দুই কবি দুই দর্শন
তন্ময় রায়
সংহতির কবি কাব্যের সংহতি
সম্প্রতি কবি শর্বরী চৌধুরীর 'মখমলের ইস্তেহার' এবং দেবার্ঘ সেন-এর ' স্পর্শ নামক জেলখানা' কবিতার বই দুটি পাঠ-অন্তে সর্বাগ্রে এই কথাগুলিই মনে এল।
পরিমিত বাক, সংহত আবেগ, শব্দ ব্যবহারের দক্ষ কারিকুরিতে 'মখমলের ইস্তেহার' ছাব্বিশটি কবিতার এক অনবদ্য সংকলন। সামগ্রিকভাবে বিষয় হিসাবে কবিতাগুলোতে জীবনের অনুচ্চারিত ব্যথা, বিষণ্নতা জয় -পরাজয় ও একাকিত্বের বোধ অন্তর্লীন প্রবাহের মতো যেমন আছে, তেমনই আছে তা থেকে উত্তরণের নিবিড় আততি। একটু বিশ্লেষণে যাই ----
' হাঁড়িমাপা চাল ফোটে উনোনে/ যেন উথলে পড়ে রতিসুখ ' জীবন ও জঠরের যুগ-যুগান্তর ব্যাপী সম্পর্কের অনশ্বরতা ফুটে ওঠে এইভাবে 'আগুন' কবিতায়।' শৈশবে পোতাগাছ বেদনাবিধুর হয়ে আছে ' বেদনা বিধুর শৈশবে পোতাগাছটি কত যে ডালপালা মেলে আত্মা চারিয়ে ছায়া দেয়,যা ' জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ওম হয়ে ওঠে ' হার বা পরাজয় কত আলোক দিশারী, কবি আমাদের অনুভব করান। কোনও কোনও হার মানুষকে অসম্ভব জিতিয়ে দেয় 'তাই,কেউ কেউ হেরে যেতে ভালোবাসে আজীবন।' কারণ তার যে বুক ভরে 'আছে প্রেম,আছে কিছু অবাক বিকেল/ যখন রাত্রি নামে নিগূঢ প্রত্যয়ে /আছে সেই রাত্রিযাপন।'
'মখমলের ইস্তেহার' পড়তে পড়তে মনে হল, কবির আর-এক সাধনা সংহতির সাধনা। কীসের সংহতি? না, ভাব-ভাষা,ছন্দের সংহতি, সেইসঙ্গে পরিমিতি বা ভঙ্গিরও বটে। 'কূটাভাস ' এমনই এক সংহত শক্তির পরিচয় কবিতা। সন্ন্যাসীর মৌনতা যেমন ছুঁতে চায় ধ্যানের গভীর, কবিও তেমনই ছুঁতে চান 'স্বভাব সন্ন্যাসীর উত্তরণে ভরা প্রার্থনাগৃহ ' প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন, কবির অতলান্ত বোধের স্পর্শে 'প্রার্থনাগৃহ'টি আর নিছক উপাসনালয় হয়েই রইল না, শব্দ সাধনায় নিমগ্ন কবির তন্ময় ধ্যানমগ্ন মুহূর্তটিকে আলোকিত করল যেন... স্থিতপ্রজ্ঞ শব্দ সাধককে নিয়ে যাবে অপার আনন্দলোকে 'ভরে যাবে হৃদপিন্ডের অলিন্দ -নিলয়।'
কবিতা পাঠের এমনই অমল আনন্দে স্নাত হবেন পাঠক সংলাপ, হার, ক্ষত, উত্তরণ,ঈশ্বর,জলস্রোত, প্রক্ষালন, সম্মোহন,একলব্য.. এইসব কবিতা পাঠে। বিভিন্ন কবিতায় হীরের দ্যুতির মতো ঔজ্জ্বল্য ঠিকরেছে, এমন কিছু পংক্তি তুলে দিলাম ----
১) আমার প্রেমিকের ঠোঁট বিকেলের রোদের মতো/ ম্লান।
২) ছেঁড়া ফ্রকে হাসছে সূর্য।
৩) প্রকৃত শোকের কাছে মাথা নত করি।
৪ ) সমস্ত কষ্টেরা নদী হয়ে যায়।
৫ ) জীবন, তুমি আর কত স্তব্ধতা শেখাবে!
বইটির একটি ভারী দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী দেবাশিস সাহা। প্রকাশক পাঠক। ৩৬ কলেজ রো কলকাতা - ৭০০০০৯। মূল্য - ৬০ টাকা।
স্পর্শ নামক জেলখানা: স্বতন্ত্র নির্মাণালেখ্য
সূচনাবাক্যের ' নির্মাণ শেষ হয়েছে' শব্দবন্ধটি লিখলাম বটে, এবং দৃশ্যত তা সত্যও বটে, কিন্তু কবিতাপাঠের পর মন যেন বলতে চাইছে, শেষ হয়নি অন্য নির্মাণ চলছে মনের আনাচে- কানাচে, এপাশে-ওপাশে, আকাশে-বাতাসে সর্বত্র।
একটু ব্যাখ্যায় আসি, ' স্পর্শ নামক জেলখানা'-র কপাট খুলি ---' আমি সেসব গোলাপি মাছেদের/ জেলবন্দি করতে / স্পর্শ নামক জেলখানা খুলেছি।' কোন সব? যারা '... প্রতিবেশী আলোরা / জল ঘুঙুরের শব্দ শুনতে এসে / এফোঁড়-ওফোঁড় করেছে মন কিনার 'এখানে আমরা অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ করি, কবির কারুকৃতি অতিচেতনার কোন স্তর স্পর্শের প্রয়াসী।
এবং সে প্রয়াস থেমে থাকে না, যখন কবি বলেন ' স্পর্শ জেলে ভালোবাসার দালালদের/ আমি ঘৃণা করি ' তখন আমরা বুঝতে পারি, স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের দাসত্বেই বন্দী থাকতে চান না তিনি। তিনি আসলে মুক্তি খোঁজেন ' স্পর্শ নামক জেলখানা'র গারদ ভেঙে। সেই ভাঙারই অনুরণন যেন রণিত হতে শুনতে পাই সতেরোটি কবিতার অবয়ব জুড়ে। এবং এই ভাঙচুর শেষে উপলব্ধি করি , এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণে কবি দেবার্ঘ সেন কতটা আন্তরিক ।
স্পর্শ নামক জেলখানা: মূল্য - ৩০ টাকা



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন