'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ৪
দীপংকর রায়
বইটিকে মাথার কাছে রেখে দিলাম সারা রাত। রোজকার কাজগুলি করে সকাল সকাল স্নান-টান সেরে নিয়ে মনের মধ্যে বেশ একটা শুদ্ধ-শান্তি ভাব নিয়ে এসে বসে পড়লাম হালকা লালচে-মেরুন রঙের কাপড়ের মলাট মোড়া সেই শরৎচন্দ্রের প্রথম খণ্ডটি সামনে নিয়ে। তাছাড়া সেই তো প্রথম আমার উপন্যাস বস্তুটি যে কি জিনিস, তা চেনা! যদিও প্রথম পাতাটি পড়েই কেন জানি না কিছুক্ষণ মনমরা হয়ে থমকে থাকলাম। ভাবছি শুধু, লেখক এ কি কথা বললেন ! কিই বা বলতে আরম্ভ করলেন তিনি; শুরু করলেন যেভাবে, ---- " আমার এই ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে,....."
আমি ভাবছি, ' অপরাহ্ন কেন? '
তার পরের প্যারায় বলছেন, ....." ছেলেবেলা হইতে এমনি করিয়াই তো বুড়া হইলাম । আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের মুখে শুধু একটানা ' ছি ছি ' শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত 'ছি--ছি--ছি- ' ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি নাই। কিন্তু কি করিয়া যে জীবনের প্রভাতেই এই সুদীর্ঘ 'ছি - ছি -র ভূমিকা চিহ্নিত হইয়া গিয়েছিল বহু-কালান্ত-রে আজ সেইসব স্মৃতি-বিস্মৃতি কাহিনীর মালা গাথিতে বসিয়া যেন হঠাৎ সন্দেহ হইতেছে , এই ছি ছি টা যত বড় করিয়া সবাই দেখাইয়াছে, হয়তো ঠিক তত বড়ই ছিল না। মনে হইতেছে , হয়তো ভগবান যাহাকে তাহার বিচিত্র সৃষ্টির ঠিক মাঝখানটিতে টান দেন, তাহাকে ভালো ছেলে হইয়া একজামিন পাশ করিবার সুবিধাও দেন না, গাড়ি-পালকি চড়িয়া বহু লোকলস্কর সমভিব্যহারে ভ্রমণ করিয়া তাহাকে 'কাহিনী ' নাম দিয়া ছাপাইবার অভিরুচিও দেন না। বুদ্ধি হয়তো তাহাকে কিছু দেন, কিন্তু বিষয়ী লোকেরা তাহাকে সুবুদ্ধি বলে না। তাই প্রবৃত্তি তাহাদের এমনই অসঙ্গত, খাপছাড়া --- এবং দেখিবার বস্তু ও তৃষ্ণাটা স্বভাবতই এতই বেয়াড়া হইয়া ওঠে যে, তাহার বর্ণনা করিতে গেলে সুধী ব্যক্তিরা বোধ করি হাসিয়াই খুন হইবেন। তারপরে সেই মন্দ ছেলেটি যে কেমন করিয়া অন্দরে অবহেলায় মন্দের আকর্ষনে মন্দ হইয়া, ধাক্কা খাইয়া, ঠোক্কর খাইয়া অজ্ঞাতসারে অবশেষে একদিন অপযশের ঝুলি কাঁধে ফেলিয়া কোথায় সরিয়া পড়ে ----- সুদীর্ঘ দিন আর তাহার কোনো উদ্দেশই পাওয়া যায় না।"
এই অংশটুকু পড়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকলো। উল্টেপাল্টে যেতে থাকলো কেন জানি না। কত কথা মনে পড়তে লাগলো ! শরৎচন্দ্রের এই ছি-ছি কার, ধিক্কার মাথার ভেতরে উলটো চিৎ হয়ে ডিগবাজি খেতে লাগলো। তিনি লিখছেন, "বুদ্ধি হয়তো তাহাকে কিছু দেন, কিন্তু বিষয়ী লোকেরা তাহাকে সুবুদ্ধি বলে না।"
থমকে যাই। বারবার থেমে গিয়ে সেই সত্য অসত্যের ভিড়ে শরৎচন্দ্র আমাকে নিয়ে যে একটি দিনই নয় অনেকগুলি দিন কেমন উথাল পাতাল করিয়ে ছাড়লেন। যদিও তার নমুনা হয়তো ঠিক ঠিক পেশ করেও পেশ করা সবটা সম্ভব নয় জানি।
ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের পরের চলার পর্ব সেও আর এক দিগন্তের সীমারেখা মুছে দিয়ে আমাকেও তাদের সহযাত্রী করে ছাড়লো। আমিও ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের সঙ্গে সঙ্গে সেই খাড়া কাঁকরের পাড় বেয়ে নদীর ভেতরে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। " তারপর সেই সুতীব্র জলধারার মুখে একখানি ছোট্ট মোচার খোলা যেন নিরন্তর কেবলই আছাড় খাইয়া মরিতেছে। ...... ক্ষুদ্র তরী তীব্র একটা পাক খাইয়া নক্ষত্র বেগে ভাসিয়া চলিয়া গেল।.... "
এইসব বর্ণনার সঙ্গে আমিও আমার ছেলেবেলার সেই নবগঙ্গার এক একটি দিনরাত্রির বিচিত্র সব মুহুর্তের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকলাম। কত কথাই না মনে পড়তে লাগলো! শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথ আমাকে সেই সব দিনের কাছে নিয়ে গিয়ে নানা ঝড়-ঝঞ্জা স্রোতের তোড়ের ভেতর ছুটিয়ে কত অন্ধকার-জোছনা রাত্তির যে ডিঙিয়ে ছাড়লো তা বলার নয়। আমি যত ভাবি ভাববো না থাক, ততোই ইন্দ্রনাথ আমাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে চলে। আমি তাদের দুজনের মাঝখানে বসে যেন কথা বলাবলি করি। নদীতে পাড় ভাঙার শব্দ শুনি। যেমন ভাবে শুনতাম যখন নবগঙ্গার বালির দুইপাড় ভাঙতো ঝপঝপ করে।
আমি তখন মামাদের সঙ্গে হ্যাঁজাক ঝুলিয়ে কোঁচ নিয়ে মাছ ধরতে বেরোতাম। মনে হতো কারা যেন ভীষণ জোরের সঙ্গে কিছু দিয়ে ঠেলে ভেঙে দিচ্ছে নদীর পাড়। প'রে মামা ঝপাত্ করে কোঁচে মস্ত বড় এক বেলে মাছ কুপিয়ে গেঁথে ফেলতো। কখনো বেশ বড়সড় একটা মৃগেল মাছ।
সেই সব কিছু মুহূর্ত মিলেমিশে এমনই এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দিতে থাকলো যে আমি আর নিজেকে আলাদা করতে পারছি না কিছুতেই।
দু'দিন বুঁদ হয়ে পড়ে থাকলাম। খাওয়া-দাওয়া-স্নান সব প্রায় অনিয়ম। কাজের দিদি তাড়া দিতে থাকলো। বকাবকি করতে থাকলো এই অবস্থা দেখে। অলোক এসে আমার ফুলের বাগান পরিচর্যার খবরাখবর নিয়ে জানতে পারলো, ওসবে এখন আমার তেমন একটা মন নেই।
সে যতটুকু পারলো গাছগাছালির গোড়ায় খুড়পি দিয়ে নাড়াচাড়া করলো। জলও দিল একটু আধটু । সার টারও দেবার কথা বলে গেল হাঁক পেড়ে।
মলি দু'দিন এদিকে ঘেঁষেনি। ও বাড়ির ঠাকুমা ও কাজের দিদির সঙ্গে লুডুর খোট বসিয়েছে ঘর থুয়ে বারান্দায় । গরুর পরিচর্যা আজ দু'দিন আমি একটুও করিনি। কাজের দিদিই সামলেছে। সারাদিনই একরকম উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছি শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথ নিয়ে। নানা জায়গায় পেনসিল মার্ক করে রাখছি কেন জানিনে। আণ্ডারলাইনও করে রাখছি। দু'বার তিনবার করে পড়ছি এক একটি প্যারা। অর্থ করতে গিয়ে সেইসব জায়গার ছবিগুলি একেবারে যেন ফুটে উঠছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যেন। মনে মনে সেইসব জায়গার কথা ভেবে বারবার মনে করছি, সেই যে রাতের বেলায় প'রে মামা আইশোদাদের সঙ্গে নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে ধোবার চরের পাশ দিয়ে যখন যেতাম, তখন যেতে যেতে ধোবার চরের উপর থেকে কারা যেন মানুষের কান্নার মতো আওয়াজ করতো। কারা যেন চিৎকার করতো, শুনতে পেতাম। কখনো আবার নৌকার পেছনে হুস হুস করে শব্দ করে ছুটে আসতো কিছু যেন। দূরে ঝপাত্ ঝপাত্ করে মাছের ঘাপলা মারার আওয়াজ আসতো। জলের উপর বাঁশের চটার বাড়ি মারলে যেমন শব্দ হয়, সেরকম শব্দ হতো চড়াত্ চড়াত্ করে। প'রে মামাকে বলতাম, বা আইশোদাকে, ওসব কি হচ্ছে গো! কিসির আওয়াজ আসতিছে তাই কও না, উপরির থে?.... এসব যে মানুষির কান্নার আওয়াজ আসতিছে যে গো! কী হচ্ছে কি তাই কও তো দেহি!..... আরে, আমি শুনতিছি, তোমরা কিছুই শুনতি পারতিছ না নাকি?
ওরা উভয়েই রে রে করে একসাথে চেঁচিয়ে উঠে বলতো, তোমারে কইছিলাম না ভাগ্নে, ওসব দিকে মন দিবা না একদম, কানেই নিতি যাবা না, যা হচ্ছে হয়ে যাকগে এক দিক দিয়ে, তাকাবা না ! দেখতিছ না, আমরা কি খেয়াল দিচ্ছি , তাই কও তো একবার দিকি ? ওসব একদম দ্যাখপা না। কত শুনেছি ওসব! চুপচাপ থায়ো একদম। কোনো ভয় নেই, আমরা আছি না, ভয় কি সেইডা কও তো ?
তাও বলতাম, একটু চাইয়ে দ্যাখপো না !
আইশো দা বলতো, না, চাইয়েও দ্যাখপানা ! ওরে মনে করিছ না মরিছ ------ কই, আমরা ডরাচ্ছি ওরে?
বেশ খানিকটা জড়সড় হয়ে মনে মনে ভাবতাম, না ভয় পাবো না। ভয় পালি এরা তো আর পরের দিন আমারে সঙ্গে আনবেনানে! ওরা যদি না নিয়ে আসে, তাহলে আমি কী করে আরো ভালো করে জানতে পাবো এইসব , এমন রাত্তিরের মাধুর্যই বা খুঁজে পাবো কোনখানে !
ঠিক অমনি একটা অবস্থা দেখলাম শ্রীকান্তরও হলো।....." উপরে মাথার উপর আবার আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলা আর সুমুখে সেই বালির পাড়। এটা কোন জায়গা, তাই ভাবিতেছি, দেখি ইন্দ্র ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, শ্রীকান্ত, তোকে একটা কথা বলতে ফিরে এলুম। যদি কেউ মাছ চাইতে আসে, খবরদার দিস নে --- খবরদার, বলে দিচ্ছি। ঠিক আমার মত হয়ে যদি কেউ আসে, তবু দিবি নে --- বলবি, মুখে তোর ছাই দেব --- ইচ্ছে হয় নিজে তুলে নিয়ে যা। খবরদার হাতে করে দিতে যাস নে যেন, ঠিক আমি হলেও না। খবরদার।
সে বলল, 'কেন ভাই? '
ইন্দ্রনাদ বলল, ফিরে এসে বলব --- খবরদার কিন্তু ---,
বলিতে বলিতে সে যেমন ছুটিয়া আসিয়াছিল, তেমনই ছুটিয়া দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল।
এরপর শ্রীকান্তের যে ভয়ে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কাটা দেওয়া, শিরা উপশিরা দিয়ে বরফ জল গড়িয়ে পড়া --- এসব সব কেন জানি, আমার ফেলে আসা কতকগুলি রাতের সেই মাছ ধরা পর্বের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হতে লাগলো। সেই যে ভয় মিশ্রিত রাতের রোমাঞ্চ জানতে যাওয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার অধ্যায়গুলি, সে যেন শ্রীকান্ত আবার নতুন করে আমার ভেতরে জাগিয়ে তুলতে লাগলো। ইন্দ্রনাথ চরিত্রটির সেই যে কিশোর কালের এত বড় বড় সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন লেখক, তা আমাকে এমনভাবে আলোড়িত করে তুলতে লাগলো যে, তা আর কী বলবো! কেন জানিনা ভেতরে কীসের যেন একটি দরজা কপাট মেলানোর শব্দ কানে আসতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, আহা, কী অনুভব সে সব! ইন্দ্রনাথ বলছে, " মরার আবার কি জাত আছে নাকি রে? " শ্রীকান্ত যখন বলছে, "কি জাতের মরা --- তুমি ছোঁবে ? " ইন্দ্র সরিয়া আসিয়া এক হাত তাহার ঘাড়ের তলায় এবং অন্য হাত হাঁটুর নীচে দিয়া একটা শুষ্ক তৃণ খণ্ডের মত স্বছন্দে তুলিয়া লইয়া কহিল, ' নইলে বেচারাকে শেয়ালে ছেঁড়াছিঁড়ি করে খাবে। আহা! মুখে এখনো এর ওষুধের গন্ধ পর্যন্ত রয়েছে রে ! বলিয়া নৌকার যে তক্তাখানির উপর ইতিপূর্বে আমি শুইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহার উপর শোয়াইয়া নৌকা ঠেলিয়া দিয়া নিজেও চড়িয়া বসিল। কহিল, ' মড়ার কি জাত থাকে রে? ' আমি তর্ক করিলাম, 'কেন থাকবে না? ' ইন্দ্র কহিল , ' আরে এ যে মড়া , মড়ার আবার জাত কি? এই যেমন আমাদের ডিঙ্গিটা --- এর কি জাত আছে? আম গাছ, জাম গাছ, যে কাঠেরই তৈরী হোক --- এখন ডিঙ্গি ছাড়া একে কেউ বলবে না --- আম গাছ, জাম গাছ -- বুঝলি -- না? এও তেমনি। "
এই উক্তি এর আগে পাঠ্য বইতেও কখন যেন পেয়েছিলাম; এখন মনে পড়ছে একটু একটু সে সব ! কিন্তু আজ তা যেন সব ঝাপসা ভাব কাটিয়ে এমনভাবে ধরা দিল! কই পাঠ্য বইতে সে বর্ণনা এমন ভাবে তো মুগ্ধ করেনি! যা এখানে এমন এক ভাবে অনুভব করছি! এতটাই বিস্ময় জেগে উঠছে যে মনে হচ্ছে বলি যেন, আহা, তখন যদি এমন ভাবে বুঝতে পারতাম , তাহলে কতটাই না ভালো হতো ?
এর পরের দৃষ্টান্ত আরো বড়। প্রতিমুহূর্তে অন্য এক জগতের সন্ধান দিচ্ছে যেন। লেখক বলছেন : দৃষ্টান্তটি যে নেহাত ছেলেমানুষের মত, এখন তাহা জানি। কিন্তু অন্তরের মধ্যে ইহাও তো অস্বীকার করতে পারি না --- কোথায় যেন অতি তীক্ষ্ণ সত্য ইহারই মধ্যে আত্মগোপন করিয়া আছে। মাঝে মাঝে এমনই খাঁটি কথা সে বলিতে পারিত। তাই আমি অনেক সময়ে ভাবিয়াছি, ওই বয়সে কাহারো কাছে কিছুমাত্র শিক্ষা না করিয়া বরঞ্চ প্রচলিত শিক্ষা - সংস্কারকে অতিক্রম করিয়া এই সকল তত্ব সে পাইত কোথায়? এখন কিন্তু বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে ইহার উত্তরটাও পাইয়াছি বলিয়া মনে হয়। কপটতা ইন্দ্রের মধ্যে ছিল না। উদ্দেশ্যকে গোপন রাখিয়া কোন কাজ সে করিতে জানিত না । সেই জন্যেই বোধ করি তাহার সেই হৃদয়ের ব্যাক্তিগত বিচ্ছিন্ন সত্য কোন অজ্ঞাত নিয়মের বশে সেই বিশ্বব্যাপী অবিচ্ছিন্ন নিখিল সত্যের দেখা পাইয়া, অনায়াসে অতি সহজেই তাহাকে নিজের মধ্যে আকর্ষণ করিয়া আনিতে পারিত। তাহার শুদ্ধ সরল বুদ্ধি পাকা ওস্তাদের উমেদারি না করিয়াই ঠিক ব্যপারটি টের পাইত।
বাস্তবিক, অকপট, সহজ-বুদ্ধি-ই ত সংসারে পরম এবং চরম বুদ্ধি। ইহার উপরে কেহই নাই। ভালো করিয়া দেখিলে, মিথ্যা বলিয়া ত কোনো বস্তুরই অস্তিত্ব বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে চোখে পড়ে না। মিথ্যা শুধু মানুষের বুঝিবার এবং বুঝাইবার ফলটা! সোনাকে পিতল বলিয়া বুঝানোও মিথ্যা, বুঝাও মিথ্যা, তাহাও জানি। কিন্তু তাহাতে সোনারই বা কি, আর পিতলেরই বা কি এসে যায়। তোমরা যাহা ইচ্ছা বুঝো না। তাহারা যা তাই তো থাকে। সোনা মনে করিয়া তাহাকে সিন্দুকে বন্ধ করিয়া রাখিলেও তাহার সত্যকার মূল্যবৃদ্ধি হয় না। আর পিতল বলিয়া টান মারিয়া বাহিরে ফেলিয়া দিলেও তাহার দাম কমে না। সেদিনও সে পিতল আজও সে পিতলই। তোমার মিথ্যার জন্য তুমি ছাড়া আর কেহই দায়ীও হয় না, ভ্রুক্ষেপও করে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্তটাই পরিপূর্ণ সত্য। মিথ্যার অস্তিত্ব যদি কোথাও থাকে, তবে সে মানুষের মন ছাড়া আর কোথাও না। সুতরাং এই অসত্যকে ইন্দ্র যখন তাহার বাস্তবের মধ্যে জানিয়া হোক, না জানিয়া হোক, কোনোদিন স্থান দেয় নাই। তখন তাহার বিশুদ্ধ বুদ্ধি যে মঙ্গল এবং সত্যকেই পাইবে। তাহা তো বিচিত্র নয়! "
ইন্দ্রনাথের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্র এই যে উপলব্ধি আমার সামনে তুলে ধরলেন, তাতেই আমি যেন আমার পথের অনেক খোঁজ পেয়ে গেলাম। কেন জানি মনে হলো, এই তো আমার শিক্ষাগুরু ; আজ আমার সামনে সব দিককার দরজা-জানলা খুলে দিলেন --- আমি যেন আমার এতদিনকার ধারণার অত্যন্ত সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি। মনে হতে লাগলো, আজই একখানা চিঠি লিখি রসিক দাদুকে।
এ তো গেল এক সত্যের প্রত্যক্ষ করা। আর এক জায়গা পড়ে আরো চমকে উঠলাম ---- মনে হতে লাগলো, আহা, এ কি বললেন তিনি ---- !
যদিও সে বর্ণনা এর আগেই --- সেখানে শ্রীকান্তের মনে হচ্ছে এইরকম, '' সাহসের এতগুলি পরীক্ষায় পাশ করিয়া শেষে এইখানে আসিয়া ফেল করিবার ইচ্ছা আমার ছিল না। বিশেষতঃ মানুষের এই কিশোর বয়সটার মত এমন মহা বিস্ময়কর বস্তু বোধ করি সংসারে আর নাই। এমনই তো সর্বকালেই মানুষের মানসিক গতিবিধি বড়ই দুর্গেয় ; কিন্তু কিশোর-কিশোরীর মনের ভাব বোধ করি একেবারেই অজ্ঞেয়, তাই বোধ করি , শ্রী বৃন্দাবনের সেই দু'টি কিশোর-কিশোরীর কৈশোর লীলা চিরদিনই এমন রহস্যে আবৃত হইয়া রহিল, বুদ্ধি দিয়া তাহাকে ধরিতে না পারিয়া, তাহাকে কেহ কহিল ভালো, কেহ কহিল মন্দ, -- কেহ নীতির দোহাই পাড়িল , আবার কেহ বা কোনো কথাই শুনিল না ---- তর্কাতর্কি সমস্ত গণ্ডি মাড়াইয়া ডিঙ্গাইয়া বাহির হইয়া গেল । যাহারা গেল, তাহারা মজিল, পাগল হইল, নাচিয়া, কাঁদিয়া, গান গাহিয়া সব একাকার করিয়া দিয়া সংসারটাকে যেন একটি পাগলা গারদ বানাইয়া ছাড়িল। তখন যাহারা মন্দ বলিয়া গালি পাড়িল, তাহারাও কহিল, এমন রসের উৎস কিন্তু আর কোথাও নাই। যাহাদের রুচির সহিত মিল খায় নাই তাহারাও স্বীকার করিল, এই পাগলের দলটি ছাড়া সংসারে এমন গান কিন্তু আর কোথাও শুনিলাম না। ''
এরপরেই আবার বলছেন, '' কিন্তু এমন কাণ্ড যাহাকে আশ্রয় করিয়া ঘটিল --- সেই যে সর্বদিনের পুরাতন, অথচ চির নুতন -- বৃন্দাবনের বনে বনে দুটি কিশোর -- কিশোরীর অপরূপ লীলা -- বেদান্ত যাহার কাছে ক্ষুদ্র, মুক্তিফল যাহার তুলনায় বারিশের কাছে বারিবিন্দুর মতই তুচ্ছ --- তাহার কে কবে অন্ত খুঁজিয়া পাইল? পাইল না , পাওয়া যায় না। তাই বলিতেছিলাম, তেমনি সেও ত আমার কিশোর বয়স! যৌবনের তেজ এবং দৃঢ়তা না আসুক, তাহার দণ্ড ত তখন আসিয়া হাজির হইয়াছে ! প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ত হৃদয়ে সজাগ হইয়াছে ! তখন সঙ্গীর কাছে ভীরু বলিয়া কে নিজেকে প্রতিপন্ন করিতে চাহে ? অতয়েব তৎক্ষনাৎ জবাব দিলাম, ভয় করব আবার কিসের ? বেশ ত যাও না। ''
শরৎচন্দ্র এ কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসে ফেললেন আমায়? এই সাহসের কথাটুকু বলতে গিয়ে একেবারে বৃন্দাবন, রাধাকৃষ্ণ লীলা! তার কিশোর বেলা! সেই কিশোর কিশোরীর মহা প্রেমপর্বের কথা বলে দিলেন এমন করে, আমি যেন কূল কিনারা পাচ্ছি না! আবার যেন এতটাই কূলে এসে দাঁড়াচ্ছি, তারপরেই-- তোলপাড় করাচ্ছে সবটা কেউ, জল-কল্লোল ! আমার মনে পড়ছে কত কথা ---- আমিও বারবার ফিরে যাচ্ছি --- সন্ধ্যাবেলার বারান্দার সেই কোণটায় বসে বসে ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত এবং আমি একাকার হয়ে যাচ্ছি। মনে পড়ছে, সেই যে মৌচাক ভাঙা মন্ত্র শেখার কথা। বশীকরণ মন্ত্র শিখবার জন্যে গ্রামের পাড়ায় যে চাউলের কাছ থেকে নিরাপদ বাগদি আসতো খড়ি কাটতে তার পেছন পেছন কত দিন ঘুরে বেড়ানোর সেই সব দিনগুলির কথা ---- আমরা তাকে নিরাপদদা বলে ডাকতাম। খুব কম কথা