বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

স্বপন নাগ

 


এই পৃথিবী জুড়ে আছে ভালোবাসাময়


স্বপন নাগ


আধা মফঃস্বল একটা শহর। পাড়ার মধ্যে দিয়ে একটা সরু গলি ধরে রাস্তা। রাস্তাটা এতই সরু যে, সন্ধে হবার আগে আগেই অন্ধকার ঘিরে ফেলত সমস্ত চত্বর। সেই অন্ধকারের সঙ্গে নির্জনতাও। রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে খানিক দূরেই গঙ্গার পারে বাঁধানো ঘাট। জোয়ার-ভাটায় ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে জল ওঠা-নামা করত, এ দৃশ্যটুকুও বেশ উপভোগ করার মত। জোয়ারের সময় জল এসে আছাড় খেত সিঁড়ির কাছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে যেন কত কথাই না সে বলে চলে।

সেই সব কথা মগ্ন হয়ে শোনে ওরা দুজন। নাসির আর শম্পা। রোজ সন্ধ্যায় ঘাটে বসে-থাকা যেন ওদের নৈমিত্তিক কাজ। পিছন দিকের সরু গলির রিক্সার শব্দ, সাইকেলের ঘন্টির আওয়াজ, গঙ্গার ওপারের রাস্তা দিয়ে ছুটে-চলা বাসের হর্ণকে ছাপিয়ে মুখরিত হয়ে উঠত ঘাটের পারে জলের অবিরাম ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। শম্পার হাতটি নিজের হাতে নিয়ে নির্বাক বসে থাকে নাসির। এভাবেই আরেকটু সময় গেলে, ছাড়াছাড়ি হবার আগে এসে দাঁড়ায় গলিরই একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে। সময় চলে যায়, ওদের কথা আর শেষ হতে চায় না !

একদিন এক শীতের সন্ধ্যায় একদল ছেলে এসে ঘিরে ধরল ওদের। হাতে তাদের লাঠি, হকি স্টিক, রড। এলোপাতাড়ি মারে রক্তাক্ত করে ফেলল নাসিরকে। পুলিশ এলো। পরের দিন খবর হল গণপ্রহারের : 'গণবিক্ষোভের শিকার প্রেমিক যুবক।' নাসিরকে নিয়ে যাওয়া হল নার্সিং হোমে। দু'দিনের যমে-মানুষে লড়াইয়ে একসময় হেরে গেল নাসির। সে মারা গেল।

মুসলমান হয়ে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা ! 'অপরাধ'-এর শাস্তি দিয়েছে এলাকার 'শান্তিকামী' জনগণ। যেহেতু জনগণ, শাস্তি তাই কারোরই হল না।

শাস্তি পেল মেয়েটি। শম্পার বাড়ির কঠোর শাসনে বন্ধ হল তার একা-চলার স্বাধীনতা। পায়ে পায়ে বেঁধে দেওয়া হল অনুশাসনের বেড়ি। ঘরে বাইরে, চিন্তায় ভাবনায় রক্তাক্ত হতে হতে একদিন হেরে গেল সেও। ঠিক দশ দিনের মাথায় পাওয়া গেল সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত তার দেহ। নিজে হেরে, নাসিরকে হারিয়ে , ভালোবাসাকেই যেন জিতিয়ে দিল শম্পা।

এই ঘটনার পরে অনেক অনেক রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। তোলপাড় চলছিল ভাবনার। যে-ঘাটে ওরা বসে থাকত, যে-ল্যাম্পপোস্টের নিচে ওরা গল্প করত, সে সব জায়গায় গেলে আশ্চর্য এক অসহায়তা আমাকে গ্রাস করে ফেলত। 'গলির শেষে যেখানটা ঠিক অন্ধকারের শুরু' লাইনটা হঠাৎই এসে যায় একদিন।  গলির শেষের অন্ধকার, না আমাদের ভাবনার মধ্যেকার অন্ধকার, গাঢ়ত্বে কে এগিয়ে এ প্রশ্নে আলোড়িত হতে থাকি সর্বক্ষণ। একদিকে বাস রিক্সা ভ্যানের সচলতা, অন্যদিকে  নিবিড় নিভৃতির নৈকট্যকে শব্দে সাজাই পরের স্তবক। পরবর্তী স্তবকে আসে সমাজের স্বঘোষিত অভিভাবক পুরোহিত আর জ্যোতিষের প্রসঙ্গ।

ভালোবাসার আবার শুদ্ধ-অসুদ্ধ হয় নাকি ! তবুও, এ কবিতার শেষ পংক্তিতে 'শুদ্ধ ভালোবাসা' শব্দবন্ধ এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যা ভালোবাসা, তা শুদ্ধই। ওরা তো হাত পেতেছিল দুজন দুজনের কাছে। হাত পেতেছিল ভালোবাসার কাছে। ভালোবাসা সমাজের কোনো পৌরোহিত্য মানে না, কোনো তর্জনী বা নির্দেশের পরোয়া করে না। সেই নির্দেশকেই উপেক্ষা করেছিল নাসির আর শম্পা। আমারও ভাবনাতে সে উপেক্ষা আজও সজীব। যা ভালোবাসা, তা তো হৃদয়-উৎসারিত এক বোধ। হৃদয়ের কিংবা বোধের আবার হিন্দু-মুসলমান  হয় নাকি ? বিশ্বাস করি, মনের মানুষকে চাওয়া আর ভালোবাসায় তাই যে-কোনো নির্দেশই উপেক্ষনীয়। কেননা, 'এই পৃথিবী জুড়ে আছে ভালোবাসাময়।'



তোমাকে চাই

স্বপন নাগ


গলির শেষে যেখানটা ঠিক অন্ধকারের শুরু

ল্যাম্পপোস্টের নিচে দু'জন --

                         দুরুদুরু

                              ভয় ....

বুকের মধ্যে রক্ত নাচে অস্থিরতাময় !


বাস যাচ্ছে

        রিকশ ও ভ্যান

                অন্ধকারে মিশে .....

একটি আকুল হাত পেতেছে

                 অমৃত ও বিষে !


কিসের সঙ্গে কিসের মিলে

রাজযোটক যে হয় -

পুরোহিত আর জ্যোতিষ বসে

                     নির্ধারণ করুক ;

হিন্দুতে নয়, মুসলমানেও

যতই রক্ত ঝরুক -

এই পৃথিবী জুড়ে আছে

                     ভালোবাসাময় !


অন্ধকার আর স্পন্দিত বুক

জাগে আশায় আশায় .....


তোমাকে চাই তোমাকে চাই

শুদ্ধ ভালোবাসায়।


****************************************************************



 স্বপন নাগ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন