বিনোদ কুমার শুক্ল- এর কবিতা
ভাষান্তর: রূপায়ণ ঘোষ
জল ঝরে পড়ছে
জল ঝরে পড়ছে,
বৃষ্টির জায়গায়-
যেখানে আমি প্রতিনিয়ত রয়েছি
আমার ঘর সেখানে বৃষ্টির
আমার রাস্তা বৃষ্টির।
বারবার ভিজতে ভিজতে
হয়ে উঠি বৃষ্টির মূল নিবাসী...
বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা চড়ুই
ঝটপট শব্দে পাখা ছড়িয়ে
ধীরে ধীরে গাছের ডালে এসে বসে
সমস্ত আকাশ এই মুহূর্তে বৃষ্টির!
জল বন্ধ হতেই
বর্ষার স্পর্শ থেকে সবকিছু নির্বাসিত হয়ে যায়
আমিও-
আমার ছায়া নেমে যায়
মূল নিবাসীর ছায়ার ভিতর...
মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টায়
মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টায়
দু-চারজন মানুষ
আমাকে সকলের থেকে আলাদা করে দেয়
আমাকে অদ্ভুত নিঃশব্দ করে দেয়!
মানুষের কাছে কথা বলবার চেষ্টায়
পাতাদের খসখস আওয়াজ হয়,
তীব্র সতর্কতায় এক-পা এগোতেই
ধাক্কা খেয়ে আরও চার-পা পিছিয়ে পড়ি
আমার নিজস্ব শূন্যতায়।
আমার শূন্যতা,
আর কতদিন কেবল আমারই গন্ধে ভরাট হবে!
মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টায়
কিছু ভাবনার ভিড় বাড়ে
জায়গা ভরাট হতে থাকে;
পৃথিবীর টানে আমি মাটিতে দাঁড়াই রোজ
আমার খালি জায়গা ভিড়ের মানুষ গোনে
শব্দ থেমে যায়-
ভিড়ের কাছে মানুষের জন্য গোনার মতো খালি জায়গা থাকে না...
বেঁচে থাকার অভ্যাসে
বেঁচে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে
জীবনে বেঁচে থাকার এই অভ্যাসে
ঘোর বর্ষণমুখর দিন এসে যায় যদি
তো বেঁচে থাকার সময়গুলিতে বৃষ্টি হতে থাকে।
ছাতা ভুলে গেলে মনে পড়ে
জীবনে বেঁচে থাকার অভ্যাসে
রোজদিন ছাতা ভুলেই থাকি
আর সহজ ভঙ্গিতে অফুরান ভিজে যাই...
এই ঘোর বর্ষণ দিনে যখন বিদ্যুৎ গর্জে ওঠে
তখন সহজেই বিদ্যুৎ গর্জায়।
অভ্যাসে অভ্যাসে বাঁচা, সচল থাকা, কাজ করে যাওয়া
সেখানে অল্প অল্প ভবিষ্য থেকে
অপরিমেয় অতীত জড়ো করি
তারপরেও দেখি অগাধ ভবিষ্য রয়ে গেছে...
এই সময় ঈশ্বরের হওয়া না হওয়ার শঙ্কায়
ঈশ্বরকেই বলে বসি- আমাকে মানুষের মতো করে তোলো
সেভাবেই নিজস্ব তাগিদে
জানা নেই কোথাও থেকে
অভ্যাসের অধিক, দুঃখের বন্যা এসে যায়
যেন পাশেই কোথাও বেদনার বাঁধ ভেঙে গেছে,
যে জীবনে সুখের একটি পাতাও ভাসেনি কখনো
আমাদের আর্তি সেখানে বিষণ্ণ মুখ জুড়ে
ভেসে থাকে আনন্দ-উল্লাসে
না আমাকে ডুবতে দেয়
না দুঃখের প্রতিবেশীকে-
আর ঠিক তখনই বিদ্যুৎ গর্জে যায়
বিদ্যুৎ গর্জানো দেখি নিজস্ব স্বভাবে।
তড়িতাহত অন্ধকারের আলোয়
একটি পা এগিয়ে দিই;
জীবনে বেঁচে থাকার এই অভ্যাসে
যেদিন মৃত্যু হবে
সেদিন কোনও এক আশ্চর্য পথিক বলবে, হয়তো মরেনি এখনো
তা সত্ত্বেও আমার মৃত্যু হবে,
মরণের মুহূর্ত জড়ো করে দেখব বৃষ্টি হচ্ছে
এবং বেঁচে থাকার অভ্যাসে বৃষ্টি হতেই থাকবে
তবুও এই অদ্ভুত সহজ মৃত্যুর সময়
জীবনে বেঁচে থাকার অভ্যাসে
নিজের ছাতাটি ভুলে যাব...
বৃক্ষ সংক্রান্ত সুখ
গাছেদের শুষ্ক শাখা-প্রশাখার পাশে
আমার শূন্য হাত ছড়িয়ে রাখি সমান্তরালে
শরীরের সবুজ ছত্রাকের উপর এসে
অবিরাম দৃষ্টি থেমে যায়।
আমি ব্যাকুলভাবে চাই,
বৃষ্টির ফোঁটা এসে
প্রথমে ভিজিয়ে দিক চোখ
তারপর কোনও পাখিদের জোড় উড়ে এসে
আমার দু-পাশের শূন্য শাখায়
বাসা বাঁধুক, ডিমে তা দিক-
আমি তাদের থেকে শিখে নিই সঙ্গম-শিল্প...
আমি ঈশ্বরকে খুঁজতে থাকি
নিজের অসীম চিন্তায় আমি বসেছিলাম
অথবা আমার নিজের লোকেরা-
আমার এই বসে থাকার ভিতরে
আমি খুঁজতে থাকি ঈশ্বরকে
তাকে প্রতিবেশীর ঘরে পাওয়া যায়
একজন প্রতিবেশীর মতো!
আমি তাকে ডেকে উঠতেই সে শুনতে পায়,
কখনও যদি শুনতে না পায়
তবে মনে হয় এখন সে ঘরের মধ্যে নেই
এখনের কিছু পরে পুনরায় ডাকি
এখনের পরবর্তী তখনের যে সময়
ডাকতে থাকি সেখানেও।
মাঝে মাঝে যখন ডাকি না তাকে
সে আওয়াজ দেয়-
নিজের এই বসে থাকার ভিতরে
ঈশ্বরকে ডাকতে থাকি
আর প্রতিবেশী শুনতে পায়।
প্রতিবেশীকে ডাকলে, প্রতিবেশী শুনতে পায়।
কোনো অপূর্ণতা পূর্ণ হয় না
কোনো অপূর্ণতা পূর্ণ হয় না
আর নতুন এক অসম্পূর্ণতা পিছলে যায়
বহু পূর্বের কোনও অসম্পূর্ণতা
প্রথম থেকেই এত এত অসম্পূর্ণ
যে সমস্ত গুনে নেওয়া শেষেও
কিছু অপূর্ণতা আবারও পিছলে যায়।
এই অশেষ অসম্পূর্ণতায় ভরা
শেষ হয়ে আসা জীবনকে
কখনও অপূর্ণ মেনে নিলে,
বলা যায় না জীবনে ভরপুর বাঁচা গেছে।
জীবনের অন্ধকারে
প্রতিটি নতুন মুহূর্ত আগুনের ফুলকির মতো
যেন ক্রমশ উজ্জ্বল-
চলে গেছে এমন সময়কে ছাইয়ের নীচে রেখে
স্ফুলিঙ্গ জ্বলতে থাকে সহজে
স্ফুলিঙ্গের জ্বলতে থাকা সময়, সময়ের সঙ্গে চলে যায়।
কাগজের উপর লেখা কিছু ভাষা
যেন ওই ছাইয়েরই ভস্ম-
ভস্ম হয়ে যাওয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়
দূরে কোথাও আগুন জ্বলে উঠে
ভস্ম হয়ে ওঠার প্রথাকে আরও দীর্ঘ করে দেয়...
অন্তিম প্রশ্বাসে
মৃত্যুর পরে
বেঁচে থাকবে কি আমার ভবিষ্যত?
আমি মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসি...
মৃত্যু যখনই হোক
অন্তিম শ্বাস নেওয়ার জন্য
আমার যথেষ্ট সময় থেকে যাবে।
আমার কাছে সময়ের যথেষ্ট ব্যবহার বেঁচে থাকে
যাতে জানালার পাশে চম্পার ফুলের সুগন্ধ
টেনে নিই শেষ প্রশ্বাসে-
বাইরের মাটিতে ঝরে পড়া
চম্পার ফুল কুড়িয়ে নিই
বাইরের বাতাসে বিবিধ গন্ধের হুল্লোড়
আমি অন্তিম প্রশ্বাসে সমস্ত সুগন্ধ টেনে নেব বলে
শেষ না হওয়া প্রশ্বাসে, বারবার শ্বাস নিতে থাকি...
******************************************************************
অনুবাদ কবিতাগুলোতে সারল্যতার মধ্যেও একটা অসীম আকর্ষণ রয়েছে যা আনমনা পাঠককেও পাঠে নিবিড় করে তোলে। সামান্য বিষয়ের মধ্যে এমন গভীরতা অতুলনীয়।
উত্তরমুছুন