বলত সে। সারাদিন এক মনে মামাদের জামরুল গাছের নিচেয়, কখনো আমাদের ঘাটের বাগানের ডানদিকে যে আতাফলের গাছটা আছে, তার তলায় এক মনে সমস্ত দিন খড়ি কাঠ ফেড়ে যেত সে তার কুড়ুলখানি দিয়ে। এই সব প্রয়োজন হত ভিয়ানের জন্যে ---- আর তার যোগান দেবার জন্যে এরকম নিরাপদদার দরকার হত। বাড়িতেই এই সব কাঠ ফাড়াফাড়ি হত তখন, গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত, এ কাজের যেন বিরাম নেই। যারা যারা ভিয়ান করত তাদেরই এরকম কাঠ ফেড়ে টাল দিতে হত থাকে থাকে, এই সব খড়িকাঠ জড়ো করে। আর সেই চেলা করা কাঠ একের পর এক সুন্দরভাবে মাচান দেবার মত করে সব বাড়ির এক একটা কোণায় সাজিয়ে রাখা হত। কাঁচা সেই খড়ি কাঠ চেরাই হয়ে গেলে তাতে রোদ হাওয়া বাতাস লেগে এমন একটা গন্ধ বের হত, যাতে চিনে নেওয়া যেত আজ কী কাঠ কাটছে নিরাপদদা । শুধু একা নিরাপদদাই নয়, পাঁচুভাইও দিদিমার যোগান দিত এই সব কাজে।
সে যাক গে, সে আমাদের অল্প কাঠ লাগত বলে পাঁচুভাইকে দিয়েই না হয় হয়ে যেত। কারণ এ কাজে পাঁচুভাই খুব একটা খড়ধর না। অত্যন্ত ধীরগতির । কিন্তু নিরাপদদা খড়ি কাটাই শুধু নয়, এ কাজ যখন যেই করত, তারই মেহনতের ছবিটাই ফুটে উঠত পেশীবহুল এক স্পষ্টতা নিয়ে ; যাতে প্রদর্শিত হত যেন পেশীর সমস্ত খাঁজগুলি, এক অন্য মাত্রা নিয়ে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম, বলতাম মনে মনে, বাবা! দম চাই! তা না হলে এই কাজটা একবার প্র্যাকটিস করতাম না হয়! কুড়ুলের এক একটা কোপ বসে যেত নিখুঁত নিরিখে কাঠের এক একটি খাঁজে । দেখতাম নিরাপদদাকে, কি রকম চিনতে পারত সে, এই গুড়িটাকে কোন দিকে ঘুরিয়ে কাটলে কোন জায়গাটায় কোপ দিলে কাঠটা সহজ মত খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। কেন জানি না, এসব জিনিসে আমার মনের অন্যমনস্ক এক অনুভব কাজ করে চলতো ভারি নিঃশব্দে! খুব মন দিয়ে ঠাওর করতে পারতাম এসব। করতে করতে আবার কখন এই সবের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে সেদিনের মত হয়তো ভুলেই যেতাম যে জন্যে আজ নিরাপদদার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি । কিন্তু সে কথা ভুলে, লক্ষ করতে থাকতাম তার এইসব কায়দা কানুন। পরে যখন ভাবতাম, এই দেখ, আজও তো বলা হলো না তাকে, বিকেল যে গড়িয়ে গেল ; এই বার তো নিরাপদদা হাত পা ধুয়েই টাকা কটা মামাদের কাছ থেকে নিয়েই মারবে ছুট, এক পায়ে দুই পায়ে এগোতে না এগোতে তাকে আর ধরা যাবে না। হয়তো ও বাড়ির নির্মলা দিদির কাছ থেকে পানটা নিয়ে তাতে চুন লাগাতে লাগাতে সুপুরি ঢেলে দিয়ে মুখে পুরে দেবে। তারপর হাঁটা লাগানো ---- আমিও সেসব দেখে দেখে অভ্যস্ত বলে, তার পিছু নিই আজকে, কিছু দূর গিয়ে ধরে ফেলি। বলি, কই, কী হলো কি নিরাপদদা? আজও তো শেখালে না! আজ আর কাল করে করে প্রায় এক মাস তো লাগিয়ে দিলে, আমি আর কত দিন তুমার জন্যি অপেক্ষা করি, তাই কও তো দেহি!
সে মুচকি হাসতে হাসতে বলে, ও বাবা, পেছন পেছন আইস দেহি আজ একেবারে ; আরে, চিন্তার কিছু নেই --- হবেনে, হবেনে তো কলাম, সময় আলিই দিবানে কয়ে, কইছি তো, আচ্ছা, যাও কাইলই হবেনে , দিবানে কয়ে ; আচ্ছা, আজ যাও, কাইল --- কিন্তু তোমাগের ওই ওপাশের কলুপে গাছের ওই লম্বা লম্বা বড় বড় কয়টা আম কিন্তু দিতি হবেনে কাইল, সাইরে নিয়ে চলে আসপা কিন্তু কলাম, তোমার ওই খাণ্ডাই দিদিমা দেখতে পালি কিন্তু রেহাই নাই, সে কথা মনে রাইখো কিন্তু ; আচ্ছা, যাও, আইজ যাও দেহি, বাড়ির দিকি আমিও যাই ইবারে ,ভাইবো না, ভাইবো না, হবে নে, কাইলই দিবানে শিখায়ে তোমারে। এহনে নিশ্চিন্তে যাও দেহিনি ------
খুব রেগে যেতাম, বলতাম, ও তো কতই হলো ; রোজই তো কচ্ছ একই কথা, আর আমি তুমারে এডা ওডা দিতিই থায়ি ,আর নিতিই থায়ো তুমি--- কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা--- তা আর হচ্ছে না দাদা কলাম, আজ তুমারে পাকা কথা দিতিই হবেনে কয়ে রাখতিছি সে কথা কিন্তু , না হলি হুজ্জতি বাধাবানে, সেকথা কিন্তু বার বার কয়ে রাখতিছি আজ ; এহোনো ভালো চাও তো ঘুরে চাও, শিখায়ে দেও দেহি ;
ধাতানিতে বেশ কাজ হলো। নিরাপদদা পরদিন কলুপে আম কডা গামছার মুড়োয় বেধেই--- দুটি মন্ত্র আমায় লিখে নিতে বললো। লেখা হয়ে গেলে খানিকটা আশ্চর্য হয়ে তাকে বললাম, এই তোমার মন্ত্র! এতো শুধু দেবতার দোহাই ! এই কলাইনে কচু হবেনে ; কি হবেনে এতি?
সে তাতে জিভ কেটে বললো, ও কতি নেই ভাইডি, একবার পরখ করেই দেহ না, তারপরে না হয় কয়েনে আমারে যা কও, দেখতি পালি শুনতি চায় কিডা---! যাও না, যাও তো দেহি --- অমাবস্যে পুন্নিমে লাগবেনানে, যাও, এই মন্তরটা কয়ে ঘাটেরকুলি যে লতা গাছটা আছে, তাতি একটু নদীর জল আনে তিনবার মন্তরডা পড়ে ফু মারে দাওগে দেহি, দেহ কী হয়, কিছুডা সময় বাদে যাইয়ে দেখপা --- দেখতি পাবানে কি হয় ; দেখপা লতার মুখ ঘুরিছে কি ঘোরেনি; দেখপা সেদিকি আর নেই, ঘুরে দাঁড়াইছে লতার মুখ, উল্টো দিকি ঘুরে দাঁড়াইছে । দেখ না ঘোরে কি ঘোরে না, দেখতি পালি আর শোনে কিডা ; ----
তার কথা শুনে ঠিক বিশ্বাস হত না। মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে দিয়ে এসে আমার কি আর তর সয়! বারবারই উঁকিঝুঁকি মারতে থাকলাম দূর থেকে। আর নিরাপদদার দিকেও লক্ষ রাখতে লাগলাম, দেখতে থাকলাম সে একজায়গায় আছে কি না, দেখলাম না না সে যেমন খড়ি কাটছিল তেমনই তো কেটে চলেছে। মনে মনে ভাবছি, নাকি সে একফাঁকে ওদিকে গিয়ে লতা গাছের মাথাটা ঘুরিয়ে রেখে এসেছে?
কিন্তু না। সে তো নড়েনি ; লতা গাছই তো মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছে যেন ! এবং বেশ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে ; আমি তো হতবাক। বিস্ময়ে বুকের ভেতরটা কেন জানি ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো। ধপাস ধপাস। কিন্তু কেন এরকম হুটোপাটি করছে বুকের ভেতরে!
( ক্রমশ )
*************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন