বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

মুক্তগদ্য * কানাইলাল জানা




২০২২ আগরতলা বইমেলায় 

কানাইলাল জানা  

পর্ব-১


যেখানেই যাই আমার যাত্রা পথের মূল মন্ত্রঃ 'পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়'। মূল উদ্দেশ্য তো আছেই তার আগে দেখব পথের দু'ধারের দৃশ্য। গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত  দিল্লি আন্তর্জাতিক বইমেলাসহ বেশ কিছু সফর যেভাবে বাতিল হয়েছে তার ফলে আগরতলা বইমেলায় (২৫/৩/২২ থেকে ৫/৪/২২) যে যাচ্ছি তা আর বড় মুখ করে বলার মতো কিছু ছিল না। তারওপর বামেদের ডাকা ধর্মঘট ২৮ ও ২৯ মার্চের মধ্যেই পড়ল আমার ট্রেন যাত্রা যদিও মন বলছিল 'এবার হবে হবে'। ২৯ মার্চ মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৩৫  কাঁটায় কাঁটায় ছাড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা  এক্সপ্রেস। শেয়ালদা থেকে সাড়ে পনেরশ কিমি ছুটবে আগরতলা অব্দি। আড়মোড়া ভেঙে প্রথম বিরতি দক্ষিনেশ্বর স্টেশন। কিছুটা  উঁচুতে দাঁড়িয়ে পড়তেই ভেসে ওঠে যে সব দৃশ্যঃ কোলাহলহীন গঙ্গার শ্রান্তিহীন বয়ে চলা, কালী মন্দিরের ঘাটে পুণ্যার্থিদের আয়েশি স্নানপর্ব, মন্দিরে ধীর লয়ে ঘন্টা ধ্বনি,কী অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্য ও গাম্ভীর্য পূর্ণ দক্ষিনেশ্বর মেট্রো স্টেশন! দিল্লিসহ আর কোথাও  যা নেই সঙ্গে স্কাই ওয়াক,  ওপাশে বাস লরি ও রেলের জন্য পৃথক রাস্তা, বিবেকানন্দ সেতু, একের পর এক উড়াল পুল, আকাশ ছোঁয়া আবাসন, ঝাঁ চকচকে বিখ্যাত কিছু স্কুল বাড়ি। অগণন মানুষের আগমন ও প্রস্থান। সব মিলিয়ে কী মনে হচ্ছে? কলকাতা শহর ও শহরতলী মিলিয়ে এই মূহুর্তে সুদৃশ্যে ঘেরা সকাল সন্ধ্যা ব্যস্ততম এলাকাটির নাম দক্ষিণেশ্বর। 

ডানকুনি ছাড়িয়ে হুগলি ও বর্ধমান জেলার খেতের উজ্জীবিত সবুজ কানে কানে বলছে 'ক্লান্তি নয় আছে শুশ্রূষা'। পরপর যে প্রাকৃতিক রোষ ঘুম কেড়ে নিয়েছিল আলু চাষিদের, 

এখন অনেকটা আশ্বস্ত। এতো সকালে বর্ধমান জংশনে নেই নকল মিহিদানা ও সীতাভোগের

ডাকাডাকি কিন্তু প্রবলভাবে আছে  হকারদের হাঁকাহাঁকি। অনেক গুলো ঢাল' ধানের গোলা অঞ্চল ও অন্যমনস্ক অজয় পেরিয়ে ঘটাং শব্দে ট্রেন বসে পড়ল বোলপুরে। খুব কম এসেছি এইসব বিখ্যাত জায়গায়। দেখছি স্টেশনের পশ্চিম দিকটািও সংগ্রহশালা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে পর্যটকদের জন্য অপেক্ষমান। অনেক দিন পর আজ আবার ট্রেন চলছে সময়ের আগে আগে। তাই থমকে গেল 'প্রান্তিক' এ। আর আমারও মনে পড়ল ভগীরথ মিশ্রের সেই গল্পটা, অনেকদিন আগে 'দেশ' পত্রিকায় বেরিয়েছিল - 'সমুদ্র যাত্রাঃ তিলজলায় বাড়ি করে নতুন দম্পতির খুব ইচ্ছে হল পুরী যাবেন। ঘর সংসার পাহারা দেবে ফাই ফরমাস কাটা রাজা। তাঁরা বেরিয়ে পড়তেই রাজাও বেরিয়ে পড়ে পাড়ার রুমকির খোঁজে যে বাসন মাজা কাচা ও মোছার কাজ করে এই বাড়িতে। রাজা তাকে বোঝায় দাদা বৌদি যাচ্ছে পুরীর সমুদ্রে তো আমরা যাব আমাদের সমুদ্রে। গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রুমকি আর রাজা তাকে বোঝায় আরে তিলজলার যে বিশাল ভেড়ি তার ঝকঝকে ফর্সা জল, ছোটো ছোটো ঢেউ সেটাই তো আমাদের কাছে 'সমুদ্র'। দুটো ডিঙি নৌকোও বাঁধা থাকে এক কোণে। এক মাঝিকে রাজি করাব আমাদের নৌকো বিহারে। তারা আনন্দ স্ফূর্তিতে মাতবে, আমাদেরও পিকনিক হবে ঘরের ভেতর নয় দাদাদের বাইরের উঠোনে। আমি বাজারহাট সারব তুমি রাঁধবে। রুমকি আরো চোখ বড় করলে রাজা বলে তোমাকে কিছু দিতে হবে না, যা দিয়ে গেল এবং যা আছে তাতেই হবে। এবার রুমকি মুখ খোলেঃ 'আমি তা বলছি না আমরা এক সঙ্গে নৌকো বিহার করলে লোকে কী ভাববে?'  রাজার উত্তর -'ভাবুক না দূর থেকে বড় জোর ভাববে আমরা প্রেমিক প্রেমিকা অথবা স্বামী স্ত্রী'। 

প্রান্তিক স্টেশনের উভয় পাশেই দেখছি আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর সাজান গোছানো। আমার মেয়ে ও তার মা মিলে এখানে রিসট বুকিং করেছে বেড়াতে আসবে। শুনে বলি আমাকে বাদ দিলে কেন ফ্যামিলি টুর থেকে? তখন তাদের ঝটিতি প্রশ্নঃ 'আমাদের বাদ দিলে কেন আগরতলা যাওয়ায়'? বলি তোমরা যে যার কাজে ব্যস্ত, তাছাড়া কষ্ট দিতে চাইনি তোমাদের, শুধু যেতেই পুরো  দুদিনের ট্রেন জার্নি। গল্পটা ছিল এজন্যই। বিকল্পের সন্ধানে। 

সাঁইথিয়া জংশন ছুঁতেই শোষক পোকার মতো টেনে ধরল আমার বিষন্ন স্মৃতিকে। যখন সিউড়ি সংশোধনাগারে কর্মরত স্থির করি ঝাঁঝাঁ অন্ডাল হয়ে যে এক্সপ্রেস ট্রেন ভাগলপুর যায় এক শীতে সে ট্রেনে করে সেখানে যাব কিন্তু তার আগেই এই সাঁইথিয়া জংশনে এই ঝাঁঝাঁ এক্সপ্রেস উঠে পড়ল বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা অপর ট্রেনের ঘাড়ে। বিরাট অ্যাক্সিডেন্ট। ব্যস আর যাওয়াই হলনা বাংলা সাহিত্যের 'তীর্থভূমি' ভাগলপুর। 

বীরভূমের মতো লাল মাটিও শস্য শ্যামলে পরিপূর্ণ অসময়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় অত্যাচার হচ্ছে না তো মা বসুন্ধরার ওপর? ঝাড়খন্ডের

'পাকুড়' আসতেই দেখি প্রথমেই বাংলা হরফে লেখা স্টেশনের নাম যা পাওয়া যবেনা বিহারের বাংলা লাগোয়া স্টেশন গুলোতে। পাকুড় এলে মনে পড়ে স্বাধীনতার আগে সেই ভয়ংকর ঘটনার কথাঃ

 পাকুড় জমিদারের দুছেলে বিনয়েন্দ্র চন্দ্র পান্ডে ও অমরেন্দ্র চন্দ্র পান্ডে। তাদের বোন বনমালা।  হাওড়া স্টেশন থেকে পাকুড় ফেরার পথে ট্রেনে ওঠার সময় ভীড়ের মধ্যে নাবালক অমরেন্দ্রের বাঁ হাতের বাজুতে কিছু একটা বিঁধলে এক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায়। পরে জানা যায় কেসটি সেপটিসেমিয়া অর্থাৎ জীবাণু আক্রান্ত রোগ। পরে প্রকাশিত হল সাবালক হওয়ার আগেই অমরেন্দ্র সম্পত্তির ভাগ চাইলে নানা নেশাগ্রস্ত বড়ভাই বিনয়েন্দ্র পাকুড়ের হাতুড়ে ডাক্তার তারানাথ ভট্টাচার্যকে বম্বে পাঠিয়ে সেখানকার হফকিন ইনস্টিটিউট থেকে আর্থার রোড ইনফেকশন ডিজিজ হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য পাঠানো প্লেগের জীবাণু চুরি করে আনে পাকুড়ের আরো দুজন ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে। যে হুল ফুটিয়ে ছিল তাকে ধরা যায়নি কিন্তু বাকি ধরা পড়া চার জনের ফাঁসির হুকুম হয় হাইকোর্টের বিচারে। ঘটনা ১৯৩৩ সালের। বিনয়েন্দ্রের বিপক্ষে ছিল বোন এবং স্ত্রীও। অমরেন্দ্রের প্রতি স্ত্রীর কেন এতো স্হেহ ভালোবাসা সে রাগও ছিল বিনয়েন্দ্রের। ফাঁসি থেকে পরে হয় যাবজ্জীবন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ছিল বিনয়েন্দ্র। দেশ স্বাধীন হলে  কারাধ্যক্ষ চারুচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বলেন মুক্তির জন্য পিটিশন করতে। শেষ পর্যন্ত ড্রাফট লিখে দেন চারচন্দ্র চক্রবর্তী বা জরাসন্ধ নিজেই। দপ্তর জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বদলি করে জেলায়। মুক্তি পেয়ে বিনয়েন্দ্র পাকুড় পৌঁছে বন্দুক যোগাড় করে ঘরে ঢোকার আগেই পর পর ফায়ারিং চালায় অপেক্ষমান স্ত্রীর দিকে তাক্ করে। কোনোমতে মতে বেঁচে যায় স্ত্রী। 

যখন আমি বহরমপুর সংশোধনাগারে পোস্টিং এক রোববার মুর্শিদাবাদ জেলার সুতির মোড় হয়ে পাকুড় যাই ঘটনার সন্ধানে। জমিদার বাড়িতে কেউ থাকে না, বিশাল আম বাগানে দুই কোণে থাকে কর্মচারীরা। মাসিক রোজগার নিজেদেরই করে নিতে হয়। দেয়ালে এখনো স্পষ্ট গুলির ফুটো যেমনটা দেখা যায় অমৃতস্বরের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে। কিছু দূরেই পাকুড়ের রানির বাড়ি। রানিও জড়িয়ে পড়েছিল সাক্ষী দিতে কারণ জমিদার বাড়ির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। গিয়ে দেখি রানি প্রয়াত, তাঁর বাড়িতে প্রচুর দেশ বিদেশের পাখি! পাকুড়ের এই রানির ছিল বহু সম্পত্তি  কলকাতার বিজয়গড় অঞ্চলে। তাঁর নামেই 'রানিকুঠি'। রানিকুঠির অনেকটাই এখন ভারত সঞ্চার নিগমের বা বিএস এন এল অধীন।


পর্ব -২


ট্রেন ফারাক্কা ব্রিজে উঠতেই দেখি  উত্তর দিক থেকে প্রবল বেগে ছুটে আসা গঙ্গার জলের মূল ভাগটি পোল ভল্টের মতো পাক খেয়ে ঢুকে পড়ছে ফিডার ক্যানেলে আর একটি ভাগ সোজা পি টি ঊষার মতো দৌড়ে যাচ্ছে যে ক'টি স্ল্যুইস গেট খোলা আছে তা দিয়ে। ফিডার ক্যানেলের জল পশ্চিমে দ্রুত বেগে ছোটাছুটি করে আবার গঙ্গায় মিশছে ধুলিয়ান পেরিয়ে। অবাক কান্ড যে বৃষ্টি নেই তবু এতো ফর্সা নীল জল আসছে কোথা থেকে? আসলে শুধু তো অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর জল মিশছে না, গঙ্গায় এসে পড়েছে রামচন্দ্রের আমলে সরজু নদী বা ঘর্ঘরা, গন্ডক, কোশী, শোন কোশী এমনকি কালীগঙ্গা ও বাগমতীর মতো হিমালয় থেকে উৎপন্ন নেপালের নদীও। গ্রীষ্ম এলে বেগ বাড়বে বরফ গলে। তবুও অভিমান বাংলাদেশ নাগরিকদের পদ্মা দিয়ে কম জল পাওয়ায় আর এখানেই দাওয়ায় শেতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে এক চরম সত্যিঃ ঘটনাটি ষাটের দশকে যখন ফারাক্কা ব্রিজ হয়নি। গঙ্গার ধার লাগোয়া বেশ কিছু জমি ছিল বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের। এক কারারক্ষীর অধীনে এক দল সাজাপ্রাপ্ত বন্দী কাজ করতে আসত ক্ষেতে। একবার সেই কারারক্ষী বসার জন্য উল্টো দিকে ঘুরে একটু জায়গা খুঁজছেন সেই সুযোগে এক বন্দী গঙ্গার ক্ষীণ স্রোত পেরিয়ে দে দৌড়।  তাকে আর ধরা যায়নি। কংগ্রেস আমলেই বন্ধ হয়ে গেছে কয়েদিদের নিয়ে খেতে কাজ করানো। বাম আমলে বন্ধ জেলর বা সুপারের বাড়িতে কাজ করা এবং ডোরা কাটা জামা প্যান্ট পরা। কয়লা ভাঙা।  এ সব অমানবিক বলে। দেখা যাবে শুধু সিনেমাতেই। 


মালদায় আর এক দৃশ্যঃ পাগল ছেলের মাথায় মা দু ঘড়া জল ঢেলে গামছা দিয়ে মাথা মুছে দিলে গুম হয়ে যেমন ঝাঁকড়া চুলে বসে থাকে তেমনি অজস্র নতুন পাতা নিয়ে ক্ষ্যাপার মতো দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত আম গাছ। এবার মুকুল আসেনি,  আম নেই মালদায়। স্টেশনে ট্রেন ঢুকল সময়ের আগেই। প্যান্ট্টি কার নেই   গরম বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মে। মালদায়ও এখন প্রচুর ভুট্টা ও আলুর চাষ। কমলা ও এই প্রথম দেখি হলুদ রঙের বস্তা, যেন এন সি সি ক্যাডেট পিছে মোড় সামনে দেখ্ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি আলুর বস্তা, মাঠ থেকেই সরাসরি ভর্তি হচ্ছে ট্রাকে।'মধুভাঙ্গী' ও  'সূর্য কমল' স্টেশন পার হতেই আরো নিবিড় চাষ। আলুয়াবাড়ি পার হতে যোগ হয়েছে আনারস ও চা। দু' বার পার হলাম মহানন্দা। এন জে পি তে নামল গা ছম ছম করা সন্ধে। কারণ এখানেই কোনো না কোনো সময় পেয়েছি 

চায়ের নামে গোবর গুঁড়ো, ২০ টাকায় সন্দেহ জনক সিল করা দু লিটার জল, পচা নাস্তা, কোনো কাজ না করা পাওয়ার ব্যাঙ্ক ইত্যাদি। ইচ্ছাকৃত কেউ পা মাড়িয়ে দিলে যেমন তাকে চপেটাঘাত করতে ইচ্ছে হয় তেমনি এক বিরক্তিকর ও অনিবার্য অন্ধকার রাতে আর কী করব হাত পা গুটিয়ে বসে দেখছি মুখোমুখি বসা তিন ভদ্রলোকের কান্ডঃ হাইলাকান্দির বাসিন্দা তিনজনই কাপড়ের ব্যবসায়ী। এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি থেকে প্রত্যেকে এনেছেন এক কেজি সুপুরি কুচি ও একশটি পান। প্রতি ঘন্টায় পান সাজাচ্ছেন আর মুখে পুরে গল্প করছেন। চেষ্টা করছি তাঁদের ভাষা বুঝতে।  এক সময় সবাই নিদ্রা মগ্ন। 

ঘুম ভাঙলে দেখি আবছা অন্ধকারে গুয়াহাটি পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন সময়ের আগেই। লামডিং জংশনের পর শুরু পাতাল প্রবেশ। হাতীখালি, মাহুর, নিউ হাফলং, জাতিঙ্গা, ডিকটছড়া,দামছড়ায় একের পর এক সুড়ঙ্গপথের সম্মোহনী আলোছায়া। অবশেষে হিলারা স্টেশনে দাঁড়াতে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এল। উপভোগ্য। বদরপুর জংশন বেশ জলকালো। নেমে গেলেন তিন ভদ্রলোক। 

করিমগঞ্জ জংশনে ঢুকলে মনে পড়ে ১৯৭১ মার্চের সেই মর্মান্তিক ঘটনা। এখানে আছে কুশিয়ারা নদী। ওপার থেকে চলছিল পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাবর্ষণ।  কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর মেজর চমনলাল নদী পেরিয়ে ওপারে জকিগঞ্জ সহ পুরো এলাকা দখল করে নেন, ভোরের দিকে হঠাৎ শত্রুপক্ষের পেতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় তাঁর। করিমগঞ্জ শহরে কুশিয়ারা নদীপারে মেজর চমনলালের নামে স্মৃতিস্তম্ভ আছে। একে একে পেরিয়ে গেলাম সুপ্রাকান্দি নিলামবাজার পাথারকান্দি হয়ে ত্রিপুরার ধর্মনগর, পানিসাগর, পেঁচারথল,  কুমারঘাট, মনু, তেলিয়ামুড়া,জিরানিয়া হয়ে আগরতলা। পেঁচারথলের পর সুড়ঙ্গপথ যেন আর শেষ হয় না। লামডিং হয়ে আগরতলা পর্যন্ত আগে ছিল মোট ৩৬ টি সুড়ঙ্গপথ, কমে এখন হয়েছে ২২, এতো সুড়ঙ্গ পথের রোমাঞ্চে নিয়ে সোজা হাজির ৪০ তম আগরতলা বইমেলায়...


 পর্ব -৩

 পরপর তিনদিন বৃষ্টি হওয়ায় ভিজে সপসপে চারপাশ। ত্রিপুরা সরকার আয়োজিত চল্লিশতম বইমেলায় ককবরক ভাষায় 'বিজাপ বার্নিক' ঢুকেই বইমেলা কমিটির নিরাপত্তা বলয়ে ব্যাগপত্র রেখে প্রথমে যাই লিটল ম্যাগাজিন টেবিলে। টেবিলের ওপর জল দাঁড়িয়ে যাওয়ায় হাত গুটিয়ে বসে আছেন রামেশ্বর ভট্টাচার্য বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী মনীশ চক্রবর্তী মণিকা দাস নকুল রায় চয়ন সাহা প্রমুখ সম্পাদকগণ। এবার যাই P- লাইনের 'ত্রিষ্টুপ পাবলিকেশন' স্টলে। আপ্যায়ন করেন ব্রজ কুমার সরকার ও এন রঞ্জিতা সরকার। গদ্য পদ্য প্রবন্ধ অনুবাদ বাংলা ও ইংলিশ ভারশানে সব গ্রন্থই অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের। কিছুদিন আগে আমার পোস্টে এঁদের প্রকাশিত বইয়ের খবর দিলে ইতিমধ্যে অনেকগুলো গ্রন্থ বিক্রি হয়েছে অন লাইনে। 'আমাজনের' সঙ্গেও রয়েছে গাঁটছড়া। ভিড় কম বলে স্টলে স্টলে গিয়ে মেলা বই দেখতে থাকি। নিয়মিত কলেজ স্ট্রিট যাই বলে বইমেলায় নামি প্রকাশনীর স্টলে ঢুকে ১০% কমিশনে বই কিনিনা কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি আলাদা বলে প্রায় সব স্টলেই ঘুরি। দে'জ পাবলিশিং সব লেখকদের কিছু কিছু বই আনলেও আনন্দ পাবলিশার্স স্টল সুনীল বিহীন, আছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'দূরবীন', 'পার্থিব', 'মানব জমিন' সহ অন্যান্য লেখকের বই।হাইলাইটে আছেন দেবারতি মুখোপাধ্যায় ও স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীকে দেখিনি। যদিও ত্রিপুরাবাসীরা বলেন কলকাতার প্রকাশনী না এলে সম্ভব নয় আগারতলা বইমেলা। সোনারপুরের 'মিসিসিপি মেঘ' প্রকাশনীর কাকলি ও কৌশিকের সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠে। নতুন প্রকাশনী চৈতালী- যশোধরা- অংশুমান -মলয় রায়চৌধুরীদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত নতুন ঝিলম ত্রিবেদী চিরশ্রী দেবনাথ সৌম্যকান্তি জানা প্রমুখদের বই ছেপে সাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন। কিন্তু বিক্রি অল্প, ধৈর্য ধরতেই হবে। 

দুর্দান্তভাবে হাজির বাংলাদেশ। 'নয়া উদ্যোগে' তো বাংলাদেশের বই আছেই, এসেছে বাংলাদেশের পৃথক পৃথক প্রকাশনী। বেশ রসেবেশে আছেন ঢাকা বাংলা একাদেমির লোকজন। তাঁদের সামনেই মূল মঞ্চ। বিকেল থেকেই চলছে নাচ গান নাটক গীতি

আলেখ্য। বিশেষ করে আদিবাসী নৃত্যঃ রিয়াংদের 'হোজাগিরি' চাকমাদের 'বিজু' হালাম গোষ্ঠীর 'হাইকক' ত্রিপুরীদের 'লেবঙ','বুমানি' এমনকি লহরিও দেখবার মতো  মনে রাখবার মতো। 

বাংলাদেশের 'অন্যপ্রকাশ' স্টলে কয়েকদিন বসেছেন ও দেশের ব্যস্ততম ও জনপ্রিয় লেখক সাদাত হোসেন।তাঁর লেখা পাঠক প্রিয় গ্রন্থঃ 'আরশি নগর','নিঃসঙ্গ নক্ষত্র', 'মেঘেদের দিন', 'তোমার নামে সন্ধ্যা নামে', 'প্রিয়তম অসুখ সে', 'মরণোত্তর'। আমার অবশ্য বেশি আগ্রহ ত্রিপুরার প্রকাশনী নিয়ে। খুঁজে পেলামঃ 'অক্ষর প্রকাশনী' 'সৈকত',  'নীহারিকা', 'স্বাগতম','তুলসী পাবলিশার্স', 'ত্রিপুরা দর্পন','আগরতলা মনিপুরী ভাষা পরিষদ', বিভিন্ন স্টলে আছে এখানকার নামী 'পৌণমী প্রকাশনীর' বই, আছে 'নব চন্দনা','মানবী', 'ভাষা', 'বিদ্যাপ্রকাশ','মুখাবয়ব', আছে ধর্ম নগরের প্রকাশনী স্টল 'সাতদিন ও 'স্রোত '। 'স্রোতের' তরুণ কবি ও কর্ণধার গোবিন্দ ধরের বই প্রকাশের আগ্রহ প্রশ্নাতীত।সর্বদা উদ্যমে টগবগ করে ফুটছে নতুন কিছু একটা করার। 'বাদল প্রকাশনী' ও দেখেন। 'স্রোত প্রকাশনী'র সামনেই শুরু হল বসন্ত উৎসব। নাচ গান কবিতা পাঠ আবির খেলা। রঙিনে রঙিন মনের ছোঁয়ায় স্মৃতি চারণ। আমাকেও কিছু বলতে বলা হয়। 

সাতের দশক থেকে অর্থাৎ বাম আমল থেকে ককবরক ভাষাকে খুব উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় সাহিত্য অকাদেমিও চায় এই ভাষাটি আরো উন্নতি করুক। উৎসাহ দিতে ককবরক ভাষায় প্রথম সাহিত্য অকাদেমি পুরষ্কার দেওয়া হয় চন্দ্রকান্ত মুড়া সিং কে। ১০ বছর আগে তাঁর সঙ্গে আড্ডা হয়েছিল আগরতলার ৭ নং রাস্তার রামেশ্বর ভট্টাচার্যের বাড়িতে। এই মুহূর্তে ককবরক ভাষায় যাঁরা ভালো লিখছেনঃ বিজয় দেববর্মা, বিকাশরাই দেববর্মা, মানস দেববর্মণ, শেফালী দেববর্মা, সুধন্ব দেবর্বমা, নন্দ কুমার দেববর্মা প্রমুখ। 

শহর থেকে কিছুটা দূরে উদয়পুর যাওয়ার পথে ৮ নং জাতীয় সড়কে হাপানিয়া-য় তিন বছর ধরে হচ্ছে আগরতলা বইমেলা। কিছু প্রকাশনীর অভিযোগ সব বইপ্রেমী বিশেষ করে বয়স্করা আসতে পারছেনা মূল শহর থেকে দূরে বলে। আমার কিন্তু দারুণ লেগেছে। পাহাড়ি ঢালকে ব্যবহার করে বিশেষ করে পেছনের দিকটায় অপূর্ব আলোকসজ্জা, অসাধারণ লাগে সন্ধে থেকে ।প্রথম ক'দিন বাদে ড়িড়ও হয়েছিল ভীষণ রকম।


*************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন