দখল
শতদল মিত্র
এখন সকাল আটটা, এই সে সময় যখন অমিত তার ঘুম ভাঙায় এবং চোখ না খুলেই কিছুক্ষণ মটকা মেরে অবৈধ সুখ ভোগের সময় তার, কেননা সকল জগত যখন ভীষণভাবে জেগে ও কর্মচঞ্চল, তখন এ ভাবে শুয়ে থাকাটা অসামাজিকই শুধু নয়, অবৈধও—এ বোধ তাকে পীড়িত করলেও, সে, অমিত নাচার, যেহেতু উঠে সে করবে টা কী? এবং তার এই মটকামারা অবস্থান পাঁচ মিনিটও হতে পারে, কিংবা পনের মিনিট—সেটা নির্ভর করে সে সকালের সে মুহূর্তে তার মনের গড়নের ওপর। আর তার এই অবস্থানটা আমি বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি। ওহ! বলতে ভুলে গেছি যে এ বাড়িতে অমিতের সঙ্গী বলতে কিছু মাকড়শা, আরশোলা, দুটো টিকটিকি, ও তার একমাত্র স্বজন কাম বন্ধু এই আমি! আমার নাম? সেটা জানতেই পারবেন পরে, কেননা আমার আসল নাম ভুলিয়ে অমিত আমাকে বিভিন্ন নামে ডাকে। অবশ্য এ অবস্থা যে শুধু আমার নামের ক্ষেত্রেই তা বললে সত্যের অপলাপ বই অন্য কিছু হবে না, যেহেতু এ বাড়ির অধীশ্বর অমিতই প্রতিদিন নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করে এবং সে নামটা তার সে দিনের ঘুমভাঙা সকালের সেই মুহূর্তের তার ঝিমধরা মনই ঠিক করে দেয়, সে দিনের আলো-হাওয়ার গুণে। যেমন এ মুহূর্তে সে, অমিত চোখ বন্ধ রেখেই বুঝতে পারে যে কালকের ঘন রাতের ঝড়ের আবেশে এখন আকাশ মেঘলা এবং সারা দিনমানই তা অংশত মেঘলাই থাকবে, যা যাই-যাই শীতে বেশ উপভোগ্য আবেশেরই। হ্যাঁ, এই একটা গুণ অমিতের দুর্দান্ত! যাকে বাহবা দিতেই হয়। যা হোক, যে কথা হচ্ছিল সে কথাতেই ফিরে যাওয়া ভালো সরাসরি, অযথা গৌরচন্দ্রিকা না করে। আমি ঠিক বুঝতে পারি এই মেঘলা দিনে ও আজকে ওর নাম রেখেছে—চব্বিশের পাঁচ। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই এতে, কেননা গ্রীষ্মের এই পড়ে পাওয়া মেঘলা দিনে চা বানানো, খিচুড়ি রাঁধা, চান করা, দুবেলা খাওয়া ইত্যাদি প্রভৃতি কাজে ও নিজেকে খুব জোর পাঁচ ঘণ্টাই ব্যস্ত রাখবে আর বাকি সময়টা ল্যাদ খাবে!
--পাতলু! ঘুম ভেঙেছে তোর? শোন আজ আমার নাম চব্বিশের পাঁচ।
হ্যাঁ, আজ আমার নাম পাতলু, গতকাল ছিল বৃত্ত, তার আগের দিন মোটু, তরশু দিন ছিল রম্বস। যেমন আজকে ও ওর নিজের নাম দিয়েছে চব্বিশের পাঁচ, গতকাল খুব গরম ছিল বলে চব্বিশের ষোলো, পরশু ওর নাম ছিল চব্বিশের সাড়ে বারো। তবে ডাকার সুবিধার্থে যেমন পঞ্চানন হয়ে যায় পঞ্চু, বীরেন্দর হয়ে যায় বীরু, তেমনই আমি শুধুই ওকে ষোলো, সাড়ে বারো বা পাঁচ বলেই ডাকি।
--সেই কবে, সূর্য ওঠা থেকে জেগে বসে আছি আমি। পাতলা, মনে আমি প্রতুত্তর করি।
--আজ তো সূর্য ওঠার কথা নয় পাতলু! সাত সকালে কেন মিথ্যে কথাগুলো বলিস?
--আরে, সূর্য দেখা না দিলেও তার জেগে ওঠাটা ঠিকই বোঝা যায়। চোখ মটকে তুই কি টের পাস নাই নাকি!
আমাদের নিজেদের কথা চালাচালির ফাঁকে অমিত, আজকের পাঁচ যে, ওঠে এবং চোখ বন্ধ করেই, যেহেতু ওর দৃঢ বিশ্বাস যে ঘুম ভাঙা সকালে আমার মুখ দেখলেই নাকি ওর দিন খারাপ যায়। ও চোখ বন্ধ করেই হাতের আভাসে চেনা পথ ধরে বারান্দায় যায়। মাথা উঁচিয়ে আকাশ পানে লক্ষ রেখে চোখ খোলে সে। আজ না হয় মেঘলা, তবুও বারান্দাটা পূবদিকে হলেও আমরা কোনও দিনই সকালের সূর্য দেখতে পাই না, কারণ সামনের দু-দুটো চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ির আখাম্বা দাঁড়িয়ে থাকা।
যাই হোক ও, অমিত বা আজকের পাঁচ যে, আকাশে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্তবগান গায়, নিত্যি অভ্যাসে—হে নীল, তুমি আমার প্রণাম নাও। যে অভ্যাসে কাল আকাশের নাম ছিল শূন্য, পরশু বোসন... কোনও একদিন প্লাজমা বা কোয়ান্টাম। এরপর সে, আজকের পাঁচ যে, সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির সবেধন দুটো দেওদার গাছের পানে চোখ ফেরায়, আদর দেয়—২৪ x ৭, ভাল থেকো তোমরা। যেমন কালকে দিয়েছিল ৩৬৫ নামে, পরশু ১২, তরশু কী খেয়াল কে জানে গাছ দুটোকে ঘুসপৈঠিয়া নামে ডেকেছিল।
এরপর সে, অমিত বা পাঁচ, যেমন কাল, কিংবা পরশু বা গত যে কোনও দিনের মতো আজও একই নিয়মে কলঘরে ঢোকে, মুখে চোখে জল দেয়, দাঁত মাজে, ওয়াক-ওয়াক শব্দ তুলে জিভ ছোলে। তারপর সে অন্যান্য দিনের পুনরাবৃত্তিতে গামছায় মুখ মুছে আদ্যিকালের কালো আবলুস ড্রেসিং টেবিলের পারা-ওঠা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে মুখ ভেংচায়, যেমন সে প্রতিদিন করে আসছে বছরের পর বছর। এবং এই একমাত্র কাজ যা সে মন দিয়ে করে। আর সত্যি বলতে কী আমার তা গা সওয়া, কেননা এ আমার নিত্যিদিনের পাওনা। আমার এ সকল ভাবনার মধ্যেই আমরা চা বানাই। অনেক কালের জমা ময়লার প্রলেপে ততটা দৃশ্যমান না হওয়া কারুকার্যময়, ছত্রিঅলা আবলুস কালো সেগুন কাঠের পালঙ্কে পা ঝুলিয়ে বসি ও পাউরুটি ডুবিয়ে চা খাই।
সুরুত্ করে চায়ে ভেজা পড়ো-পড়ো নরম পাউ রুটির টুকরোকে জিভে টেনে নিয়ে ও বলল—কালকে রাত্রে ওরা এসেছিল। আওয়াজ পেয়েছিলিস?
--পেয়েছি বইকি। ছাদের সিঁড়ির দরজাটা ভাঙারও চেষ্টা করেছিল। একটা পাল্লা একটা কবজা ভেঙে ঝুলছেও দেখতে পেলাম। একটু থামি আমি, চা টানি জুত্ করে জিভ ও ঠোঁটের যুগ্ম কায়দায়। তারপর আবারও বলি—তবে মনে হল সব কিছু নিতে পারেনি ছাদের। তাড়াহুড়োতে একটা জিনিস ফেলে গেছে বোধহয়। কুড়িয়ে রেখেছি। রূপোর একটা পিকদানি।
--তাহলে আজ কালোয়ার এলে দেখাতে হবে তো? রূপোর তো এখন মেলা দাম!
চা শেষ করে বিড়ির পোঁদে ফু দিয়ে আগুন ধরাতে ধরাতে বলে সে। আমি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বিড়ি টানতে থাকি। এরপর আমরা রান্না ঘরে যাই, খিচুড়ি বসাই। একবার নিচে নেমে দু’জনে দুটো ডিম কিনে আনি।
--আহ-হা! ডিমভাজা, খিচুড়ি! যা জমবে না! আনন্দে হাত ঘষে সে।
বাড়ির সামনের ছোট মুদি কাম মনোহারি দোকানটাই আমাদের খবরখানা, সেই খবরখানা থেকেই শুনতে পাচ্ছি ক-দিন ধরে আমপান আসছে, আমপান আসছে! সামনের ফ্ল্যাটের এক গ্রাম্ভারি কালেজিয় মাষ্টার, করোনাতঙ্কে এ দোকানের দায়েপড়া খদ্দের যে আপাতত, একদিন ক্লাস নেওয়ার ঢঙে নাছোড় শুনিয়েছিল সকল খদ্দেরকে দু-গজি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে যে, আমপান মানে নাকি—আকাশ, থাই না ফাই কোন এক দেশের আদরের নাম! ঝড়ের নাম আকাশ! আদিখ্যেতা যত!
যা হোক আসছে আসছে করে আমপান এসেই পড়ল একদিন ঘাড়ে, যার জানান কাল থেকেই দিচ্ছিল সে মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস, সঙ্গে বৃষ্টির নাছোড় সঙ্গতে এবং আজই নাকি সে দুপুরে এ শহরে আছড়ে পড়বে। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির সুরের জাদুমায়ায় কিনা কে জানে, আজ সকালে উঠেই কুলীন অমিত চোখ না খুলেই ঘোষণা করল — শোন বিন্দু, আজকে আমার নাম চব্বিশের জিরো। বুঝলাম আজ আমার নাম বিন্দু এবং এও জানকারিতে এলো যে, সে অমিত আজ সারাদিনই গাত্রোত্থানরহিতই থাকবে, সেহেতুই সে আজ জিরো। সারাদিনমান ল্যাদ খাবে সে। মানে নো খাওয়া-দাওয়া, অবশ্য বনেদী রক্তের খেয়াল—মাঝে উঠে চা-মুড়ি খেলেও খেতে পারে, যেহেতু চটজলদি খাবার বলতে ওটুকুই সম্বল, যদিও চাল-ডাল-ডিম ঘরে মজুত ঝড়ের কথা মাথায় রেখেই, কেননা পিকদানি বাবদ কিছু টাকা আপাতত হাতে আছে আমাদের। সবটা এখনো শেষ হয় নাই।
দুপুরের পর থেকেই ঝড়ের দাপট বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে। আমি ভাঙা জানলা দিয়ে আনমনে দেখতে থাকি জলে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে দেওদার গাছদুটোর মাটিতে নুয়ে পড়া এবং খাড়া হওয়া আবার নতুন করে নুয়ে পড়বে বলে। অমিত আর ওঠে না, শুধু সন্ধ্যে নাগাদ একবার ওঠে জল বিয়োগের জন্য এ বুলি ঠোঁটে ঝুলিয়ে —শালা, বৃষ্টির বাতে পেচ্ছপও পায় ঘন ঘন! ঝড়ের দাপট ক্রমশ বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে—সেই সঙ্গে বৃষ্টির অঝোর ঝরে যাওয়া আর বাড়তে বাড়তে সে আমপান বা আকাশ তার সব শক্তি নিয়ে যেন আছড়ে পড়ে সন্ধে নাগাদ, যেন বা আমপান নামের মান রাখতে আকাশই ভেঙে পড়ে মাটিতে, বাতাস গুঙিয়ে ওঠে অপ্রাকৃত এক আক্রোশে। আর ঠিক সে সময়ে বিদ্যুত্ চলে যায়, ঘর-বার আঁধারে ভিজিয়ে, তবুও আকাশ যেন কী এক দৈবী আলোয় ভরে থাকে, যে আলোয় আমার চোখে স্পষ্ট ফুটে ওঠে রাস্তার জমা জলের ছিলছিলে ঢেউ, পাড়ার সবেধন দু-খানি সবুজের বার বার নুয়ে পড়া আর আর দেখতে না দেখতে সামনের ছোট্ট দোকানটির বারান্দার টিনের ছাউনিটির দোল খেতে খেতে আচমকা উড়ে যাওয়া।
--বুঝলি বিন্দু, এমন ঝড়-বাদলের পরশ গায়ে মাখতে হয়। তাতে শুভ হয় মানুষের। নইলে পরের জন্মে কেঁচো হয়ে জন্মাতে হবে।
আমার প্রাকৃত ঘোর থেকে চেতনে ফিরতে একটু সময়ই লাগে যেন, যদিও ক্ষণিকই তা, ভাবি ও কী এই ঝড়-জলে বাইরে বেরবে নাকি! কিন্তু না, আমাকে চমকে দিয়ে শরীর থেকে লুঙ্গি ও গেঞ্জি খুলে ফেলে দু হাত তুলে ঝাড়া উলঙ্গ সে, অমিত বা আজকের জিরো ঘরের মধ্যে বন বন ঘুরতে থাকে এই সঙ্গীতের সঙ্গে-- এই মানব জনম আর কী হবে... ।
আর এই সঙ্গীতের সাথ সঙ্গতেই কিনা কে জানে, ঝড়ের দ্বিতীয় ঢেউ যেন আছড়ে পড়ে মাটির বুকে আর আমাদের পুরাণ এই বাড়ির ছাদের ওপর-- গুমগুম বিকট এক আওয়াজ তুলে।
--শুনছিস বিন্দু। ওই ওরা আবার এসেছে। স্থানু ও উলঙ্গ সে ছায়া বলে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একমাত্র গৃহখানির, আমাদের মানবের অহঙ্কারী আশ্রয়ের একদিকের একটি দেওয়াল ধসে পড়ে, ঘর ভাসিয়ে।
--বিন্দু, আর দেরি না। শিগগির চল—ওই ওরা আমাদের ধরতে এসেছে! এই বলে সে, অমিত আমার হাত ধরে ছুটে নেমে আসে বাড়ির বাইরে... ছুটতে থাকে নির্জন-অন্ধকার রাস্তা ধরে, ছুটতেই থাকে, ছুটতেই থাকে... আমার জলে ভেজা হাত কখন যেন ফসকে ছেড়ে যায় তার হাত থেকে... ছুটতে থাকে আমার যমজ, আঁধার চিরে ছায়াহীন, যেন বা এক অতিপ্রাকৃত আশ্রয়ের খোঁজে এই নিঃসীম আকাশের নিচে। অসহায় আমি বিন্দুবত্ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি তার, অমিত বা আজকের জিরোর ক্রমশ ক্ষুদ্র হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া... হয়তো বা, তার জন্মের ওপারে, যেহেতু সে তো জন্মাতেই চায়নি, তাই নিজেকে সে কোনোদিনই ভালোবাসতে পারেনি...
সে সময় মাটি মোচড়ানো এক আকাশ দামাল ঝড় ও বাদলে আমাদের পাড়ার সবেধন দুটি সবুজ প্রাণপণে মাটির আরও আরও গভীরে শেকড় চালিয়েছিল, প্রাণের আকাঙ্খায়।
**********************************************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন