একটি দুপুর প্রচ্ছদ
সম্রাট মুখোপাধ্যায়
'আমার বাবা মারা গেছেন এক মাস হল,নিশ্চিত নই এক মাসই কিনা'...এমনতর একটা লাইন লেখার মতো 'স্মার্ট' আমি নই।এক কলোনি-সংস্কৃতিতে বাঁচতে-বাঁচতে,অসম সমাজব্যবস্থায় ক্রমাগত প্রহৃত হতে হতে অতখানি ইউরোপীয় নিঃস্পৃহতা জোটাব কোথ্ থেকে ?
আমার পড়া আর আমি এক নই।
আমার অনাধুনিক গদ্য ও আবেগ-পরিপূর্ণ হৃদয় প্রতি মুহুর্তে জানান দিচ্ছে আমার বাবা ঠিক এক মাস আগে এই দিনেই চলে গিয়েছে শারীরিকভাবে আমাদের ছেড়ে।
আজ আমি বইমেলা যাই নি।
না,এবার আমি একদিনও বইমেলা যাই নি।
এবার হয়ত আমি বাকি ক'দিনও বইমেলা যাব না।
বই আর বইমেলা তো এক নয়।বই এক স্বতোৎসারিত মন্ত্র।বইমেলা এক আয়োজিত উৎসব।
আমার মতো কারও কারও কাছে হয়ত সবচেয়ে বড় উৎসব।বাঙালির জীবনে বসন্তে আসা অকাল-শারদোৎসব।
শোকপালন এক নিভৃতি দাবি করে।
শোকপালন উৎসব থেকে দুরে রাখে।
আর এই যে বই,বইমেলা...এই সবই তো ছিল বাবার সঙ্গে আমার সবচেয়ে অটূট গ্রন্থি।
অতএব,এ'বছর উৎসব আঙিনা থেকে,বই ঘিরে হইহুল্লোড় থেকে দূরেই আছি।গত চার দশকের উৎসবকে মনে-মনে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখার একটা সুযোগও পাচ্ছি এতে।
আজ দুপুরে বইমেলায় ছিলাম না।বইয়ের সঙ্গে ছিলাম।
গিয়েছিলাম প্রতিক্ষণ প্রকাশনা'র দপ্তরে।একটি কাজে।সি আই টি রোডের আনন্দ পালিত স্টপেজে নেমে এক পুরোনো চার্চমুখী গলিতে।
আর এই পথে পৌঁছতেই মনে হল যেন আজ আমার অনিবার্যই ছিল এই পথে ফেরা।এ'যেন এক বৃত্তাকার উপন্যাসের গঠন!
১৯৭৯।আমি ক্লাস ফোর।আমার দীর্ঘ অসুস্থতার পরে বাড়ির নিজস্ব ডাক্তার সন্দেহ করলেন আমি দুরারোগ্য কোনও রোগে আক্রান্ত।বেশ কয়েক-দফা রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হল।তখন বাড়ি এসে রক্ত নিয়ে নামী ল্যাব থেকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করানো এত সুলভ ছিল না।সব কিছু 'ফেলো-কড়ি-মাখো-তেল' হয় নি।
তো,আমার বাবা আমায় তখন নিয়ে আসতেন এখানে।এই সি আই টি রোডের এক ল্যাবরেটরিতে।রক্ত দিতে।ড.যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্যের(যতদূর নামটি মনে আছে) ল্যাবরেটরি বলে খ্যাত ছিল এটি(তখন অমনই হত,যেমন আরেক বিখ্যাত জায়গা ছিল তালতলার ড.সুবীর দত্ত'র ল্যাব...ব্র্যান্ড বলতে তখন এরাই)।গল্পের শেষটি মিলনান্তক।বাড়িতে মা-মাসিদের কান্নার লহর পেরিয়ে অবশেষে আমি রোগমুক্ত হই।দেখা যায়,আমার রোগটি রক্তের অ্যালার্জি ঘটিত হলেও,ততটা জটিল নয়।
কিন্তু তার মাঝে রক্ত দেওয়া,রিপোর্ট নেওয়া,ডাক্তার দেখানো...সব মিলিয়ে আমার সেই মধ্য-শৈশবের সাতের-দশক-শেষ কলকাতার সঙ্গে দিন চার-পাঁচেকের একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে।'ট্যুর ডি এল ডোরাডো' বলা যায়।সেই আমার প্রথম দু'চোখ মেলে এই মহানগরকে দেখা।আমার মনে তাই কলকাতার ভূগোল শুরু হয় এই পশ্চিম-কলকাতার পথ-ঘাট দিয়ে।আঃ কী বাঁধানো,চওড়া,গাছময় ছিল তখন এদিককার সব ফুটপাথ!আর এইসব সফরে আমার একমাত্র গাইড ছিল বাবা।কখনও তার হাতের মুঠো,কখনও কোল আমার না-হারিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল।
প্রতিটি ট্যুরের শেষে বাড়ি ফেরার রেলপথে একটি নতুন কেনা ইন্দ্রজাল কমিকস্'এর বেতাল-সান্নিধ্য বা স্বপনকুমার-খ্যাত 'বিশ্বচক্র সিরিজ'এর একটি রোমাঞ্চ-শিহরণ নিশ্চিত।এরা তখন দামেও ষোলো আনা,আনন্দেও ষোলো আনা।
সে এক কার্নিভাল!
বাবা মাঝে-মাঝে বলত,"আমি যা করেছি জীবনে,সে তোরা ভাবতেও পারবি না।"এ'কথা শুনে কখনও তর্ক করেছি...রেগে গেছি...মজা করেছি।জীবনে রোদ-মেঘ সবই থাকে তো...।
আজ বুঝি বাবা,কী তুমি বলতে চাইতে...সফলভাবে এক সন্তানকে মৃত্যুর মুখ থেকে সরিয়ে এনে নীরোগ রাখা...থ্যাঙ্ক ইউ বাবা!
আজ হঠাৎই,কিছু না ভেবে,আমার বাবার মৃত্যুর তারিখে ফিরে গেলাম আবার সেই রাস্তায়!
এমন কাকতালীয়তা তো দিনলিপির অধিক!
এমন কাকতালীয়তা তো স্মৃতিধার্যতায় অলীক!
আমি শুধু জানলাম,যে,এমনটাই ঘটল!এমনটাও ঘটে!
দেখলাম সাইনবোর্ডটা বদলালেও সেই একই জায়গায় ল্যাবরেটরি আজও বসে আছে!
এখনও পড়ে থাকা দুপুরে ফুটপাত-জোড়া রোদ ঝাঁঝাঁ করে আর মানুষের নশ্বর চলাচল কেমন ছায়াবাজি মনে হয়!
এখনও একটা পুরোনো,বড় গাছ সব স্বাক্ষ্য নিয়ে খাড়া!এমনকি,যে দোকানে জোড়া-সন্দেশ খেতে যেতাম সেটি পর্যন্ত আজও অপেক্ষমান!
আমি কী আজ দুপুরে কালভিনোর সেই মায়ানগরের সুড়ঙ্গমুখে পৌঁছে গিয়েছিলাম কোনওভাবে ? এটা কি ছিল আমার কাল আর বাস্তবতাকে ডিঙিয়ে যাওয়া ?
আজ যে বইটি প্রতিক্ষণ দপ্তর থেকে পেলাম সেটি জীবনানন্দ দাশের এক কম-পড়া আশ্চর্য উপন্যাস।নাম 'কলকাতা ছাড়ছি'।
কলকাতা আমাকে আজ তার ভেতরে আমার প্রথম প্রবেশের হাঁ-মুখটা আর একবার দেখিয়ে দিল।
একটি দুপুর প্রচ্ছদ হয়ে রয়ে গেল।
আমি এ'বছর বইমেলায় নেই।
আমি আমার বাবার লেখা একটি বই হিসেবে অবশ্য এই পৃথিবীতে রয়ে গেছি।
এই ছবিটা আমার বাবার।হয়ত আমারও।
************************************************************
উপরের ছবিটি এই নিবন্ধ লেখক সম্রাট মুখোপাধ্যায়-এর পিতার
************************************************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন