেচ্ছাচার নয়। কথাটির তাৎপর্য -ভগবানকে পাওয়া একমাত্র উদ্দেশ্য -এই দিকে লক্ষ্য রাখা। আমরা দেখি, ঠাকুর স্পর্শদোষ হলে খাবার গ্রহণ করতে পারতেন না। কোন অসৎ ব্যক্তি স্পর্শ করলে অসহ্য যন্ত্রণা হত। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, -আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ  সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ। আহার সম্পর্কে আহার্য বিষয়ের জাতিদোষ, আশ্রয়দোষ, নিমিত্তদোষের কথা রামানুজ বলেছেন। কিন্তু আচার্য শঙ্কর 'আহ্রিয়তে' অর্থে ইন্দ্রিয় দিয়ে বিষয় গ্রহণকেই 'আহার' বলেছেন, স্থূল আহারকে নয়। আমরা ঠাকুরের জীবনে দেখেছি, তাঁর মধ্যে দুটোরই প্রকাশ। দুটো মিলিয়েই সম্পূর্ণ তাৎপর্যটি পাওয়া যায়। আমরা দুটোকেই গ্রহণ করব।

     ‎ 

(৪)

একবার রাঁচিতে আমাকে জনৈকা মহিলা ভক্ত বলছে, -'মহারাজ! ঠাকুর তো সংসারে দাসীর মতো থাকতে বলেছেন। তাই আমি দাসীর মতো সংসারে থাকি।' আমি বললাম, -'দাসীর মতো মানে তুমি কি বুঝেছ? দাসীর মতো মানে কি irresponsible‌ হয়ে থাকা? কথাটির অর্থ হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে কর্তব্যকর্ম ঠিক ঠিক করা। এটা বহু অভ্যাস করে করতে হয়। সহজে হয় না। ভোগবাসনা থাকলে কি করে এটা হবে? এটা ত্যাগের কথা।'

     ‎ রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ খুব বড় পন্ডিত ছিলেন, আমাদের সুধীর মহারাজের (স্বামী শুদ্ধানন্দ) সহপাঠী। পরে মঠের সাধু হয়েছিলেন। নাম হয়েছিল স্বামী চিদঘনানন্দ। আমি ওঁর সঙ্গে একদিন গাড়ি করে মঠে এসেছি। পথে হাওড়া থেকে মঠ পর্যন্ত ক্রমাগত বলে যেতে লাগলেন, -'সমস্ত বেদ পড়ে দেখলাম, কোথাও অদ্বৈতবাদ ছাড়া দ্বৈতবাদের কথা নেই-.. ইত্যাদি।' মঠে ফিরে এসে সুধীর মহারাজকে বললাম, -'মহারাজ আপনার বন্ধু তো এই কথা বলেন!' সুধীর মহারাজ শুনে বললেন, -'আর ওদের কথা! পন্ডিতরা একটা ছাঁচে-গড়া বুলি মুখস্থ করে তাই আওড়াচ্ছে। নিজস্ব অনুভব কিছুই নেই।' শুধু বইয়ের কথাগুলো আওড়ালে হবে না। অনুভূতির দিকে যেতে হবে।

     ‎ গঙ্গার ওপরে শিকল বাঁধা আছে, শিকলের আরেকটি প্রান্ত মাঝ-গঙ্গায় পরশপাথরে বাঁধা আছে। সেই পাথরের কাছে যেতে হবে। উপায় হচ্ছে ওপরে যে শিকলটি আছে সেটি ধরে ধরে সেই পাথরের কাছে যাওয়া। ছাড়লে চলবে না। লীলা ধরে ধরে নিত্যে পৌছে যাও। শরীর ত্যাগের পূর্বে মহারাজ নিত্য ও লীলা দুই-ই সত্য বলে গেছেন। হরি মহারাজকেও (স্বামী তুরীয়ানন্দ) তাই বলতে শুনেছি। তিনি বলতেন, -

     ‎ 'বহুত গঈ থোড়ী রহী থোড়ী অভী হ্যায়।

     ‎ নট কহে সুনো নটী তাল ভঙ্গ ন পাই।।'

     ‎ মোদ্দা কথা হল - লক্ষ্য ঠিক রাখতে হবে। মনুষ্য জন্ম মানেই অনেক দূর এসেছি। কিন্তু 'থোড়ী' এখনও কিছুটা আছে। সাধন পথে লেগে থাকতে হবে, যেন 'তাল ভঙ্গ ন পাঈ' -লক্ষ্য ভ্রষ্ট না হই।

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

  



এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ / ৭     সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেনসুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 



শুধু কবিতার জন্য  


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার

জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা

ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য

শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু

কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত

অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;

শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।

মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু

কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।


*************************************

পাঠ প্রতিক্রিয়া

 



দুই কবি দুই দর্শন 

তন্ময় রায় 


সংহতির কবি কাব্যের সংহতি


কবিতা আসলে কিছু বলে না অথবা বলে এত কিছু, ধরে রাখা যায়না মানসপটে। একের পর এক দৃশ্য বদলায়, কোনও এক অদৃশ্যকে এনে যেন! এই দৃশ্য- অদৃশ্যের চলাচলটুকুর সওয়ার হয়ে থাকে ছন্দ, অলংকার,উপমা, চিত্রকল্প বা আর যাকিছু তার আবরণ কিংবা আবরণহীন সুচারু কাব্যকলা।


সম্প্রতি কবি শর্বরী চৌধুরীর 'মখমলের ইস্তেহার' এবং দেবার্ঘ সেন-এর ' স্পর্শ নামক জেলখানা' কবিতার বই দুটি পাঠ-অন্তে সর্বাগ্রে এই কথাগুলিই মনে এল।


 পরিমিত বাক, সংহত আবেগ, শব্দ ব্যবহারের দক্ষ কারিকুরিতে 'মখমলের ইস্তেহার' ছাব্বিশটি কবিতার এক অনবদ্য সংকলন।  সামগ্রিকভাবে বিষয় হিসাবে কবিতাগুলোতে জীবনের অনুচ্চারিত ব্যথা, বিষণ্নতা জয় -পরাজয় ও একাকিত্বের বোধ অন্তর্লীন প্রবাহের মতো যেমন আছে, তেমনই আছে তা থেকে উত্তরণের নিবিড় আততি। একটু বিশ্লেষণে যাই ----


' হাঁড়িমাপা চাল ফোটে উনোনে/ যেন উথলে পড়ে  রতিসুখ ' জীবন ও জঠরের যুগ-যুগান্তর ব্যাপী সম্পর্কের অনশ্বরতা ফুটে ওঠে এইভাবে 'আগুন' কবিতায়।' শৈশবে পোতাগাছ বেদনাবিধুর হয়ে আছে ' বেদনা বিধুর শৈশবে পোতাগাছটি কত যে ডালপালা মেলে আত্মা চারিয়ে ছায়া দেয়,যা ' জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ওম হয়ে ওঠে ' হার বা পরাজয় কত আলোক দিশারী, কবি আমাদের অনুভব করান।  কোনও কোনও হার মানুষকে অসম্ভব জিতিয়ে দেয় 'তাই,কেউ কেউ হেরে যেতে ভালোবাসে আজীবন।' কারণ তার যে বুক ভরে 'আছে প্রেম,আছে কিছু অবাক বিকেল/ যখন রাত্রি নামে নিগূঢ  প্রত্যয়ে  /আছে সেই রাত্রিযাপন।'


'মখমলের ইস্তেহার' পড়তে পড়তে মনে হল, কবির আর-এক সাধনা সংহতির সাধনা। কীসের সংহতি? না, ভাব-ভাষা,ছন্দের সংহতি, সেইসঙ্গে পরিমিতি বা ভঙ্গিরও বটে। 'কূটাভাস ' এমনই এক সংহত শক্তির পরিচয় কবিতা। সন্ন্যাসীর মৌনতা যেমন ছুঁতে চায় ধ্যানের গভীর, কবিও তেমনই ছুঁতে চান 'স্বভাব সন্ন্যাসীর উত্তরণে ভরা প্রার্থনাগৃহ ' প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন, কবির অতলান্ত বোধের স্পর্শে 'প্রার্থনাগৃহ'টি আর নিছক উপাসনালয় হয়েই রইল না, শব্দ সাধনায় নিমগ্ন কবির তন্ময় ধ্যানমগ্ন মুহূর্তটিকে আলোকিত করল যেন... স্থিতপ্রজ্ঞ শব্দ সাধককে নিয়ে যাবে অপার আনন্দলোকে 'ভরে যাবে হৃদপিন্ডের অলিন্দ -নিলয়।'


 কবিতা পাঠের এমনই অমল আনন্দে স্নাত হবেন পাঠক সংলাপ, হার, ক্ষত, উত্তরণ,ঈশ্বর,জলস্রোত, প্রক্ষালন, সম্মোহন,একলব্য.. এইসব কবিতা পাঠে। বিভিন্ন কবিতায় হীরের দ্যুতির মতো ঔজ্জ্বল্য ঠিকরেছে, এমন কিছু পংক্তি তুলে দিলাম ----


১) আমার প্রেমিকের ঠোঁট বিকেলের রোদের মতো/ ম্লান।

২) ছেঁড়া ফ্রকে হাসছে সূর্য।

৩) প্রকৃত শোকের কাছে মাথা নত করি।

৪ ) সমস্ত কষ্টেরা নদী হয়ে যায়।

৫ ) জীবন, তুমি আর কত স্তব্ধতা শেখাবে!


বইটির একটি ভারী দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী দেবাশিস সাহা। প্রকাশক পাঠক। ৩৬ কলেজ রো কলকাতা - ৭০০০০৯। মূল্য - ৬০ টাকা।




স্পর্শ নামক জেলখানা: স্বতন্ত্র নির্মাণালেখ্য 


তেরোটি কবিতার কবিতাশরীর নিয়ে নির্মাণ শেষ হয়েছে ক্ষীণতনু 'স্পর্শ নামক জেলখানা' কাব্য পুস্তিকাটি। কবি দেবার্ঘ সেন। প্রচ্ছদশিল্পী-- নবনীতা সরকার। প্রকাশক-- গীর্বান ।


সূচনাবাক্যের ' নির্মাণ  শেষ হয়েছে' শব্দবন্ধটি লিখলাম বটে, এবং দৃশ্যত তা সত্যও বটে, কিন্তু কবিতাপাঠের পর মন যেন বলতে চাইছে, শেষ হয়নি অন্য নির্মাণ চলছে মনের আনাচে- কানাচে, এপাশে-ওপাশে, আকাশে-বাতাসে সর্বত্র।


একটু ব্যাখ্যায় আসি, ' স্পর্শ নামক জেলখানা'-র কপাট খুলি ---' আমি সেসব গোলাপি মাছেদের/ জেলবন্দি করতে / স্পর্শ নামক জেলখানা খুলেছি।' কোন সব? যারা '... প্রতিবেশী আলোরা / জল ঘুঙুরের শব্দ শুনতে এসে / এফোঁড়-ওফোঁড় করেছে মন কিনার 'এখানে আমরা অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ করি, কবির কারুকৃতি অতিচেতনার কোন স্তর স্পর্শের প্রয়াসী। 


                                                       এবং সে প্রয়াস থেমে থাকে না, যখন কবি বলেন ' স্পর্শ জেলে ভালোবাসার দালালদের/ আমি ঘৃণা করি ' তখন আমরা বুঝতে পারি, স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের দাসত্বেই বন্দী থাকতে চান না তিনি। তিনি আসলে মুক্তি খোঁজেন ' স্পর্শ নামক জেলখানা'র গারদ ভেঙে। সেই ভাঙারই অনুরণন যেন রণিত হতে শুনতে পাই সতেরোটি কবিতার অবয়ব জুড়ে। এবং এই ভাঙচুর শেষে উপলব্ধি করি , এক স্বতন্ত্র  কাব্যভাষা নির্মাণে কবি দেবার্ঘ সেন কতটা আন্তরিক  । 


স্পর্শ নামক জেলখানা: মূল্য - ৩০ টাকা 

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা



ধুলোর সিংহাসন

পর্ব -- সাত

দেবাশিস সাহা 


[ পূর্বানুষঙ্গ : এক ছুটির দিনে বইপত্র গোছাতে গিয়ে অশোকের চোখে পড়ে বহু পুরোনো একটি ডায়েরি। 'তোর জন্মকথা' শিরোনামে পঁচিশ বছর আগের রোজনামচা। নিজেরই হাতে লেখা।বর্তমান থেকে মুহূর্তে মন ছুটে যায় ,ফেলে আসা পঁচিশ বছর আগের অতীত দিনগুলিতে। ইতিমধ্যে ফোন আসে বড় শ্যালিকার। উপমার পরীক্ষা শেষ হলে, তারা একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। সম্মতি জানায় অশোক-অলি। তারপর....]  



ভোরের রোদ্দুর মাখা সকালটা তিনতলার জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। নতুন জায়গা। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। উঠতেও ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ওই আকাশ,ওই ইতিউতি ভেসে বেড়ানো মেঘ, ওই ভোরের স্নিগ্ধ রোদ্দুরের দিকে চোখ পড়তেই উঠে পড়ল অশোক। বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসে সকালের আলোয় মাখামাখি পুরী শহরটাকে দেখছিল। সত্যি, কী ভীষণ ভালো লাগছে! কত কতদিন পর এমন মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে। ওর শরীরের প্রতিটি কলাকোশ, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন মুক্তির আনন্দে দুহাত তুলে নাচতে  চাইছে। ঘুম থেকে উঠেই আজ আর কাউকে মুখস্ত করাতে হচ্ছে না ( a + b )3 = a3 + 3a2b + 3ab2 +b3 কাউকে বোঝাতে হচ্ছে না ' আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া ফুল, / নামুক মহুয়ার গন্ধ।' সমর সেনের 'মহুয়ার দেশ ' কবিতার এই লাইনগুলোর মানে কী। কেউ এসে বিরক্ত করছে না ' স্যার, আমাকে শেক্সপিয়ারের ওথেলোর ক্যারেক্টারটা লিখে দিন। না হলে --- '

     ' না হলে কী? '

     ' রত্না আন্টি আজ চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাবে  বলেছে।'


      মাথাটা যদিও সামান্য ঝিমঝিম করছে। 'শতাব্দী এক্সপ্রেসে' ঘন্টা আষ্টেকের জার্নির হ্যাং-টা এখনও কাটেনি পুরোপুরি। মাথার ভেতর এখনও যেন মাঝে মাঝেই ছুটছে চলন্ত ট্রেনের চাকা,প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার শেষ হুইসল আর  মাঝেই  মাঝে এসি কামরার জানলার কাঁচ দিয়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে অল্প অল্প সবুজ,ছুটন্ত গাছপালা ,নদী ,ঘরবাড়ি। দেখা যাচ্ছে আদিগন্ত সবুজ ধানক্ষেত,জলাশয়ে সারি সারি বকের ডানামেলা কিংবা বহুদূর বিস্তৃত কাশফুলের মাথা দোলানো। কলকাতায় এমন নিভৃতি কোথায়! খালি ধুলো ধোঁয়া আর দূষণ। যে দিকে তাকাও পিঁপড়ের সারির মতো ওলা, উবের ,ট্যাক্সি, সার সার ট্রাম,বাস মিনি আর মেট্রোর সদম্ভ বিজয় ঘোষণা। নির্জনতা মুখ লুকোতে লুকোতে নিরুদ্দেশ, এ শহর থেকে কোথায় কত দূরে কে জানে!


      আর এখানে,এই পুরী শহরে, কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা নির্জনতা যেন নতুনরূপে সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে ওদের হোটেল ' তিমি লজ ' থেকে অল্প দূরে। সমুদ্র ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষায় ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে সব ক্লান্তি, দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার অবসাদ।

     ' কী ভাবছ অত? এই নাও ---' তাকিয়ে দেখে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে প্রদীপটা এসে হাজির।

     ' চা খেয়ে যাও বাজার করে আনো,তোমরা যা  খাবে,মাছ মাংস যা খুশি কিনে আনো, আমার রান্না করে দিতে কোন আপত্তি নেই।'এক নিঃশ্বাসে বলল প্রদীপদা। সত্যিই প্রদীপদার জবাব নেই। নিজে বড় ক্যাটারিং-এর মালিক। পাঁচ-সাতশো লোককে রান্নাবান্না করে খাওয়ানো ওর কাছে কোনও ব্যাপারই না। সেখানে ওরা তো দলে মাত্র সাত জন। এ সংখ্যাটা ওর কাছে নেহাতই নস্য। সেই তুলনায় অশোক নেহাতই শিশু। অনেক ঘাম ঝরিয়ে হয়তো দু 'মুঠো আলুসিদ্ধ ভাত ফুটিয়ে দিতে পারে। কাজেই প্রদীপদার কথা শোনা ছাড়া কোন উপায় নেই। প্রদীপটা নিজেই বলেছে হেঁসেলের দায়িত্ব আমার। তোমরা ঘোরো ফেরো খাও দাও। মস্তি করো। আমার কাছে পুরী জলভাত। প্রায় ফি বছর আমি পুরী আসি,টুরিস্টদের সঙ্গে। 

         এমন প্রস্তাব কেউ প্রত্যাখ্যান করে? অনেক ভেবে  দেখেছে অলি -অশোক,নিজেরা রান্না করে খেলে পাঁচদিনের পুরী ভ্রমণের খরচ অনেক কম পড়বে। হোটেলে খাওয়া নয় তো, টাকার শ্রাদ্ধ। তার চেয়ে হাঁড়ি কড়াই ভাড়া করে ,নিজেরাই পছন্দমত রান্নাবান্না করে খাও। আর প্রদীপদা যখন সঙ্গে আছে,এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে!


      পিছনে তাকিয়ে দেখে অশোক একে একে সবাই এসে হাজির। রিনাদি ,অলি,নিলু, উপমা, গোগোল আর কাশীদা। কাশীদা প্রদীপদার বন্ধু। ফিজিওথেরাপিস্ট। চলতে-ফিরতে শরীরকে চাঙ্গা রাখতে ফিজিওথেরাপি কতটা জরুরি সবাইকে বুঝিয়ে চলেছেন ,হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠা অবধি।এমনকী  কাল রাতেও ট্রেনে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে যে অবসাদ এসেছে সবার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, তা কী ভাবে কাটাতে হবে, নিজে অনুশীলন করে হাত পায়ের ব্যায়াম দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অশোক কাশীদার কথা শুনবে কী, ওর চেহারা আর কথা বলার বিশেষ ধরণ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। কাশীদার নাম শুনলেও,অশোক আগে কখনও দেখেনি। এই প্রথম দেখছে। আর প্রথম দেখাতেই মুখস্ত করে নিচ্ছে কাশীদার সর্বাঙ্গ। বেশ নাদুস-নুদুস গোলগাল চেহারা কাশীদার। মাথায় সমুদ্রের মতো বিশাল টাক। কপালের কাছ থেকে শুরু করে মাথার প্রায় শেষ পর্যন্ত গড়ের মাঠ। তবে পিছনে অর্ধচন্দ্রাকৃতি কিছুটা চুলের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে,তিনি একেবারেই কেশবিহীন টেকো নন। তবু সমুদ্রের উপমাটা কেন এল, অশোক বুঝতে পারছে না। হয়তো পুরি এসেছে বলেই। দু'হাত দূরেই তো সমুদ্র।


   ' চা খাওয়া হয়েছে তো সবার? 'হাঁক  পাড়ল প্রদীপদা। প্রদীপদা বেশ রসিক,আমুদে মানুষ। মাঝে মাঝে এমন অঙ্গভঙ্গি করে,আর প্রয়োজনমতো দু'অক্ষর চার অক্ষর ছেড়ে দেয় ,উপস্থিত সবাই হেসে লুটোপুটি খায়। আর পেটে একটু লাল জল পড়লে তো কথাই নেই। কাছে উপমা আছে কি গোগোল দেখাদেখি নেই।সমানে হরিনাম জপ করতে থাকে। গালাগাল দিয়ে অদৃশ্য শত্রু'র চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে।

   ' হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে '

   ' শোনো অশোক, তাহলে তুমি রিনা আর অলিকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে যাও। আমি ততক্ষণ টিফিনের বন্দোবস্ত করি। টিফিন সেরে সবাই মিলে সমুদ্রস্নানে যাব।'

   ' যে আজ্ঞে,হুজুর।' বড় ভায়রার কথায় সম্মতি জানায় অশোক।


      পুরী বাজারে ঢুকে অশোকের চোখ ছানাবড়া। কোথায় সুভাষ পার্ক নতুন বাজার আর কোথায় পুরী বাজার! সাত সমুদ্র তের নদী না হোক, বহু দূরের কোনও এক অচেনা বাজারে এসে পড়েছে যেন। কেউ এখানে চেনে না তাকে। এত ভিড় দোকানপাট লোকজন। অথচ সুভাষ পার্ক নতুন বাজারের মতো দেখামাত্রই কোনও মাছ ব্যাপারী চিৎকার করে উঠছে না,' অশোকদা আসুন, আসুন, একেবারে টাটকা ফ্রেস ডায়মন্ডের ইলিশ। ওদিক থেকে গুপি হাঁক পাড়ছে না, ' অশোকদা এদিকে এদিকে,একেবারে জ্যান্ত টেংরা চালানের না,পুকুরের,কম দামে ছেড়ে দিচ্ছি।' পাশ থেকে কোনও ছাত্রের বাবা বলে উঠছে না, ' কি অশোকবাবু,বাজার হল?' ভাবতে কেমন যেন রোমাঞ্চ লাগছে অশোকের।

    এদিক ওদিক ঘুরে দেখল, জিনিসপত্রের সব আগুন দর। কলকাতার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। টুরিস্ট স্পট বলে কথা! যত পারো ট্যুরিস্টদের ঘাড় মটকাও। শুধু মাছের দামটা একটু যা সস্তা মনে হল। প্রমাণ সাইজের ভেটকি আড়াইশো টাকা কেজি। পার্শে দুশো টাকা। কলকাতায় এত সস্তা এই মাছ পাওয়া যাবে না। হয়তো সমুদ্র সামনে বলেই। মাংসের দামটাও তুলনামূলকভাবে একটু কম।

   ' কী গো,কী মাছ নেবে,রিনাদি?'

   ' ভেটকিই নাও,তাহলে তোমার প্রদীপদাকে বলব দু'চার পিস ফিস ফ্রাই করে দিতে।' আহা! দারুণ হবে । তবে রিনাদি, ভেটকির সাথে কিছু পার্শেও নিস।'

    ' হাঁ, তা তো নেবই, দু'রকম মাছ না হলে জমবে কী করে? '

    ' মাংস নেবে না?' অশোক, রিনাদি অলি দু'জনের দিকে তাকায়।

    'একদিনে কত খাবে? মাংস আজ থাক,কাল বরং দেখা যাবে।'


      বাজার থেকে ফিরে ওরা দেখল প্রদীপদা টিফিন তৈরি করে রেডি। প্লেটে প্লেটে সাজাচ্ছে কাশীদা। মোবাইল ঘাটতে ব্যস্ত গোগোল, উপমা।

    ' কী টিফিন করলে প্রদীপদা?'

     ' লুচি আলুর চচ্চড়ি।' সাতজন একত্রিত হয়ে টিফিনপর্ব সেরে নিল চট করে।


     'এই নিলু,গোগল,উপমা, তোরা সব রেডি হয়ে নে। এবার আমরা সমুদ্রস্নানে যাব। ' হাঁক পাড়ল প্রদীপদা।

'এক্ষুনি? '

    'হ্যাঁ,হ্যাঁ আমার তো আবার এসে লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে নাকি।'

   ' ঠিক আছে, মা,রিনামাসি তোমরা তৈরি হয়ে নাও। আমি,নিলুদাদা, গোগোলদাদা তৈরি হয়েই আছি।' উৎসাহ উপচে পড়ছে উপমার গলায়।


     সমুদ্র? পুরীর সমুদ্র? আজ সত্যি সত্যিই স্বচক্ষে দেখা হবে,অশোক যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এত কাল বন্ধুদের মুখে,পাড়া-প্রতিবেশী যারা  পুরী গেছে, তাদের মুখে শুধু শুনেই এসেছে, পুরীর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের কথা। এই প্রথম সমুদ্র দেখার আনন্দ ও উত্তেজনায় ওর সমস্ত মন প্রাণ থরথর করে কাঁপছে। মনে পড়ছে,কোন ছোট বেলায় স্কুলের ইংরাজি essay ' travelling as a part of education ' মুখস্ত করতে গিয়ে পড়েছিল 'the roaring sea of puri is calling me.' কেউ  পুরীর গল্প করলেই,এই লাইনটা মনে ভেসে উঠত অশোকের। আর আজ সেই সমুদ্র কত সামনে! আর মাত্র দু'পা। ওই ওই তো শোনা যাচ্ছে ঢেউয়ের শো শো শব্দ। প্রখর রোদ মাথার উপর। এলোমেলো সামুদ্রিক হাওয়া। হাওয়ার দাপট এতটাই বেশি মনে হচ্ছে যেন সামনে এগোতে দেবে না। কিন্তু আজ আর কোনও বাধা মানবে না অশোক। এই ঢেউয়ের কাছে পৌঁছতে সময় লেগে গেল পঞ্চাশ বছর। আর একটা মুহূর্ত নষ্ট করা যাবে না।


     হই হই করতে করতে এগোচ্ছে প্রদীপদা ,কাশীদা  পিছনে অলি, রিনাদি। তার পিছনে নিলু,গোগোল,  উপমা। উৎসাহে ডগমগ। চোখে সানগ্লাস,হাতে মোবাইল। সেলফি তুলে চলেছে অনর্গল।দু'চার পা পিছিয়ে পড়েছে অশোক।ইচ্ছে করেই।পুরো দলের সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা করতে এই মুহূর্তে একদম ভালো লাগছে না ওর। আর কোনও  বাধা নেই।সামনে থেকে মুহূর্তে সরে গেল যেন ঘন কুয়াশার আবরণ। ওই ওই তো সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি আর সেই অনন্ত অফুরন্ত ঢেউ -এর মধ্য থেকে ফেনময় দীর্ঘ সাদা ঢেউ একের পর এক প্রচন্ড আশ্লেষে গড়িয়ে এসে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। পাড়ে? না,অশোকের বুকে,বুঝতে পারছে না অশোক। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর চুপটি করে বসে পড়ে একটা বড় পাথরের উপর। নির্নিমেষ দু'চোখ। ওর সমস্ত বোধ,সমস্ত চেতনা চৈতন্য কেমন যেন স্তিমিত হয়ে আসছে। ওর সমস্ত সত্তায় নীরবে নিঃশব্দে ওই সমুদ্র এখন মাথা পেতে শুতে চাইছে। ওর ছোট্ট বুকে ওই বিরাট বিশালকে আশ্রয় দিয়ে,কেমন যেন ধীরে ধীরে নিরাশ্রয় হয়ে পড়ছে অশোক। মনে হচ্ছে,ওর ঘর নেই, বাড়ি নেই, অতীত নেই,ভবিষ্যৎ নেই। জন্ম জন্মান্তর ও যেন এই ঢেউ সামনে রেখে তাকিয়ে আছে, তোমারই দিকে, হে সুন্দর, হে বিরাট বিশাল! তোমার সেই বিরাট বিশালত্বের পরিমাপ করতেই কি পালতোলা 'এরিয়েল 'নৌকো ভাসাতেন  ইংরেজ কবি শেলি? তারপর একদিন কূলকিনারা পরিমাপ করতে না পেরে আত্মসমর্পণ করলেন প্রিয় বন্ধু এডোয়ার্ড উইলিয়ামস আর এক কিশোর নাবিককে নিয়ে? ' সমুদ্রের হাওয়া আমার ফুসফুস পুড়িয়ে দিক ' লিখেছিলেন বছর কুড়ির ৱ্যাবো? ' মুক্ত মানুষ তুমি সমুদ্রের জন্য তৃষিত / সমুদ্র তোমার আয়না...' মানুষ ও  সমুদ্র ' কবিতায়  লিখেছিলেন বোদল্যের? এই নীলাচলেই নীল সমুদ্রকে কৃষ্ণ ভ্রমেই কি অপার প্রেমের সৌন্দর্যে লীন হয়েছিলেন, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু?

 

      মেসো,ও মেসো? 'কে মেসো! কার মেসো! গোগোল ডেকেই চলেছে। অশোকের কানে ঢুকছে না কোনও ডাক। বাকহারা। অপলক। এইবার কাছে এসে ঘাড়ে একটা হাত রেখে গোগোল বলল, ' তুমি তো এখানে বসে আছ, এগুলো ধরো। মা বা অলিমাসি কেউ এলে, তুমি জলে নামবে।'

    কিছুটা সংবিৎ ফিরল যেন। অশোক দেখল,ওর কোলের উপর জমে উঠেছে টিমের সবার সানগ্লাস, মোবাইল ,গামছা ,তোয়ালে, সিগারেটের প্যাকেট। পায়ের কাছে স্তূপীকৃত জমেছে সবার চটি জুতো।


     গোগোল যেতেই আবার ডুব চিন্তার সমুদ্রে।আমি কি যাব, না আমার বুকের ভেতর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়া সমুদ্রের গায়ে-মাথায় কপালে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে বলব, কতকাল অপেক্ষা করে আছি, ঘুমোও  লক্ষীটি ঘুমোও,আমি তোমাকে বিরক্ত করব না। ভাবছে অশোক। পাশে ফেরিওয়ালা হাঁকছে, ' চাই চিড়ে ভাজা ,বাদাম ভাজা গরম গরম।' দু'হাত ভরে পুতির মালা, একটা ছেলে খদ্দের খুঁজছে। চা-ওয়ালা লোকটা হাঁক  পাড়ছে, ' চাই গরম চা। পাশে কত লোকজন। কত কোলাহল। হই চই। ওই তো একটু দূরে স্নানরত অজস্র মানুষের বিস্ময় পুলকিত অভিব্যক্তি। কিন্তু অশোক শুনতে পাচ্ছে না এসব কিছু। বুকের ভেতর শুয়ে পড়া সমুদ্রকে যেন বলছে, ' আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে ওই ভাবে আছড়ে পড়ো অনন্তকাল।'


   ' পাপাই, রিনামাসির স্নান হয়ে গেছে, উপরে যাচ্ছে, রিনামাসির কাছে সবকিছু রেখে,এবার তুমি স্নান করবে, চলে আসো।' চিৎকার করে বলছে উপমা। অশোক লক্ষ করে, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উথালপাতাল স্নানপর্ব সারছে প্রদীপদা ,কাশীদা ,অলি , নিলু,উপমা, গোগোল।  আর সবাই ইশারায় অঙ্গভঙ্গি করে ডাকছে ওকে । একসময় রিনাদি উঠে এসে বলল, ' অশোক, এইবার তুমি চাও স্নান করে আসো, আমি  ততক্ষণ পাহারা দিচ্ছি।'


     এক পা দু'পা করে এগোয় অশোক। রোদ উঠেছে প্রচন্ড। কিন্তু গায়ে লাগছে না ততটা। তেতে উঠেছে বালি। পা দিতেই ছ্যাত করে উঠছে। বেলাভূমিতে আর একটু এগোতেই একটা ঢেউ এসে আলতো করে পা ছুঁয়ে গেল। অশোকের খুব ইচ্ছে করছিল,ঢেউটাকে ধরে রাখতে। ইচ্ছে করছিল বলতে, 'তুমি কেন আমার পা ছোঁবে, তুমি অনন্তের চকিতবার্তা, সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে আবহমান ঢেউয়ে ঢেউয়ে চুম্বন করে যাচ্ছ এই মৃত্তিকা। আমি সামান্য মানুষ, তোমার পায়ে, আমিই জনম জনম আছড়ে পড়ব। আমার ক্ষুদ্রত্ব তুমি ভেঙে চুরমার করে দাও,তোমার বিরাট বিশালত্বে।'


    আর একটু নামতেই মনে হল অশোকের, এই ঢেউটাই যেন একটু আগে, যখন ও পাথরের উপর বসেছিল, চুপ করে শুয়ে ছিল ওর বুকের ভেতর। এখন অশোক নামতেই জেগে উঠেছে সে-ও।


    কার্যত, এই অশোক আর একটু আগের অশোক যেন আলাদা। এ যেন সেই কলকাতা থেকে আসা ছাপোষা অশোক বোস, তপোবন কোচিং-এর সেই অশোক স্যর নয়, যার মাথার উপর ব্যাংকের তের লাখ টাকার লোনের বোঝা, যে সমুদ্র দেখতে এসেছে পাঁচ হাজার টাকা ২%  ইন্টারেস্টে ধার করে, যাকে কেউ ভালবাসে, কেউ উপেক্ষা করে,আবার কেউবা ঘৃণা করে। সে সব ভুলে এই মুহূর্তে সে তার দিকে ছুটে আসা ঢেউগুলোকে আলিঙ্গন করতে চাইছে, বলতে চাইছে, ' আবার কবে আসব জানি না, এই এসেছি ,আমাকে গ্রহণ করো।'



      ভেটকি আর পার্শে মাছ দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা জম্পেশ হল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলছে ইয়ার্কি ফাজলামো। এ ওর ফিশ ফ্রাই চুরি। এই আইটেমটা যাচাই নয়,একটা করেই পড়েছে সবার পাতে। খেতেও হয়েছে দারুণ টেস্টি। সত্যি,প্রদীপদার রান্নার জবাব নেই। ' মাছের মাথা দিয়ে ডালটা একঘর হয়েছে মেসো।' উপমা সার্টিফিকেট দিচ্ছে প্রদীপ মেসোকে।' বাবা আর এক পিস ভেটকি দাও না।' গোগোলের আবদার। 'নে না, কত খাবি 'প্রদীপদা দু'পিস তুলে দেয় ছেলের পাতে। 'তোমার আছে তো?' কাশীদা আতঙ্কিত হয়। ' তুমি খাও তো টেকো, আমি তো পরিবেশন করছি।' প্রদীপদার চটজলদি জবাব। কাশীদাও কম যায় না, ' গোগোল রাহুর  মতো গিলিস না,একটুবাদেই ঘুরতে যাব, বমি করে মরবি।' আসলে গোগোলের পিছনে না লাগলে,কাশীদার পেটের ভাত হজম হয়না। ' কী রে অলি, তুই খেয়েছিস তো ঠিকঠাক?' রিনাদি জানতে চায়। ' কেন,ঠিক ঠাক খাব না কেন, পদুদার রান্না আমার হেব্বি  লাগে। ' সবাই খিলখিল করে হেসে ওঠে, অলির মুখে প্রদীপদার নামের অপভ্রংশ 'পদু ' শুনে। প্রদীপদাও চুপ থাকার মানুষ না,সাথে সাথে উত্তর, ' হা ঘরের মতো আর গিলিস না, গ্যাট হয়ে বসেছে দ্যাখো, যেন এবার পাতাটাও চিবিয়ে খাবে। কেনরে,আমার ভায়রা কি তোকে খেতে দেয় না?' খেতে খেতে চলছে এই রকম হাসি ঠাট্টা তামাশা। আর চলছে নিলু ,গোগোল ,উপমার দেদার ছবি তোলা আর সাথে সাথে ফেসবুকে পোস্ট করা।

       'নাও অনেক হয়েছে,এবার যে যার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। বিকেলে সাইটসিন দেখতে যাব।' নির্দেশ প্রদীপদার।


      বিকেল গড়াতে না গড়াতেই দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ল ওরা। আপাতত হাঁটছে পুরীর বাজারের ভেতর দিয়ে। দুটো ব্যান্ড এড কিনতে হবে। হাঁটাহাঁটিতে উপমা-রিনাদির পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। এ-গলি,    সে-গলি করে এগোচ্ছে ওরা। একটু পিছিয়ে পড়েছে অশোক। চারদিক দেখে নিচ্ছে ভালো করে। চোখে পড়ছে অজস্র দোকানপাট মানুষজন। একটা জিনিস নজরে আসছে অশোকের,পথে-ঘাটে দোকানে বাজারে যত মানুষ দেখা যাচ্ছে,মনে হচ্ছে,তারা  বেশিরভাগই কলকাতা থেকে এসেছে। উড়িষ্যাবাসী খুব কম। সত্যি কলকাত্তাইয়া বাঙালির রাজত্ব কোথায় নেই! হোটেলের ঘরে টিভিতে দেখছিল, লন্ডন প্যারিস নিউইয়র্ক দাপিয়ে বাঙালির দুর্গাপুজো কেমন আন্তর্জাতিক চেহারা পাচ্ছে। আর পুরী তো কলকাতা থেকে মাত্রই আট ন'ঘন্টার ট্রেনযাত্রা। অতএব সমুদ্র তোমার নিস্তার নেই,তোমার বুকে আমরা লাফাব। ঝাপাব। কলকাতার দূষণ খানিকটা পরিত্যাগ করব। তুমি সব মুখ বুজে সহ্য করো। আর পুজোর সময় বলেই হয়তো  বাঙালির ভিড়টা একটু বেশি। পুজোর ছুটিতে অনেকেই দার্জিলিং, সিমলা নিদেন দিঘা কিংবা পুরী বেরিয়ে পড়ে। যেমন এবার বেরিয়ে পড়েছে চিরকালের গৃহবন্দি অশোকও। পুজোর ছুটিতে এমনিতেই দিন দশেক কোচিং ছুটি দেয়। এবারও দিয়েছে। কামাইয়ের ব্যাপার নেই। ওরা বেরিয়েছে নবমীর দিন আর ফিরবে লক্ষ্মী পূজার আগে, কোচিং খুলবে লক্ষ্মীপূজার পর দিন। অতএব গার্জিয়ানদেরও মুখ ভার করার প্রশ্ন নেই।


    ' তুমি অত পিছিয়ে পড় কেন?' প্রদীপদার গলা। ' নাও দু'টান মারো ' জ্বলন্ত সিগারেটটা ধরিয়ে দেয় অশোকের হাতে। সিগারেটটা সবে একটা টান দিয়েছে কি দেয়নি, কাশীদা বলে উঠল, '  ওই দ্যাখো  স্বর্গদ্বার। ' স্বর্গদ্বার ' কথাটা শুনে চমকে ওঠে অশোক। ' পুরীতে এসে সশরীরে স্বর্গদ্বারে এসে পড়লাম, কী সৌভাগ্য, এবার তাহলে স্বর্গে ঢুকে পড়লেই হল। ' না না, এটা সেই স্বর্গদ্বার নয় ' কাশীদা ভুল ভাঙাল ' আসলে এটা পুরী শ্মশান, মানুষের অন্তিম ঠাঁই। ' মানুষের অন্তিম ঠাঁই ' ফিজিওথেরাপিস্ট কাশীদার মুখে এমন দার্শনিক উচ্চারণ শুনে অবাক হয়  অশোক। ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কাঠের চিতা জ্বলছে দু'তিনটে। ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। একটা চিতার কাছাকাছি অশোক লক্ষ করল,বছর আষ্টেকের  একটি ছেলে। অঝোরে কাঁদছে। আর চোখ মুছছে।  আর মাঝে মাঝে কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার দিকে তাকাচ্ছে।কী খুঁজছে ছেলেটি? ওই ধোঁয়ার মধ্যে? প্রিয়জন কারও মুখ? ছেলেটাকে ভাল করে লক্ষ করে কী জানি কেন অশোকের মনে ' অভাগীর স্বর্গে'র কাঙালীর মুখটা ভেসে উঠল।


    স্বর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে,অলি ছুটে এসে অশোকের জামা টেনে ধরে, ' শ্মশানের সামনে এতক্ষণ দাঁড়াতে হবে না। চলো আমরা সমুদ্রতীরে যাই।' শ্মশান আর সমুদ্র এই দুই ' শ '-এর ভয়ানক আকর্ষণে অশোক তখন ভীষণ টালমাটাল। উপমা হাত ধরে টানে, ' চলো আমরা সমুদ্রতীরে যাই '।কাশীদাও বলল, ' হ্যাঁ, তাই চলো,সন্ধের সময় সমুদ্রতীরে বিশাল মেলা বসে। কাশীদাও যে প্রদীপদার মতোই এর আগে বহুবার পুরী চষে বেড়িয়েছে,তা ওর কথাবার্তা থেকেই পরিষ্কার।


    এখন মেলার পথে পা বাড়িয়েছে সবাই। স্বর্গদ্বার পেরোতেই অশোকের চোখে পড়ল, একটা দেয়ালে বড় বড় করে লেখা ' হরিদাস ঠাকুরের সমাধি মন্দির ' হরিদাস ঠাকুর! শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ! অবাক হয় অশোক। নিমেষে ওর মনটা ডুব দিতে চাইল পাঁচশো  বছর আগেকার ইতিহাসে। হরিদাস ঠাকুর জাতিতে ছিলেন মুসলিম। কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা। খোল করতাল বাজিয়ে ফুলিয়ায় নবদ্বীপে হরিনাম সংকীর্তন করে ফিরতেন। সহ্য হল না কাজির। তিনি সুলতানি শাসকদের কাছে অভিযোগ জানালেন। তলব করা হল হরিদাসকে। জানতে চাওয়া হল,যবন হয়েও কেন তিনি হিন্দু ধর্মাচরণ করে বেড়ান। মনে পড়ল অশোকের, বৃন্দাবন দাসের ' শ্রী চৈতন্য ভাগবত ' বইতে পড়েছে, সেই সময় হরিদাস ঠাকুর তাদের বলেছিলেন-----

       শুন,বাপ, সবারই একই ঈশ্বর

       নাম-মাত্র ভেদ করে হিন্দুয়ে যবনে।

       পরমার্থে এক কহে কোরাণে পুরাণে।।

       এক শুদ্ধ  নিত্যবস্তু অখণ্ড অব্যয়।

       পরিপূর্ণ হইয়া বইসে সবার হৃদয়।।

       কিন্তু ওই যে কথায় বলে ' চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি ' শাসকদল বুঝল না,এই কথার মর্মার্থ। শাস্তির বিধান দিল তারা। আদেশ হল বাইশ বাজারে জল্লাদরা নিষ্ঠুরভাবে বেত্রাঘাত করতে করতে প্রাণ কেড়ে নেবেন হরিদাস ঠাকুরের এবং সেটাই হবে বিধর্মীর উপযুক্ত শাস্তি। সেই আদেশ মত জল্লাদরা বাইশ বাজারে হরিদাস ঠাকুরকে  নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করতে লাগল। কিন্তু কী আশ্চর্য! হরিদাস ঠাকুরের  শরীরে বিন্দুমাত্র বিকার দেখা গেল না। যেন ভক্ত প্রহ্লাদ। প্রাণ নেওয়া তো দূরের কথা, জল্লাদরা আতঙ্কিত হল, হরিদাসের প্রাণ নিতে না পারলে, তাদের যে প্রাণ সংহার করবেন কাজি। শুনে হরিদাস ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। এই সময় তাঁর শরীরে বিশ্বম্ভরের অধিষ্ঠান হল। শত চেষ্টাতেও জল্লাদরা হরিদাস ঠাকুরকে নড়াতে  পারল না। হরিদাস ঠাকুরের পাপ যাতে আরও বৃদ্ধি পায়, তাই কাজি তাকে কবর না দিয়ে, গঙ্গায় নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দিলেন। গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হল হরিদাসকে। কিন্তু তিনি ডুবলেন না। ভেসে রইলেন। যখন বাহ্য দশা  ফিরে পেলেন, সাঁতরে পাড়ে উঠে আবারও  হরিনাম সংকীর্তন শুরু করলেন। সেই হরিদাস ঠাকুরের সমাধি! রোমাঞ্চিত হয় অশোক।


 ' দেরি কোরো না, চলো চলো, এগোও। ' ঠেলতে থাকে প্রদীপদা।'একবার মন্দিরে ঢুকি,চলো দেখে আসি।'  

' মন্দির এখন বন্ধ ' পাশ থেকে কাশীদা জানায় ' কালকে না হয়, যাওয়া যাবে।'


    অগত্যা ভিড় ঠেলে এগোতে থাকে। কিছুটা সামনে রিনাদি, নিলু ,অলি ,গোগোল, উপমা।এত ভিড়! ওদের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। হঠাৎ চোখে পড়ল ' কাকাতুয়া' নামে একটা মিষ্টির দোকান।  উপমার বন্ধু শ্রাবণী নাকি বলেছিল,এখান থেকে পুরীর গজা কিনতে। ট্রেনে আসবার সময় উপমা বলেছিল। অবাক হয় অশোক,দোকানের সামনে একটা খাঁচায় সত্যি সত্যিই একটা জ্যান্ত  কাকাতোয়া রাখা। দোকানটার নাম এক বর্ণও  ভুল নয়।

     দেখতে দেখতে এসে গেল সমুদ্রতীরের মেলা। দুপুরে যখন স্নান করতে এসেছিল সবাই, তখন এতটা ভিড় ছিল না।এখন পুরো বিচ একেবারে লোকে লোকারণ্য। অলি নিলু ,উপমা ও গোগোলকে নিয়ে গেল ঘুরে ঘুরে মেলা দেখতে। কাশীদা ,প্রদীপদা ও অশোক একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে বসল একেবারে সমুদ্র সামনে রেখে। ঢেউয়ের দু-একটা ছোবল এসে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। বেশ লাগছে। চিড়ে ভাজা ,পাপড়িচাট , চানাচুর খেতে খেতে গল্প করছে ওরা। অশোক এক-আধ বার মুখে দিচ্ছে আর দু'চোখ ভরে দেখছে রাতের সমুদ্র। ঢেউগুলো এখন আরও  উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যেন। এখন কি জোয়ার, না ভাটা? তবে এটা শুক্লপক্ষ। আকাশ নির্মেঘ। চাঁদ উঠেছে। প্রায় গোলাকার। সারা বেলাভূমি জ্যোৎস্নায় থই থই। পরশু লক্ষ্মীপুজো। পূর্ণিমা অমাবস্যায় সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে। অশোকরা পুরী আসবে শুনে, ওর কবি বন্ধু তপন বলেছিল ' যাও,পূর্ণিমায় সমুদ্র দুর্দান্ত লাগবে।' নিলু ঘোরাঘুরি ও কেনাকাটি করতে ব্যস্ত, রিনাদি -উপমার পায়ে ব্যথা। প্রদীপদা, কাশীদা গদ্যভাবাপন্ন। সৌন্দর্য পিপাসা কম। কাল রাতে কেউ না আসুক, হোটেল থেকে চুপিসারে একা এসে, সারারাত সমুদ্র দেখে কাটাব, ভাবছে  অশোক।



       'অশোক! অশোক!' এখানে, এই অচেনা সমুদ্রতীরে কে ওর নাম ধরে ডাকছে। পিছন ফিরে তাকায় অশোক। দেখে এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সঙ্গে বছর কুড়ি বাইশের একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। উঠে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দেন অশোকের দিকে, ' কী রে,চিনতে পারছিস?'

      অশোকের স্মৃতি কাজ করছে না দেখে ভদ্রলোক নিজেই পরিচয় দেন, ' আমি বিজন।'    

     'বিজন ভট্টাচার্য?' অশোকের সহজাত রসবোধ জেগে ওঠে।

     'আরে না, নবান্ন-র বিজন ভট্টাচার্য নয়। তিনি কি আজ বেঁচে আছেন ? 

    ' তা-ও ঠিক। তবে?'

     'আমি বিজন পুরকায়স্থ।'

     'ও মনে পড়েছে,মনে পড়েছে,অ্যান্ড্রুজ কলেজ?'

      'ঠিক তাই।'


       আলিঙ্গনাবদ্ধ হয় অশোক-বিজন। উথলে উঠে স্মৃতি। মনে পড়ে যায়,কলেজের প্রথম পরিচয়ের দিনটা। আজকের মতোই সেদিনও একই রকমভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ও বলেছিল, 'আই এম বিজন পুরকায়স্থ। '

      'পুরো কায়স্থ? একটুও বাদ না' শুনেই অশোক ওভার বাউন্ডারি হাঁকাতে চেয়েছিল। বিজনও  কম যায় না। অশোক যখন প্রত্যুত্তরে বলেছিল 'আই এম অশোক বোস। ' বিজনও পাল্টা সুইপ শট দিয়েছিল, ' সুভাষ বোসের রিলেটিভ নয় তো?'


     প্রথম আলাপের পরেই,ওরা নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিয়েছিল পরস্পরের। অশোকের যেটা সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল,সেটা হল,বিজনও ওরই মতো কবিতা অন্তপ্রাণ। ওরও প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। প্রিয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। প্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। তারপর আর গলায় গলায় বন্ধু হতে বেশি দেরি হয়নি। একসঙ্গে কফি হাউস, রেস্টুরেন্ট, একপ্লেট চাওমিন বা বিরিয়ানি ভাগাভাগি করে খাওয়া, সিনেমা, থিয়েটার দেখা ...সবেতেই দুই হরিহর আত্মা । সঙ্গে জুটেছিল ওর বান্ধবী পায়েল শেঠ। কবেকার কথা সে সব! তারপর বিজন সরকারি চাকরি পেয়ে শিলিগুড়ি ট্রান্সফার হল। জীবিকার নিষ্পেষণে ক্ষীণ হয়ে এল যোগাযোগ। বছর পাঁচেক আগে অবশ্য একবার হঠাতই কলেজ স্ট্রিটে দেখা হয়ে গেছিল দু'জনের। কী কাজে এসেছিল যেন বিজন। অশোক গিয়েছিল উপমার বই কিনতে।

    বিজনই পরিচয় করিয়ে দিল, 'এই অন্বেষা, আমার একমাত্র কন্যারত্ন।'

   ' তুমি কী করো মা?'

   ' আমি ----'

     মেয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিজন বলে, 'ও  ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর,এই মাস ছয়েক হল টাটা টেলকোতে জয়েন করেছে।' অশোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অন্বেষা।

    'তোর মেয়ে?'

    'এইতো এবার বিএ ফাইনাল দিল,আপাতত কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য শিয়ালদার মৌলালিতে একটা কোচিং ক্লাসে ভর্তি করিয়েছি।'

    'তা বেশ বেশ,মেয়ে কই?'

   'মেলায় কেনাকাটা করছে বোধহয় মায়ের সঙ্গে ।'

   'আর তোর সেই পায়েল শেঠ?'

   পাশের ভদ্রমহিলাকে ইঙ্গিত করে বিজন বলে, 'ইনিই  তিনি।'

   তিনজনেই হেসে ওঠে। অন্বেষা মুখ লুকোয়। নমস্কার বিনিময় করে অশোক বলে ,'কেমন আছেন ?'

  ' ভাল' উত্তরটা দিয়েই ,পায়েলের কৌতূহলী প্রশ্ন , 'এখন কাব্যচর্চা হয়?' 

  'চর্চা তো হয় কিছুর একটা,তবে কাব্যটা বাদ দিয়ে।'

  'কী রকম?'

   'বলা যাবে পারে,আছেন তো ক'দিন?'

   'সে নয় পরে শোনা যাবে ,কিন্তু অশোক, বন্ধুকে 'তুই' আর বন্ধুর স্ত্রীকে 'আপনি' সম্মোধন ---এটা কীরকম হল, এত শ্রেণিবৈষম্য কেন ?'

   হো হো করে হেসে ওঠে অশোক,হাসির দমক থামলে পায়েলের সরাসরি অনুযোগ , 'আগে তো তুই তোকারির কী সহজ সম্পর্ক ছিল আমাদের,দীর্ঘ অসাক্ষাতের প্রমোশন একেবারে আপনিতে পৌঁছে দিল?' । 


   হঠাতই বুকের রক্ত চলকে ওঠে অশোকের। এক সময় বিজন -পায়েল -অশোক ত্রিকোণ  প্রেমের দ্বন্দ্বও জমে উঠেছিল বেশ। তখনও অলি আসেনি অশোকের জীবনে। পায়েল আর কবিতার নেশায় বুঁদ। রক্তের মধ্যে ঠেলে ঠেলে উঠে কবিতার লাইন ------

' জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার

হৃদয়ে আমার চড়া

চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি

কোথায় ঘোড়সওয়ার।'

কিন্তু ঘোড়সওয়ার নয়, হৃদয়ের চড়ায় পায়েলকে নিয়ে স্বপ্নে -জাগরণে উধাও হচ্ছে অশোক। অবশ্য সে প্রেম জীবনের চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি । বড় বিজনেসম্যানের একমাত্র আদুরে মেয়ে পায়েল অলির মতো ভুলটা করল না। বিজন চাকরি পেতেই,অনায়াসে ত্রিকোণ ভেঙে দ্বিবাহুলগ্না হল বিজনের।


'বাবাই পয়সা দাও ' হঠাৎ কোত্থেকে দৌড়ে এসে উপমা আবদার করল, ' হাওয়াই মিঠাই খাব।' 

'একটু দাঁড়া মা ' তারপর বিজন -পায়েলকে  লক্ষ করে বলল, 'এই আমার ---'

'কন্যারত্ন ' শেষ করল বিজন -পায়েলই। উপমা ওদের প্রণাম করল।

'থাক বাবা থাক,গড ব্লেস...'

অশোক পয়সা দিতেই  উপমা দৌড় লাগাল। 'ভারী মিষ্টি মেয়েটা তোমার!'পায়েল বলল।

'তোরা কোন হোটেলে আছিস?'

' তিমি লজ।'

'আমরা আছি সিগালে। আয় না,কাল সকালে, জমিয়ে আড্ডা হবে।'

'কাল আমাদের প্রোগ্রাম ফিক্সডরে,কাল আমরা পুরীর মন্দিরে পুজো দেব, তারপর কোনারক ধবলগিরি  উদয়গিরি খণ্ডগিরি...এই সব দেখব। 

'তোরা কবে ফিরছিস?'

'পরশু।'

'কোন ট্রেন?'

'গরিবরথ।'

'তোরা? একই ট্রেন?'

'না,ভুবনেশ্বর থেকে ফ্লাইট।'


'ঠিক আছে দেখছি ,পরশু সকালে দেখা করা যায় কিনা।' 

'যায় কিনা টিনা নয়,মেয়েকে দেখলাম, গিন্নিকে তো দেখা হল না,আসতেই হবে কিন্তু।' পায়েল জোর খাটায়।

'আচ্ছা ফোন করব যাওয়ার আগে।'

'ওকে,আমরা কিন্তু আশায় থাকব।'


      বিকেলটা ফুরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সন্ধেটাও  যায় যায়। কিন্তু অশোকের মন থেকে পায়েলের মুখটা কিছুতেই মুছে যাচ্ছে না। এই সেই পায়েল! সুডৌল স্তন, ঠোঁটের ওপরে একটা ছোট্ট তিল দ্বিগুণ বাড়িয়েছে যেন ওর যৌন আবেদন। আভিজাত্যের ছোঁয়া চলায় বলায়। শারীরিক বিদ্যুৎছটায় যে কোনও  যুবক মুহূর্তে কুপোকাত। একদিন ওর রূপের বিভায় ক্লিন বোল্ড হয়েছিল অশোকও। আর আজ যাকে দেখল, সে কোন পায়েল! তোবড়ানো গাল।হাই পাওয়ার চশমা।  পাতলা চুল।একটু যেন টেনে টেনে হাঁটছে।বাতে ধরেছে নিশ্চয়ই ওরই মতো।


'বাবাই একটু টেস্ট করো '

'কী রে,হাওয়াই মিঠাই? না ,আমি খাব না।'

'একটু খাও না,কিচ্ছু হবে না।'

   মেয়ের জোরাজুরিতে একটুখানি মুখে দেয় অশোক। চিবিয়েই ফেলে দেয়।খুব মিষ্টি। মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল। আর ঠিক এই সময়, কোথা থেকে একটা উৎকট গন্ধ ভেসে এল, কীসের গন্ধ বুঝে উঠতে পারছে না কেউ। হঠাৎ দেখা গেল, ওদের সামনে দিয়ে চলেছে ' মরুভূমির জাহাজ 'উট। উটের গায়ে এত গন্ধ থাকে! এর মধ্যে উপমা এসে বায়না ধরল, 'বাবাই উটে  চড়ব ' অশোক না করল না,বলল, ' ঠিক আছে কাল চড়িস, আজ রাত হয়ে গেছে।'


 ' হ্যাঁ,এবার চলো সবাই,উঠে পড়ে রিনাদি ,কাশীদা প্রদীপদা। খুব দ্রুতই সন্ধেটা ফুরিয়ে গেল। রাত প্রায় দশটা। সাধারণত এরকম সময় কোচিংয়ে থাকে। আর আজ কোথায়! প্রথাগত রুটিন ছেড়ে বেরিয়ে কী যে ভাল লাগছে!পুরীর প্রাসাদোপম হোটেল,রেস্টুরেন্ট ,মানুষজন, পর্যটকদের চোখেমুখে বাঁধভাঙা খুশির উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে যখন লজে পৌঁছল,তখন রাত্তির দশটা গড়িয়েছে।


( আগামী পর্বে )


উপন্যাস * দীপংকর রায়



'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৪  

দীপংকর রায় 


বইটিকে মাথার কাছে রেখে দিলাম সারা রাত। রোজকার কাজগুলি করে সকাল সকাল স্নান-টান সেরে নিয়ে মনের মধ্যে বেশ একটা শুদ্ধ-শান্তি ভাব নিয়ে এসে  বসে পড়লাম হালকা লালচে-মেরুন রঙের কাপড়ের মলাট মোড়া সেই শরৎচন্দ্রের প্রথম খণ্ডটি সামনে নিয়ে। তাছাড়া সেই তো প্রথম আমার উপন্যাস বস্তুটি যে কি জিনিস, তা চেনা! যদিও প্রথম পাতাটি পড়েই কেন জানি না কিছুক্ষণ মনমরা হয়ে থমকে থাকলাম। ভাবছি শুধু, লেখক এ কি কথা বললেন ! কিই বা বলতে আরম্ভ করলেন তিনি; শুরু করলেন যেভাবে, ---- " আমার এই ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে,....."


         ‌    আমি ভাবছি, ' অপরাহ্ন কেন? '

             তার পরের প্যারায় বলছেন,  ....." ছেলেবেলা হইতে এমনি করিয়াই তো বুড়া হইলাম । আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের মুখে শুধু একটানা ' ছি ছি ' শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত 'ছি--ছি--ছি- ' ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি নাই। কিন্তু কি করিয়া যে জীবনের প্রভাতেই এই সুদীর্ঘ 'ছি - ছি -র ভূমিকা চিহ্নিত হইয়া গিয়েছিল বহু-কালান্ত-রে আজ সেইসব স্মৃতি-বিস্মৃতি কাহিনীর মালা গাথিতে বসিয়া যেন হঠাৎ সন্দেহ  হইতেছে , এই ছি ছি টা যত বড় করিয়া সবাই দেখাইয়াছে, হয়তো ঠিক তত বড়ই ছিল না। মনে   হইতেছে , হয়তো ভগবান যাহাকে তাহার বিচিত্র সৃষ্টির ঠিক মাঝখানটিতে টান দেন, তাহাকে ভালো ছেলে হইয়া একজামিন পাশ করিবার সুবিধাও দেন না, গাড়ি-পালকি চড়িয়া বহু লোকলস্কর সমভিব্যহারে ভ্রমণ করিয়া তাহাকে 'কাহিনী ' নাম দিয়া ছাপাইবার  অভিরুচিও দেন না। বুদ্ধি হয়তো তাহাকে কিছু দেন, কিন্তু বিষয়ী লোকেরা তাহাকে সুবুদ্ধি বলে না। তাই প্রবৃত্তি তাহাদের এমনই অসঙ্গত, খাপছাড়া --- এবং দেখিবার বস্তু ও তৃষ্ণাটা স্বভাবতই এতই বেয়াড়া হইয়া ওঠে যে, তাহার বর্ণনা করিতে গেলে  সুধী ব্যক্তিরা বোধ করি হাসিয়াই খুন হইবেন। তারপরে সেই মন্দ ছেলেটি যে কেমন করিয়া অন্দরে অবহেলায় মন্দের আকর্ষনে মন্দ হইয়া, ধাক্কা খাইয়া, ঠোক্কর খাইয়া অজ্ঞাতসারে অবশেষে একদিন অপযশের ঝুলি কাঁধে ফেলিয়া কোথায় সরিয়া পড়ে ----- সুদীর্ঘ দিন আর তাহার কোনো উদ্দেশই পাওয়া যায় না।"


              এই অংশটুকু পড়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকলো। উল্টেপাল্টে যেতে থাকলো কেন জানি না। কত কথা মনে পড়তে লাগলো ! শরৎচন্দ্রের এই ছি-ছি কার, ধিক্কার মাথার ভেতরে উলটো চিৎ হয়ে ডিগবাজি খেতে লাগলো। তিনি লিখছেন, "বুদ্ধি হয়তো তাহাকে কিছু দেন, কিন্তু বিষয়ী লোকেরা তাহাকে সুবুদ্ধি বলে না।"


                থমকে যাই। বারবার থেমে  গিয়ে সেই সত্য অসত্যের ভিড়ে শরৎচন্দ্র আমাকে নিয়ে যে একটি দিনই নয় অনেকগুলি দিন কেমন উথাল পাতাল করিয়ে ছাড়লেন। যদিও তার নমুনা হয়তো ঠিক ঠিক পেশ করেও পেশ করা সবটা সম্ভব নয় জানি। 

                ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের পরের চলার পর্ব সেও আর এক দিগন্তের সীমারেখা মুছে দিয়ে আমাকেও তাদের সহযাত্রী করে ছাড়লো। আমিও ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের সঙ্গে সঙ্গে সেই খাড়া কাঁকরের পাড় বেয়ে নদীর ভেতরে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। " তারপর সেই সুতীব্র জলধারার মুখে একখানি ছোট্ট মোচার খোলা যেন নিরন্তর কেবলই আছাড় খাইয়া মরিতেছে। ...... ক্ষুদ্র তরী তীব্র একটা পাক খাইয়া নক্ষত্র বেগে ভাসিয়া চলিয়া গেল।.... "


              এইসব বর্ণনার সঙ্গে আমিও আমার ছেলেবেলার সেই নবগঙ্গার এক একটি দিনরাত্রির বিচিত্র সব মুহুর্তের মধ্যে  প্রবেশ করতে থাকলাম। কত কথাই না মনে পড়তে লাগলো! শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথ আমাকে সেই সব দিনের কাছে নিয়ে গিয়ে নানা ঝড়-ঝঞ্জা স্রোতের তোড়ের ভেতর ছুটিয়ে কত অন্ধকার-জোছনা রাত্তির যে ডিঙিয়ে ছাড়লো তা বলার নয়। আমি যত ভাবি ভাববো না থাক, ততোই ইন্দ্রনাথ আমাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে চলে। আমি তাদের দুজনের মাঝখানে বসে যেন কথা বলাবলি করি। নদীতে পাড় ভাঙার শব্দ শুনি। যেমন ভাবে শুনতাম  যখন নবগঙ্গার বালির দুইপাড় ভাঙতো ঝপঝপ করে। 

               আমি তখন মামাদের সঙ্গে হ্যাঁজাক ঝুলিয়ে কোঁচ নিয়ে মাছ ধরতে বেরোতাম। মনে হতো কারা যেন ভীষণ জোরের সঙ্গে কিছু দিয়ে ঠেলে ভেঙে দিচ্ছে নদীর পাড়। প'রে মামা ঝপাত্ করে কোঁচে মস্ত বড় এক বেলে মাছ কুপিয়ে গেঁথে ফেলতো। কখনো বেশ বড়সড় একটা মৃগেল মাছ। 

                সেই সব কিছু মুহূর্ত  মিলেমিশে এমনই এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দিতে থাকলো যে আমি আর নিজেকে আলাদা করতে পারছি না কিছুতেই।

               দু'দিন বুঁদ হয়ে পড়ে থাকলাম। খাওয়া-দাওয়া-স্নান সব প্রায় অনিয়ম। কাজের দিদি তাড়া দিতে থাকলো। বকাবকি করতে থাকলো এই অবস্থা দেখে। অলোক এসে আমার ফুলের বাগান পরিচর্যার খবরাখবর নিয়ে জানতে পারলো, ওসবে এখন আমার তেমন একটা মন নেই। 

                সে যতটুকু পারলো গাছগাছালির গোড়ায় খুড়পি দিয়ে নাড়াচাড়া করলো। জলও দিল একটু আধটু । সার টারও দেবার কথা বলে গেল হাঁক পেড়ে। 


                মলি দু'দিন এদিকে ঘেঁষেনি।  ও বাড়ির ঠাকুমা ও কাজের দিদির সঙ্গে লুডুর খোট বসিয়েছে ঘর থুয়ে বারান্দায় । গরুর পরিচর্যা আজ দু'দিন আমি একটুও করিনি। কাজের দিদিই সামলেছে। সারাদিনই  একরকম উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছি শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথ নিয়ে। নানা জায়গায় পেনসিল মার্ক করে রাখছি কেন জানিনে। আণ্ডারলাইনও করে রাখছি। দু'বার তিনবার করে পড়ছি এক একটি প্যারা। অর্থ করতে গিয়ে সেইসব জায়গার ছবিগুলি একেবারে যেন ফুটে উঠছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যেন। মনে মনে সেইসব জায়গার কথা ভেবে বারবার মনে করছি, সেই যে রাতের বেলায় প'রে মামা আইশোদাদের সঙ্গে নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে ধোবার চরের পাশ দিয়ে যখন যেতাম, তখন যেতে যেতে ধোবার চরের উপর থেকে কারা যেন মানুষের কান্নার মতো আওয়াজ করতো। কারা যেন চিৎকার করতো, শুনতে পেতাম। কখনো আবার নৌকার পেছনে হুস হুস করে শব্দ করে ছুটে আসতো কিছু যেন। দূরে ঝপাত্ ঝপাত্ করে মাছের ঘাপলা মারার আওয়াজ আসতো। জলের উপর বাঁশের চটার বাড়ি মারলে যেমন শব্দ হয়, সেরকম শব্দ হতো চড়াত্ চড়াত্ করে। প'রে মামাকে বলতাম, বা আইশোদাকে, ওসব কি হচ্ছে গো! কিসির আওয়াজ আসতিছে তাই কও না, উপরির থে?.... এসব যে মানুষির কান্নার আওয়াজ আসতিছে যে গো! কী হচ্ছে কি তাই কও তো দেহি!..... আরে, আমি শুনতিছি, তোমরা কিছুই শুনতি পারতিছ না নাকি? 

                 ওরা উভয়েই রে রে করে একসাথে চেঁচিয়ে উঠে বলতো, তোমারে কইছিলাম না ভাগ্নে, ওসব দিকে মন দিবা না একদম, কানেই নিতি যাবা না, যা হচ্ছে হয়ে যাকগে এক দিক দিয়ে, তাকাবা না ! দেখতিছ না, আমরা কি খেয়াল দিচ্ছি , তাই কও তো একবার দিকি ? ওসব একদম দ্যাখপা না। কত শুনেছি ওসব! চুপচাপ থায়ো  একদম। কোনো ভয় নেই, আমরা আছি না, ভয় কি সেইডা কও তো ?

                 তাও বলতাম, একটু চাইয়ে দ্যাখপো না !

                 আইশো দা বলতো, না, চাইয়েও দ্যাখপানা ! ওরে মনে করিছ না মরিছ ------ কই, আমরা ডরাচ্ছি ওরে? 


                বেশ খানিকটা জড়সড় হয়ে মনে মনে ভাবতাম, না ভয় পাবো না। ভয় পালি এরা তো আর পরের দিন আমারে সঙ্গে আনবেনানে! ওরা যদি না নিয়ে আসে, তাহলে আমি কী করে আরো ভালো করে জানতে পাবো এইসব , এমন রাত্তিরের মাধুর্যই বা খুঁজে পাবো কোনখানে !


                  ঠিক অমনি একটা অবস্থা দেখলাম শ্রীকান্তরও হলো।....." উপরে মাথার উপর আবার আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলা আর সুমুখে সেই বালির পাড়। এটা কোন জায়গা, তাই ভাবিতেছি, দেখি ইন্দ্র ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, শ্রীকান্ত, তোকে একটা কথা বলতে ফিরে এলুম। যদি কেউ মাছ চাইতে আসে, খবরদার দিস নে --- খবরদার, বলে দিচ্ছি। ঠিক আমার মত হয়ে যদি কেউ আসে, তবু দিবি নে --- বলবি, মুখে তোর ছাই দেব --- ইচ্ছে হয় নিজে তুলে নিয়ে যা। খবরদার হাতে করে দিতে যাস নে যেন, ঠিক আমি হলেও না। খবরদার। 

                  সে বলল, 'কেন ভাই? '

                   ইন্দ্রনাদ বলল, ফিরে এসে বলব --- খবরদার কিন্তু ---, 

                   বলিতে বলিতে সে যেমন ছুটিয়া আসিয়াছিল, তেমনই ছুটিয়া দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল।

এরপর  শ্রীকান্তের যে  ভয়ে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কাটা দেওয়া, শিরা উপশিরা দিয়ে বরফ জল গড়িয়ে পড়া --- এসব সব কেন জানি, আমার ফেলে আসা কতকগুলি রাতের সেই মাছ ধরা পর্বের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হতে লাগলো। সেই যে ভয় মিশ্রিত রাতের রোমাঞ্চ জানতে যাওয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ  হওয়ার অধ্যায়গুলি, সে যেন শ্রীকান্ত আবার নতুন করে আমার ভেতরে জাগিয়ে তুলতে লাগলো। ইন্দ্রনাথ চরিত্রটির সেই যে কিশোর কালের এত বড় বড় সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন লেখক, তা আমাকে এমনভাবে আলোড়িত করে তুলতে লাগলো যে, তা আর কী বলবো! কেন জানিনা ভেতরে কীসের যেন একটি দরজা কপাট মেলানোর শব্দ কানে আসতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, আহা, কী অনুভব সে সব! ইন্দ্রনাথ বলছে, " মরার আবার কি জাত আছে নাকি রে? " শ্রীকান্ত যখন বলছে, "কি জাতের মরা --- তুমি ছোঁবে ? " ইন্দ্র সরিয়া আসিয়া এক হাত তাহার ঘাড়ের তলায় এবং অন্য হাত হাঁটুর নীচে দিয়া একটা শুষ্ক তৃণ খণ্ডের মত  স্বছন্দে তুলিয়া লইয়া কহিল, ' নইলে বেচারাকে শেয়ালে ছেঁড়াছিঁড়ি করে খাবে। আহা!  মুখে এখনো এর ওষুধের গন্ধ পর্যন্ত রয়েছে রে ! বলিয়া নৌকার যে তক্তাখানির উপর ইতিপূর্বে  আমি শুইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহার উপর শোয়াইয়া নৌকা ঠেলিয়া দিয়া নিজেও চড়িয়া বসিল। কহিল, ' মড়ার কি জাত থাকে রে? ' আমি তর্ক করিলাম, 'কেন থাকবে না? ' ইন্দ্র কহিল , ' আরে এ যে মড়া , মড়ার আবার জাত কি? এই যেমন আমাদের ডিঙ্গিটা --- এর কি জাত আছে? আম গাছ, জাম গাছ, যে কাঠেরই তৈরী হোক --- এখন ডিঙ্গি ছাড়া একে কেউ বলবে না --- আম গাছ, জাম গাছ -- বুঝলি -- না?  এও তেমনি। "

 

                 এই উক্তি এর আগে পাঠ্য বইতেও কখন যেন পেয়েছিলাম; এখন মনে পড়ছে একটু একটু সে সব ! কিন্তু আজ তা যেন সব ঝাপসা ভাব কাটিয়ে এমনভাবে ধরা দিল!  কই পাঠ্য বইতে  সে বর্ণনা এমন ভাবে তো মুগ্ধ করেনি! যা এখানে এমন এক ভাবে অনুভব করছি! এতটাই বিস্ময় জেগে উঠছে যে মনে হচ্ছে বলি যেন, আহা,  তখন যদি  এমন ভাবে বুঝতে পারতাম , তাহলে কতটাই না ভালো হতো ?

                  এর পরের দৃষ্টান্ত আরো বড়। প্রতিমুহূর্তে অন্য এক জগতের সন্ধান দিচ্ছে যেন। লেখক বলছেন : দৃষ্টান্তটি যে নেহাত ছেলেমানুষের মত, এখন তাহা জানি। কিন্তু অন্তরের  মধ্যে ইহাও তো অস্বীকার করতে পারি না --- কোথায়  যেন অতি তীক্ষ্ণ সত্য  ইহারই মধ্যে আত্মগোপন করিয়া আছে। মাঝে মাঝে এমনই খাঁটি কথা সে বলিতে পারিত। তাই আমি অনেক সময়ে ভাবিয়াছি, ওই বয়সে কাহারো কাছে কিছুমাত্র শিক্ষা না করিয়া বরঞ্চ প্রচলিত শিক্ষা - সংস্কারকে অতিক্রম করিয়া এই সকল তত্ব সে পাইত কোথায়?  এখন কিন্তু বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে ইহার উত্তরটাও পাইয়াছি বলিয়া মনে হয়। কপটতা ইন্দ্রের মধ্যে ছিল না। উদ্দেশ্যকে গোপন রাখিয়া কোন কাজ সে করিতে জানিত না । সেই জন্যেই বোধ করি তাহার সেই হৃদয়ের ব্যাক্তিগত বিচ্ছিন্ন সত্য কোন অজ্ঞাত নিয়মের বশে সেই বিশ্বব্যাপী অবিচ্ছিন্ন নিখিল সত্যের দেখা পাইয়া, অনায়াসে অতি সহজেই তাহাকে নিজের মধ্যে আকর্ষণ করিয়া আনিতে পারিত। তাহার শুদ্ধ সরল বুদ্ধি পাকা ওস্তাদের উমেদারি না করিয়াই ঠিক ব্যপারটি টের পাইত। 

বাস্তবিক, অকপট, সহজ-বুদ্ধি-ই  ত সংসারে পরম এবং চরম বুদ্ধি। ইহার উপরে কেহই নাই। ভালো করিয়া দেখিলে,  মিথ্যা বলিয়া ত কোনো বস্তুরই অস্তিত্ব বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে চোখে পড়ে না। মিথ্যা শুধু মানুষের বুঝিবার এবং বুঝাইবার  ফলটা! সোনাকে পিতল বলিয়া বুঝানোও মিথ্যা, বুঝাও মিথ্যা, তাহাও জানি। কিন্তু তাহাতে সোনারই বা কি, আর পিতলেরই বা কি এসে যায়। তোমরা যাহা ইচ্ছা বুঝো না। তাহারা যা তাই তো থাকে। সোনা মনে করিয়া তাহাকে সিন্দুকে বন্ধ করিয়া রাখিলেও তাহার সত্যকার মূল্যবৃদ্ধি হয় না। আর পিতল বলিয়া টান মারিয়া বাহিরে ফেলিয়া দিলেও তাহার দাম কমে না। সেদিনও সে পিতল আজও সে পিতলই। তোমার মিথ্যার জন্য তুমি ছাড়া আর কেহই দায়ীও হয় না, ভ্রুক্ষেপও করে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্তটাই পরিপূর্ণ সত্য। মিথ্যার অস্তিত্ব যদি কোথাও থাকে, তবে সে মানুষের মন ছাড়া আর কোথাও না। সুতরাং এই অসত্যকে ইন্দ্র যখন তাহার বাস্তবের মধ্যে জানিয়া হোক, না জানিয়া হোক, কোনোদিন স্থান দেয় নাই। তখন তাহার বিশুদ্ধ বুদ্ধি যে মঙ্গল এবং সত্যকেই পাইবে। তাহা তো বিচিত্র নয়! "


                ইন্দ্রনাথের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে  শরৎচন্দ্র এই যে উপলব্ধি আমার সামনে তুলে ধরলেন, তাতেই আমি যেন আমার পথের অনেক খোঁজ পেয়ে গেলাম। কেন জানি মনে হলো, এই তো আমার শিক্ষাগুরু ; আজ আমার সামনে সব দিককার দরজা-জানলা খুলে দিলেন --- আমি যেন আমার এতদিনকার ধারণার অত্যন্ত সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি। মনে হতে লাগলো, আজই একখানা চিঠি লিখি রসিক দাদুকে।

                 এ তো গেল এক সত্যের প্রত্যক্ষ করা। আর এক জায়গা পড়ে আরো চমকে উঠলাম ---- মনে হতে লাগলো, আহা, এ কি বললেন তিনি ---- ! 

                  যদিও সে বর্ণনা এর আগেই --- সেখানে শ্রীকান্তের মনে হচ্ছে এইরকম, '' সাহসের এতগুলি পরীক্ষায় পাশ করিয়া শেষে এইখানে আসিয়া ফেল করিবার ইচ্ছা আমার ছিল না। বিশেষতঃ মানুষের এই কিশোর বয়সটার মত এমন মহা বিস্ময়কর বস্তু বোধ করি সংসারে আর নাই। এমনই তো সর্বকালেই মানুষের মানসিক গতিবিধি বড়ই দুর্গেয় ; কিন্তু কিশোর-কিশোরীর মনের ভাব বোধ করি একেবারেই অজ্ঞেয়, তাই বোধ করি , শ্রী বৃন্দাবনের সেই দু'টি কিশোর-কিশোরীর কৈশোর লীলা চিরদিনই এমন রহস্যে আবৃত হইয়া রহিল, বুদ্ধি দিয়া তাহাকে ধরিতে না পারিয়া, তাহাকে কেহ কহিল ভালো, কেহ কহিল মন্দ, -- কেহ নীতির দোহাই পাড়িল , আবার কেহ বা কোনো কথাই শুনিল না ---- তর্কাতর্কি সমস্ত গণ্ডি মাড়াইয়া ডিঙ্গাইয়া বাহির হইয়া গেল । যাহারা গেল, তাহারা মজিল, পাগল হইল, নাচিয়া, কাঁদিয়া, গান গাহিয়া সব একাকার করিয়া দিয়া সংসারটাকে যেন একটি পাগলা গারদ বানাইয়া ছাড়িল। তখন যাহারা মন্দ বলিয়া গালি পাড়িল, তাহারাও কহিল, এমন রসের উৎস কিন্তু আর কোথাও নাই। যাহাদের রুচির সহিত মিল খায় নাই তাহারাও স্বীকার করিল, এই পাগলের দলটি ছাড়া সংসারে এমন গান কিন্তু আর কোথাও শুনিলাম না। '' 


               এরপরেই আবার বলছেন, '' কিন্তু এমন কাণ্ড যাহাকে আশ্রয় করিয়া ঘটিল --- সেই যে সর্বদিনের পুরাতন, অথচ চির নুতন -- বৃন্দাবনের বনে বনে দুটি কিশোর -- কিশোরীর অপরূপ লীলা --  বেদান্ত যাহার কাছে ক্ষুদ্র, মুক্তিফল যাহার তুলনায় বারিশের কাছে বারিবিন্দুর মতই তুচ্ছ --- তাহার কে কবে অন্ত খুঁজিয়া পাইল? পাইল না , পাওয়া যায় না। তাই বলিতেছিলাম, তেমনি সেও ত আমার কিশোর বয়স! যৌবনের তেজ এবং দৃঢ়তা না আসুক, তাহার দণ্ড ত তখন আসিয়া হাজির হইয়াছে ! প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ত হৃদয়ে সজাগ হইয়াছে ! তখন সঙ্গীর কাছে ভীরু বলিয়া কে নিজেকে প্রতিপন্ন করিতে চাহে ? অতয়েব তৎক্ষনাৎ জবাব দিলাম, ভয় করব আবার কিসের ? বেশ ত যাও না। '' 


                শরৎচন্দ্র এ কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসে ফেললেন আমায়? এই সাহসের কথাটুকু বলতে গিয়ে একেবারে বৃন্দাবন, রাধাকৃষ্ণ লীলা! তার কিশোর বেলা! সেই কিশোর কিশোরীর মহা প্রেমপর্বের কথা বলে দিলেন এমন করে, আমি যেন কূল কিনারা পাচ্ছি না! আবার যেন এতটাই কূলে এসে দাঁড়াচ্ছি, তারপরেই--  তোলপাড় করাচ্ছে সবটা কেউ, জল-কল্লোল !  আমার মনে পড়ছে কত কথা ---- আমিও বারবার ফিরে যাচ্ছি --- সন্ধ্যাবেলার বারান্দার সেই কোণটায় বসে বসে ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত এবং আমি একাকার হয়ে যাচ্ছি। মনে পড়ছে, সেই যে মৌচাক ভাঙা মন্ত্র শেখার কথা। বশীকরণ মন্ত্র শিখবার জন্যে গ্রামের পাড়ায় যে চাউলের কাছ থেকে নিরাপদ বাগদি আসতো খড়ি কাটতে তার পেছন পেছন কত দিন ঘুরে বেড়ানোর সেই সব দিনগুলির কথা ---- আমরা তাকে নিরাপদদা বলে ডাকতাম। খুব কম কথা বলত সে। সারাদিন এক মনে মামাদের জামরুল গাছের নিচেয়, কখনো আমাদের ঘাটের বাগানের ডানদিকে যে আতাফলের গাছটা আছে, তার তলায় এক মনে সমস্ত দিন খড়ি কাঠ ফেড়ে যেত সে তার কুড়ুলখানি দিয়ে। এই সব প্রয়োজন  হত ভিয়ানের  জন্যে ---- আর তার যোগান দেবার জন্যে এরকম নিরাপদদার দরকার হত। বাড়িতেই এই সব কাঠ ফাড়াফাড়ি হত তখন, গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত, এ কাজের যেন বিরাম নেই। যারা যারা ভিয়ান করত তাদেরই এরকম কাঠ ফেড়ে টাল দিতে হত থাকে থাকে, এই সব খড়িকাঠ জড়ো করে। আর সেই চেলা করা কাঠ একের পর এক সুন্দরভাবে মাচান দেবার মত করে সব বাড়ির এক একটা কোণায় সাজিয়ে রাখা হত। কাঁচা সেই খড়ি কাঠ চেরাই হয়ে গেলে তাতে রোদ হাওয়া বাতাস লেগে এমন একটা গন্ধ বের হত, যাতে চিনে নেওয়া যেত আজ কী কাঠ কাটছে নিরাপদদা । শুধু একা নিরাপদদাই নয়, পাঁচুভাইও দিদিমার যোগান দিত এই সব কাজে। 


              সে যাক গে, সে আমাদের অল্প কাঠ লাগত বলে পাঁচুভাইকে দিয়েই না হয় হয়ে যেত। কারণ এ কাজে পাঁচুভাই খুব একটা খড়ধর না। অত্যন্ত ধীরগতির । কিন্তু নিরাপদদা খড়ি কাটাই শুধু নয়, এ কাজ যখন যেই করত, তারই মেহনতের ছবিটাই ফুটে উঠত পেশীবহুল এক স্পষ্টতা নিয়ে ; যাতে প্রদর্শিত হত যেন পেশীর সমস্ত খাঁজগুলি, এক অন্য মাত্রা নিয়ে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম, বলতাম মনে মনে, বাবা! দম চাই! তা না হলে এই কাজটা একবার প্র্যাকটিস করতাম না হয়! কুড়ুলের এক একটা কোপ বসে যেত নিখুঁত নিরিখে কাঠের এক একটি খাঁজে । দেখতাম নিরাপদদাকে, কি রকম চিনতে পারত সে, এই গুড়িটাকে কোন দিকে ঘুরিয়ে কাটলে কোন জায়গাটায় কোপ দিলে কাঠটা সহজ মত খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। কেন জানি না, এসব জিনিসে আমার মনের অন্যমনস্ক এক অনুভব কাজ করে চলতো ভারি নিঃশব্দে! খুব মন দিয়ে ঠাওর করতে পারতাম এসব। করতে করতে আবার কখন এই সবের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে সেদিনের মত হয়তো ভুলেই যেতাম যে জন্যে আজ নিরাপদদার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি । কিন্তু সে কথা ভুলে, লক্ষ করতে থাকতাম তার এইসব কায়দা কানুন। পরে যখন ভাবতাম, এই দেখ, আজও তো বলা হলো না তাকে, বিকেল যে গড়িয়ে গেল ; এই বার তো নিরাপদদা হাত পা ধুয়েই টাকা কটা মামাদের কাছ থেকে নিয়েই মারবে ছুট, এক পায়ে দুই পায়ে এগোতে না এগোতে তাকে আর ধরা যাবে না। হয়তো ও বাড়ির নির্মলা দিদির কাছ থেকে পানটা নিয়ে তাতে চুন লাগাতে লাগাতে সুপুরি ঢেলে দিয়ে মুখে পুরে দেবে। তারপর হাঁটা লাগানো ---- আমিও সেসব দেখে দেখে অভ্যস্ত বলে, তার পিছু নিই আজকে, কিছু দূর গিয়ে ধরে ফেলি। বলি, কই, কী হলো কি নিরাপদদা? আজও তো শেখালে না! আজ আর কাল করে করে প্রায় এক মাস তো লাগিয়ে দিলে, আমি আর কত দিন তুমার জন্যি অপেক্ষা করি, তাই কও তো দেহি! 

                সে মুচকি হাসতে হাসতে বলে, ও বাবা, পেছন পেছন আইস দেহি আজ একেবারে ; আরে,  চিন্তার কিছু নেই --- হবেনে, হবেনে  তো কলাম, সময় আলিই দিবানে কয়ে, কইছি তো, আচ্ছা, যাও কাইলই হবেনে , দিবানে কয়ে ; আচ্ছা, আজ যাও, কাইল ---  কিন্তু তোমাগের ওই ওপাশের কলুপে গাছের ওই লম্বা লম্বা বড় বড় কয়টা আম কিন্তু দিতি হবেনে কাইল, সাইরে নিয়ে চলে আসপা কিন্তু কলাম, তোমার ওই খাণ্ডাই দিদিমা দেখতে পালি কিন্তু  রেহাই নাই, সে কথা মনে রাইখো কিন্তু ; আচ্ছা, যাও, আইজ যাও দেহি, বাড়ির দিকি আমিও যাই ইবারে ,ভাইবো  না, ভাইবো না, হবে নে, কাইলই দিবানে শিখায়ে তোমারে। এহনে নিশ্চিন্তে যাও দেহিনি ------

               খুব রেগে যেতাম, বলতাম, ও তো কতই হলো ; রোজই তো কচ্ছ একই কথা, আর আমি তুমারে এডা ওডা দিতিই থায়ি ,আর নিতিই থায়ো তুমি--- কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা--- তা আর হচ্ছে না দাদা কলাম, আজ তুমারে পাকা কথা দিতিই হবেনে কয়ে রাখতিছি সে কথা কিন্তু , না হলি হুজ্জতি বাধাবানে, সেকথা কিন্তু বার বার কয়ে রাখতিছি আজ ; এহোনো ভালো চাও তো ঘুরে চাও, শিখায়ে দেও দেহি ;


                  ধাতানিতে বেশ কাজ হলো। নিরাপদদা পরদিন কলুপে আম কডা গামছার মুড়োয় বেধেই--- দুটি মন্ত্র আমায় লিখে নিতে বললো। লেখা হয়ে গেলে খানিকটা আশ্চর্য হয়ে তাকে বললাম, এই তোমার মন্ত্র! এতো শুধু দেবতার দোহাই ! এই কলাইনে কচু হবেনে ; কি হবেনে এতি?

                 সে তাতে জিভ কেটে বললো, ও কতি নেই ভাইডি, একবার পরখ করেই দেহ না, তারপরে না হয় কয়েনে আমারে যা কও, দেখতি পালি শুনতি চায় কিডা---!  যাও না, যাও তো দেহি --- অমাবস্যে পুন্নিমে লাগবেনানে, যাও, এই মন্তরটা কয়ে ঘাটেরকুলি যে লতা গাছটা আছে, তাতি একটু নদীর জল আনে তিনবার মন্তরডা পড়ে ফু মারে দাওগে দেহি, দেহ কী হয়, কিছুডা সময় বাদে যাইয়ে দেখপা --- দেখতি পাবানে কি হয় ; দেখপা লতার মুখ ঘুরিছে কি ঘোরেনি; দেখপা সেদিকি আর নেই, ঘুরে দাঁড়াইছে লতার মুখ, উল্টো দিকি ঘুরে দাঁড়াইছে । দেখ না ঘোরে কি ঘোরে না, দেখতি পালি আর শোনে কিডা ; ----

                 তার কথা শুনে ঠিক বিশ্বাস হত না। মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে দিয়ে এসে আমার কি আর তর সয়! বারবারই উঁকিঝুঁকি মারতে থাকলাম দূর থেকে। আর নিরাপদদার দিকেও লক্ষ রাখতে লাগলাম, দেখতে থাকলাম সে একজায়গায় আছে কি না, দেখলাম না না সে যেমন খড়ি  কাটছিল তেমনই তো কেটে চলেছে। মনে মনে ভাবছি, নাকি সে একফাঁকে ওদিকে গিয়ে লতা গাছের মাথাটা ঘুরিয়ে রেখে এসেছে? 

      কিন্তু না। সে তো নড়েনি ; লতা গাছই তো মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছে যেন  ! এবং বেশ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে ; আমি তো হতবাক। বিস্ময়ে বুকের ভেতরটা কেন জানি ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো। ধপাস ধপাস। কিন্তু কেন এরকম হুটোপাটি করছে বুকের ভেতরে!


( ক্রমশ )


*************************************************************************