বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

কবিতাগুচ্ছ * কল্পোত্তম



কবিতাগুচ্ছ * কল্পোত্তম


দেশান্তর 


গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলে

দৌড়াবোই,

মনে আগুন লাগিয়ে দিলে

হয়ে যাবো চুপচাপ।


ওপারের নদী-পাহাড় মাঠ-ঘাট

দেখতে হয় এপার থেকে।


করিম চাচার যে মেয়েটা ভালোবাসতো

সে এখন, মনের বিরুদ্ধে 

ভালোবাসে অন্য কাউকে। সে এখন

উড়ু উড়ু ঘরনি হয়ে ভাবে

একটা বন ও একটা মনের মাঝে

যেদিন পার হয়ে গেল আন্তর্জাতিক রেখা

বন্ধ হয়ে গেল একে অপরকে দেখা। তারপর

এপারের মোরগের ডাক ওপারে যায়

মোরগ গেলে  

ফেরে না।


করিম চাচার মেয়ে 

যে চুড়িটা ফেলে গিয়েছিল মতি চাচার ঘরে

কালের কণ্ঠ হয়ে 

সে চুড়িটা রয়ে গেছে আজও


কানের ভেতর তার শব্দ রয়ে গেছে

চোখে রয়ে গেছে, চৈত্রে বলিষ্ঠ হওয়া আমের মতো

করিম চাচার মেয়ের অবয়ব।


 ২ 

ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়াতে নেই।

ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়ালে

ভাঙা মনে হয় নিজেকে,

ভাঙা মনে হয়

নিজের দিকে থাকা সব কিছুই।


আরও একটা ভাঙন শুরু হয় অলক্ষ্যে 

সীমানা অতিক্রম করা ভাঙন।


বন পুড়লে সবাই দেখে

মন পুড়লে দেখে না 


মনের পুড়ন দেখতে হলে

পোড়াতে হয় নিজেকেও।



পথেই পথের বাঁক


রাস্তায় শিখেছি হাঁটতে,

এখনও শিখিনি আমি রাস্তা ডিঙোতে।


চৌরাস্তার মাথায় পড়লে পারি না বুঝতে

কোন্ দিকে যাবো? অথচ প্রতিটা রাস্তাতেই 

চৌমাথার মুখোমুখি হই

একবার না একবার, এইসব নিরিবিলি চৌমাথায়

হিসেব কষতে বসি। কষতে কষতে দেখি

বাকিরা ঠিক কিভাবে এগোই।


কোনো কোনো পথচারী হেঁটে যায় নির্বিকার,

প্রতিফলন, প্রতিসরণের কথা মাথায় না রেখে

আলোকবর্ষ পথ ছুটে আসা আলোও তো

হতে পারে লক্ষ্যহীন। 


কোন্ দিকে যাই আমি?

চোখের সামনে দেখি যত পথ

সবই তারা বড়োই রঙিন।








কৃষিতন্ত্র 

এসেছো তুমি।

এবার নামব আমি ক্ষেতে,

লাঙলের ফলায়

একে একে উপড়ে দেব

ফড় নিয়ে উঠে আসা

আগাছার আগাপাশতলা।


শেকড় গভীরে, জানি

তাদেরও পরস্পর সংযোগ দৃঢ়।


আমার ফালের ডোগা

আরো বেশি শক্তিশালী

আরো বেশি ছোঁচালো বানিয়ে

মূল শেকড়ের মাঝে ঢোকাবো এবার।

দেখি, পড় পড় শব্দ করে ছিঁড়ে কি না

আমার চাষের জমি ছাড়ে কি না

পুঞ্জিভূত শেকড় তাদের।


এসেছো তুমি।

এবার নামব আমি ক্ষেতে

আগাছাকে ফেলে দিয়ে আলপথে

নতুন চারার উপযোগী

করে নেব আমাদের ক্ষেত

চার বাহু মিলে।


 ২ 

কঠিন মাটিকে আলগা করার কৌশল

নিপুণভাবে করায়ত্ব করতে পেরেছো,

করায়ত্ব করতে পেরেছো

বীজ থেকে অঙ্কুর বের করে আনার

বীজমন্ত্রের উচ্চারণ কৌশল।

ইঁদুরের সঙ্গে বসবাস করেও

তার যাপন কৌশল থেকে

নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছো অনায়াসে।


যারা কঠিন করে মাটিকে

তুমি তাদের দলে নও

যারা খণ্ড করে বীজকে

তুমি তাদের দলে নও

যারা তৈরি করে বেনোজল

তুমি তাদের দলেও নও,

তুমি তাদের দলে, যারা

উপড়ে ফেলতে পারে

অজস্র অঙ্কুরের মাঝে লুকিয়ে থাকা আগাছা

যারা ঘুম ভাঙাতে পারে

শত শত বছর আগে ঘুমিয়ে পড়া  

সম্ভাবনাময় বীজের ঘুম।


৩ 

জমিকে উর্বর করার যতকিছু উপায়

কৃষিকাজ করতে করতে

জমির কাছেই শিখে নেয়

কৌশলী কৃষক। জেনে নেয় জমির বিন্যাস

জল ধারণ ক্ষমতা, উৎপাদন সম্ভাবনা।

তারপর কর্ষণে কর্ষণে আরও বেশি উর্বর

আরও বেশি উৎপাদনশীল, মোলায়েম

করে তোলে মাটিকে।


কৃষিজমির মাটির অধিকার

আমারও নেই, তোমারও নেই

কৃষকের তৈরি মাটি কৃষকেরই।

শিল্প সম্ভাবনা থাকলেও

কৃষিজমি কর্ষিত হোক

কৃষকের নিজস্ব ইচ্ছায়।


সিক্ত হোক মাটি

হোক বীজ বপন

উপযুক্ত রোদ বাতাসে

বেড়ে উঠুক মনঃপুত অঙ্কুর


বেড়ে উঠুক সামাজিক, প্রশাসনিক দায়

মাটিকেই নিরঙ্কুশ সুরক্ষা দিতে।


ঘাম আর কৃষকের কোনো রং হয় না, তবু

কারা যেন হাঁটাতে চায় কৃষকদের

রাজধানী মুখো রাস্তায়

মেলাতে চায় কোনো না কোনো রঙে।


ধুলো-মাটির আস্তর লেগে থাকা কৃষকের গায়ে

সেইসব কোনো রঙই মানায় না।


আকাশ আর মাটির মধ্যাবরণের 

রং পাল্টানোর জাদুকাঠি

কৃষকের হাতে থামিয়েছে যে

সে জানে, কৃষক এক স্বয়ং সম্পূর্ণ অধ্যায়

তাকে মঞ্চস্থ করার কলা

রয়েছে শুধু ঘামে।

 

***********************************************************




 কল্পোত্তম

নিরলস সাহিত্যচর্চায় মগ্ন তরুণ কবি কল্পোতম । একটি উপন্যাস সহ ইতিমধ্যেই তিনি লিখে ফেলেছেন পাঁচটি গ্রন্থ । কাব্যগ্রন্থ  *  সাতরঙা পাড়  *  বত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক* ঝুমুর সঙ্গীতের বই  * রিঝে রঙে  উপন্যাস  *  পেইন্টেড ট্রেন  গল্পগ্ৰন্থ  *  স্বপ্নসিঁড়ি




1 টি মন্তব্য: