বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

কবিতাগুচ্ছ * তৈমুর খান





কবিতাগুচ্ছ * তৈমুর খান 


অসময় 


ঘুরে দাঁড়াচ্ছি যদিও 

নিজেকে বোঝাবার উপমা নেই আর 

চারপাশে ঘোর কোলাহল 

দম আটকে যাচ্ছে প্রায়শ 

দুইপায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে লতা 

মাথার উপর ভাঙা মেঘ 


পাখিরা উড়ে যাচ্ছে 

অন্য কোনো বসন্তের দিকে


আগমন বার্তা 


তোমার উপর ভরসা রাখি 

বর্ষা দেবে, ছাতাও দেবে 

পারাপারের নৌকা দেবে 


হাওয়ায় ছেড়ে মনের গাড়ি 

একা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আছি 

শ্রাবণ নামছে, - - - - 

মেঘদূতেরও ভেজা ডানা 

উড়তে উড়তে দেখছে আমায় 


কত কালের বিরহ নিয়ে 

            ভাঙা বুকের পাঁজর নিয়ে 

                দাঁড়িয়ে আছি 

আমার উঠোন সবুজ হলে 

        নেমে আসবে গানের পাখি



স্বপ্নদিন 


আকাশ থেকে ঘোড়া নামছে 

ক্ষেত মজুরের বাড়ির সামনে 

শুভদিন কি আসছে তবে? 

দাঁড়িয়ে ভাবছি আনমনে 


ঘোড়ার ডানায় বৃষ্টিরেখা 

মেঘচাদরে শরীর ঢাকা 

কপাটবিহীন দরজা ধরে 

কালপ্রতিমাকে খুঁজছি একা 


উড়তে চাই দূর গগনে ঘোড়সওয়ারী

দুঃখগুলো বিরহগুলো বনের পাখি 

যাক উড়ে যাক, প্রাণ ফিরে পাক 

              নষ্ট তরী 


ভাসতে ইচ্ছে, হাসতে ইচ্ছে 


আজকে শুভদিন সওয়ারী


বাঘ


সব খোলা দরজা দিয়ে বাঘ ঢুকে যায় 

হিংস্র বাঘেরা রাজনীতির পোষা বেড়াল 

সুন্দর সুন্দর বেড়ালেরা আমাদের ঘরকন্নার বারান্দায় বসে 

লেজ নাড়ে 

লেজগুলো কী সুন্দর পতাকা 

বাতাসে আলোয় পত্ পত্ ওড়ে


আমিও দেবতা হয়ে যাই


কখনো কখনো তুমি পরি 

আমাদের সন্ধ্যাগুলি মনোরম হলে 

তখন উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকি 

ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোও 

            কীভাবে আশ্চর্য সব পাখি হয়ে ওড়ে 


চন্দন গাছের নীচে আমি বসে থাকি 

আর পৃথিবীটা ইচ্ছে মতো ঘোরাই


ক্রীতদাস 


নৌকাটি কাছে আনো 

বহু দিন এপারেই থেকে গেছি 

সঙ্গমের রোদে বৃষ্টির পতাকা ওড়ে 

ভীরু চোখ কাঁপে বাক্যের সংযমে 


সত্যকে গোপন করা কঠিন জেনেও 

আজ ক্রীতদাস হয়ে তোমার দরজায় ফিরেছি 


চাবুকের সমস্ত দাগ চেনাব তোমাকে 

আমার সংগ্রহে সব মধ্যযুগ আছে








মানববাগান


আমাদের কর্মপন্থাগুলি 

আমাদের ধর্মপন্থাগুলি 

দীক্ষিত হোক 

মানববাগানের ফুল ফুটুক 

সারস্বত আনন্দের প্রজাপতিগুলি 

উড়ুক আজ —উড়ুক —উড়ুক 


অনন্ত এখানে নামো 

এখানে আমরা অনন্ত সবাই 

জ্যোৎস্না চাদর ফেলে গেছে 

যৌবন রহস্যময় হাঁটে 

বয়ঃসন্ধি সম্মোহনের নদী 

সোনালি আলোর আড়ালে 

সেও দেখি হাসে

 

হাত ধরো 

একটি হাত, দুটি হাত, অজস্র হাত 

হাতে হাতে প্রাণের স্পর্শ জেগে আছে 


মানববাগানে দিন 

মানববাগানে রাত 

মানববাগানে ভোর —গোধূলিসংকেত 

চলো, কলরব বিছিয়ে বসি 

চলো, স্তব্ধতা পেতে শুই 

চলো, স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন রাখি

 

আমাদের মৃত্যু আছে? 

আমাদের জন্ম আছে? 

আমাদের ঈশ্বর? 


আছে অথবা নেই 

নেই অথবা আছে 

দেখতে পাই অথবা না দেখা 

ধারণা অথবা ধারণাতীত কিছু 

সব নিয়ে মানববাগান 

সব নিয়ে আমাদের গান

 

যে গাইতে পারে না 

অথবা যে গাইতে পারে 

গাওয়া না গাওয়াও 

কথা আর সুরের সন্তান ;


নাস্তিক আস্তিক তারাগুলি আলো দেয় 

আকাশে মহাকাশে তীব্র জ্যোতিষ্কবলয়ে 

তাদের বিনম্র জাগরণ 

টের পাই 


আমাদের অনন্ত অস্তিত্বে আলো পড়ে 

অপার্থিব আলোগুলি কোমল 

অভিলোচনের মতো স্বয়ংক্রিয় 

বিস্ময় জাগায় ;


ঘরের লণ্ঠনকে তবু পাশে রাখি 

বউটিরও ডানা নেই বলে 

মাঝে মাঝে ডানা-কাটা পরি 


বিস্ময়কে আঙুল দেখাই

দুঃখের কাছে চোখ সরোবর 

যে বোঝে না কিছু তাকেও বোঝাই ;


মায়া নেমে এসে ফুটেছে পদ্ম হয়ে 

সম্পর্ক অলীক ভ্রমর 

কেউ যদি কাপালিক হও 

এ বাঁশিটি ফুঁ দিয়ে দ্যাখো 

বাজলে কী সুর হয় তাতে 

না বাজলে শুধুই দণ্ড 

কেবল ব্যর্থ বাঁশ 


সহিষ্ণু জ্বরের তাপে শরীর পোড়ে না 

তবু ছাই ওড়ে 

বিমর্ষ অদৃশ্য চিতা জ্বলে 


এ চিতায় দাঁড়িয়ে থাকি সারারাত 

যদি তুমি আসো হে কবিতা 

নির্মোহ সংলাপ 


আমিও তাহলে নাচতে পারি 

মৃত্যুর ঘুঙুর পরে পায়ে 

জীবনের অপার্থিব উত্তরণ পাই 


যদিও লাইনগুলি ছোট 

মাঝে মাঝে ছন্দপতন 

যদিও মানববাগানে দুঃখধুলো 

যদিও বিষাদ সেই নিগ্রো সনাতন 


তবুও একপংক্তিতে ক্রিয়া বসে 

সাপেক্ষ অব্যয় পদে বাক্য হয় ভালো 

নষ্ট তারার কাছে এসে 

সমস্ত পোশাক খুলে ফেলি 

পার্থিব পোশাকগুলি মলিন কদর্য ধুলোবালি 

তারাও ওঠে হেসে 

শরীরও হাসে একা একা শূন্যতার তাপে 


মানববাগানের ফুল কারা তুলতে আসে? 

জানি না বিসর্গ-বিন্দু 

আমিও অযোগবাহ বসি তার পাশে 

উচ্চারণ তাড়নজাত 

নিসর্গ ভাষায় বিদ্যুতের চমক 

কিছুটা চমকানি পেয়ে ধাঁধায় ঘুরপাক 


তবুও বৃষ্টি পড়ে 

ভেজা ভেজা সতীর্থকাল 

অলীক চেতনার মাঠে ক্ষণজীবী সুর 

বেজন্মা গানের কলি খুঁজে পাই 

ভিজতে ভিজতে উন্মুখ প্রহরে 

হারানো স্মৃতির সঙ্গে দেখা হয় 


বাক্যবিন্যাসগুলি বাগানের প্রাচীর 

প্রাচীরের রন্ধ্রে ঘুম ও জাগরণ 

যাওয়া-আসা করে 

প্রশ্রয়ে ডুবে থাকা উদ্বেগের আয়ু 

বাতাসিকে ডাকে শুধু চলন্ত হৃদয়ে 

আসলে প্রস্বরে ঝড় হওয়া বায়ু 


মূল্যহীনকে যদি ডাকে মূল্যবান 

যদি-বা বিবাহ হয় ওদের 

কে তবে হয় সন্তান? 


একালে ওকালে ভবিষ্যতের চাতালে 

চেয়ে থাকে আমাদের স্বয়ংক্রিয় বিস্ময় 

বিবাহ সন্তান জন্ম, সন্তানের পরিণতিময় 

একটি যুগ 

একটি নিরক্ষর দার্শনিক 

শিক্ষিত হবে বলে কেবল ধ্যানস্থ তার্কিক 

হয়ে যেতে পারে 

অথবা কিছুই পারে না —

মানববাগানে শুধু তোলে বুনোফুল 


পর্যটন থেকে নিবৃত্তি আসে না 

মনের আরোগ্য নেই 

রোগ পুষে রাখার সামর্থ্যে 

সব কল্লোল-কল্লোলিনী ঢেউ তোলে 

বার্তা দেয় 

বার্তার পাঠশালায় করুণ সদ্গতি 


এ সমাধিক্ষেত্র থেকে নীল তিথি 

আর সবাক তীর্থক্ষেত্রগুলি চেয়ে আছে 

আমরা জন্তুর ধর্মে নিয়ন্ত্রণ সাজাই 

যদিও অনিয়ন্ত্রিত দিন 

অন্ধকার এসে খেয়ে নিতে থাকে 

জীবনের প্রার্থিত সময় 


এ বাগানে সত্য আছে? 

কোন্ সত্যকে রোজ ডাকি তবে 

ডেকে ডেকে অন্ধ হই 

শূন্যতার পথে কার পদধ্বনি শুনি

 

অথবা নিরর্থ আলো এসে দৃষ্টির ধারণা দেয় 

কিংবদন্তির পাড়ায় কত মোলায়েম গল্প 

আহা গল্পের ভেতর অল্প নাচ লেগে থাকে 

প্রবৃত্তিই সবকিছুর সমাধান চায় 

যদিও সমাধান বলে কোনও ধান নেই কৃষকের 

সবই তো মৃত খড়, আলুথালু বৈরাগ্য সমীচীন 

আর যা আছে গার্হস্থ্য মেদুর বিছানায় 

রতির বেহালা 

বিশেষ্যের বদলে সর্বনাম 

কর্তব্যের গেরস্থালি জুড়ে মূর্খ বিশেষণ 

দিব্যি সেজে ওঠে 


নিচে সুরক্ষিত বাড়িটি তার 

বাড়িতে ঘুমায় কাম, অথবা জেগে থাকে 

আমরা ছিপ হাতে সবাই শিকারি 

অনেক সোনালি রুপালি মাছ ধরি

 

মানববাগানে অতিচেতনার হাঁস 

বাসা বাঁধে, ডিম দেয়, বাচ্চা হয় 

অনেক কাকলির ভেতর 

নতুন নতুন কাকলি 

বাসার চারিপাশ ঘিরে ঘোরে সর্বনাশ।


***********************************************************



  তৈমুর খান

বাংলা কবিতায় একটি পরিচিত নামছোট বড় বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত লিখে থাকেনতাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ----কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) 

1 টি মন্তব্য:

  1. ছোটো ছোটো কবিতাগুলোতে রাজনৈতিক বাতাবরণের বিরুদ্ধে একটা চড়া সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সামাজিক সমস্যার মাঝে রাজনীতির রং কিভাবে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কবি।

    উত্তরমুছুন