অধ্যাত্ম প্রসঙ্গ
স্বামী নির্বাণানন্দ
(১)
বহু জন্মের সাধনার পুণ্য-ফলে এই মনুষ্যজন্ম। এই মনুষ্যজন্মের একমাত্র উদ্দেশ্য ভগবানলাভ। সকলের মধ্যে ভগবান বা আমাদের পূর্ণ-সত্তা রয়েছেন। স্বামীজী বলেছেন, -'Each soul is potentially divine. The goal is to manifest this Divinity within by controlling nature, external and internal. Do this either by work, or worship, or psychic control, or philosophy by one, or more, or all of these -and be free.' -জীবমাত্রই অন্তর্নিহিত স্বরূপের দিক থেকে ঈশ্বর। বহিঃপ্রকৃতি এবং অন্তঃপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এই অন্তর্নিহিত ঈশ্বরভাবকে ব্যক্ত বা প্রকাশ করাই জীবনের পরম লক্ষ্য। কর্ম অথবা উপাসনা অথবা মনঃসংযম অথবা জ্ঞান -এদের মধ্যে এক, একাধিক অথবা সবগুলির মাধ্যমে ঐ প্রকাশ ঘটাও এবং মুক্ত হও।
স্বামীজী বলেছেন, যে যেভাবে পারবে, সেভাবেই ঈশ্বরকে বিকাশ করাকেই একমাত্র লক্ষ্য জ্ঞান করবে। 'যে যেভাবে পারবে' -কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকলের জন্য এক পদ্ধতি, এক পথ বলা হচ্ছে না। রুচি অনুসারে, শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য এবং প্রবণতা অনুসারে যার যে ভাবটি suit করে, যার যেটি উপযোগী, ঠাকুরের ভাষায় -'যার পেটে যা সয়', সেই ভাব বা পথ ধরে চলতে হবে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের শাস্ত্রকারগণ, আচার্যগণ শুধু মানুষের মনস্তত্ত্বকেই যে পূর্ণভাবে বুঝতেন তাই নয়, তাঁরা মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য গভীর গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্নও ছিলেন। ঋকবেদে বলা হয়েছে, -'একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি' -এক সত্যকে ঋষিরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বেদে যা কিছু পাই সেই সবই ঋষিদের অনুভব। পথ ও পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য এক। লক্ষ্য হল দেবত্বের বিকাশ। সেই লক্ষ্য থেকে যেন ভ্রষ্ট না হই। 'নট কহে, সুন নটী, তাল-ভঙ্গ না পাই।' যেভাবে খুশি নাচ, কিন্তু তাল যেন ঠিক থাকে -যেন বেতালে পা না পড়ে।
(২)
লীলা ধরে ধরে নিত্যে পৌঁছাতে হয়। সূর্যরশ্মি ধরে ধরে সূর্যে পৌঁছাতে হয়। নিত্য ও লীলার মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। নিত্য-লীলা অভেদ সম্বন্ধ। নিত্যে পৌঁছালে লীলা নিত্যে লয় হয়। স্থূল, - সূক্ষ্ম, - কারণ। কারণ মহাকারণে লয় হয়। লীলা মিথ্যা -একথা ঠাকুর বলছেন না। অনুভবের পর ঠাকুর লীলাকেও সত্য বলছেন। সুতরাং নিত্য আর লীলা দুটো জিনিস নয়। লীলা ও নিত্যের সম্বন্ধ হচ্ছে Relative Truth থেকে Absolute Truth. নিত্যে পৌঁছালে 'আমি'ই যে থাকছে না, ফলে কে বলবে? কাকেই বা বলবে? কিন্তু লীলাতে যখন রয়েছি তখন তাকে স্বীকার করতে হবে। তুমি কলকাতার উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর থেকে রওনা হলে; পথে উত্তরপাড়া, বালী, হাওড়া পড়ল। তুমি তো লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে এগুলিকে অস্বীকার করতে পারনা। তবে নিত্য অনুভব করে লীলাতে নেমে আসলেও মন সাধারণ লোকের মত নিচে নামতে পারে না। ঠাকুর নিত্য থেকে লীলায় নামবার সময় বিভিন্ন স্তর বা sphere থেকে বলবার চেষ্টা করেছেন। যখন নিত্য থেকে লীলাতে একশো ধাপ নেমে আসছেন, তখন শুধু ওঁ, ওঁ বলছেন। মহারাজ বলতেন, -'ঠাকুর যখন সমাধির পর নামতেন তখন তিনি বিড়বিড় করে কত কথা বলতেন। সেগুলি কিছুই বোঝা যেত না। অনেক পরে তাঁর কথা স্পষ্ট হত।'
একবার স্বামীজীর শিষ্য শুকুল মহারাজ (স্বামী আত্মানন্দ) মহারাজকে কতকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন। মহারাজকে তামাক সেজে দেওয়া হয়েছে, আমি যখন গিয়েছি, তখন অনেক কথা হয়ে গিয়েছে। কেবল মহারাজের কথাটি শুনতে পেলাম। মহারাজ বলছেন, -'দেখ শুকুল, দেখতে পাচ্ছি নিত্য আর লীলার মাঝে যেন একটা fine কাঁচের পর্দা দেওয়া আছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ওটা ভেঙে নিত্যে মিশে যাই। কিন্তু ঠাকুর দিচ্ছেন না।'
নিত্য মানে অদ্বৈত। অদ্বৈতভূমি মানে চুড়ান্তভূমি। ঐ ভূমিতে যাওয়া দুরূহ। তাই অদ্বৈতবাদের অধিকারী অতি অল্প। তাই বলে কি আমরা চেষ্টা করব না? জীবনে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বড় বড় কথা বা বক্তৃতাতে কাজ হবেনা। আচার্য শঙ্করের অদ্বৈতবাদ highly intellectual -তা বুঝবার বা অনুশীলন করবার মত লোক খুব কমই আছে। মহারাজ বলতেন, -'তোমাদের উদ্দেশ্য তোমার বড় বক্তা বা বড় philosopher হওয়া নয়। ব্রহ্মজ্ঞান এবং তারপরে কি হয় -এসব বড় বড় কথা না বললে অনেকের মনে ধরে না। জীবনে কি করতে হবে, সেদিকে লক্ষ্য নেই, শুধু বড় বড় কথা! অধিকাংশ মানুষ ভক্তিবাদী, নাহয় জ্ঞানমিশ্রা ভক্তিবাদী। অনেকের ধারণা, অদ্বৈত বাদ গ্রহণ করলে নিয়ম-বিধি কিছুই মানবার দরকার নেই। যথেচ্ছাচার করা যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অদৈতবাদীর আচরণ অনুকরণ করা খুবই কঠিন। সর্বত্র সে শুদ্ধ ব্রহ্মকে দেখবে। তাই ঠাকুর বলতেন, -'অদ্বৈতজ্ঞান তো শেষের কথা।'
(৩)
ঠাকুর তাঁর সন্তানদের মধ্যে এক স্বামীজীকে ছাড়া আর সবাইকে ভক্তিমার্গের উপদেশ দিয়েছিলেন। স্বামীজীকে অদ্বৈত শিক্ষা দিয়েছেন। কিছুটা অদ্বৈত শিক্ষা অবশ্য তুরীয়ানন্দ মহারাজ এবং অভেদানন্দ মহারাজকেও দিয়েছেন। তাঁর সন্তানরা প্রত্যেকেই এক-একজন কত বড় বড় আধার, তবুও অদ্বৈত-শিক্ষা তিনি সকলকে দিলেন না। আর স্বামীজীকে শুধুই যে অদ্বৈত শিক্ষা দিয়েছিলেন তাও নয়, লীলাও মানিয়েছেন।
মহারাজ বলতেন, -'গুরুবাক্য ধরে সাধন করে গেলে ক্রমে মন যত শুদ্ধ হবে তত বুঝতে পারবে, কি করা উচিৎ। কারও মনে আঘাত দিতে পারবে না। দিলেও অনুতাপ করবে। ঠাকুর হাজরাকে বকেছেন; রাত্রে কষ্ট হচ্ছে, তখনই গিয়ে হাজরার সঙ্গে কথা কয়ে এলেন।' আমরা তো গুরুকে সবসময় সাক্ষাতে পাব না। মন শুদ্ধ হলে, সেই মন থেকেই গুরুর নির্দেশ পাব। সেই শুদ্ধ মনই গুরুর কাজ করবে, আর ঠাকুরই হলেন গুরু। মন হচ্ছে দর্পণ। হৃদয়ে জ্যোতিস্বরূপ, চৈতন্যস্বরূপ হয়ে বসে আছেন ঠাকুর। দর্পণ স্বচ্ছ হলে তাঁর আকার পরিস্কার দেখা যাবে, নির্দেশও পাওয়া যাবে। মন যত অস্বচ্ছ হবে ঠাকুরও তত অস্পষ্ট হয়ে যাবেন।
মনের ওপর আহারাদির একটা ভূমিকা আছে। তবে আহারাদি সম্বন্ধে কড়াকড়ির কোন নির্দেশ নেই ঠাকুরের। শুধু লক্ষ্য ঠিক রেখে চলতে হবে। ঠাকুর বলতেন, -'শূকরের মংস খেয়ে যদি ভগবানে মন থাকে তবে সে ধন্য, আর যদি হবিষ্যান্ন খেয়ে সংসারে মন যায় তবে তাকে ধিক্।' এর অর্থ আহারে যথেচ্ছাচার নয়। কথাটির তাৎপর্য -ভগবানকে পাওয়া একমাত্র উদ্দেশ্য -এই দিকে লক্ষ্য রাখা। আমরা দেখি, ঠাকুর স্পর্শদোষ হলে খাবার গ্রহণ করতে পারতেন না। কোন অসৎ ব্যক্তি স্পর্শ করলে অসহ্য যন্ত্রণা হত। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, -আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ। আহার সম্পর্কে আহার্য বিষয়ের জাতিদোষ, আশ্রয়দোষ, নিমিত্তদোষের কথা রামানুজ বলেছেন। কিন্তু আচার্য শঙ্কর 'আহ্রিয়তে' অর্থে ইন্দ্রিয় দিয়ে বিষয় গ্রহণকেই 'আহার' বলেছেন, স্থূল আহারকে নয়। আমরা ঠাকুরের জীবনে দেখেছি, তাঁর মধ্যে দুটোরই প্রকাশ। দুটো মিলিয়েই সম্পূর্ণ তাৎপর্যটি পাওয়া যায়। আমরা দুটোকেই গ্রহণ করব।
(৪)
একবার রাঁচিতে আমাকে জনৈকা মহিলা ভক্ত বলছে, -'মহারাজ! ঠাকুর তো সংসারে দাসীর মতো থাকতে বলেছেন। তাই আমি দাসীর মতো সংসারে থাকি।' আমি বললাম, -'দাসীর মতো মানে তুমি কি বুঝেছ? দাসীর মতো মানে কি irresponsible হয়ে থাকা? কথাটির অর্থ হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে কর্তব্যকর্ম ঠিক ঠিক করা। এটা বহু অভ্যাস করে করতে হয়। সহজে হয় না। ভোগবাসনা থাকলে কি করে এটা হবে? এটা ত্যাগের কথা।'
রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ খুব বড় পন্ডিত ছিলেন, আমাদের সুধীর মহারাজের (স্বামী শুদ্ধানন্দ) সহপাঠী। পরে মঠের সাধু হয়েছিলেন। নাম হয়েছিল স্বামী চিদঘনানন্দ। আমি ওঁর সঙ্গে একদিন গাড়ি করে মঠে এসেছি। পথে হাওড়া থেকে মঠ পর্যন্ত ক্রমাগত বলে যেতে লাগলেন, -'সমস্ত বেদ পড়ে দেখলাম, কোথাও অদ্বৈতবাদ ছাড়া দ্বৈতবাদের কথা নেই-.. ইত্যাদি।' মঠে ফিরে এসে সুধীর মহারাজকে বললাম, -'মহারাজ আপনার বন্ধু তো এই কথা বলেন!' সুধীর মহারাজ শুনে বললেন, -'আর ওদের কথা! পন্ডিতরা একটা ছাঁচে-গড়া বুলি মুখস্থ করে তাই আওড়াচ্ছে। নিজস্ব অনুভব কিছুই নেই।' শুধু বইয়ের কথাগুলো আওড়ালে হবে না। অনুভূতির দিকে যেতে হবে।
গঙ্গার ওপরে শিকল বাঁধা আছে, শিকলের আরেকটি প্রান্ত মাঝ-গঙ্গায় পরশপাথরে বাঁধা আছে। সেই পাথরের কাছে যেতে হবে। উপায় হচ্ছে ওপরে যে শিকলটি আছে সেটি ধরে ধরে সেই পাথরের কাছে যাওয়া। ছাড়লে চলবে না। লীলা ধরে ধরে নিত্যে পৌছে যাও। শরীর ত্যাগের পূর্বে মহারাজ নিত্য ও লীলা দুই-ই সত্য বলে গেছেন। হরি মহারাজকেও (স্বামী তুরীয়ানন্দ) তাই বলতে শুনেছি। তিনি বলতেন, -
'বহুত গঈ থোড়ী রহী থোড়ী অভী হ্যায়।
নট কহে সুনো নটী তাল ভঙ্গ ন পাই।।'
মোদ্দা কথা হল - লক্ষ্য ঠিক রাখতে হবে। মনুষ্য জন্ম মানেই অনেক দূর এসেছি। কিন্তু 'থোড়ী' এখনও কিছুটা আছে। সাধন পথে লেগে থাকতে হবে, যেন 'তাল ভঙ্গ ন পাঈ' -লক্ষ্য ভ্রষ্ট না হই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন