নীলা
দেবাংশু সরকার
বিয়ের পর থেকেই দেনা পাওনা নিয়ে কথা শুনতে শুনতে জেরবার হয়ে যাচ্ছে নীলা। বিয়ের সময়ে একলক্ষ টাকা বর পণের প্রতিশ্রুতি দিলেও চল্লিশ হাজারের বেশি জোগাড় করতে পারেন নি তার বাবা। তখন বলেছিলেন যে ভবিষ্যতে ঐ টাকা তিনি শোধ করে দেবেন। কিন্তু অকাল মৃত্যুর জন্য তিনি কথা রাখতে পারেন নি।
যত দিন নীলার বাবা জীবিত ছিলেন এবং কিছু কিছু করে টাকা দিচ্ছিলেন ততদিন নীলার শাশুড়ি কিছুটা চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু নীলার বাবা মারা যাওয়ার পর অত্যাচার চরমে ওঠে। অত্যাচারের গতানুগতিক পদ্ধতি মেনে কাজের মাসিকে ছাড়িয়ে দিয়ে রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর পরিস্কার সমস্ত দায়িত্বই চাপিয়ে দেওয়া হয় নীলার ওপর। কিন্তু এত কিছুর পরেও কথা শোনানো থামে না। নীলার শাশুড়ি জানতে চান পণের বাকি টাকা কিভাবে উদ্ধার হবে? টাকা উদ্ধারের জন্য পাহাড় প্রমান চাপ আসতে থাকে নীলার ওপর।
সারা দিন নীলা ঘরের সমস্ত কাজ করেও শাশুড়ির মন পায় না। বর পণের বাকি টাকা নিয়ে নীলাকে দিন রাত কথা শুনিয়ে যান তার শাশুড়ি। একেতো পিতৃ বিয়োগের শোক, তার ওপর ঘরোয়া অশান্তি। স্বামী অসিতের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কাজ হয় না। অসিত বলেছে সে তার মায়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারবে না। উপরন্তু অসিত পাল্টা অভিযোগ করে বলে যে নীলার বাবার এরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত হয় নি। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে নিয়মিত কথা কাটাকাটি হয়।
প্রত্যেক দিন অসিত কাজ সেরে বাড়ি ফিরলেই নীলা কান্নাকাটি শুরু করে। ব্যাপারটা অসিতের কাছে ক্রমশ বিরক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। যত দিন যায় এই অশান্তির জন্য ঘরের প্রতি, নীলার প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে অসিতের। সে দিনের বেশির ভাগ সময় তার কর্মক্ষেত্রে কাটায়। খুব সকালে বেরিয়ে যায়, বাড়ি ফেরে মাঝ রাতে। প্রশ্ন করলে বলে - কাজের চাপ আছে, ওভার টাইম চলছে।
শ্বশুর বাড়ির চাপে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নীলা অনেক চেষ্টা করে চাকরি জোগাড় করে স্থানীয় একটা নার্সিংহোমে। সামান্য মাইনের প্রায় সমস্তটাই প্রতিমাসে শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়ে বর পণের টাকা মেটাতে থাকে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, ঘরের কাজ সেরে নীলা নার্সিংহোমে যায়। যতক্ষণ নার্সিংহোমে থাকে, সে চাপ মুক্ত থাকে। একটু হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু বাড়ি ফিরলেই সেই চাপা হাসি বোবা কান্নাতে বদলে যায়।
নার্সিংহোমের সব কর্মীই নিজের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পায় না। কিন্তু নীলার শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের অস্পষ্ট দাগ দৃষ্টি এড়ায় না অলোকের। অলোক একজন কর্মী ঐ নার্সিং হোমের। তার তিন কুলে কেউ নেই। একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে সে একা থাকে । অলোকের অমায়িক এবং আন্তরিক ব্যবহার ধিরে ধিরে জায়গা করে নেয় নীলার মনে। ক্রমশ নীলা বিশ্বাস করতে শুরু করে অলোককে। বিশ্বাস করে নিজের দুঃখ যন্ত্রনা, নিজের অসহায়তার কথা খুলে বলে অলোককে। বলে হালকা হয় মনের দিক থেকে । অলোকের জীবনেওতো কেউ নেই। কারো কথা শোনার সুযোগ নেই। কাউকে কিছু বলার সুযোগ নেই। নীলার কথা সে মন দিয়ে শোনে, মন দিয়ে ভাবে।
বিশ্বাস থেকে আসে ভালো লাগা। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। ভালোবাসা থেকে পরস্পর হয়ে ওঠে পরস্পরের আশ্রয়স্থল। একে অন্যকে জড়িয়ে নতুন করে বেঁচে ওঠার স্বপ্ন দেখে ।
রথ যাত্রার দিনেও ছুটি নেই নীলার। আজও সে সকালে নার্সিংহোমে গেছে। এমার্জেন্সি ডিউটি। ছুটি বলে কিছু নেই। অবশ্য নীলা ছুটি চায়না। বাড়ির মধ্যে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। বাড়ির বাইরেই সে খুঁজে পায় মুক্ত বাতাস। নার্সিংহোমটা তার কাছে স্বস্তির ঠিকানা, শান্তির আশ্রয়।
চন্ডি মন্ডপের লাগোয়া মাঠে বসেছে রথের মেলা। বেশ ভিড় হয়েছে। মাঠ জুড়ে ব্যাপারীরা বসেছে তাদের পসরা নিয়ে। কোথাও জিলিপি, কোথাও পাঁপড়, কোথাও মেয়েদের গয়নাগাটি, কোথাও আবার বাচ্চাদের খেলনার দোকান। মেলা চলবে এক সপ্তাহ ধরে। মাঠের এক ধারে বসে এক কথক ঠাকুর রাধা কৃষ্ণের প্রেম লীলার গান গাইছে। ব্যাক্ষাও করছে সেই গানের। কয়েকজন স্রোতাও জুটে গেছে তার।
একজন মহিলা স্রোতা প্রশ্ন করে - রাধা কেন সাড়া দেয় কৃষ্ণের ডাকে?
কথক ঠাকুর বলেন - সব ডাক যে উপেক্ষা করা যায় না, মা। তাছাড়া কৃষ্ণ একা রাধাকে ডাকে না। যমুনার জল ডাকে রাধাকে। কদম গাছ ডাকে রাধাকে। শুকসারি ডাকে রাধাকে। শিখিপাখা ডাকে রাধাকে। মোহন বাঁশি ডাকে রাধাকে। এতো জনের ডাক কি করে উপেক্ষা করবে সে?
বাড়ি ফেরার পথে মেলা প্রাঙ্গণে ঢোকে নীলা। একা একা ঘুরতে থাকে ভিড়ে ঠাসা মেলার মাঠে। সস্তার গয়নার দোকানে ঢোকে সে। হাতে নিয়ে দেখতে থাকে কানের দুল, হাতের চুড়ি। আবার ভাবে কেন কিনবে সে? কেন পরবে গয়না? কার জন্য সাজবে? কে দেখবে তার সিঙ্গার? আবার ভাবে আরো একদিন আসবে অলোককে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু ভয় পায়, যদি কেউ দেখতে পায়! যদি বাড়িতে জানিয়ে দেয়, তাহলে মহা কেলেঙ্কারি হবে। ঘুরতে ঘুরতে কথক ঠাকুরের কথা কানে যায় তার। নীলা দাঁড়িয়ে পড়ে। শুনতে থাকে কথক ঠাকুরের ব্যাখ্যা। ইচ্ছা থাকলেও নীলা বেশিক্ষন দাঁড়ায় না মেলার মাঠে। বেশি দেরি করলে বাড়ি ফিরে আবার অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে ভাবে কেবল বাইরের ডাকেই কি কেউ ঘর ছাড়ে? নাকি ঘরের পরিস্থিতি বাধ্য করে ঘর ছাড়তে?
সংসারের চক্রব্যুহে আটকে দিশেহারা হয়ে পড়ে নীলা। ছটফট করতে করতে মুক্তির পথ খোঁজে। কিন্তু কোনো পথই সে খুঁজে পায় না। সে যেন কোনো এক অন্ধ গোলক ধাঁধায় আটকে পড়ছে। ক্রমশ চারিদিক যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয় তার। এই অন্ধকার কি কাটবে তার জীবন থেকে?
নীলার মুখ দেখে অলোক বুঝতে পারে তার মনের কথা। সে বলে - আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, কালো মেঘ কেটে গেছে। সূর্যের কিরণ উঁকি দিচ্ছে। কি সুন্দর একটা দিগন্ত জোড়া রামধনু তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তোমার জীবনের কালো মেঘ একদিন কেটে যাবে। তোমার জীবনেও রামধনু হেসে উঠবে। ভালোবাসার ফুল ফুটবে।
- না গো, হবে না, হবে না ! আমার অবস্থা খাঁচা বন্দি পাখির মত। আমার কোনো মুক্তি নেই। বদ্ধ খাঁচার মধ্যে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে শেষ হয়ে যাবে আমার জীবন!
- কে বলেছে মুক্তি নেই? খাঁচার পাখি আবার ডানা মেলে উড়বে। আবার গান গাইবে। তুমি রাজি থাকলে আমরা এখান থেকে অনেক দুরে চলে যাবো। বল যাবে?
- কোথায় যাবো?
-যাবো অনেক দুরে। ঐ দিগন্তের ওপ্রান্তে। যেখান থেকে ঐ রামধনুটা উঠেছে তোমাকে দেখে হাসবে বলে। নাম না জানা হাজারো ফুল ফুটে উঠবে তোমাকে ঘিরে। সেই অচিন দেশে তোমাকে নিয়ে যাবো আমি। বল যাবে?
কাজের শেষে বাড়ি ফিরছে নীলা চন্ডি মন্ডপের পাশের মাঠে আজও মেলা বসেছে। ভাঙা মেলা। লোকজন কম। কথক ঠাকুর আজও গান গাইছে ।
একজন স্রোতা প্রশ্ন করে - তবে কি শেষ জীবনটা রাধার খুব দুঃখে আর একাকীত্বে কেটেছে?
- মা গো, রাধাতো সাধারন নারি নয়। দেবী লক্ষ্মী রাধা রূপে এসেছিলেন এই ধরা ধামে। তার আবার দুঃখ কি? তার আবার একাকীত্ব কি? হয়তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নারি জাতিকে একটা শিক্ষা দিয়েছিলেন এই লীলা খেলার মাধ্যমে। কোনো অবস্থাতেই তারা যেন সংসার না ভাঙে। ঘাটের ভরসায় ঘর না ছাড়ে ।
আর দাঁড়ায় না নীলা। বাড়ির দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে।
ঘাটকে ভরসা করে ঘর ছাড়তে চলেছে নীলা। অলোকের হাত ধরে সে পাড়ি দেবে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে। হেঁটে চলেছে সে। কাঁধে একটা বড় ব্যাগ। তার মধ্যে আছে অজানা ভবিষ্যতের কিছু পাথেয়। আছে মোবাইল ফোনটাও। ব্যাগে মধ্যে ফোনটা বেজে উঠলো টিক টিক করে। একটা ম্যাসেজ এলো। ফোনটা বের করে নীলা দেখলো অসিতের ম্যাসেজ। লেখা আছে - সব সময়ে সত্যি কথা বলা যায় না। সব সময়ে প্রতিবাদ করা যায় না । আমিও পারিনি। তবে গত কয়েক মাসে দিন রাত ওভার টাইম করে পঁচিশ হাজার টাকা জমিয়েছি। ড্রয়ার থেকে নিয়ে তুমি মাকে দেবে। বাকি টাকাটা তুমি আমি মিলে খুব তাড়াতাড়ি শোধ করে দেবো। তারপর শুরু করবো আমাদের নতুন জীবন।
ম্যাসেজটা পড়ে হতভম্ব হয়ে যায় নীলা। থমকে দাঁড়ায় পথের মাঝে। এতোদিন সে অসিতকে ভুল বুঝে ছিল! এতোদিন এক ঘরে থেকেও সে বুঝে উঠতে পারেনি অসিতকে! তার প্রতি এতটা নিরব প্রেম জমে আছে অসিতের মনে, অথচ সে টেরই পায় নি! তবে কি তার নিজের মধ্যে কোনো খামতি ছিল? এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে? ঘরে না ঘাটে? কাকে আঁকড়ে ধরবে? নিরব প্রেম না উচ্ছ্বসিত ভালোবাসাকে? ভাবতে থাকে নীলা।
*********************************************************************
পেশা মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ। স্কুলের পত্রিকায় নিয়মিত লেখার অভ্যাস থাকলেও। তারপর দীর্ঘ বিরতি। লকডাউনের প্রথম বছরটা(2020) কেটে যায় টিভিতে রামায়ণ, মহাভারত দেখে। লকডাউনের দ্বিতীয় বছরের (2021) অখন্ড অবসরে লেখালেখির দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু ।
সাম্প্রতিক লেখা - প্রজাপতি সাহিত্য পত্রিকা/ সৃজন সাহিত্য পত্রিকা/ রংমিলন্তি প্রকাশন/ কারুলিপি অনুগল্প সংকলন/ অবেক্ষন/ ড্যাস সাহিত্য পত্রিকা/ লেখা ঘর সাহিত্য পত্রিকা/ মৌনমুখর সাহিত্য পত্রিকা/ তুলি কলম আকাশ/ ঘোড়সওয়ার/ স্নিগ্ধা প্রকাশন/ নীরব আলো প্রভৃতিতে প্রকাশিত হয়েছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন