বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

গল্প * কিন্নর রায়



চান্দ্রমহিমা

কিন্নর রায়


সদ্য রোঁয়া ওঠা গোঁফ যেমন হয়, তেমনই  কোনও বাঞ্ছিত আকাঙ্ক্ষা ফুটে বেরোয় তার আচরণে এই লকডাউনের মধ্যে। বৃষ্টি নেমে এলে সমস্ত চরাচর অন্ধকার হয়ে যায়। তখন এক - আধটা বিদ্যুৎরেখা সারসের পাখা হয়ে উড়ে যেতে চায় ধূসর নীল আকাশের বুকে। সন্ধের অন্ধকার নেমে এলে তার মনের মধ্যে মৃত্যু জোড়া মুনিয়া হয়ে লাফালাফি করে। নাহ,শকুন নয়, চিল নয়, ঈগল নয়, শঙ্খচিল নয়।মৃত্যু তার কাছে জোড়া মুনিয়া এবং সেই দুই পাখির রঙ সোনালি । মৃত্যুকে স্বর্ণাভ ভাবার মধ্যে কোনও কি বাল্যস্মৃতি উঁকি দেয়, তার মধ্যে? ঘাটলা বাঁধানো পুকুরে সমস্বর  প্রকৃতির মধ্যে কোনও এক অতি ফর্সা নারীর স-রোম পায়ের গোছ, চ্যাটাল পায়ের পাতায় শুয়ে থাকা রসমঞ্জির, যেন কোনও উর্বশীর হাসি।


             উর্বশী, মেনকা, রম্ভা -- এসব নাম সে জেনেছে কৈশোরকালেই, অথচ সঘন বিদ্যুৎরেখায় পুরুষাঙ্গ স্ফীত ও উচ্ছ্রিত হয়ে ওঠে নারীর বাদামী, কালো ফর্সা স্তনাভাস  মনে পড়লে হাফপ্যান্টের নীচে চামড়া'র মাংসের সতেজ পাইপগান,যা দিয়ে সে এখনি ফুঁড়ে দিতে পারে যাবতীয় কিছু। সন্ধ্যার অন্ধকারে শিরশিরে বাতাস বয়, চাঁদ তখন ক্ষয়ে যাওয়া রুপোর নৌকা " ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে  " মান্না দে-র গলায় এই গান শুনেছে সে জীবনের কবুতর বেলায়। তখন বক বকম বক বকম করার সময়। যে নারী দেখে, তাকেই  ভাল লাগে তার। গমরঙের উজ্জ্বল উরু অথবা পাকা ধানী রঙের স্তন এবং দড়িবাঁধা ইজেরের নীচে লুকিয়ে রাখা খরগোশ-খুকি এবং তার রোয়াঁদার সৌন্দর্য এসবই সে দেখেছে জীবনের নানা দাঁড় ও খাঁচায়। বুকের গভীরে জোড়া মুনিয়া লাফিয়েই চলে এক দুই তিন, তিন দুই এক....   সে বুঝতে পারে উজ্জ্বল মুনিয়ারা আরও উজ্জলতর হয়ে উঠছে। দম দেওয়া দেয়াল ঘড়ির কাঁটা ভেঙে গেলে পেন্ডুলামও থমকে যায়। পেতলের পেন্ডুলাম কাছের খোপের ভিতর কেমন যেন পাগলামন্ত্রে দুলতে থাকে। বুকের ভেতর বসা সোনালি মুনিয়ারা দু'জনে দু'দিক থেকে এসে বসে পেন্ডুলামের ওপর। কত দূরে ছিল চারটে শালিক। নির্জন কিন্তু মৃত্যুময় নয়। তবু মুনিয়াদের দিকে তাকিয়ে শালিকদের  চোখে কেন যেন জল আসে। এই জল কি  মৃত্যুরেখা? সে বুঝতে পারে না। লকডাউনের মধ্যে কত কত নতুন শব্দ শেষ শিখে নেয়। কোয়ারেন্টাইন আইসোলেশন ডেল্টা অমিক্রণ বুস্টার ডোজ আরো কত হাবিজাবি কথা আলতু ফালতু জিনিস তাকে  বঁড়শি-বেঁধা করে ।


               আপনি কোভ্যাকসিন না কোভিশিল্ড ---এটাই যেন তার একমাত্র পরিচয়। স্পুটনিক নিলেন কি? রাশান এই ডোজ এখন ইন্ডিয়াতেও পাওয়া যাচ্ছে।


               ধুর মশাই রাশিয়া, সেই আগের রাশিয়া আছে নাকি! তখন তো সোভিয়েত ইউনিয়ন, লাল পতাকা।


              এই সব ব্যাপারেই আপনার লাল লাল আর লাল। ওটা একটা অসুখ মশাই আপনার। সব ব্যাপারে লাল খোঁজা। লালেদের সেই দম নেই আর।দেখছেন না চারপাশে, তবু আপনি লাল?


             সে আর হতে পারলাম কই? আমি মধ্যবিত্ত, কারলনের গদিতে শুয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি।


              ও বিপ্লব ফিপ্লব  আর হবে না। ওসব শিকেয় তুলে রাখুন। পুতিনটা একটা জোচ্চোর, ক্ষমতালোভী। দেখছেন না, যেন তেন প্রকারেন বছরের পর বছর গদি আঁকড়ে  থাকছে। না মরলে গদি যাওয়ার কোনও  সম্ভাবনা নেই।


               দেখছেন না ইউক্রেনে কী করছে, বোম মেরে মেরে মাঠ করে দিল একেবারে।  আর চীনের ওই লোকটা সেওতো গদি আঁকড়ে আছে থাকবে আমৃত্যু! তিনি আবার লাল না ঈ? এই লালের নমুনা!


                সন্ধ্যার অন্ধকারে সে আবারো বুনো শুয়োরের দাঁত হয়ে যাওয়া ভাঙা চাঁদকে দেখে। চাঁদের গায়ে এখন কোনও  কুয়াশা নেই। জ্যোৎস্না বড় মায়ালু। কাঁটা ভাঙা ঘড়ির ভেতর থেকে পেন্ডুলাম আঁচড়ানো মুনিয়ারা উড়ে যাচ্ছে ত্রিভুবন অন্ধকার চান্দ্রমহিমার দিকে। সে এবার বড় করে শ্বাস নিতে চাইল।


****************************************************************************



কিন্নর রায়

বাংলা সাহিত্য জগতে কিন্নর রায় একটি অতি পরিচিত নাম। সুদীর্ঘকাল তিনি সাহিত্যসৃষ্টির কাজে মগ্ন রয়েছেন। তাঁর ভাষাশিল্প পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। লুপ্ত জীবিকা লুপ্ত কথা এবং দেশভাগ থেকে নকশালবাড়ি সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর দুটি গ্রন্থ বিগত বইমেলায় নিঃশেষিত হয়েছে। তাঁর 'প্রকৃতি পাঠ ' বইটি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাম্মানিক বাংলা)পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন