অপত্য জারণ
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
সম্পর্কটা কাঁদে প্রাত্যহিকীর যাপনে। দাম্পত্যের সুরেলা বিশ্বাস বা সততা উধাও। ঝিলিকের আচরণে বহুগামিতা ধরা পড়েছে বারে বারে। প্রথমদিকে চিৎকার চেঁচামেচি,তারপর সামাজিক লজ্জায় আসতে আসতে সইয়ে নেওয়া। মায়ের কথা মনে পড়ে তমালের, " সুখের চেয়ে শান্তি বড়ো "।ভালোবাসার চিতাকাঠ জ্বলে নিশিদিন সুখহীন। অদ্ভুত এক অবস্থা---পরিবার আছে,অথচ নেই !দিনযাপন বড়ো ধাঁধা এখন তমালের কাছে। মাঝখানে জেগে থাকে তিতির ,প্লাবনে ডোবা ভুবনডাঙ্গার মতো। ছোট্ট বাচ্চাটার কি দোষ ! ওকে তো জেনেবুঝেই ওরা পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিল।তিতির এখন তমালের সঞ্জীবনী। ওকে মানুষ করেই এই কদর্য সম্পর্ক থেকে মুক্তি নেবে তমাল। দমবন্ধ হয়ে আসে। জীবনে এক খোলা আকাশ চায় ও, যেখানে উড়তে থাকবে আপন আবেগে।কোথাও তখন হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা ! বাড়িতে থাকলে তিতির ওর অবলম্বন।এই তিতিরই মাঝে মাঝে বেঁচে থাকার লোভ ফিরিয়ে নিয়ে আসে তমালের জীবনে কিছু কিছু ঘটনায়।
সেদিন অফিস থেকে ফিরেই শুনলো বাড়িতে চিৎকার।বউয়ের গলা যেন মাইক। সারা পাড়া তটস্থ থাকে।ভাষাও সেরকম !মেয়ে চুপটি করে এককোণে দাঁড়িয়ে কান ধরে। মায়ের শাস্তি।দু এক ঘা পড়েছেও বোধহয়।চোখ ফুলে লাল। ফোঁপানো কান্না সারা মুখ জুড়ে।ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল কিছু লুকাচ্ছে তিতির। নিস্পাপ চোখ অনেক কথা বলতে চায় ওর বাবানকে। মায়ের ভয়ে বলতে পারছে না। ওকে কোলে তুলে নিল তমাল বউয়ের চিৎকার অগ্রাহ্য করেই। ওকে জড়িয়ে ধরতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ও বাবানের বুকে। সারা শরীর জুড়ে কাঁপন ।মেয়ের কান্না ওর ভেতরেও কান্নার প্লাবন ডেকে নিয়ে আসছে যেন। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে তিতির জানালো,আজ বিকেলে খেলতে নেমে ওর লাল সোয়েটারটা হারিয়ে ফেলেছে। বাড়ি ফিরে মাকে বলতেই মার বকুনি। সেই বিকেল থেকে চলছে।তমাল মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, কিছু লুকোচ্ছে তিতির। হয়তো বাবাও বকতে পারে ভেবে আসল সত্যটা বলছে না। নিষ্পাপ চোখের তারায় একটা অদ্ভুত আনন্দ দেখতে পাচ্ছে ও।মা'র অতো বকুনির পরেও কোথায় যেন রহস্য রেখে দিল তিতির !
পরদিন রবিবার ! প্রতি রবিবার সকালে বাবার সাথে বাজার যাবেই তিতির।এই একটা দিন যেন ও বাবার ছায়া ! বাজারের সব্জিওলারা সবাই ওকে চেনে।ও পছন্দ করে আর তমাল কেনে।যেন তিতির তমালের গাইড ! সব থেকে বেশী মজা হয় মাছের বাজারে। শুভ জ্যান্ত মাছ রেখে দেয়।জানে রবিবার তিতির আসবে।মাছের লাফানো ওর দেখতে ভালো লাগে।ও মাছকে ' জি জি' বলে।পমফ্রেটকে বলে ' কমেট'!রুইকে বলে ' ছুঁই'! আশপাশের সকলেই মজা পায় ' তিতিরদিদি'র কথায়।
বাজার করে ফেরার পথে গলির মুখে ঢুকতেই চমক।পাগলীটা ওর ছেলেটাকে নিয়ে বসে। খাবার চাইছে সকলের কাছে।পাগলীর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ও।তিতিরের দিকে তাকালো।মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে।সব বুঝতে পারলো তমাল।তমাল মেয়ের চোখের তারায় এক নতুন পৃথিবী দেখল।ঐটুকু মেয়ে বুঝতে পেরেছে অপরের কষ্ট! খুব শীতে ছোট্ট বাচ্চাটার কষ্ট ! হয়তো আর একটা সোয়েটার কিনে দিতে বাবার আর্থিক চাপ হবে,এটা ভেবেছে ও ! তাই বাবাকে সত্যিটা বলেনি। বাবার কম আয়ের কথা ওতো প্রায়ই মায়ের চিৎকারে শুনতে পায় ! ওর চোখের দিকে তাকালো তমাল। বাঁচার ইচ্ছাটা জোড়ালো ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে যেন তমালের বুকের বেলাভূমিতে।চাপা দিয়ে রাখা কান্নারা হঠাৎ ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে যেন ! তিতিরের হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলল তমাল এক সবুজ আলোর বৃত্তের দিকে।
**************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন