অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি পার্থ প্রতিম গোস্বামী-র কলমে -----
ব্যালকনি
পার্থ প্রতিম গোস্বামী
এই সময়টা প্রতিদিন ব্যালকনিতে এসে বসে শ্রাবস্তী। সকালের কাজের চাপ সামলে, এই তার একটু জিরোবার সময়। চা খেতে খেতে সে পাখি আর কাঠবিড়ালীদের রকমসকম দেখতে থাকে। গাছের জাফরি কাটা ছায়ায় তারা নিশ্চিন্তে এক্কা দোক্কা, অথবা চোর পুলিশ খেলে। শ্রাবস্তীর মনে হয় যেন তার সাথেই খেলছে ওরা। মাঝে মাঝে তাদের সাথেই বকবক করে সে। ওরাও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় তার দিকে। মুখের কোথাও কি একটুও মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে ওদের? এসব গোপন ব্যাপার প্রাণীবিজ্ঞানীদের জানার কথা নয়।
তার স্বামী, অরুণাংশু সেন, কাশীপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরীতে উঁচু পদে চাকরী করে। চাকরি সূত্রে এই গাছ আর জলাশয়ে ঘেরা সরকারি আবাসনের সৌভাগ্যবান আবাসিক তারা। এত সুন্দর পরিবেশ, আবাসনের ভেতর ঢুকে পড়লে, কলকাতা বলে মনেই হয় না আর। শ্রাবস্তী খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারে, আবৃত্তি শেখায়ও সে। তার স্বামীও আবৃত্তি তো করেই, তার পাশাপাশি সেতারের হাতও অতি চমৎকার। দুজনেই খুব গুনী শিল্পী মানুষ। কিন্তু স্বামীস্ত্রীর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পটির থেকে বঞ্চিত তারা। দীর্ঘদিন এই অভাব পূরণের নানাবিধ প্রচেষ্টার পর এই সত্যকে মেনেই নিয়েছে এক প্রকার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো বলেই গেছেন, মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া এক জিনিস নয়। তাই শূন্যতা ঘুরে বেড়ায় ঘরময় । অরুণাংশুর চাকরীর ব্যস্ততা আছে। শ্রাবস্তীর আছে না হওয়া কথোপকথন। তুলতুলে নরম পাখি আর কাঠবিড়ালিকে মনের অজান্তেই সে না পাওয়া কিছুর বিকল্প বলে ধরে নেয়।
সেদিন হঠাৎ করেই অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে অপূর্ব জ্যোৎস্না ছড়িয়ে চাঁদ নেমে এল হাতের মুঠোয়। অন্যান্য দিনের মতোই শ্রাবস্তী ব্যালকনিতে গিয়েছিল চা নিয়ে। হঠাৎ ব্যালকনিতে ডাঁই করে রাখা অব্যবহৃত জিনিসের গাদার থেকে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ তার কান ধরে টান দিল। সে খানিকটা ভয়ে, খানিক কৌতুহলে এগিয়ে গেল গুটি গুটি পায়ে সেই আওয়াজ লক্ষ্য করে। অনতিবিলম্বেই তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হল সেই কল্পনাতীত। একটা জুতোর বাক্সে গোটা কয়েক এত্তটুকু এত্তটুকু কাঠবিড়ালির ছানা। সে তো আনন্দে বিহ্বল, কি করবে বুঝতে পারে না। কতদিন মনে মনে সে আদর করতে চেয়েছে ওদের বুকে জড়িয়ে। আজ ওরা একেবারে হাতের নাগালে। সে হাতে তুলে নেয় একে একে সবকটিকে। দৌড়ে চলে যায় তার শয্যাশায়ী বৃদ্ধা শাশুড়ী মায়ের কাছে। যেন ঠাকুমাকে তার নাতি নাতনীর মুখ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে চিকচিক করছে টলটলে আলো। এতদিনের সমস্ত চাপা ফিসফিস, অব্যক্ত খারাপ লাগা আর বাঁকা চোখের প্রত্যুত্তর যেন সেই ছোট্ট প্রাণগুলি। রান্নাঘর থেকে দুধ নিয়ে ড্রপারে করে পরম মমতায় তাদের খাওয়াতে থাকে সে। ভাসিয়ে দিতে থাকে তার সমস্ত শূন্যতা, আর বাড়িয়ে দিতে থাকে সমস্ত আদর সেই অবোধ ছানাগুলির দিকে। তারাও কী অদ্ভুত মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
নাঃ, এবার স্নান করতে যেতেই হবে। শাশুড়ী মায়ের দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে এল। চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই জুতোর বাক্সতেই আবার তাদের আলতো করে রেখে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে সে। আচ্ছা, দুপুরে কি খাওয়াবে ওদের? ওরা কি এইটুকু বয়সে ভাত খেতে পারবে ? কাঠবেড়ালী ভাত খায় তো? ঘরে অবশ্য কাজুবাদাম আছে। সে শুনেছে কাঠবিড়ালীরা বাদাম খেতে খুব ভালোবাসে। নাহলে দুধ তো আছেই। তার উপচানো মনের ভালোবাসা জলের মতো লাফিয়ে পড়ে বালতি টপকে, কিভাবে প্রকাশ করবে এই অনর্গল বয়ে যাওয়া, সে ভেবে পায় না। গুনগুন করে গান ভেসে আসে বন্ধ দরজা ভেদ করে। মন বেশ ফুরফুরে তার। এসে আবার আদর করবে ওদের।
দূর থেকে কি কেউ লক্ষ্য করছিল এসব ? যার আত্মজ এরা। নাকি সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল উদর সংস্থানে, যা থেকে এইসব কচি প্রাণগুলিও জীবনের রসদ পাবে। সে ফিরে এল। এসেই তার বাৎসল্যের গায়ে এক বিসদৃশ গন্ধে তার মাতৃসত্তা কেঁপে উঠলো।
স্নান থেকে ফিরে কেঁপে উঠলো আর একজনও । জুতোর বাক্স খাঁ খাঁ করছে, নিঃসীম দুপুরের মতো।
*************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন