[ 'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ৯
দীপংকর রায়

দিন চলে যায় এমনই কত ঠিক অথবা ভুলের ভেতরে......! এমনই সে সব অবগাহন পর্বে আস্তে আস্তে অভ্যস্থ হয়ে উঠছি , কতরকমের অভ্যাসের ভেতরে ! যেখানে দুটি গাই গোরু রয়েছে । তাদের দুধের হিসেব নিকেশ, দানা-ভুসি , খোল-বিচালির গন্ধের ভেতর গোবর - চোনায় মিশে আছে যেন একটি সংসারের চারপাশ ।
সে সব কাজকর্মের পরে একটুখানি যা অবসর তাও ইদানীং এলোমেলো ঘোরাঘুরির ভেতরেই কেটে যায় । আর তার পরে যেটুকু , সে তো শরৎবাবুর শ্রীকান্ত নিয়ে নেয় ।
যেখানে শ্রীকান্ত চির জীবনের কথা দিয়ে রাজলক্ষ্মীর কাছ থেকে বিদাই নিয়ে চলে যায় মগদের দেশে জীবনের কঠিন বাস্তবকে দেখার জন্যে ।
আজ পড়ছিলাম সেই অধ্যায়টি ।
কদিন ধরেই রেখেছিলাম দ্বিতীয় খণ্ডটি বিছানার মধ্যে । আজ মেলে ধরলাম সেটিই । লেখক শুরু
করছেন এই বলে , " এই ছন্নছাড়া জীবনের যে অধ্যায়টায় সেদিন রাজলক্ষ্মীর কাছে শেষ বিদায়ের ক্ষণে চোখের জলের ভিতর দিয়ে শেষ করিয়া দিয়া আসিয়াছিলাম, মনে করি নাই , আবার ছিন্ন সূত্র যোজনা করিবার জন্য আমার ডাক পড়িবে । কিন্তু ডাক যখন সত্যিই পড়িল , তখন বুঝিলাম , বিস্ময় এবং সঙ্কোচ আমার যত বড়ই হোক , এই আহবান শিরোধার্য করিতে লেশমাত্র ইতস্তত করা চলিবে না ।
তাই আজ আবার এই জীবনের বিশৃঙ্খল ঘটনার গ্রন্থিগুলা আর একবার বাঁধিতে প্রবৃত হইয়াছি ।
আজ মনে পড়ে , বাড়ি ফিরিয়া আসার পরে আমার এই সুখ-দুঃখে মেশানো জীবনটাকে কে যেন হঠাৎ করিয়া দুই ভাগে ভাগ করিয়া দিয়াছিল । তখন মনে হইয়াছিল, আমার এই জীবনের দুঃখের বোঝা আর আমার নিজের নয় । এ বোঝা বহিয়া বেড়াক সে , যাহার নিতান্ত গরজ । অর্থাৎ আমি যে দয়া করিয়া বাঁচিয়া থাকিব , এ তো রাজলক্ষ্মীর ভাগ্য । চোখে আকাশের রঙ বদলাইয়া গেল । বাতাসের স্পর্শ আর একরকম করিয়া গায়ে লাগিতে লাগিল ----- কোথাও যেন আর ঘর-বার , আপনার পর রহিল না । এমনই এক প্রকার অনির্বচনীয় উল্লাসে অন্তর-বাহির একাকার হইয়া উঠিল যে, রোগ কে রোগ না বলা , বিপদ কে বিপদ বলিয়া আর মনে
হইল না । সংসারের কোথাও যাইতে , কোনো কিছু করিতে দ্বিধা-বাধার যেন আর লেশ মাত্র সংস্রব রহিল না ।… "
এর পরেই লিখছেন , " এ সব অনেক দিনের কথা । যে আনন্দ আর আমার নাই , কিন্তু সেদিনের এই একান্ত বিশ্বাসের নিশ্চিন্ত নির্ভরতার স্বাদ একটা দিনের জন্যেও যে জীবন উপভোগ করিতে পাইয়াছে , ইহা আমার পরম লাভ । অথচ হারাইয়াছি বলিয়াও কোনোদিন ক্ষোভ করি নাই । শুধু এই কথাটাই মাঝে মাঝে মনে হয় , যে শক্তি সেদিন এই হৃদয়টার ভিতর হইতে জাগ্রত হইয়া , এত সত্বর সংসারের সমস্ত নিরানন্দ কে হরণ করিয়া লইয়াছিল , সে কি বিরাট শক্তি ! আর মনে হয় , যেদিন আমারই মত আর দুটি অক্ষম , দুর্বল হাতের উপর এত বড় ভারটা চাপাইয়া না দিয়া , যদি সমস্ত জগৎ ব্রম্ভান্ডের ভারবাহী সেই অখন্ড বিশ্বাসের সমস্ত বোঝা শপিয়া দিতে শিখিতাম তবে আজ আর ভাবনা কি ছিল ? কিন্তু যাক সে কথা । "
এর পর নানা কথা ------ রাজলক্ষ্মী কে আবার কাছে পাওয়া তার বাড়িতে । এবং রাজলক্ষ্মীর নানা প্রশ্নের এক একটা জায়গা এরকম : ........ আগে বল , ওই লোকটা এখানে থাকতে তুমি আমাকে কেন মন্দ মনে করনি ?
না ।
পিয়ারী আবার একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল , কিন্তু আমি যে ভালো নই , সে তুমি তো জানো ? তবে কেন সন্দেহ হয় না ?
প্রশ্নটা অত্যন্ত কঠিন । সে যে ভালো নয় , তাও জানি , সে যে মন্দ এও ভাবিতে পারি না । চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম ।
হঠাৎ সে চোখ মুছিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, আচ্ছা , জিজ্ঞেস করি তোমাকে , পুরুষ মানুষ যত মন্দই হয়ে যাক , ভালো হতে চাইলে তাকে ত কেউ মানা করে না ; কিন্তু আমাদের বেলায় সব মন্দ কেন ?
অজ্ঞানে , অভাবে পড়ে একদিন যা করেচি , চিরকাল আমাকে তাই করতে হবে কেন ? কেন আমাদের তোমরা ভালো হতে দেবে না ?....."
শ্রীকান্ত পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ের এই আরম্ভের কথপকথন।এই আত্মজাগরণ উভয়ের মধ্যে । তার এক একটি অভিব্যাক্তির সঙ্গে কোথায় কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগলাম । এবং কেন জানি না সমস্ত দুপুর , বিকেল বেলাটা , সন্ধ্যা ঘুরে গেলেও আমি আজ একটি মুখকেই ভেসে উঠতে দেখলাম বারবার আমার চোখের সামনে ,
সে আমার নতুন মামিমা । কেন জানি বারবার মনে হতে লাগলো , এ জগতে এমন কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে, যাদের এক-কথায় অর্থ করা যায় না । সেই সব সম্পর্কের মায়া-টান এমনই , সেখানে কত অর্থ গোপন রেখে অনাদি কাল এমন কিছুর অর্থ দান করে যেতে থাকে , যাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অথচ তার দুই হাতে উজার করে দেওয়া স্নেহ মমতার অজানা দানে , এই জীবনটা কত প্রাচুর্যে যে ভরে থাকে ;---তা শ্রীকান্ত যেমন অন্নদাদির কাছ থেকে পেয়েছিল , রাজলক্ষ্মীর কাছ থেকে ; তেমন ঘটনাবহুল হয়তো আমার নতুন মামিমার কথাটি নয় , তবে , তার কাছে আমার নিরুপদ্রব আশ্রয় যেটুকু ছিলো , তা আর কারো কাছে তো ছিল না !
কেন জানি আজ বারবার তার কথাটি-ই মনে পড়তে লাগলো।
বারবার মনে পড়তে লাগলো তার অনেক না বলা কথাগুলি । অনেক সন্ধ্যা বেলার ,অনেক দুপুর বেলার , সঙ্গ-সুখানুভূতির মুহূর্তগুলি ভীষণ মনে পড়তে লাগলো । সে নানা ভাবে , নানা অজানা অর্থ দান করে যেতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে পড়তে লাগলো, কল্যানীর কথা ।
সেও কি কম ?
সেই ওর ছেলেমানুষী , সেই ওর সকল দাবি ; নিশ্চুপে সঙ্গ দিয়ে যাওয়া দিনের পর দিন মাছ ধরার সময় ।
সেই ওর ভোর বেলায় বকুল ফুল কুড়িয়ে আমার পড়ার টেবিলের উপর রেখে যাওয়া নিঃশব্দে ; তার মধ্যে কি হাজার হাজার রাজলক্ষ্মীর মুখ আমি খুঁজে পেলাম না কি ?!
এর পরে শ্রীকান্ত অভয়া পর্বে , যেখানে অভয়ার জীবন জটিলতার অমীমাংসিত পর্বে অভয়া তাকে বিবেচকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে , একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো , সে প্রশ্নের উত্তর কি এই এত বছরের পরে এসেও খুব সহজ ভাবে তার সমাধান হয়েছে ?
নাটক যাত্রাপালা এসব ওদেশে থাকতে সেই যে দেখে চলে এসেছি , এখানে এসে তা আর সেভাবে হয় নি ।
মাঝে অবশ্য দুদিন দু ' জায়গায় গেছিলাম যদিও ; তাই হয়ে ওঠেনি কথাটা ঠিক না । একদিন দিদি , জামাইবাবু , মা ও ভাগ্নেটিকে সঙ্গে করে নানু বাবুর বাজারের পেছনের মাঠটায় দেখেছিলাম 'চেঙ্গিস খাঁ ' যাত্রাপালা ।
আর একদিন , শঙ্কর, ফোচন ওদের সঙ্গে সাজাহান পালা টি ।
এদেশের যাত্রাপালা তো আর ওদেশের যাত্রাপালার মতো সারা রাত্তির ধরে হয় না। কিম্বা সঙ্গে নানা ধরণের নাচ গানও থাকে না ।
ওদেশে পালার মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে এমন সব নাচ গান থাকে , যা না থাকলে ওদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ-জনেরা সে পালা দেখবেই না ।
এদেশে যাত্রাপালা , সে যত বড় ই হক না কেন ; তার সময় সীমা তিন চার ঘন্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শুধু পালাটাই আসল । তাতে অতিরঞ্জন নেই ।
তাই পালা দেখার মুগ্ধতাটাই নিতে হবে । যাত্রার ভেতর দিয়ে বাড়তি মনোরঞ্জনের অন্য কোনো সুযোগ নেই। ওই তিন চার ঘন্টার মধ্যেই দর্শক কে যতটুকু নাটকীয় মুগ্ধতা দেওয়া যায় , সেইটুকুই ।
ওদেশে যাত্রাগান শুনে এসে পরদিন কি তারও পরের দিন , সেই কাহিনীর রেশ চলাচল করতো মনের ভেতরে ; কেমন যেন সকল চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেয়ে বেশ খানিকটা সময় বুঁদ হয়ে থাকা এমনই একটা ভাব । এবং সেই ঘোরটুকু নিয়েই ঘুরে বেড়ানো ছিলো অন্তত আমার ক্ষেত্রে হয়তো খানিকটা বেশিই ।
কিন্তু এদেশের যাত্রাপালা শুনে এসেও সে জিনিস হলো ঠিকই খানিকটা , কিন্তু তা বেশি সময় ভেতরে বইতে পারা গেল না কেন যে, তা জানি না ।
সেটা কি ওই দেশের নানা দিক দিয়ে একটা অবস্থানগত নিভৃতির কারণ ?
নাকি আর কোনো মনোরঞ্জনের কিছু ছিল না বলে, বছরে একবার এই ধরণের একটা বিষয়ের রেশ অধিক জায়গা নিয়ে নিত মনের ভেতরে ?
এখানে নানা ধরণের হয়তো প্রচারের সুযোগ সুবিধা থাকার কারণে, টি . ভি , রেডিও , সিনেমা , নাটক , নানা কিছু ; তাই সেই নির্জন তার প্রভাব টা অতটা অনুভব করতে পারলাম না যেন ।
তবে , চেঙ্গিসএর রেশ বেশ কিছু দিন ছিলো ।
যাত্রাপালার কথা থাক ।এখন তো এখানে পাড়ার ক্লাবে ক্লাবে বড় বড় তাঁবু খাটিয়ে যে উনিশ পয়সার সিনেমা আরম্ভ হয় বর্ষার সময়টা পেরোলেই ; পুজো-টুজো মিটে যাবার পর পরই এক এক ক্লাবের আয়োজন শেষ হলেই অন্য ক্লাবের উন্নয়ন বাবদ শুরু হয়ে যায় এই সব সিনেমা ।
এ উন্নয়ন সে উন্নয়ন উপলক্ষে এই যে উনিশ পয়সার সিনেমা দেখার হিড়িক পড়ে যায় । মাইকিং আরম্ভ হয়ে যায় প্রায় সারা দিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় ; আজ কি দেখানো হবে, আগামীকাল কী কী দেখানোর সম্ভাবনা আছে , সেই সব —-।
সঙ্গে যদিও আর একটি কথা থাকে , যদি ফ্লিম পাওয়া যায় তবেই , এই সবের এনাউন্সমেন্ট ; সে ক্ষেত্রে ছবির পরিবর্তন হয় একরকম রোজ ই । বলা হয় , না , আজ এই বইটা পাওয়া গেল না । অমুক ফ্লিমের বদলে অমুক ফ্লিম টা দেখানো হবে আজ ।
আর ঠিক তখনই পাড়ার ভেতরে কীরকম একটা সোরগোল পড়ে যায় সেই সিনেমা টি দেখবার জন্যে ।
তবে সবটাই ছবির জনপ্রিয়তার উপর টিকিটের ডিম্যান্ড ।
কোথাও কোথাও চেয়ারের ব্যবস্থা থাকে। কোথাও আবার চট বা শতরঞ্চির উপরে বসেই দেখতে হয় মানুষে মানুষে গাদাগাদি করে ।
এই সিনেমা গুলি এসে অবশ্য একটি কাজ হয়েছে ,দুপুর বেলা হলেই যেমন মানুষের সিনেমা হল মুখো সাজগোজ করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটবার যে একটা চেনা জানা চিত্র ছিলো , ----সেটায় কিছুটা যেন ছেদ ফেলে দেয় , এই উনিশ পয়সার সিনেমা দেখার হিড়িক পড়লে । মানুষ - জনের হল মুখো ছুটবার লাইন আর দেখা যায় না , দুপুর বেলা হলে ।
এর পরে সন্ধ্যা বেলায় তাঁবুর নিচের সোরগোলেই মাতে অনেকে।
এই রকম সব দেখতে পাওয়ার কারণ হলো , এই অঞ্চলে কাছাকাছি দুটি আধুনিক মানের সিনেমা হল তৈরি হয়েছে। আর একটিও নতুন তৈরি হচ্ছে । শুনতে পাই সেটি নাকি এর চাইতেও উন্নতমানের হবে ।
এদিকে আজ আবার এরা ধরেছে পাড়ার মাঠের সিনেমা দেখবে না । গঙ্গার পাড়েরটায় যাবে ।
এ সব ক্ষেত্রে যদিও আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কিছুই থাকে না । লজ্জা হয় , প্রতিদিন ওরা পয়সা দেবে , সেটা আবার কেমন ! এক আধ দিন আমারও তো দেওয়া উচিৎ ?
কথায় কথায় বলা হয় যদিও উনিশ পয়সার সিনেমা । বাস্তবে তা কিন্তু না , দু' টাকা তিন টাকা । কোনো কোনো দিন চার ও হয়ে যায় সেটা । এক এক সময় এক এক মূল্য নির্ধারণ করা হয় । তাই , সে ক্ষেত্রে উনিশ পয়সার সিনেমা সেটা শুধু মাত্র একটি ঘরোয়া নাম । কেটাগরী ! যার সঙ্গে ওই কথার কোনো মিল নেই । আর সেই কারণেই একদিন এদের সেই প্রশ্নটা করেই বসলাম , ''কি যে তোরা উনিশ পয়সার সিনেমা , উনিশ পয়সার সিনেমা করতিছিস ভাই ; এডারে কি সত্যিই সিডা কয় নাকি ? ''
এই যে বন্ধুবান্ধব , এদের সঙ্গে আমার স্কুল কলেজের কোনো বন্ধুত্ব তো নেই ;—-এরা তো সকলেই যার যার স্কুল কলেজ করে । আমি ওদের বাড়তি সময়ের সঙ্গী শুধু মাত্র । তাও আমাদের বাড়িতেই বেশি । কারো বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারার মতোন সামাজিক কোনো পরিচয় আমার নেই তো !
আমাদের বাড়ির এই আড্ডার খবরাখবর পাড়ার অন্যান্য ছেলেপেলেদের মধ্যেও নাকি আজকাল আলোচিত হয় ।
তারাও বলে , "ওই কুতুর দাদাটার সঙ্গে এরা সারাক্ষন কি এত আড্ডা মারে রে ! "
আসলে এর কারণও হয়তো শংকর । হয়তো কাল্টু । নাকি ফোচন?
বিশেষ ভাবে হয়তো শংকরই । নানা ভাবে সামাজিক একটি মর্যাদা; নাকি ওর স্কুল-কলেজের পড়াশোনাটাই বিষয় ?
নাকি বর্তমানে সেনজিভিয়ার্সের উপরি সুনাম ?
কাল্টু ও ফোচন স্থানীয় স্কুলেই পড়াশোনা করেছে । মাধ্যমিকে কাল্টুর রেজাল্ট ভালো বলে সেও এখন সেনজিভিয়ার্সে । শংকরের সঙ্গেই যাতায়াত করে । এবং সেখানকার কিছু বন্ধুবান্ধব , তারাও আমাদের আড্ডায় চলে আসে ছুটিছাটার দিনে । তারাও কীভাবে কীভাবে যেন শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে যায় এখানে আসা যাওয়ার কিছুদিন বাদেই !
এদের মধ্যে ফোচনই একটু খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় । বাকি আর সকলেই একটা ধারাবাহিকতার মাঝেই হেঁটে চলেছে।
ফোচনের খাপছাড়া হওয়ার কারণ কি পায়রার পেছনে ছোটা ?
ফাঁক পেলেই গড়িয়ার হাট মুখো সোম শুক্রবার গুলোতে । কয়েক দিন আমিও গেছি তার সঙ্গে দুপুর রোদে গড়িয়ার সেই হাটে । পায়রা কিনতেই না শুধু , সেখানে পায়রা বিক্রিও করে এসেছি তার সঙ্গে ।
ওদের বাড়ির ছাদে , পায়রার বাক্সয় নানা ধরনের , নানা নাম ধামের সেসব বকরবকম ব্যাপারসেপার । আমি সে সবের নাম ধাম শুনি , মনে রাখতে পারি না কিছুই ।
তাই ওর নজর সবসময়ই দেখি আকাশমুখো ।ছাদের এ কোনায় ও কোনায় ঘোরাঘুরি আর হাতে তালি দেওয়া শূন্য-মুখো চেয়ে চেয়ে ।
সে সব দেখে একটুও ছোটো ভাবি না ওকে । বরঞ্চ মনে হয় পায়রা চরিত্রের কতো সুলুক সন্ধান , কত গবেষণা ওর মধ্যে ! কত সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাদের ! এক একটি পায়রার এক এক রকম , যা তার একেবারে নখদর্পনে সবটা ।
কিন্তু বিষয়টা হয়ে গেছে এখানেই গন্ডগোল । ফোচনের কী সুন্দর একটি দরদি মানসিকতা রয়েছে ! কত পর্যবেক্ষণ ! নানা বিষয় পশু পাখি নিয়ে । অথচ স্কুলের গন্ডী টি পেরতে না পেরোতেই , ও ওরকম দিশেহারা আকাশ-মুখিন হাততালির জগতে ঢুকে পড়লো কেন যে ! আমি অবশ্য ওর অনেক মানবিক গুনাগুন লক্ষ্য করি । যা অত্যন্ত একান্তের এবং জনদরদি বললে একটুও বেশি বলা হবে না ।
কিন্তু সে তো যা হচ্ছে তা হোক , পাড়ার মোড়ের আলোচনার প্রধান বিষয় এখন আমাদের বাড়ির এই আড্ডা । তাদের কৌতুহল , " কারা সব এখান থেকে ওখান থেকে নতুন নতুন ছেলেপেলেরা এখানে এসে ভিড়ছে কী কারণে ? কী করে এরা এই ঘরকুনো ছেলেটির সঙ্গে ? যদিও ইদানিং দেখা যাচ্ছে , কালীবাড়িতে , না হলে খালপাড়ে পণ্ডিতের দানাভুসির দোকানে । গোরু - বাছুরের সঙ্গেই তো ওর বেশি যোগ; অথচ তার কাছে এই সমস্ত ছেলেপেলেরা কি এত বকরবকর করে তা কে জানে ? "
শংকর বিষয়টা শুনেছে । তবে ও এসব কানে তুলতে চায় না । কারণ , সেই হচ্ছে এই আলাদা হয়ে যাওয়ার মতন একটা ইমেজ তৈরি তে সব সময় সচেতন ও সতর্কও যেন । তার কথা হলো, " কে কোথায় কখন কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে , মেলা মেশা করবে , তার কৈফিয়ত কি পাড়ার ওই সব ছেলেপেলেদের দিতে হবে ? আমাদের ভালো মন্দর বিচার করবে তারা কেন ? আমরা কি যাচ্ছি তাদের সংশোধন করবার জন্যে ? "
তাই হঠাৎ কেউ উঁকিঝুঁকি মারলেও ; এখানে এসে দাঁড়ালে ; সে তখন এমন একটা ভাব তৈরি করে তাকায় তার দিকে , সে তখন কোনো কিছুই না জানতে চেয়ে যেমন এসেছিল তেমনই ফিরে যায় । সে তার সব অভিসন্ধি গুটিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হবেই । সে ক্ষেত্রে আমাকে আর বলতে হতো না তুমি এখন এসো তো বাছাধন , আমরা এখন একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যাস্ত রয়েছি —ছুটি ছাটার দিন হলে এই আড্ডা শেষ হতে হতে বেলা তিনটে চারটেও বেজে যায় এক একদিন। ইদানীং কাজের দিদির তাতে অস্বস্তিও বেড়ে গেছে ।
আলোচনার বিষয় তো একটা না, সে নানা দিক পরিক্রমা করে ফেরে যেন । সে অলোক থাকলে মাছ , গাছ , যেমন ; ফোচন থাকলে পায়রার অজানা জগৎ ; তার মধ্যে কুকুর, খরগোশ , গিনিপিগ, কী বা নেই ! তাদের দেশ বিদেশে কতরকমের সব নাম -ধাম- খাদ্য -খাবার- উৎপাদন- উদযাপন ; কত কি ! আবার কখনো সিনেমা তো কখনো রবীন্দ্রনাথ , কখনো নজরুল । জীবনানন্দ ব্যাতিত আর অন্য কোনো কবি তখনো পর্যন্ত প্রবেশ করেনি । তবে দেশ পত্রিকা যে একটি সাহিত্যের মূল্যবান পত্রিকা , এটা ওরা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে বেশ গম্ভীর গলাতেই ।
অতি কষ্টে পঞ্চাশ পয়সা থেকে সম্প্রতি একটাকা দিয়ে তার প্রত্যেকটি সাপ্তাহিক সংখ্যাগুলি সংগ্রহও করে চলেছি । সেগুলিকে সামনে ফেলে ,একেবারে যেন কাট চেরাইও চলছে ; ভালো মন্দর ধারণা সবটাই এদের । আমার নীরবে হজম করে যাওয়া ছাড়া ব্যাক্তিগত অভিমতটি জানানোরও অধিকার ছিল না সে সবে । কারণ সমর্থন মিলবে না সে অভিমতের একটিরও । তবে একথা শুনতে হতো প্রায়-ই ----" কীরে , লিখতে পারবি এখানে ? এখানে না লিখতে পারলে কিন্তু তোমার কবিতার কোনো কদরই হবে না , সমাজের কোথাও । "
তারপরেই বলতো শংকরই , " আমি কিন্তু এই কথাটা শুনে শিখেছি । আমাদের নাগতলার ইংরেজীর মাস্টার মশাই কেদার বাবু বলেছেন এই কথাটা । "
কেদার ভাদুড়ির কবিতা মাঝে মধ্যে ছাপা হতে দেখি দেশ পত্রিকায় । জিজ্ঞাসা করি ," ইনিই কি সেই কেদার ভাদুড়ি ? "
শংকর বলে ," হুঁ........তিনিই বলেছেন এই কথাগুলি । ওখানে লেখা ছাপা হলে তবেই তোমার একটা সামাজিক পরিচয় হলো । তাছাড়া টাকাও তো ভালোই পাওয়া যাবে ! তাই বলছি ওখানে লেখা ছাপা হলে তবেই তোমাকে লোকে- জনে কবি বলে মানবে । "
একদিকে শংকরের এই কথা বলার মধ্যে দুটি দিককে আমি লক্ষ্য করি , কারণ ওর এই কথাগুলি বলার মধ্যে একটা মিচকি হাসিও আছে যে , তাও আমি লক্ষ্য করেছি খুব ভালো করে । তাও বেশ খানিকটা মুষড়েও পড়ি মনে মনে। আবার মনে মনে ভাবিও , এরা কী এমন লেখে, যার কিছুই তো আমি বুঝি না ! তাহলে ওখানে লিখবো কেমন করে ?
ওরা চলে গেলে গতকালের নিজের লেখাটি মেলাই দেশ পত্রিকার বিভিন্ন কবির কবিতার সঙ্গে । না , এদের লেখালিখির সঙ্গে কোথাও কোনো একটা জায়গায়ও তো আমার লেখালিখির সঙ্গে মিলছে না ! অন্তত একটুখানি মিলও তো পেতে পারতাম ! কিন্তু কিছুই মিললো না তো ! তাহলে কি করি ?
কাউকেই বলি না । ঘটনাটা আড়ালেই রাখি । আড়ালে আড়ালেই এই সব ঘটতে থাকে ।
নানা ভাবে তাকে এদিক ওদিক করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি । নিজের কোনো একটি লেখাকে ওদের মতো করে দাঁড় করাতেও চেষ্টা করি । কিন্তু এই যে এতগুলি লেখা , যে লেখার সঙ্গে আমি আমার লেখার ধরণ পাল্টে ওদের মতো করতে চাইছি ; কিন্তু তা কার মতো করবো ? এখানে তো সকলেই এক তালে , এক ভাষায় , এক ধরণেই লিখছে ! এখানে কে কার থেকে ভাষায় ভাবে আলাদা ? কি বৈশিষ্ট্য তাতে , বিশেষ একটি দিকের ? তা তো বুঝতে পারছি না ! এদের একে অন্যের ভাষার সঙ্গে বিশেষ কোনো আলাদা কিছু তো খুঁজে পাচ্ছি না ! তাহলে কি এখানে সেরকম লেখাই ছাপা হয় , যা এক সুরে , এক তালে , এক ভাষায়ই লেখা হয় ? হয়তো তার একটা বিশেষ বয়ান আছে । আলংকারিক সামঞ্জস্যতা আছে নাকি ? তা না হলে আমি যে এতবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওদের মতো দাঁড় করাতে চেষ্টা করছি , কই , তাতো কিছুতেই হচ্ছে না দেখতে পারছি ! কাটতে কাটতে , ঘোরাতে ফেরাতে যেয়ে দেখতে পারছি , আমার লেখাটির তো আর কোনো অবশিষ্ট থাকছে না কিছুই ; শেষে পুরোটাই বাদ পড়ে যাবে নাকি খাতা থেকে ?
তাই ফের পুরোনো লেখাটিকেই টুকে রাখি , কেটে ফেলা লেখাটি বাদ দিয়ে ।
ওখানে ছাপা লেখার মধ্যে সম্পূর্ণ একটি ছবি আমি খুঁজে পাই না কোথাও । তাকে এদিক দিয়ে ভাবতে যাই তো , ওদিক দিয়ে সে আবার পালিয়ে যায় । হতে পারে হয়তো তার সকল অনর্থ আমার বোঝাবুঝির মধ্যেই ; কোনো দিক দিয়েই তাতে আমি একটি সম্পূর্ণতার মুখ দেখতে পাই না । ভাবি , কী যে এরা বলে উঠতে চায় , এদের লেখার মধ্যে দিয়ে , তার তো আমি কিছুই বুঝি না ! এবং এতে বেশ অস্থির ও হয়ে উঠি মনে মনে । পরে এক সময় আড়ালেই সেই যুদ্ধ ,ধস্তাধস্তিটা বাদ দিয়ে , ওরা ডাকতে এলে , ওদের সঙ্গে চলে যাই সন্ধ্যে বেলার উনিশ পয়সার সিনেমা দেখতে তাঁবুর তলায় ।
ওমা ! এখানেও একই অবস্থা? ওরা কী সুন্দর 'ওয়াক্ত ' ছবি দেখে পরদিন আলোচনা করে , বলরাজ সাহানীর কী অভিনয় ! ওমুক একেবারে বাঘা আর্টিস্ট !
আমি কিছুই বুঝি না । হাঁ করে চেয়ে থাকি । ওদের অবশ্য বুঝতে দিই না , বিষয়টা নিয়ে একবার শুধু একথাটাই বলি, এই ভাষাটাই তো বুঝি না ! তোরা কি সুন্দর বুঝিস রে ভাই …… !
তাহলে কি আমার ভাষাবোধেই সব গন্ডগোল ?
সব ক্ষেত্রেই একটা ঝাপসা ঝাপসা ভাব । সব যেন কীরকম ধরেও ধরতে পারি না কিছুতেই ।
ওরা একদিন ' নিশিপদ্ম ' দেখে এসে বললো , হিন্দিতে এই বইটির কী যেন নাম হয়েছিলো ? মনে নেই । যাইহোক , রাজেশ খান্নার সঙ্গে তুলনা না করে , কত আলোচনা করতে লাগলো ওরা ! আমি তো ছাই এই সব তারতম্যের মাথামুন্ডু কিছুই জানি না । শুধু কেন জানি না , যেদিন পথের পাঁচালী দেখলাম , সেদিন আবার আমি আমার সেই ফেলে আসা ওদেশের গ্রামটিতে চলে গেলাম । কী মনখারাপ হলো ! অপু দূর্গার সমস্ত বিচরণ ভূমি আমার চোখে জল এনে দিলো । আপন মনে লুকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম । অথচ কাঁদবার কারণ তো ইন্দির ঠাকরণ না ! কাঁদবার কারণ কি দূর্গার মৃত্যু ? কই , সেটাও তো না সবটা ! অপু দূর্গার জন্যে মনখারাপের জায়গাটা কি ? না , তাও তো না ! তাহলে ? কোথায় যে ভেতরটা মুষড়ে উঠলো অমন ; সেটাই ভাবতে থাকি সকল সময় ।
যদিও পরে বুঝতে পেরেছিলাম পথের পাঁচালীর প্রকৃতিই তো আমার ফেলে আসা সেই প্রকৃতি ! সমস্ত মনটা জুড়ে এখনো যে ছায়া ফেলে রয়েছে । সে তো রোদ-বৃষ্টি ঝড়- জলে মাঠে -পুকুরে , নানা অনটনের চিত্র বুঝিয়ে আজও সেখানেই রেখেছে আমাকে । যেখানে পথের পাঁচালী শুরু এবং শেষ হলো । সেখানের আমিই তো সেই আমি, যাকে সত্যি সত্যি কি আজ খুঁজে পেলাম ?
এর বেশ কিছুদিন পরে দিদির বাড়িতে টেলিভিশনে শ্রীকান্ত অন্নদা দিদি বা বড়দিদি , অভয়া শ্রীকান্ত ও শাপমোচন চলচ্চিত্রটি দেখেও একই অবস্থা । কেন জানি না মনটা বারবার ফিরে যেতে চায় সেখানেই ---- যেখানে সমস্ত ঝড় জল মাথায় করে মামাদের সঙ্গে বাগানে যেয়ে আম কালে হয়তো কয়েকটি কাঁচা আম বা একটি নারকেল কিম্বা হাতে একখানি নারকেল ডেগো কুড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসে বাড়ির উঠোনের উপরে ধপাস করে ফেলার মধ্যে যে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ , তাতেই যে প্রশান্তি , ওই গুটিকয়েক কাঁচা আম কিম্বা ওই একটি নারকোলের ডেগোর মধ্যে , বা একটি নারকেলের মধ্যে , কী এমন সম্পদ ছিলো , যা আমায় আজও সেখান থেকে চলে আসবার পরেও , মনটাকে একটা বিরাট মমতার ছায়ায় ফেলে লালন করছে , সেই অমূল্য ধনটি কে ঘিরে কেবলই ; আরো কি কোনো কিছুই নেই তার সঙ্গে ?
সত্যিই কি এতই মূল্যবান বস্তু সে?
তাহলে সেই হাহাকারই তো সকল বিষয় হয়ে উঠতে পারে ! যেখানে মন আনন্দ পায় আজও ফিরে চেয়ে !
এর পর বেশ কিছুদিন আর খাতা বের করিনি এদের সামনে । কারণ , তখন আমি ফিরে চলেছি সেখানে , যেখানে আজই প্রথম জানতে ও বুঝতে পারলাম , সেই জীবনই আমার মনের দেশ ।
হয়তো সে আমার মনেরই ধন। আমি তার বাইরে যদি অন্য কোনো দিকে ফিরে চাই , তাহলে তাকে আমি মন থেকে বলতে পারবো কোন দিকে চেয়ে ?
এখানে আসবার পরে এই কটি ছেলেপেলেদের মধ্যেই তো আমার সব আদানপ্রদান বোঝাপড়া ; এর বাইরে তো এই বিশাল শহরটি — এই দেশের আরো কত বড় বড় শহর নগর গ্রাম - জীবন রয়েছে ; রয়েছে তাদের কত বৈচিত্র্য ; কত বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাদের ! সে সব কেন আমার বিষয় হয়ে উঠতে দিচ্ছে না , এই মুহূর্তগুলি ?
উত্তর পাই না কিছুই ।
তবে ইদানীং এই লাভটুকু হয়েছে যেমন এই পত্রিকা রেখে ; সেখানে অনেক বই পত্রের বিঞ্জাপন দেখি । সেই সব বই -পত্র সংগ্রহ করতে পারি কীভাবে , সেটাই মনে হয় সব সময় । কত সব বিষয়ের বই পত্র সে সব ! যে ভাবেই হোক সেগুলি সংগ্রহ করবো কীভাবে সেটাই ভাবতে থাকি নিরন্তর ।
সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হয় , এছাড়াও তো আর একটি সংবাদ পাওয়া যায় — কতো সব পত্র পত্রিকার বিজ্ঞাপন থাকে ! এসব কোথায় পাওয়া যায় তাতো বিস্তারিত জানা নেই !
সে কথাটি কার কাছে জানতে পাবো ?
শেষপর্যন্ত সেও শংকরই আবিস্কার করে এনে আমাকে জানায় । জানতে পারা গেছে কলেজস্ট্রিট এবং রাসবিহারীর মোড়ে , দু-জায়গায় দুটি দোকান আছে । সেখানেই নাকি শিল্প - সাহিত্যের এই সব পত্র-পত্রিকা পাওয়া যায় । তাছাড়া সন্ধ্যাবেলায় রাসবিহারীর মোড়ে নাকি একটা আড্ডাও হয় , এই সব পত্র-পত্রিকার দোকানের সামনে । ইচ্ছে করলে সেখানে নাকি আমিও যেয়ে ঘুরে আসতে পারি ।
ওদেশ থেকে মা এবং ভাইয়েরা কেউই এখনো ফিরে আসেনি ।
''রা '' টা যুক্ত হলো হয়তো এই কারণে , কথা আছে , দিদিমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসবে নাকি ওরা , তাই —-;
সে ক্ষেত্রে তার পাসপোর্ট ভিসা যদি এর ভেতরে করানো সম্ভব হয় , তবেই । নিয়ম কানুন তো নতুন এখন , হলেও হয়ে যেতে পারে হয়তো ।
আর এদিকে , দিন কাটছে একই রকম— সকাল বিকেল গোরু বাছুর পরিচর্যা । বিকেল বেলা গুলোয় দুধের খরিদ্দারদের সঙ্গে কাজের দিদির কথাবার্তা আদান-প্রদান শোনা । সুজিত গোয়ালা গোরুর দুধ দুইয়ে দিয়ে যায় দু- বেলাই । এসবের মধ্যে ফাঁক পেলেই দিদির বাড়িতে ও ঠাকুমার বাড়ি ঢু মারা । দিদির বাড়ির বিশেষ টান ছবি দেখার । খবর শোনারও । ঠাকুমার বাড়িতে যাই , আর এক অদ্ভুত টানে , শুনলে হাসি ও পেতে পারে । হয়তো বলবে , এটা আবার কিরকম আনন্দ রে বাবা —- !
আমার কাছে আনন্দটা হলো এই রকমের ,----- ঠাকুমা নিজের জন্যে একটি ঘর রেখে বাকি সব কটাই ভাড়া বসিয়ে দিয়েছে । তার মধ্যে পুরোনো ভাড়াটিয়াও আছে কয়েকজন , যাদের আমি অনেক কাল ধরেই দেখে আসছি । এদের জীবনযাপনের মধ্যে এদেশীও একটা ছাপ । যা ঠিক বাঙালদের সঙ্গে মেলে না । কেন জানি না সে সব আচার আচরণ গুলির ব্যবহারিক দিক গুলি দেখে আমি ভীষণ মজা পাই ।
ঠাকুমার সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনেকটাই অভিভাবক সুলভ । যে কোনো বিষয়ে তারা তার পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না । সব সময় তার কড়া নির্দেশের অপেক্ষায় চেয়ে থাকে যেন সকলে । যার একটুখানি নমুনার কথা উঠলে একথাই বলতে হয় , এমনটি কোথাও দেখিনি এখন আর, ভারাটিয়া বাড়িয়ালির সম্পর্কে ; আর তাই তারা সকল বিষয়েই এককথায় অভিভাবক মানে তাকেই যেন ।
পুব দিকের ঘরের সত্যদার মেয়েটি সম্পা তো ঠাকুমার সব সময়ের সঙ্গী । ফাইফরমাজ যত সব ই সম্পা । আমার সঙ্গে সেই সুবাদে কথা বলা বলি ও গল্প করার একটি সম্পর্ক । সে মাধ্যমিক পাশ করে সম্প্রতি এগারো ক্লাসে উঠেছে । পড়াশোনায়ও বেশ ভালো শুনি ।
সত্য দা এখানে থাকে না । তার একটি আইসক্রিমের কারখানা আছে দূর্গাপুরে । সে সেখানেই থাকে বেশির ভাগ সময় । তার আরও একটি বড় ছেলেও আছে । সে সেখানেই থাকে নাকি । সত্যদার ধর্ম সম্পর্কের এক বোনের কাছেই সে প্রতিপালন হয় ।
এইসব নানা কারণে সত্যদার স্ত্রী ঠাকুমার উপরেই অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। অভিভাবকের মতো ।
আর পূর্ব দিকে , যেখানে আমাদের থাকার ঘর ছিলো , সে ঘরটিতে এখন দত্ত মশাইরা থাকেন ।স্থানীয় বাজারে যাদের মুদিখানার দোকান আছে ।
বাকি দক্ষিণ অংশে , যে দুখানি ঘর আমার মায়ের তৈরি করা ছিলো , তার একটিতে জয়ন্তি দি নামের একজনের সংসার-ধর্ম , সেখানে সে তার সন্তান - সন্ততিদের নিয়ে থাকে । সেও অনেক কাল । তাদের উত্তর কলকাতার দিকে মনোহারী জিনিসপত্রের দোকান আছে নাকি ।
তার পাশের ঘরটিতে থাকে একজন বিহারী । তারা তাদের দেশওয়ালী বেশ কয়েকজন মিলে একই জায়গায় রান্নাবান্না করে , দুবেলা হৈ চৈ বাধিয়ে খাওয়াদাওয়া করে । সে সব বিরাট আয়োজন; গামলা গামলা তরিতরকারি রুটি তৈরির দুবেলা হুরুদ্দাম ব্যাপারসেপার । হিন্দি বাঙলা মিলে মিশে একেবারে বিরাট হৈ হল্লা বাধিয়ে , তার পর বাকি আর সকলের খাওয়া-দাওয়ার পাট মিটলে , যার যার ডেরায় ফিরে যায় সেদিনের মতো । পরদিন আবার একই চিত্র তৈরি হয় । তারা যখন এক জায়গায় মিলিত হয় সকলে এই খাওয়ার সময় হলে ।
আমি অবশ্য ঠাকুমার রান্নাবান্নার খোঁজ নি আরও একটি বিশেষ টানে , সে হলো তার হাতে রান্না করা ডাটাচচ্চড়ি রুটি । যার
স্বাদ অন্য কারো হাতের রান্নার সঙ্গে মেলে না ।
ঠাকুমার ওখানে দিনের বেলাতেও মশারীর ভেতর ঢুকে তার সঙ্গে কথা বলতে হয় । বিশেষ করে দুপুর বেলায় সে যখন বিশ্রামে যায় সে ।
তাই , আমি তার ওখানে গেলে ,যেয়েই সরাসরি মশারীর ভেতরে ঢুকে পড়ি । তারপর তার পাশে শুয়ে শুয়ে সে সব কত কথা
কওয়াকয়ি ! তার মধ্যে বেশির ভাগটাই তার বাপের বাড়ি সম্মন্ধীও ; আর সে সব বলতে বলতে ঠাকুমার গলায় এমন এক নাটকীয় ভঙ্গী উঠে আসে , আর আমি সেই ধরণটা ভীষণ রকম ভাবে উপভোগ করি ।
হয়তো দুপুরবেলায় কোনো কোনো দিন তার ওখানে কাটিয়ে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসেই বলি , এই যা....! ..... না না , ভীষণ দেরি হয়ে গেছে ঠাকুমা , এখন যাই , কাল এসে বাকিটা শুনবো আবার -
নানা অধ্যায়ের কথাই মনে পড়ে ।
ঠাকুমার বাড়ির গলিটা পেরোতে যেয়ে পুরোনো যারা আছে ,তারা আমার ছেলেবেলার নামটা ধরে দেখা হলে বলে ,কখন এসেছিলি রে ? এখন কোথায় থাকিস ? এখানে ,নাকি পাকিস্তানেই —- এই যা …!.... এখন তো জয়বাংলা , বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে —---
আমি তাদের জানাই , না না , এখন এখানেই থাকি ।
হয়তো এখন কাউকে কাউকে আর একবারে পরিষ্কার করে মনে করতে পারি না —-- ঝাপসা হয়ে গেছে তাদের আগের মুখটা । সব ক্ষেত্রে সেটা আর মেলাতে পারি না এখন আগের সবটার সঙ্গে , তাও কুশল বিনিময় করি একটুখানি । তারপর হাঁটা লাগাই হনহনিয়ে…..। ভাবি , যদি এই স্মরণে না থাকাটার কথা ধরা পড়ে যায় —-- !
এদিকে যা ভেবেছি সেটাই ঘটে । কাজের দিদি ঘুমিয়ে পড়েছিলো । সুজিত ভাই তাকে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে নিজেই দানাভুসি নিয়ে , গোরুর জাবনা মেখে নিয়ে দোহাই শুরু করে দিয়েছে।
একটু পরে হয়তো কাজের দিদি উঠে তাড়াতাড়ি আরো যাতে সব কিছু এগিয়ে যায়, সেই চেষ্টা করছে দেখি ।
আর এমনই একটা অবস্থার ভেতর হয়তো বাড়িতে ঢুকি ।
তখন এই এলোমেলো অগোছালো পরিস্থিতিটা দেখে বেশ অপরাধ বোধই হয় যেন ; ভাবি , ইশ্ … এই এতগুলি মানুষকে আমিই দেরি করিয়ে দিলাম বুঝি …..;
যদিও খরিদ্দারদের এই নিয়ে খুব একটা হেলদোল নেই । তারা বেশ একটা আসোর সাজিয়ে নিয়ে সমস্ত বারান্দাটা জুড়ে বেশ হাত পা ছড়িয়েই বসে গেছে নানা গল্পগাছায় তখন । তাদের দেখলে বোঝাই যায় , ঠিক আছে বাবা যতো পারো দেরি করো গে , এখন অত তাড়া নেই কারোরই ; বিকেলের এই অবকাশ টুকুই তো , একটু গল্প গাছা করে ওঠা যায় যদি সকলের সঙ্গে ….!
আর এই বাড়ি টা ?
সে তো আর কিছুক্ষণ বাদেই সন্ধ্যা লাগলে আবার জনমানবহীন হয়ে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়বে একাকী ।
হয়তো ঘরের ভেতরে আমার বই পড়ার আয়োজন চলবে
তখন । না হলে কেউ যদি আসে ,তাহলে তো হলো কিছুক্ষণ ; না হলে আবার একার জগতে মুখ লুকিয়ে ঢুকে পড়া ।
কেন বুঝি না , এই সব ধারাবাহিকতার ভেতরে আমার মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে । মনে হয় , না , হচ্ছে না কিছুই ! ঠিক পথে চলছে না যেন কিছুই ।
আচ্ছা , আমি কী এমন কিছু করতে চাই ? যা না করতে পেরে আমার কেবলই মনে হচ্ছে , ঠিক পথে চলছে না তো কিছুই ! আমি কি সত্যি সত্যিই কিছু একটা করতে চাই , যেটা না করতে পেরে আমার ভেতরে এত অস্থিরতা ? আমি কি তার সবটা পরিষ্কার ভাবে জানি কিছু ?
উত্তর পাই না । মনে হয় বাঁধা-ধরা পথে যা যা এখন করা উচিত তাও তো আমি নিয়মমাফিক করি না । কিম্বা তা করার জন্যেও তো কোনো সাড়া পাই না ভেতর থেকে !
এই যে এরা , যারা এখন আমার সব সময়ের বন্ধু , তারাও তো সকলেই একটা নিয়মের মধ্যে দিয়েই তো চলছে । স্কুল কলেজ করছে । পড়াশোনা শেষ হলে হয়তো একটা চাকরিবাকরিরও চেষ্টা করবে , সে এদিক ওদিক যেদিক থেকেই হক ; কিন্তু আমি ? আমি কোন পথ ধরে এই জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাবো ! তাহলে গো-পালন-ই আমার ভবিতব্য , নাকি অন্য কিছু ?--- লিখে তো আর জীবন চলবে না ; তাছাড়া– সে কাজেই বা স্বীকৃতি কোনখানে ? স্বীকৃতি দেয়ই বা কে ! স্বীকৃতি পাবার যোগ্যতা কিছু আছে নাকি আমার ? এখনকার শিল্পসাহিত্যের মাথামুণ্ডু তো আমি কিছুই ধরতে পারি না ! জানিও না কোথায় কী হয় । আর সেটাই তো ওরাও বোঝাতে চায় আমায় । বলতে চায় , সময় পাল্টে গেছে , এখন আর শরৎচন্দ্রের সময় নেই । নজরুল রবীন্দ্রনাথেরও না । তাই যোগ্যতা প্রমান করতে হবে ।তা না হলে ভবিষ্যত অন্ধকার ।
এ কথাগুলি যদিও কেউকে আর বলে দেবার দরকারও নেই —-
সে সব যেন নিজেই বুঝে যেতে বাধ্য হচ্ছি দিনে দিনে —-- ; শিক্ষার মান এখন আর বোধের উপর সবটা নির্ভর করে না । কায়দাই তাকে অধিকার করে নিয়েছে । কায়দাই সবটা । তার কৌশলের মূল্যই অধিক । তার জন্যে অনেকগুলি পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয় । যোগ্যতার প্রশ্ন উঠলে , শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উঠলে , আমি তাদের কে একথাই বলি, আমি তো কোনো ইস্কুল কলেজে পড়িনি ভাই !
একথা শুনে অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না ।
তখন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি । বলি মনে মনে , কেন এরা বিশ্বাস করতে চায় না ? সত্যিই তো পড়িনি । গেছি মাত্র । সত্যি সত্যিই পড়েছি কি ? ওকে কি অন্তর থেকে পড়া বলে ? তাছাড়া সত্যিই তো , আমি তো অন্য কোনো ভাষায় কথাও বলতে পারি না ! পারতপক্ষে চেষ্টাও করি না । অন্তত যেটুকুও চেষ্টা করলে অন্তত পারি কিছুটা ; তাহলে ,এরা কেন বিশ্বাস করতে চায় না ? একটা স্বভাবসুলভ ভাষায় কথা বলতে পারি এই যা ; তাও আধা এদেশ আধা টা ওদেশিও আঞ্চলিক মিলিয়ে মিশিয়ে ; তাহলে , কেন এরা আমার লেখাপড়ার যোগ্যতার লাইসেন্স টি নিয়ে এত কৌতুহলী হয়ে পড়ে ?
শংকর বলে , শোন , তুই কিন্তু ইংরাজী টা শিখে নিতে পারিস ভালো করে । ইংরাজী টা শিখতে তো তোর কোনো বাধা থাকার কথা না ! তোর ভালো না লাগলেও এটা কিন্তু তোকে শিখে নিতে হবে ভাই ; এই ভাষাটি না জানলে তুই কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের কিছুই জানতে পারবি নে । আর এ প্রসঙ্গে আমার কি মনে হয় জানিস , বিশ্বসাহিত্যের গতিবিধি টা না জানতে পারলে তুই কিন্তু অনেকটাই নাজানা থেকে যাবি ।
বোকার মতো হাঁ করে থাকি এদের কথাবার্তা সব শুনে । নিজের মধ্যে নিজেকেই প্রশ্ন করি , আচ্ছা , ইংরেজি টা শিখতে পারলেই কি তাঁদের ভাষার শিল্প-সাহিত্য সব আমি বুঝতে পারবো ?
শিল্প-সাহিত্যের ভাষার কি আলাদা আলাদা দেশ আছে ? আমাদের দেশিও ভাষায় কি শিল্প-সাহিত্যের সঠিক ভাষাটি বোঝবার কোনো উপায়-ই নেই ? ভাষার আলাদা আলাদা দর্শন হয় নাকি —-? যা দিয়ে খুব সহজে আমরা শিল্পকে বর্ণনা করতে পারি ? অথচ বুঝিয়ে দিতে পারি না ঠিকঠাক ভাবে যেন…… ।
শিল্পের চোখ এবং কান দুটোই আলাদা হয় । অন্তত আমার তো সেটাই মনে হয় কেন যেন ।
আমরা যা লিখি , আমরা যা উপস্থাপন করি , তার তো একটাই ভাষা । যা সমস্ত ভাষাতেই ধরা দেয় এক-ই রূপে । তাকে ইঙ্গিত থেকেই তো বুঝতে হয় । তার ইঙ্গিতের ভাষা আলাদা আলাদা হয় কি কোথাও ? তাহলে ইংরাজী শেখার দাবি যেমন , তেমন পৃথিবীর সব দেশের ভাষা বুঝতে পারলে কি আমি তাঁদের সব শিল্প-সাহিত্য বুঝে যাবো ?
তাহলে শংকর কেন বলছে ,ইংরাজী ভাষাটা না জানতে পারলে আমি সব কিছু থেকে বাদ পড়ে যাবো ?
আমার চুপ করে থাকা দেখে শংকর হঠাৎ করেই বলে ওঠে —- 'তুই একটা কাজ কর , এর আগে তুই আমাদের বেদ , পুরাণ , উপনিষদ এইগুলো একবার ভালো করে পড়ে নে তো দেখি— তুই কি জানিস , আমাদের দেশে কত জন দার্শনিক আছেন ? আচ্ছা থাক না হয় সে সব , তুই আপাতত যোগ কটিই আগে পড়ে নে , তার পরে ওগুলি পড়িস না হয় । এভাবেই এগোতে হবে তোমাকে ভাই । একটি একটি করেই সংগ্রহ করে এগো না , দেখবি অনেক কিছুই ইশারাতেই বুঝে যেতে পারছিস। তখন হয়তো তোর অনেক কিছুই বুঝে যেতে আর কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না দেখবি ।
ওর হঠাৎ করে বলা আর একটি ইংরাজী শব্দরও সবটা বুঝতে পারলাম না যেন ; ইঙ্গিতে ইশারায় তবুও কি খানিকটা বুঝে নিতে পারতাম না , আর একটু চেষ্টা করলে?
তবে খুব গভীর ভক্তি সহকারেই শুনে যেতাম সকলের সব কথাগুলি । তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সরিয়ে রাখিনি কখনো কিছুই । তবে যেগুলি খারাপ লাগতো সেটা তো লাগতোই । একটি কথা তো সত্যিই , আমি কত কিছুতেই তো ওদের থেকে পিছিয়ে ! ওরা ইতিমধ্যে কত কিছুই তো আমার থেকে বেশি জানতে পেরেছে !
ওকে বলতাম , তুই এই সব বিষয়ে এত কিছু জানিস কোথা থেকে রে ? তুই তো শিল্প-সাহিত্যের ধার কাছ দিয়েও হাঁটিস নে ! পছন্দও করিস নে । তেমনই তো মাঝেমধ্যে বলিস ও ; লেখালিখিও করিস নে ,তাহলে এসব বিষয় নিয়ে অবলীলায় এত কিছু বলে যাস কি করে ?
সে তার উত্তরে বলতো , এগুলো জানার জন্যে কি সাহিত্য করতে হয় নাকি ? তুই তো সাহিত্য করিস , তাহলে তুই এগুলো জানিস না কেন ? এসবের সঙ্গে সাহিত্য করার কোনো সম্পর্ক নেই ।
ওর এই গুরু-গম্ভীর কথাগুলি অনেকেই শুনলে মনে করবে হয়তো , এই কথাগুলি একটু বুঝি বা সবজান্তা গোছের না ? অথচ আমি কিন্তু একবারও সে কথা ভাবতাম না । বরঞ্চ ওরা চলে গেলে ভাবতাম বসে বসে । ভাবতাম , এই বইগুলি এখুনি হাতে পেলে বুঝি খুবই ভালো হতো ।
একটি বিষয় নিয়ে ভীষণ ভাবে ভাবছি কদিন ধরে —- আচ্ছা , কোনো একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে গেলেই , ধরো , কোনো একটি বই , বা সিনেমার বিষয়টাই ধরো না কেন ; তার সবটা প্রভাব কেন এরকম ভাবে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ! আর তখনই আমার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় । আচ্ছা , এ পর্যন্ত আমি যেসব লেখালিখি করেছি , তার সবটা কি আমি এই ধরণের একটা প্রভাব থেকেই করেছি ? কোই , নাতো ! তাও তো না !
কিছুই তো একেবারে জানি না সেসব বিষয়ে ! খাতা কলম নিয়ে বসবার আগেও আমি জানি না , কী লিখতে চলেছি তখন । সত্যি বলতে কি , লিখতে বসার পরেও জানতে পারি না সে সব বিষয়ে । আমি যা লিখে চলি , তাতে পূর্ব-পরিকল্পনা বলে কিছুই তো থাকে না । থাকে শুধুই একটা অনুভব , অন্তরালে । সেই যেন ঠেলে নিয়ে চলে আমাকে । বিষয়-টিষয় নিজেই তৈরি হয়ে চলতে থাকে , শব্দ ও আসে সেই বিষয়ের গতিতেই একটি তরঙ্গের মতো ! কলম নিজেই চালিয়ে নিয়ে চলে আমায় তখন ।
তাহলে , শংকর যে এতকিছু পড়তে বলছে আমায় , তার প্রভাবটা যাবে কোথায় ?
আমি কি সে সব পড়ার পরে , জানার পরে , ভুলে যাবো সে সব ?
আর যদি ভুলেই যাই , তাহলে পড়ার অর্থটাই বা কী দাঁড়ালো ? পড়ার অর্থ তো একটা কিছু থাকবে !
হয়তো বা সে সব ওই তরঙ্গের মধ্যে দিয়ে মিশে যেয়ে আমাকে এমন একটা কিছু দেবে , হয়তো তা আরো উৎকৃষ্ট কিছু ; তা না হলে সে সব পড়েই বা কি হবে ?
এসব সব আপন মনের ভাবনার কথা । এসব সব একান্তের । কেউ নেই তাতে ! এমন কেউ যেন সেখানে নেই কোনো দিনও । থাকেও না ?
আজ সকালে উঠেই লক্ষ্য করছি সামনের বাড়ির মাসিমার সেই বোনঝিটির আবারও আগমন ঘটেছে ।
এই তো সেদিন এসে গেল চলে ; আবার কেন রে বাবা ! এর আগে তো এত ঘনো ঘনো কেন , দেখিই নি । এই কদিন যেতে না যেতে তাহলে আবার কেন ?
হয়তো বিশেষ কোনো দরকারেই হবে হয়তো এই আগমন । যাক সে যে দরকারেই হোক গে ,আমার কি তাতে ?
একটু বেলা হলেই চারদিক কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায় । তখন আবার তার সেই ওবাড়ি থেকে এ বাড়ির দিকের পর্যবেক্ষণ শুরু হয়ে যায় । মনে মনে বলি , কী এত দেখে রে বাবা !
সে যেন আমাদের এই বাড়িটা উল্টে নিয়ে দেখে সব সময় । নিশ্চয় এটাই দেখে , আমাদের বাড়ির নানা দৈন্যটুকু । এই একটি বারান্দা , তার প্লাস্টার চটা দেওয়ালগুলি , যাতে কয়েক বছর রং হয় নি । ওপাশে একখানি টালির চালের বাথরূম , পায়খানা , কলতলা। আর টালির চালের ঘরটির সঙ্গে কাঠের দোতলা , তাতে মুরগির ঘর । তার নিচটায় একটি কালো ও লালচে আভার দুটি গাই গোরু বাঁধা । আর একটি সাদা লালে মেশানো খানিকটা , সেটি তো একটি নুলো বাছুর , বাঁধা রয়েছে ঘরের সামনের দিকটায় । বাকি মানুষজন কে বা কারা থাকে তার সবটা তো ইতিমধ্যেই সে জেনেছে । তাহলে এই সব কিছু নিয়ে ওর এত কৌতুহল তো থাকার কথা নয় !
তাহলে বাকি আর কিসে এতো কৌতুহল ?
মাসিমাদের বাড়িটায় হয়তো সম্প্রতি একটু নতুন ঘরদোর হচ্ছে ঠিকই , তাও এখনও তো মাসিমার পুরোনো বেড়ার ঘরটিও রয়েছে ।
আচ্ছা , ওদের বাড়িটার কথা তো শুনলাম সেদিন কথায় কথায় মাসিমার মুখে , বেহালার দিকে ।
সে যাই হোক , এসবের সঙ্গে তার এই উঁকিঝুঁকির কি অর্থই বা থাকার আছে ! আচ্ছা , আমার ই বা এত লক্ষ্য করার কি আছে এতো ? কেন ই বা এত ভাবাচ্ছে , বুঝতে পারছি না তো !
একটি সম বয়সি বা কম , যাই হলো , সে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছু একটা লক্ষ্য করছে , সেই নিয়ে এত বাড়ি-ঘর-দুয়োর গোরু-বাছুর বাথরূম-পায়খানা-কলতলা রং বেরঙে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে তুল্যমূল্য কুরুক্ষেত্র বানাতে নেমে পড়েছি , কেন ই বা এমন করে !
এত লজ্জা বোধ ?
কই , ওদেশে থাকতে তো এসবের ধারকাছ দিয়েও কখনো ঘেঁষি নি ! এসবের বিন্দুবিসর্গ কোনোদিন মাথায়ও তো আসেনি ! তাহলে , কেন এখানে এসেই বা এমন একটি চটকদার মেয়ের উঁকিঝুঁকি মারা দেখে কেনই বা আমার মনে হচ্ছে এত কিছু ? ওই মেয়েটি যদি , কখনও এমনটা হয় , সে আমাদের বাড়িতে এসে সোজা ঘরের ভেতরে বসে পড়ে ; তাহলে কী লজ্জাতেই না পড়বো ! এরকম দেয়ালগুলোর সব চুন খসা , নোনা ধরা জায়গায় জায়গায় ; ঘরখানার ভেতরে ঢুকেই হয়তো সে হাঁপিয়ে উঠবে । ওরা হয়তো কত সচ্ছল ! ঝকঝকে, মোজাইক করা ঘরদুয়োর ওদের । একতলা কিম্বা দোতলা ঘরদুয়োর , ছাদ আঁটা বাড়ির মালিকানা হয়তো তাদের । বুঝি বা হয়তো মলিদের মতোন । না হলে ফোচনদের বাড়ির মতোন হলেও তো হতে পারে ! না হয় শংকরদের মতোন ! আমাদের এই টালির চালের চুন খসা দাঁত বের করা , একেবারে পঞ্চপাটি হাসি যেন তার ! সর্বদা হাসতে থাকে ।
আচ্ছা ওর কি এসবে চোখ পড়বে আদেও ?
কেনোই বা পড়বে ?
পড়ার তো একটা কারণ চাই ! এমন কারণ , বিষয়ী চিন্তা-ভাবনা নাও তো থাকতে পারে তার ! এসব হয়তো চোখেই পড়লো না । আবেগে হাসতে হাসতে হয়তো ফাটিয়ে দিলো এইসব তুচ্ছ বিষয় আসয় ; কোনো দিকে একবারও চাইলোই না । শুধুই নিছক সৌজন্য মূলক একটা আড্ডা মেরে হোইহোই করে চলে গেলো ।
মনে মনে কী সব ছাইপাঁশ ভাবছি যে !
আমি কি শুধুমাত্র ওই মেয়েটির চোখের ভেতর দিয়ে এইসব অনটন বা আভিজাত্যপূর্ণ বিষয় আসয় , বা সচ্ছল অসচ্ছল এই সব বিষয়গুলোই শুধু ভাবতে বসেছি! কোথায় এই বয়সে একটি মেয়ের চোখের ভেতর দিয়ে কত সব অনুভূতির দেশে পৌঁছে যাওয়ার কথা , তা না ওর চোখের ভেতর দিয়ে কেন জানি আমি এই বাড়িটার দৈন্য টাই লক্ষ্য করার কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছি শুধু শুধু !
হয়তো আমি যা ভাবছি ও আদেও তা ভাবছে না । ও হয়তো হলেও হতে পারে একটুখানি কৌতুহলী এই কথা ভেবে —- আমি যে এত লক্ষ্য করছি এই বাড়িটার মানুষগুলির প্রতি , অথচ ওই ছেলেটি কেবলই দেখো আমাকে দেখে কোথায় লুকিয়ে যাচ্ছে আড়ালে ! ঘরের বাইরেও বের হচ্ছে না একবার । আগের বার তবু সকালের দিকে উঠোনের বাগান পরিচর্যা করতে দেখেছিলাম । এবারে তাও আসছে না !
ও হয়তো ভাবছে , এমন বিচিত্র পাগল তো দেখি নি কোথাও !
ওর ভাবনাই তো ঠিক ! তা না হলে আজকে কাজের দিদিকে আগেভাগেই বা বললাম কেন এই কথা —- আজকের বিকেল বেলার সব তুমিই সামলিও দিদি । আমাকে কিন্তু বাইরে ডেকো না । আমার একটা বিশেষ কাজ আছে ওই সময় টায় । কেউ এসে ডাকলেও আমাকে ডেকো না । বলো বাড়িতে নেই সে । বেরিয়ে গেছে বাইরে ।
কাজ তো ঘোড়ার ডিম । কোনো কাজই ছিলো না । শুধু শুয়ে শুয়ে না হলে বসে , বিছানা থেকে সামনের দিকের জানালাটা আধপাল্লা খুলে এই সব নজর রেখে বেড়াচ্ছি । ছাইপাঁশ ভেবে বেড়াচ্ছি । যেন নানা মুদ্রাদোষে পেয়ে বসেছে আমায় ! আর সেই সব ভেবে ভেবে আড়ালে সিঁধিয়ে যাচ্ছি কোথাও ।
একাত্তরের পর থেকেই আমাদের এই বাড়িটার একটি নামকরণ করা হয়েছিলো । জয় বাংলা বাড়ি । পাড়ার রকে বসা ছেলেপেলেরা কেউ বাইরে থেকে এসে খোঁজ করলে আমাদের বাড়িটার , ওরা তাদের কে জিজ্ঞাসা করতো , আপনারা কি জয় বাংলা বাড়িটা খুঁজছেন ?
একাত্তর এখন অনেকটাই পেছনে চলে গেছে । তাই সেই সময়ের আবহটাও এখন নেই । তাই এখন হয়তো সেই নামটার আলাদা ঠাট্টাতে আর জমবে না তেমন , তাই এখনকার মাধুর্যের বিষয়টা বিবেচনা করে , আর একটি বিশেষত্ব বের করে ফেলেছে এইসব ছেলেপেলেরা —---তাই এখন এই বাড়িটার নামকরণ হয়েছে গোরুওয়ালা বাড়ি ।
********************************************************************************************
আগামী পর্বে
*********************************************************************************************