সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩



********************

স্বরবর্ণ * ১

তৃতীয় বর্ষ * দ্বিতীয়  সংখ্যা

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ জুন * ২০২৩ 

এই সংখ্যার জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ১৫ মে পর্যন্ত, বিস্তারিত তথ্য উপরের লিংক থেকে জানা যাবে 

**************************************

লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন ------


* স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন ।

* লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

* প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যেই ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

* পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ মে  ২০২৩  এর মধ্যে পাঠান ।

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

* কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। পরিকল্পনার সুবিধার জন্য। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে ।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা 




শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৩

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি




স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর


স্বরবর্ণ * ১  * ১লা বৈশাখ ১৪৩০  

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ এপ্রিলের পর থেকে । 


************************

স্বরবর্ণ * ১

তৃতীয় বর্ষ * প্রথম সংখ্যা

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ জুন * ২০২৩ 

লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন ------


* স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন ।

* লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

* প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যেই ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

* পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ মে  ২০২৩  এর মধ্যে পাঠান ।

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

* কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। পরিকল্পনার সুবিধার জন্য। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে ।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা 


প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * মণীন্দ্র গুপ্ত




{ এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ / ১৩ সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন মণীন্দ্র গুপ্ত |}


পূর্ণিমা 

মণীন্দ্র গুপ্ত 












আজ চতুর্দশীর রাত। 

গাছপালার হাসির মধ্যে এসে চাঁদ আটকে গেছে। 

আর যেহেতু মেয়েটির নাম পূর্ণিমা----- ওদিকে একা একা সে 

পাড়ি দিচ্ছে মধ্য গগন। 

চাঁদিনী বা নিশ্চন্দ্র রাতে ও সে পূর্ণিমা। খর দিবসেও 

সে পূর্ণিমা। 

ঘুরে ঘুরে সে অ্যানিমিয়ায় ভোগে। সন্ধের মুখে ঘুষখুসে জ্বর আসে। 

দৈবঞ্জ বলেছেন, বিয়ে দিলে সে মৃতবৎসা হবে। বৈদ্য বলেছেন, 

সূতিকা তার ভবিতব্য।


চতুর্দশী পেরিয়ে পূর্ণিমা যখন আমার কাছে এল, আমি

ভাবতে লাগলাম ওকে কোথায় বসাই; 

পূর্ণিমা সিং হলে ও যাবে গুরু বিপিন সিংহের নর্তনালয়ে

নাচ শিখতে। 

পূর্ণিমা বিশ্বাস হলে ও যাবে ঝালতলা বস্তি থেকে উষায় বেরিয়ে

যাবে ঝি খাটতে।


পূর্ণিমা বাগচী হলে ও স্বামীর সঙ্গে যাবে কানাডা। 

পূর্ণিমা সরদার হলে বিপক্ষ পার্টির লোকেরা ওকে ধান কাটার মরসুমে 

বলাৎকারের জন্য টেনে নিয়ে যাবে।


কিন্তু রাতের বেলা, ধোয়াপোছা পূর্ণিমা, তত সহজ মেয়ে না। 

সব শুনে সে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর 

গভীর হয়ে দুহাত বাড়িয়ে বলল, 'এসো আমরা এই 

পূর্ণ নিশীথিনীর মধ্যে ডুব দি।'














********************************************************************************************

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ



অমৃতময় সেই মহাজীবন প্রসঙ্গে

          - স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ

১)

     

পরমপূজনীয় দ্বাদশ সঙ্ঘাধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ যে আদর্শ আমাদের সামনে রেখে গিয়েছেন, সেই আদর্শ এবং সেই জীবনের আকর্ষণ চিরকাল থাকবে। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ আদর্শকেন্দ্রিক। সেইজন্য শূন্যতা রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘে আসে না। কারণ এই শূন্যতা অবিলম্বেই পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ব্যক্তির একটি ভূমিকা থাকেই। কারণ, ভাব তো ব্যক্তিকে আশ্রয় করেই মূর্ত হয়ে ওঠে। ব্যক্তিকে ধরে আমরা সেই ব্যক্তির পিছনে যে নৈর্ব্যক্তিক সত্তা রয়েছেন, যে আদর্শ রয়েছে, তার কাছে পৌছাবার চেষ্টা করি। পরমপূজ্যপাদ ভূতেশানন্দজী মহারাজ একজন ব্যক্তি অবশ্যই, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি একটি প্রতীকও। রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ ভাব ও আদর্শের, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের, তিনি একটি প্রতীক। সেই হিসেবে আমাদের কাছে তাঁর ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব। 

     পূজ্যপাদ মহারাজের জীবনী আমরা সবাই এখন জানি। মহারাজের সম্পর্কে সংবাদপত্রেও বিশদভাবে বেরিয়েছে। এবং বেলুড় মঠ থেকে প্রকাশিত তাঁর ছোট্ট জীবনটিতেও আমরা সবাই দেখেছি যে, ১৯০১ সালে মহারাজের জন্ম। অর্থাৎ যে শতাব্দী (বিংশ শতাব্দী) আমরা অতিক্রম করতে চলেছি, সেই শতাব্দীর সূচনায় তাঁর আবির্ভাব। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম নবজাতকদের অন্যতম এবং আমাদের সঙ্ঘে যাঁরা অধ্যক্ষ হয়েছেন তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিংশ শতাব্দীর জাতক। এর আগে যাঁরা অধ্যক্ষ হয়েছেন তাঁরা সবাই তার আগের শতাব্দীর অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর মানুষ। একমাত্র তিনি বিংশ শতাব্দীর মানুষ। পূজ্যপাদ মহারাজের আগে আমাদের সঙ্ঘাধীশ ছিলেন শ্রীমৎ স্বামী গম্ভীরানন্দজী মহারাজ। দুজনেরই এক সঙ্গে ব্রহ্মচর্য। ভূতেশানন্দজী মহারাজের অবশ্য আগে দীক্ষা হয়েছে। আবার সন্ন্যাসও প্রায় একসঙ্গে, এক-দু'মাসের পার্থক্য। গম্ভীরানন্দজী মহারাজের সন্ন্যাস স্বামীজীর জন্মতিথিতে, আর ভূতেশানন্দজী মহারাজের সন্ন্যাস ঠাকুরের জন্মতিথিতে। বয়সে গম্ভীরানন্দজী ভূতেশানন্দজীর থেকে দু বছরের বড় ছিলেন। 

     একটা জিনিস আমার ভাবতে ভাল লাগে যে, মহারাজ যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন স্বামী বিবেকানন্দ জীবিত আছেন। ১৯০২ সালের চৌঠা জুলাই স্বামীজীর তিরোধান হয়েছিল। আর ১৯০১ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর মহারাজের জন্ম হয়। ...


২)

     পূজনীয় ভূতেশানন্দজী মহারাজের মাতুলালয় ছিল বলরাম মন্দিরের কাছেই -রাজবল্লপাড়ায়। মহারাজের মা, বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ারই মেয়ে। মাঝে মাঝেই তিনি নিশ্চয়ই সোমসার থেকে বাপের বাড়ি রাজবল্লভপাড়ায় আসতেন! তিনি খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি কি বাড়ির পাশেই বলরাম মন্দিরে এই নবজাতককে কোলে নিয়ে একবারও আসেননি -ভাবতেই কেমন লাগে! আরও ভাবতে ভাল লাগে -যখন নবজাতককে কোলে নিয়ে এসেছেন, সেই সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ সেখানেই আছেন। তাহলে নিশ্চয়ই স্বামী বিবেকানন্দ এই নবজাতককে দেখেছেন। আমাদের দশম সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজ বলতেন একটি সুন্দর কথা। বলতেন, যখন স্বামীজী পাশ্চাত্য জয় করে ফিরলেন ভারতবর্ষে, সেইসময় ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাদ্রাজে ক্যাসল কার্নানে স্বামীজী ছিলেন। দলে দলে মানুষ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বামীজীকে দর্শন করতে আসতেন। সেইসময় স্বামীজীকে দর্শন করতে কাকার হাত ধরে এসেছিলেন একটি পাঁচ বছরের বালক। সেই বালকই হচ্ছেন পাণ্ডুরঙ্গ প্রভু, পরবর্তিকালে আমাদের প্রভু মহারাজ। নিজের মুখে তিনি বলেছেন, "স্বামীজীকে আমি দেখেছি, কিন্তু তার কোন স্মৃতি আমার নেই। আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। মনে নাই বা থাকল, কিন্তু স্বামীজী তো আমাকে দেখেছেন!" ভাবতে ভাল লাগে যে ভূতেশানন্দজীর মাও একবার নবজাতককে কোলে নিয়ে বলরাম মন্দিরে এসেছেন এবং স্বামীজী তাকেও দেখেছেন। তাঁর কোন স্মৃতি থাকার কথা নয়। 

     যখন ভূতেশানন্দজী মহারাজ পৃথিবীতে এলেন তখনকার ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলটি একেবারে charged হয়ে রয়েছে। তখন স্বামী বিবেকানন্দ জীবিত, শ্রীশ্রীমা দেহে রয়েছেন, শুধু স্বামী যোগানন্দ ছাড়া ঠাকুরের অন্যান্য সন্ন্যাসী পার্ষদরা সকলেই দেহে রয়েছেন। তাহলে ভাবুন, স্বয়ং ভগবতী রয়েছেন এবং একজন বাদে ঠাকুরের সমস্ত ত্যাগী পার্ষদেরা রয়েছেন। সেই পরিমণ্ডলে মহারাজের জন্ম। সেই জমাট, super-charged সঘন আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের একটা প্রভাব তো থাকবেই। আর প্রভাব কোথায় বেশি? যার receptivity বা ধারণের ক্ষমতা, গ্রহণের ক্ষমতা, -যত বেশি। 

     আমরা মহারাজের জীবনীর সঙ্গে এখন পরিচিত। এবং তার জন্ম ও বাল্যজীবনের কথা অনেকটাই জানি। হয়তবা সবটা জানিনা, কিন্তু অনেকটাই এখন আমরা জেনেছি। তা থেকে বোঝা যায়, সেই আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের সত্তাকে গ্রহণের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা পূজনীয় মহারাজের মধ্যে ছিল। ...


৩)

     প্রসঙ্গত একটি আশ্চর্য যোগাযোগের কথাও মনে আসছে। মহারাজের নিজের মুখ থেকেই শোনা, -মহারাজের মা চারুবালা দেবী খুব শিবভক্ত ছিলেন। এবং যে গ্রামে মহারাজের জন্ম বা যেখানে মহারাজের পূর্বাশ্রম, বাঁকুড়ার সেই সোমসার গ্রামের গ্রামদেবতা হচ্ছেন সোমেশ্বর শিব। সেই থেকেই গ্রামটির নাম 'সোমসার'। গ্রামে একাধিক শিবমন্দির। গ্রামটি যেন একেবারে শিবক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। মহারাজ এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন যার গৃহদেবতা হচ্ছেন সদাশিব, যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন সেই গ্রামের দেবতাও শিব। মহারাজ সন্ন্যাস নাম হিসেবে পেলেন স্বামী ভূতেশানন্দ। অন্য নাম তো হতে পারত! ভূতেশ মানে শিব। ভূতেশানন্দ মানে শিব যাঁর প্রিয়, যাঁর আনন্দের কেন্দ্র। যেন বেছে বেছে এমন একটি নাম তাঁকে দেওয়া হল! মহারাজের মুখে শোনা গিয়েছে, -বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসীরা তাঁকে বলেছিলেন, "মহাপুরুষ মহারাজকে বলে তুমি নামটা পাল্টে নাও। কি একটা 'ভূতেশানন্দ' নাম! সবাই ভুত ভুত বলবে।" মহারাজ বলেছিলেন, "কেন আমার তো খুব ভাল লাগছে।" ভাল তো লাগতেই হবে, কারণ ব্যাপারটা যে ওই ভাবেই পূর্বনির্দিষ্ট! তাঁকে ব্রহ্মচর্য এবং সন্ন্যাস দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ স্বামী শিবানন্দ। স্বামী শিবানন্দ ছিলেন শিবময় এক মহাত্মা। বাস্তবিকই তিনি ছিলেন শিবস্বরূপ শিবানন্দ। ভূতেশানন্দজীর মন্ত্রগুরু ছিলেন স্বামী সারদানন্দ। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী সারদানন্দকে বলেছিলেন, "তোমার আদর্শ শিব।" বাস্তবিকই স্বামী সারদানন্দ ছিলেন শিবতুল্য, নীলকন্ঠ পুরুষ। সারদানন্দজী মহারাজের যখন উদ্বোধনে মহাপ্রয়াণ হয়, তখন রাত দুটো। বেলুড় মঠে ঠিক সেই সময় মহাপুরুষ মহারাজ স্পষ্ট শুনলেন স্বামী সারদানন্দ তাঁকে বলছেন, "তারকদা কাশী চললাম।" শিবক্ষেত্র কাশীতে কার গতি হয়? শিবপ্রিয় ভিন্ন আর কারও কি কাশীতে গতির ভাগ্য ঘটে? মহাপ্রয়াণের মুহূর্তে স্বামী সারদানন্দের ওই উক্তির অর্থ কি এই নয় যে, তিনি শিবসত্তার অধিকারী? অর্থাৎ শুধু ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাসগুরু স্বামী শিবানন্দই নন, তাঁর মন্ত্রগুরু স্বামী সারদানন্দজীও ছিলেন শিবসত্তার অধিকারী। এখানেও শিবের সঙ্গে ভূতেশানন্দজীর এক অপূর্ব সংযোগ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে গুরু স্বামী সারদানন্দ দেহত্যাগ করেন উনিশে আগস্ট ১৯২৭, শিষ্যের দেহত্যাগ হয় দশই আগস্ট ১৯৯৮। দেহ রক্ষার মাস গুরু ও শিষ্যের একই, আগস্ট মাস। শুধু জীবনেই গুরু ও শিষ্যের সাদৃশ্য নয়, প্রয়াণেও তাঁদের অদ্ভুত সাদৃশ্য! ...


*********************************************************************************************

অণুগল্প * দেবাশিস সাহা



নিঃশব্দ বিস্ফোরণ

দেবাশিস সাহা 


দিঘা না পুরী না, কাশ্মীর বা কন্যাকুমারীও না, ওরা এসেছে না-আসা না-চেনা কোন এক অনন্ত সরোবরের অনিঃশেষ নীলে মিশে যেতে হারিয়ে যেতে, যেখানে হারালে হারানোর নেশায় পেয়ে বসে, অর্থ বা অশ্রু সঞ্চয় আছে যা যতটুকু, ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে উজাড় করে। ওরা, মানে, অসীম আর ওর ছায়ার নিবিড়তম অতিথি যে-জন। দু'জনই-বা বলি কেন, আসলে তো ওরা একজন, একই মুদ্রার এপিঠ -ওপিঠ।


আর এই দু'-পিঠ যখন মিশে যায় ছোট্ট একটা বিন্দু হয়ে, কিংবা হারায় মহাশূন্যে, তখনই উলোটপালোট তখনই নিঃশব্দ বিস্ফোরণ...অসীমের কষ্টার্জিত ঘাম অশ্রু মেশা সাধের মানব জমিনটুকুয়...কান্নায় ভাসে দুয়ারে অপেক্ষায় আছে ওর যেসব প্রিয়জন।


সব হারিয়েও আরও হারাতে ইচ্ছে করে অসীমের। হারানোর মধ্যে যে এত আনন্দ আনন্দের উদগীরণ  কালাকালহীন যে অন্বয়, তাই ওকে নিয়ে যায় কোন অচেনায় অজানায়... তাই দিঘা না পুরী না, কাশ্মীর বা কন্যাকুমারী ও না...


*****************************************************************************************************











******************************************************************************************************

বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩

অণুগল্প * প্রদীপ দে



প্রদীপ দে 

" লড়াই লড়াই লড়াই চাই "


--  দ্যাখো, একবার চোখ তুলে দেখো পাশের বাড়ির তরুণ দাদাকে। কি পরিশ্রমী আর কি চাকরি! আহাঃ মাহিনা কত পায় জানো?

--  না জানিনা আমার জেনে কি লাভ? তা তোমার ওই দাদার উপর এত পিরিত জাগালো কেন হে?

--  তা জাগবে না? ওতো ভালো পূরুষ? কি হ্যান্ডসাম আর মাহিনাটা দেখো? তোমার মত অকর্মক নয়তো?

--  ওহঃ তাই বুঝি? তাহলে ওর গিন্নিকেও দ্যাখো।যেমন রূপ তার তেমনই গুন। আর বিদেশী ফার্মে চাকরি? মন জুড়িয়ে যায়! শাড়ি ভর্তি টাকা। আর ওর পাশে নিজেকে একবার ভাল করে দেখো ……

--  ওহঃ তোমারো অনন্যা কে চোখে লেগে গেছে?

একটা ঢলানি ! চাকরি করে, না ছাই করে?

বেশ্যাবৃত্তি করে - বুঝেছো। ওহঃ তুমিও ওর ফিগার দেখে নিয়েছো! তাহলে তো হয়েই গেলো। যাও টাকা নিয়ে গিয়ে ঢালো!

--  আর তোমার তরুণ দাদার কি খবরাখবর। কেবলই দেখি তোমায় ঝাড়ি মারে? লটকে যাও। আর কি?

--  অসভ্য জানোয়ার! তুমি ওর পায়ের নখের যুগ্যিও নও, বুঝলে?

--  অনন্যা ও অসামান্যা বুঝলে? 

--  তোমার স্বভাবই শুধু নিন্দা করা। বুঝলে?

তরুণ একেবারে তরুণ ই!  আজ ও হিরো!

--  তা হিরো যদি পেয়েই গেছো তাহলে এই বুড়ো জিরোর পাশে এসেছো কেন?

--  হ্যাঁ হ্যাঁ সব জানি আমাকে ছিবড়ে বানিয়ে এবার কুঁড়ি খুঁজতে গেছো -আসলে ওই অনন্যাকে তরুণদাও ছেড়ে দিয়েছে!

--  তা তোমার তরুণ ই বা কম কিসে?

--  ওর মন অনেক উদার - বউকে সন্দেহ বাতিক করে না!

--  আমিই বা কম কিসে? আমি ও দেদার! তোমাকে খেলতে ছেড়ে দিয়েছি।

--  কিন্তু আমি তোমায় ওতো সহজে ওই গাভীর পাল্লায় পড়তে দেবো না বুঝলে?

--  বাঃ বাঃ বেশ কথা!

ঝগড়া অল্প থেকে ভারী হচ্ছে। পরিবেশ গরম হচ্ছে। উত্তেজনার পারদ সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছে। আমরা দুজনেই লড়াকু। মিউচুয়াল স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা করার নিমিত্তেই এই বিয়েশাদি / বরবাদি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর কেউই কোন নিয়ম মানবো না, এক ইঞ্ছি জমিও কেউ ছাড়তে রাজী নই। তাই শান্তির কাঙাল না হয়ে - লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করেই বাঁচতে চাই - এই পদ্ধতিতেই এগিয়ে চলেছি।   

বাইরে পাড়ার বন্ধুরা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো, 

--   কি দাদা নারী নির্যাতন চালাচ্ছেন ? জেনে রাখুন এখন নারীদের যুগ আর ক্যালেন্ডারের এই আটই মার্চ হচ্ছে, বিশ্ব নারী দিবস!

আমার বোঝাতেই সাহসে এল না যে আমি আমার বউ ছাড়া অন্য সকল নারীদের কত কত ভালোবাসি!


***********************************************************************************************************



প্রদীপ দে 

লেখক  নেশায়। পেশা ছিল হিসেবনিকেশ।  বয়স -৬২ । কলকাতা নিবাসী। বিবাহিত।
নিজের লেখা কয়েকটি বই আছে।



অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়



লালন

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


বুকের ভেতর ডানা ঝাপটানো অবশেষে আকাশ পেল। তিনদিনের পুরুলিয়ার সবুজ সফর। দীর্ঘ দিন কর্মক্ষেত্র থাকার কারণে পুরুলিয়ার শিরা উপশিরায় বাস আমার।মেয়ে ডকুমেন্টারি বানাচ্ছে 'অরণ্য নির্ভর জীবন ' এর ওপর। আমার উপন্যাস ' ক্লোরোফিলে বাস ' ওকে উৎসাহিত করেছে। পুরুলিয়া ও জঙ্গলমহল নিয়ে ও কাজটা করতে চায়।তাই পুরুলিয়ার প্রজেক্টে কিছুটা গাইডের মতো আমার ভূমিকা।

      মোটামুটি ওর কাজ শেষ। দুটো দিন পাহাড় ও আশপাশের এলাকা চষে বেড়িয়েছে।বাঘমুন্ডির ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক ওর বন্ধু। তাই সরকারি সাহায্যের অভাব হয়নি। আমারও  একপেট সবুজ খাওয়া হলো অনেক দিন পর।হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাওয়া। শেষ দিন বিকেলে একটু ছুটি পাওয়া গেল মেয়ের কাছ থেকে। ওরা হোম স্টেতে ফিরে গেলে আমি গাড়ি নিয়ে চললাম চড়িদা গ্ৰামে। পর্যটকদের কাছে এই গ্ৰামের পরিচিতি ' মুখোশ গ্ৰাম' হিসেবে। মুখোশ ও ছৌ নিয়ে পুজো সংখ্যায় লেখার অনুরোধ আছে সম্পাদকের।তাই একটু রসদ সংগ্রহে ঘুরতে যাওয়া।

   ড্রাইভার বিনোদ এলাকার ছেলে।চলার পথে ও অনেক কথাই জানালো মুখোশ গ্রামের বিষয়ে।ছৌ নাচের ওপর ওর জ্ঞান বিস্মিত করার মতো। আসলে ও কিছুদিন ছৌ নাচের সাথে যুক্ত ছিল।বিয়ের পর সংসারের চাপে ও তাপে গাড়ি কিনে রাস্তায় নামা।ওর গাড়ি চালানোর হাত খুব ভালো। সবচেয়ে ভালো লাগে সাধারণ ড্রাইভারদের মতো ওর কোন নেশা নেই। তিনদিন আমাদের সঙ্গেই আছে।কোন নেশা করতে দেখিনি। সকালে প্রাতরাশে এক কাপ চা ,ব্যস।চাতাল আমি অনেক দোকানে চা খেতে  দাড়ালেও ও শুধু দর্শক। তবে কোন দোকানে ভালো চা পাওয়া যায় তার খবর সব ওর নখদর্পনে। অনেক পর্যটকের চা প্রিয়তার জন্য ওর এসব খবর রাখা।

    চা খেতে খেতে সন্ধা নেমে এলো ।রাস্তার ধারে ধারে অনেক দোকান। শুধু মুখোশের ছয়লাপ।ও আমাকে দূর্গা মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা ধরে নিয়ে চললো গ্ৰামের একটু ভেতরে। গাড়িতে আশার সময় আমার প্রশ্ন শুনে ও হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে আমার উদ্দেশ্য। অন্ধকারে মোবাইলের আলো সঙ্গী করে হেঁটে চলেছি আমরা দুজন। অদ্ভুত এক নীরবতা চারদিকে। বাড়িগুলো যেন অন্ধকারের বুকে নীরবে দাঁড়িয়ে। ঝিঁঝিঁর আওয়াজ শুধু আমাদের বৃত্তে। কিছুক্ষণ পর বিনোদ একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।দরজায় ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ বেড়িয়ে এলেন বাইরে।পরনে ধুতি একটু তুলে পড়া। ঘোলাটে চশমার কাঁচে দুটো উজ্জ্বল চোখ।হাতময় আঠা মাখা। বুঝলাম কাজে ব্যস্ত।

      বিনোদের মুখে সব শুনে আমার মুখোমুখি দুয়ারে বসলেন।বলে চললেন ওনার কথা। আমি টেপ রেকর্ডার অন করে ওনার কথাস্রোতে ভাসতে থাকলাম।একসময় ছৌয়ের দল নিয়ে খুব ঘুরে বেড়াতেন এ মেলা সে মেলা। কলকাতায় দূর্গা পূজোতেও ছৌয়ের দল নিয়ে গেছেন। তখন খুব চাহিদা ছিল চারদিকে।পয়সাও পাওয়া যেত।বেশ কয়েক বছর হলো মানুষ ছৌয়ের আগ্ৰহ হারিয়েছে।এখন চাহিদা খুব কম।তাই দলও গেছে ভেঙ্গে।আগে বিকেলে ছৌয়ের অনুশীলন চলতো সামনের মাঠে বাচ্ছাদের নিয়ে।এখন অভিভাবকরাও ছেলে মেয়েকে ছৌ শেখাতে আগ্ৰহ হারিয়েছে।ছৌ নেচে এখন পেট ভরে না। সংসার চালানো দূর অস্ত।তাই জমিতে চাষ আর মুখোশ তৈরি করেই সংসার চলে এখন। এলাকার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হয় ওনার। সরকারেরও সে রকম উদ্যোগ নেই।যা আছে তা নামমাত্র। সংস্কৃতি বুকের ভেতর লালন করতে হয়।তা চাপিয়ে দিয়ে হয় না। চোখের সামনে তা শেষ হতে দেখছেন ওনারা । পরবর্তী প্রজন্মকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। পেটের ক্ষিদেই একমাত্র শাশ্বত সত্য। দুবেলা দুমুঠো গরম ভাতের নিশ্চিত জোগাড়ই এখন ওদের মুখ্য উপজীব্য।

 


ওনার বড়ো ছেলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে শহরে স্নাতক পড়তে যায়। রেজাল্টও ভালো হয়। তারপর অনেক চেষ্টা করেও একটা ছোটখাটো চাকরিও জোটাতে পারেনি।নেতা মন্ত্রী টাকা পয়সার চক্করে বিরক্ত বিধ্বস্ত হয়ে শেষমেশ জমিতে এখন চাষবাস করে। অবসরে মুখোশ তৈরি। মুখোশে ওর হাত বেশ ভালোই। কিছু পয়সা আসছে এখন ওর হাত ধরেই।ছোটো ছেলেটা এসব দেখে লেখাপড়ার দিকে আর যায় নি।দাদার সাথে এই কাজই করে সারা দিন।

     হঠাৎ চুপ করে রইলেন । দূরের অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। বুঝলাম, মেনে নিতে পারছেন না তার লালনে থাকা সংস্কৃতির এই হারিয়ে যাওয়া। নীরবতা কাটাতে প্রশ্ন করে উঠলাম : " এভাবে চললে তো একদিন ছৌ সংস্কৃতি অবলুপ্ত হয়ে যাবে? " প্রশ্ন শুনে চোখ থেকে চশমা খুলে ধুতির কাপড়ে মুছতে মুছতে বলে উঠলেন :" মানুষ যে চায় না ! আধুনিকতা কেড়ে নিচ্ছে সব।এই ছৌকেও। একদিন হয়তো মুখোশ তৈরিও উঠে যাবে ! বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো অন্য কিছুতে মানুষকে আসক্ত করে তুলবে "।

      বুকের ভেতর কেমন যেন একটা মোচড়। বৃদ্ধের শেষের কথাগুলোয় চাপা কান্নার আওয়াজ যেন কানে বাজতে লাগলো। ঘড়ির কাঁটায় নটা বাজে। এবার উঠতে হবে। বিদায় নিয়ে দরজার দিকে এগোতেই বৃদ্ধের মুখনিঃসৃত তীরটা যেন বুক ফালাফালা করে দিল : " আসলে মুখোশ তৈরি করতে করতে মুখ আর মুখোশের পার্থক্যটা ধরে ফেলতে সুবিধা হয় এখন আমাদের !" চমকে উঠলাম।কার উদ্দেশ্যে বললেন কথাটা। আমাদের মতো নাগরিক সুসভ্য মানুষগুলোকে যারা মাঝেমাঝেই তাদের সংস্কৃতির দৈন্যদশা দেখে মেকি হাহুতাশ করে ? নাকি সরকারের বকচ্ছপ সংস্কৃতি রক্ষার পরিকল্পনার অসাড়তা দেখে ক্ষোভ উগরানো? বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখের কোণে জল চকচক করছে।


                 

************************************************************************************************


 

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 


  রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..

                

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল



[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * দুই

বিশ্বনাথ পাল

কিছুক্ষণ কেঁদে বেশ হালকা মনে হল যেন বুকের মধ্যে থেকে কোনও দুঃসহ পাথর নেমে গেল। আমি অয়নকে সংক্ষেপে আমার কান্নার কারণ বললাম। অয়ন আমাকে সাইকেল চালানোর পরামর্শ দিল। বলল, “সাইকেল চালালে এই চিন্তার হাত থেকে কিছুটা মুক্তি পাবি।” 

মৌমিতার প্রত্যাখ্যান ও সামনে পরীক্ষা অথচ কিছুই পড়া হয়নি— এই দ্বৈত চাপ আমি  সামলাতে পারলাম না। আমার মনের ভারসাম্য টলে গেল। মাঝে দুই-একদিন কাটাকলেও যেতে হয়েছিল স্পেশাল ক্লাস করতে। ফলে কল্পনায় ভীতিউদ্রেকারী সহপাঠীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।তা যেন অনুঘটক হিসাবে কাজ করল। মনে হতে লাগল আমি সকলের আলোচনার বিষয়। আমাকে সকলে দেখছে। মানুষকে ভয় পেতে শুরু করলাম।খাওয়া গেল কমে, ঘুম উবে গেল। আমার অস্বাভাবিকতা মায়ের চোখ এড়াল না। একদিন মা আমাকে নিয়ে গেল এক ডাক্তারবাবুর কাছে। সাইকিয়াট্রিস্ট। একটা হাতুড়ির মতো সামগ্রী দিয়ে হাতে পায়ে ঠুকে তিনি আমার পরীক্ষা করলেন। টেবিলে রাখা কাগজ দেখিয়ে বললেন, “কী মনে হয়— এই খবরের কাগজের লেখাগুলো সব সাজানো?” 

আশ্চর্য! আমার তখন সব কিছুকেই বানানো, সাজানো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি সবটা দেখছি না, সবটা শুনছি না। আমাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যই এত আয়োজন। আমার আড়ালে যেন অনেক যুক্তি পরামর্শ করে আমার সামনে নিখুঁত অভিনয় করছে সবাই। কী জন্য  যে এমন মনে হত বলতে পারব না।

ডাক্তারবাবু আমাকে ওষুধ লিখে দিলেন। বেশি না একটা করে ট্যাবলেট রোজ রাতে খাওয়ার পরে। সম্ভবত ওষুধটার নাম ছিল সিজোনিল প্লাস। কী জানি আমার অসুখটার নাম সিজোফ্রেনিয়া ছিল কিনা। এক মাস পরে আবার যেতে বললেন।

ওষুধ খেয়ে আমার ভাল ঘুম হতে লাগল। অনেক সুস্থ বোধ করলাম। একটু যেন আত্মবিশ্বাসীও মনে হল। কিন্তু দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া গেল না। কারণ আমাকে তাড়া করে বেরাচ্ছে পরীক্ষার ভূত। পরীক্ষার বৈতরণি কীভাবে পার হব সেই চিন্তা পেয়ে বসল। পরীক্ষার পড়াশোনা  না করে মৌমিতাকে প্রোপোজ করার জন্য আমার আপশোশ হতে লাগল। কিন্তু হাত থেকে একবার তির নিক্ষিপ্ত হলে আর তা ফেরত আনা যায় না। সেই অনুশোচনায় নাকি দুধের সাধ  ঘোলে মেটানোর আশায় আমি মৌমিতার বন্ধুত্বলাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। সাইকেল চালিয়ে মৌমিতাদের বাড়ি গিয়ে ওর সঙ্গে গল্প করতাম। ইউনিভার্সিটি খোলা থাকতেই একদিন গিয়েছিলাম। আবার এটাও বলা যায় ক্ষতস্থান সারাতে ছুরির কাছেই যেন নিরাময় চাইলাম। ছুরির সঙ্গে মৌমিতার মিলও আছে। মৌমিতার সৌন্দর্যও ধারালো।


তিন


পড়তে বসে পড়লাম অথৈ জলে। পাঁচশো নম্বরের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা— পঞ্চাশ নম্বর করে  দশটা পেপার। কোনও কোনও পেপারে আবার পঁচিশ করে দুটো ভাগ— এ ও বি। আলাদা আলাদা শিক্ষকদের দ্বারা নেওয়া ক্লাস। স্নাতকোত্তরে সাধারণত প্রাইভেট টিউশন কাউকে নিতে দেখা যায় না। উপযুক্ত শিক্ষকও সহজলভ্য নয়। তবে আলাদা বইপত্র খুঁজে না পড়লেও চলে। ক্লাসনোটটাই ভাল করে বুঝে তার মধ্যে থেকে উত্তরের অংশ প্রশ্নানুযায়ী বেছে নিতে হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ কঠিন মনে হল। একে তো অর্থনীতির মতো গুরুগম্ভীর বিষয়। তাও আবার পাঠ্যবই নেই। নিয়মিত ক্লাস করলেও হুবহু নোট তো আর নেওয়া হয়নি। কম সময়ে অনেক কিছু লেখার তাগিদে সংক্ষিপ্তাকারে, কখনও কখনও মূল পয়েন্টগুলো লেখা হয়েছে। এবং সেইসব নোটের খাতা বাড়িতে আর উলটে দেখা হয়নি। ফলে সেই নোট খুলে পড়তে বসে বুঝলাম কেমন হিব্রু, পালি, ল্যাটিনের মতো লাগছে। ক্লাস চলাকালীন যদি বাড়িতে খাতাপত্রগুলো উলটে পালটে পড়াশোনার চর্চা থাকত, তাহলে বিষয়টা অন্যরকম হত। কিন্তু তখন আমার মনোজগতে প্রেম করার উদগ্র বাসনা। কাটাকল থেকে বাড়ি ফিরে ছুটতাম টিউশনি পড়াতে। তারপরে রাতে যেটুকু সময় পেতাম শরীর ও মনের ক্লান্তি কাটিয়ে পড়াশোনায় নিয়োজিত হতে গেলে যে শৃঙ্খলার প্রয়োজন, আমার তা ছিল না।

মন অনুশোচনায় ভরে গেল। কী করব? ইউনিভার্সিটিতে ড্রপ দেওয়ার একটা ব্যাপার প্রচলিত ছিল। প্রস্তুতি যাদের আশানুরূপ  হত না, ভাল রেজাল্ট করার স্বার্থে তারা সেবার পরীক্ষায় বসত না এবং পরের বার পরীক্ষার জন্য তৈরি হত। কিন্তু ভাল রেজাল্ট তো দূরের কথা, আমার মনে হল পরীক্ষায় বসলে আমি ফেল করব। অতএব ড্রপ দেওয়াই উপযুক্ত কাজ হবে। পরীক্ষায় বসে ফেল করলে মুখ দেখাব কেমন করে এই চিন্তায় আমার মুখের হাসি কর্পূরের মতো উড়ে গেল।

ঘুরে ঘুরে মানুষজনের কাছে গিয়ে আমার ড্রপ দেওয়ার স্বপক্ষে সমর্থন আদায় করতে লাগলাম। যদিও তা দুষ্প্রাপ্য ছিল। একদিন মৌমিতার বাড়িতে গেলাম। ইতিমধ্যে আমি মৌমিতার বাড়ি গিয়েছি কয়েকবার। আমাদের বাড়ি থেকে সাইকেলে দশ মিনিটের দূরত্ব। প্রস্তাব দেওয়ার পরিণামে বন্ধুত্ব বা সৌজন্যে ভাটা পড়েনি। ড্রপ দেওয়ার সংশয়িত সিদ্ধান্তের কথা জানাতেই  বলল, “পরীক্ষাটা দে। এম.এস.সি.-তে কেউ ফেল করে না।”

‘এম.এস.সি.-তে কেউ ফেল করে না’— সত্য নয়। গতবছর দু’জন করেছিল। দুশো  জনের মধ্যে দুজন। যেকোনও সাধারণ বুদ্ধির মানুষের কাছে সংখ্যাটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু আমার মনে হল পরীক্ষায় বসলে আমি নির্ঘাত ওই দু’জনের একজন হব।  

শমীক নামে ক্লাসের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ গড়িয়ে বন্ধুত্বে পৌঁছেছিল। ওদের নাকতলার ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে যেতাম। শমীক আমাকে কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছিল। একদিন ওর কাছে রাখলাম আমার সিদ্ধান্তের কথা। শুনেই বলল, “পরীক্ষায় বস, পাশ করে যাবি। এম.এস.সি.-তে কেউ ফেল করে না।’’

দর্পন-এ আমার কবিতা মনোনীত করেছিলেন যে সম্পাদক ও কবি তাঁর নাম অনল আচার্য। একদিন মেট্রোতে তাঁর সঙ্গে দেখা। কাছে গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে বললাম, “দর্পন-এ আপনি আমার একটি কবিতা ছেপেছিলেন।” 

‘কী করি’-র উত্তরে বললাম, “এম. এস-সি. পড়ছি, কিন্তু প্রিপারেশন ভাল হয়নি বলে এবার ড্রপ দেব ভাবছি।” এতটা হয়তো না বললেও চলত, কিন্তু কৃতজ্ঞতায় আমার সারল্য তখন বাঁধনহারা। 

বললেন, “না-না, পরীক্ষাটা দিয়ে দাও।পাশ করে যাবে।”

আমার ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ সিনেমার কথা মনে পড়ল। শীতের এক অমাবস্যার রাতে বাইকে করে জঙ্গলের মাঝে নির্জন রাস্তায় যাওয়ার সময় একজোড়া লোমশ নখওলা হাতের কবলে পড়েন উত্তমকুমার। সেই ভূতুড়ে হাতের থেকে নিস্তার পেতে তিনি চায়ের দোকান, থানা যেখানেই গিয়ে  ঘটনার বর্ণনা দেন, তারা ঠিক সেই লোমশ নখওলা হাত বের বলে, ‘দেখুন তো এরকম হাত?’ আমারও যেন সেই অবস্থা। পরীক্ষার ভূত থেকে বাঁচতে যার কাছেই যাই, তিনি বলেন,  ‘পরীক্ষাটা দাও, পাশ করে যাবে।’  

সেবার বইমেলায় ‘আকাশ’ গ্রুপের পক্ষ থেকে বিগত কয়েক বছরের মতো আমাদের  লিটল ম্যাগাজিনের পসরা টেবিলে সাজিয়ে বসেছিলাম। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমাদের। আমাদেরই গ্রুপের কোনও সদস্যের সূত্রে পরিচয়। নাম  স্বর্ণালী চৌধুরি। নামের মতোই ঝলমলে স্বভাবের স্বর্ণালী আমার থেকে বছর চার-পাঁচের ছোট,  অথচ কী অবলীলায় নাম ধরে ডাকত। আমার থেকে আবার সিগারেটের কাউন্টার চেয়ে খেত। আমাদের মনে তখন গোবি-সাহারার অবস্থান, ফলে কোনও সুন্দরীর মুখে দাদা শোনার চেয়ে স্বনাম শোনা ভাগ্যই মনে হত। তো সেই স্বর্ণালী একদিন পাশের বাড়ির এসটিডি বুথে ফোন করে বলেছিল সোমনাথকে ডেকে দিতে। দিয়েছিল তারা। দেড় মিনিটের কথায় একটা অ্যাপন্টমেন্ট স্থির হয়েছিল। পরদিন সকালে রবীন্দ্রসদনে স্বর্ণালীর সঙ্গে দেখা করি। একসঙ্গে প্রায় সারা দিন  কাটে। প্রথমে হেঁটে পার্কস্ট্রিট। সেখানে একটি আর্ট গ্যালারীতে হরেন দাসের ছবির প্রদর্শনী দেখলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে রক্সিতে দেখি ‘কৌন হ্যায়’। সম্ভবত মনোজ বাজপেয়ীর প্রথম ছবি। হিন্দি থ্রিলার। বেশ ভাল লেগেছিল। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে দু-একবার  আমার হাত চেপে ধরেছিল স্বর্ণালী সিনেমা দেখতে দেখতে ভয় পেয়ে। স্বর্ণালী হল আমার সেই বান্ধবী যাকে সেদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় কবিতা শুনিয়েছি এবং ওর কথাই একদিন সুজাতাকে বলেছিলাম। আরও কত কথা যে বলেছিলাম সেদিন। স্বর্ণালীও অনেক কথা বলেছিল।  না, কোনও পূর্বরাগের ছোঁয়া ছিল না এই সাক্ষাতে। আসলে স্বর্ণালী যাবে ওর প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে, আমাকে ওর সঙ্গী ঠাওরেছিল।  সকাল যখন সন্ধ্যার কোলে আশ্রয় নিয়েছে, আমরা ফিরে এসেছি রবীন্দ্রসদন চত্বরে। সেখানে কোনও এক অফিসে ওর প্রেমিক চাকরি করে। দূর থেকে আগত চাপদাড়ির এক বছর চল্লিশের ভদ্রলোককে ও চিনিয়ে দেয় ওর প্রেমিক হিসাবে। তাকে আসতে দেখেই আমি বাড়ির দিকে পা বাড়াই। একটা গাছের বেদীতে বসে থাকা স্বর্ণালী আমায় বলে, “আর একটু বসে যা।” 

  সেদিন স্বর্ণালীকে বিশ্বাস করে আমার একটি স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। উপন্যাস লেখার স্বপ্ন। বিভূতিভূষণ হবেন আমার প্রেরণা। ওমা! দু-চার দিন পরে দেখি অয়নের কাছে আমার স্বপ্নের কথা ফাঁস  হয়ে গেছে। আমার ভীষণ অভিমান হয়েছিল। কারণ কথাটা তো আমি অয়নকে বলিনি। স্বর্ণালীকে বলেছি। এটা যে অন্য কারও শোনা উচিত নয় ওর বোঝা উচি্ত ছিল। স্বপ্ন রাষ্ট্র হয়ে গেলে দেখার চোখে কুয়াশা নামে বলে মনে হত আমার।   

যাইহোক, প্রেমিকা না হয়েও একটি মেয়ে যে আমার সঙ্গে সারা দিন কাটাল, এতে তার ওদার্যে মুগ্ধতার জন্ম হয়েছিল। অবশ্য আমার প্রেমিকা যদি অন্য কারও সঙ্গে এভাবে সারা দিন কাটাত, ঘুরত—কতটা সহজ ভাবে নিতাম জানি না।  

পরে একটি কথা জেনে ব্যথিত হয়েছি। স্বর্ণালীর সেই প্রেমিকের ঘর-সংসার আছে। তিনি একজন বিবাহিত পুরুষ।

পরীক্ষায় ফেল করার ভয়ের সামনে আমার আত্মবিশ্বাস যখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, পরীক্ষার হল যখন আমার কাছে ফায়ারিং স্কোয়াড, তখন আমার এই স্বর্ণালীর কথাই মনে পড়ল। মনে হল মাকালীর কাছে পুজো দিয়ে প্রার্থনা জানালেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাব। স্বর্ণালীদের  বাড়ি ডানলপে। ওখান থেকে দক্ষিণেশ্বর কাছে। ওকে ফোন করে একদিন ওদের বাড়ি চলে যাই, তারপর ওর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে মাকালীর কাছে পুজো দিই।তার আগে কখনও যাওয়া হয়নি। কিন্তু মাকালীও আমার আত্মবিশ্বাস ফেরাতে ব্যর্থ হল।  

পরীক্ষা দেব না দেব না— এই দোলাচল অনেকদিন চলল। পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা যে করিনি তা নয়। অনেকবারই খাতাপত্র খুলে অর্থনীতির গুরুগম্ভীর তত্ত্ব উদ্ধার করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছি। বাড়িতেও এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলল।    

আমাদের বাড়ির অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। বাবা ঊষা কোম্পানিতে কাজ করতেন। শ্রমিকের কাজ। বদলি বা ক্যাসুয়াল শ্রমিক। নো ওয়ার্ক নো পে। তাই সংসার চালানোর জন্য পারিবারিক পেশা হিসাবে ঠাকুর বানানো যেমন ছিল, বাবা টুকটাক জমিজমার দালালিও করত। কিন্তু বাবার মতো সৎ ও বোকা মানুষ পাওয়া ভার। মায়ের ভাষায় বাবা নাকি জমির  মালিককে বলত, “আপনি একদম দাম কমাবেন না।” আবার জমির ক্রেতাকে বলত, “ওই জমির দাম অত টাকা হয় নাকি?” ফলে কালেভাদ্রেই লেনদেন সম্পূর্ণ হওয়ার শিকে ছিঁড়ত  বাবার কপালে। তার ওপর ডিল ফাইনাল হলে রেজিস্ট্রিবিহীন লাইসেন্স না থাকা দালালকে ফাঁকি দেওয়াও খুব সোজা ছিল এবং সেই সহজ পথ বেছে নিতে প্রায় কেউ-ই দ্বিধা করত না। 

বাড়িতেও বিস্তর ঝামেলা। ট্রেনের দুটো কামরাকে পাশাপাশি জুড়ে দিলে যেমন হয়, আমাদের বাড়িটা ছিল অনেকটা সেরকম। তবে উচ্চতাটা আরেকটু বাড়িয়ে ধরতে হবে। কারণ দোতলা বাড়ি। দৈর্ঘ্যেও বেশি। একপাশের কামরায় আমাদের বাস, অন্যটায় জ্যাঠাদের। রান্নাঘর, বাথরুম ছাড়াও প্রায় প্রতিসম ভাবে দুদিকে দুটো করে ঘর। দ্বিতীয় ঘরটা ভিতরের দিকে প্রস্থে ছোট হয়ে মাঝে সিঁড়ির ঘরের জন্য জায়গা দিয়েছে। জ্যাঠাদের দোতলাটা কমপ্লিট। আমাদেরটা শুধুমাত্র ছাদ ঢালাই হয়ে জানলা দরজাবিহীন, প্লাস্টারবিহীন হয়ে পড়ে থেকে আমাদের আর্থিক দূরবস্থার কথা নীরবে দৃষ্টিকটুভাবে ঘোষণা করছে। নীচের তলার প্রথম যে বড় ঘর, তাতে দুটি  রেলকামরার মাঝের পার্টিশন নেই ধরতে হবে। রাস্তা বা উঠোনের দিকে যাওয়ার রাস্তা আমাদের  দিকে। ফলে দরজা খোলা থাকলে রাস্তা থেকে আমাদের খাটের একাংশ দেখা যেত। এই ঘরটা দুপক্ষের কমন। ঘরের সিলিঙের মাঝে একটা লম্বালম্বি দশ ইঞ্চির বিম যেন সীমান্ত রেখা বা আমাদের  লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি। কমন ঘরের  যৌথ মালিকানা থাকলেও জ্যাঠাদের দাবি ঘরটা তারাই তৈরি করেছেন, তাই তাদের অধিকার। বড় ঘর এবং উঠোনের অনেকটাই ছিল জ্যাঠাদের দ্বারা অধিকৃত। উঠতে বসতে মা-বাবাকে, এমনকী আমাদেরও খোঁটা শুনতে হত। এদিকে ঠাকুরদার কেনা জমিতে একান্নবর্তী পরিবারের বানানো বাড়ি, পরে ভিন্ন হাঁড়ি হওয়া দুই পরিবার বা বাবা-জ্যাঠার মধ্যে লম্বালম্বি সমান ভাগ হবে এমন বন্দোবস্ত অলিখিতভাবে ছিল। কিন্তু গায়ের জোরে ও সম্পন্ন হওয়ার ক্ষমতায় জ্যাঠারা আমাদের নিচু নজরে দেখত শুধু নয়, দাবিয়ে রাখত নানা ভাবে। বুঝিয়ে দিত ওরা আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ্য। ওদের সঙ্গে আমরা সহজে বিবাদে  জড়াতাম না। কিন্তু কালেভাদ্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ফেললে ঝগড়া বেঁধে যেত। ছোটবেলা থেকেই ঝগড়া কাজিয়া শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু আমার মনে ভেসে বেড়াত এক উদাসী নাও। চারপাশের দৈন্য, মালিন্য, হাহাকার যেন আমার অন্তরে প্রবেশ করতে পারত না। ভেসে বেড়ানো আমার বেশ পছন্দের ছিল। কিন্তু বেশি দিন ভেসে বেড়ানো গেল না, শ্রেণিচেতনা আমার মধ্যেও প্রবেশ করল। 

জ্যাঠাদের সম্পন্নতার কারণ জ্যাঠার রাইটার্সে চাকরি। তৃতীয় শ্রেণির কর্মী হলেও সরকারি চাকরি। আর বাবা একটি কারখানার বদলি শ্রমিক। তারওপর আবার বাবার বেশি ঠাকুর  বানানোর পারদর্শিতা ছিল না। আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারটি যোজনা কমিশনের নির্ধারিত দরিদ্রের সঙ্গায় না পড়লেও আমাদের গরিবই বলা চলে। গরিব মানে তো শুধুমাত্র খেয়েপরে বেঁচে থাকার দুশ্চিন্তা বা কিছু সম্পদের অনধিকার নয়, পিছিয়ে থাকার দুঃখও। অথচ আমাদেরও ঈর্ষা করার লোকের অভাব ছিল না। ইর্ষার ধারালো দাঁতের ফাঁকে যেন আমাদের অবস্থান। দোষের মধ্যে আমরা একটু পড়াশোনায় ভাল ছিলাম। এক ক্লাসে বছর বছর থাকার বিলাসিতা ছিল না।  

মা বলল, “দরকার নেই আর পড়াশোনা করে। তুই ডবলুবিসিএসের জন্যই কোথাও ভর্তি হ।”  

মায়ের সিদ্ধান্তও মানতে পারলাম না। পরীক্ষায় বসলে ফেল করব এই ভয়ে না-হয় পরীক্ষা দিলাম না, কিন্তু পরের বার পাশ করার জন্য ঝাঁপাব না? যদি এম. এস-সি.-তে ভর্তি না হতাম, আলাদা কথা ছিল। কিন্তু ভর্তি হয়ে এক বছর ক্লাস করে ফেল করার ভয়ে লেখাপড়াই ছেড়ে দিলে নিজের কাছে নিজে কী জবাব দেব? ডবলুবিসিএসের জন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে প্রস্তুতি  নেওয়া বেশ চাপের ব্যাপার। কারণ বাবা সদ্য চাকরিতে স্বেচ্ছাবসর দিয়েছে মায়ের ঐকান্তিক প্ররোচনা বা পরামর্শে। কাজ হারানোর ক্ষতিপূরণ বাবদ বাবার হাতে নগদ আশি হাজার টাকা এসেছে। সেই টাকার থেকে আট-দশ হাজার নিয়ে মা কোথাও ভর্তি হতে বলছে। বাবাকে বলেলেও বাবা আপত্তি করবে না। মায়ের কথা শুনে একদিন সরদার কলেজ অব ফারদার এডুকেশন নামের একটি সংস্থায় ঘুরে এলাম। তারা চাকরির পরীক্ষার জন্য  প্রশিক্ষণ দেয়। শুধু ডবলুবিসিএসের জন্য এক রকম রেট আবার কম্বাইন্ড কোর্সের রেট আরেক রকম। কিন্তু আট হাজারের নীচে কোনওটাই নয়। এখন এই সংখ্যাটা অনেক কম মনে হলেও আজ থেকে প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে এর যথেষ্ট দাম ছিল। অত টাকা কোথাও বিনিয়োগ করে ভর্তি হয়ে বিনিময়ে যদি রিটার্ন কিছু দিতে না পারি? মানে যদি চাকরি পেতে ব্যর্থ হই? অতএব ও-পথ মাড়ালাম না। আরেকটা কথা বলে নিই, বাবার চাকরি ছাড়ার গুরুতর কারণ বাড়ির ঝামেলা। চাকরি ছাড়লে নগদ মোটা টাকা পাওয়া যাবে এমন প্রচার ছিল কোম্পানির তরফে। সেই টাকায় বসত সম্পত্তি জ্যাঠাদের থেকে আলাদা করে নিলে শান্তি ফিরবে— এটাই ছিল মায়ের অভিমত। বাবার ইচ্ছে ছিল না। মায়ের লাগাতার আগ্রহে বাবা একদিন চাকরি ছেড়েই দিল। গোল্ডেন হ্যান্ডসেক। সোনালি করমর্দন। কিন্তুর বাড়ির ঝামেলা সম্পূর্ণ মিটল না।  

সরদার কলেজ অব ফারদার এডুকেশন থেকে ঘুরে এসেও আমার দ্বিধা গেল না। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোনও কোচিং-এ ভর্তি হয়ে পরীক্ষা দিলে প্রচণ্ড চাপে পড়ে যাব। এত চাপের  মধ্যে আমি কি মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারব? দ্বিতীয়ত ফেল করার ভয়ে যে ছেলে পরীক্ষায় বসা থেকে বিরত হয়, তার মনোবল তো এমনিতেই তলানিতে। সে কী করে বিসিএসে সফল হবে? 


মৌমিতাদের বাড়ির পরিবেশে ঔদার্য ছিল। মেয়ের কোনও ছেলেবন্ধু এসে মেয়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করলে বাবা-মায়ের মনে কোনও সন্দেহ উঁকি মারত না। অথবা মেয়ের প্রতি তাদের বিশ্বাস অটুট ছিল। মৌমিতার মা-ও মনে হয় আমাকে বেশ পছন্দ করতেন। চা করে তো দিতেনই, সঙ্গে এটা-ওটা খেতে দিতেন। মাঝে-মাঝে আমাদের সঙ্গেও টুকটাক গল্পে যোগ দিতেন। কত-কী যে বলতাম তার ঠিক ছিল না। মৌমিতা পরিষ্কার জানিয়েছিল যে বন্ধুত্বের সম্পর্কে ওর কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কোনও প্রত্যাশা রেখে ওর সঙ্গে মেশা যাবে না। কিন্তু আজ মনে হয় সাইকেল  চালিয়ে দু-চার দিন অন্তর ওদের বাড়ি গিয়ে গল্প জুড়ে বসার মধ্যে কোথাও ওকে ইম্প্রেস করার মরিয়া চেষ্টা ছিলই।

ইচ্ছে হত একান্তে কোনও নদীর পাড়ে বসে মৌমিতাকে কবিতা শোনানোর। জীবনানন্দের কবিতা—

‘তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো! 

এখনও নারীর মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।’

একদিনের কথা মনে পড়ে। বিকেলে ছাদে মাদুরে বসে আমরা গল্প করছি। আমার অনর্গল কথার স্রোত ফুরোচ্ছেই না। সন্ধ্যার কোলে মাথা রেখে বিকেল ঢলে পড়বে এরকম সময় মৌমিতা বাধ্য হয়েই বলে, “এবার বাড়ি যা, আমি পড়তে বসব।”

ওর তো আর আমার মতো পড়াশোনা মাথায় ঢোকার সমস্যা নেই। 

শুধু গল্প করতেই নয়, আরও একটা উদ্দেশ্য থাকত ঘন ঘন মৌমিতাদের বাড়ি যাওয়ার।


চার 



আমার ক্লাসনোট নেওয়া নাকি বেশ ভাল ছিল। মানে ক্লাসের বন্ধুরা কয়েকজন বলেছিল।  কীভাবে যেন সেই কথা মৌমিতার কানে যায়। ফলে মৌমিতা আমার ইন্ডিয়ান ইকনমির নোটের খাতাটা নিয়েছিল। বলে যে এটার থেকে ও নিজের মতো করে একটা নোট বানাবে পরীক্ষার জন্য। এই নোটের খাতাটা ফেরত আনা ওদের বাড়িতে ঘন ঘন যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু চাইতে কেমন বাধো বাধো ঠেকত। বাধা কাটিয়ে এক-দু’বার চেয়ে ফেললে শুনতাম, “এখনও লেখা হয়নি রে, কাজ চলছে।” আর এদিকে পড়তে বসলেই খালি মনে হত ওই খাতাটা তো আমার কাছে নেই। ওই খাতাটার অনুপস্থিতি অসম্ভব কষ্ট হয়ে বুকে বাজত। যেন ওই খাতার অভাবে আমার পড়ার প্রস্তুতি শুরু করাই দুষ্কর। মনে হত পরীক্ষা নামক যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র আমার অন্যের বাড়িতে রয়ে গেছে। ওইটি ছাড়া আমার অস্ত্রপ্রশিক্ষণ পূর্ণতা পাবে না। মৌমিতা ওর বানানো নোটটা আমাকে শেয়ার করবে এমনই কথা ছিল। পরীক্ষা শুরুর দিন পনেরো আগে আমার খাতাটা ফেরত পেলাম, সঙ্গে মৌমিতার নোটটাও দিন দুইয়ের জন্য ধার। কিন্তু হাতের লেখা বিশেষ সুবিধের মনে না হওয়ায় এবং অন্যের বানানো নোটে সাচ্ছন্দের অভাবে জেরক্স না করেই ফেরত দিই। 

পরীক্ষার ঠিক দশ দিন আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। পরীক্ষা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত। কাজ নেই পরীক্ষা দিয়ে। জীবনে কখনও ফেল করিনি। পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে। তার চেয়ে সামনের বছর আবার পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভাবা যাবে। আপাতত ফেল করার গ্নানি  থেকে তো মুক্ত হব। অতএব দিলাম পরীক্ষায় ড্রপ।

পরীক্ষার দিনগুলো খুব বাজে কাটল। মনের মধ্যে ভীষণ আবসাদ টের পেলাম। পরীক্ষা দেব বলে দুটো মোটা টাকার টিউশনি আমার এক বন্ধুর কাছে গচ্ছিত রেখেছি মাস খানেকের জন্য। স্টাডি লিভের অবসর পরীক্ষার বৈতরণি পার করতে ঠিকঠাক ব্যবহার করব ভেবে।   বন্ধুটি আমার হয়ে গিয়ে পড়াবে। সোজা কথায় প্রক্সি দেবে। সেই মাসের মাইনেতেও তারই  অধিকার। পরীক্ষার পরে আবার আমি গিয়ে বহাল হব। আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতি টিউশনি হাতছাড়া ও ছাত্রের ক্ষতির কারণ যাতে না হয় তাই এই ব্যবস্থা। সেই টিউশনিতে আবার বহাল হলাম বলে সারাক্ষণ নিজের ব্যর্থতা নিয়ে ভাবা থেকে অস্থায়ী মুক্তি পেলাম।  

এদিকে মৌমিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হল না। হল না আমারই ঐকান্তিক আগ্রহে। কিন্তু আপশোশ রয়ে গেল। হাত থেকে বেরনো তির যদি ফেরত আনা যেত, যদি তির নিক্ষেপের স্মৃতি আমাদের দু’জনেরই মাথা থেকে বিলুপ্ত করা যেত, তাহলে হয়তো মৌমিতার নিঃসঙ্কোচ বন্ধুত্ব পেতাম।

কিন্তু পরীক্ষা দিলে ফেল করার যেমন চাপ, না দিলে লোকলজ্জার চাপও কম নয়।  সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হলে আমাকে মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হবে, কিংবা তারা যদি জানতে চায় পরীক্ষা দিলাম না কেন, কী বলব তখন? হয়তো বলতে হবে না, পাশ থেকে কেউ টোন করবে, “ও তো প্রেমে ল্যাং খেয়ে ড্রপ দিয়েছে।” অথবা মুখে কিছু না বললেও তাদের নিশ্চুপ দৃষ্টিবাণে আমি বিদ্ধ হব। রক্তাত হব। এইসব ভেবে আতঙ্কে দিন কাটতে  লাগল। 


********************************************************************************************

আগামী সংখ্যায়

********************************************************************************************

উপন্যাস * দীপংকর রায়

 



[ 'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৯  

দীপংকর রায়


 দিন চলে যায় এমনই কত ঠিক অথবা ভুলের ভেতরে......! এমনই সে সব অবগাহন পর্বে আস্তে আস্তে অভ্যস্থ হয়ে উঠছি , কতরকমের অভ্যাসের ভেতরে ! যেখানে দুটি গাই গোরু রয়েছে । তাদের দুধের হিসেব নিকেশ, দানা-ভুসি , খোল-বিচালির গন্ধের ভেতর গোবর - চোনায় মিশে আছে যেন একটি সংসারের চারপাশ ।

    সে সব কাজকর্মের পরে একটুখানি যা অবসর তাও ইদানীং এলোমেলো ঘোরাঘুরির ভেতরেই কেটে যায় । আর তার পরে যেটুকু , সে তো শরৎবাবুর শ্রীকান্ত নিয়ে নেয় ।

      যেখানে শ্রীকান্ত চির জীবনের কথা দিয়ে রাজলক্ষ্মীর কাছ থেকে বিদাই নিয়ে চলে যায় মগদের দেশে জীবনের কঠিন বাস্তবকে দেখার জন্যে ।

     আজ পড়ছিলাম সেই অধ্যায়টি ।

     কদিন ধরেই রেখেছিলাম দ্বিতীয় খণ্ডটি বিছানার মধ্যে । আজ মেলে ধরলাম সেটিই । লেখক শুরু                             

করছেন এই বলে ,  " এই ছন্নছাড়া জীবনের যে অধ্যায়টায় সেদিন রাজলক্ষ্মীর কাছে শেষ বিদায়ের ক্ষণে চোখের জলের ভিতর দিয়ে শেষ করিয়া দিয়া আসিয়াছিলাম, মনে করি নাই , আবার ছিন্ন সূত্র যোজনা করিবার জন্য আমার ডাক পড়িবে । কিন্তু ডাক যখন সত্যিই পড়িল , তখন বুঝিলাম , বিস্ময় এবং সঙ্কোচ আমার যত বড়ই হোক , এই আহবান শিরোধার্য করিতে লেশমাত্র ইতস্তত করা চলিবে না ।

    তাই আজ আবার এই জীবনের বিশৃঙ্খল ঘটনার গ্রন্থিগুলা আর একবার বাঁধিতে প্রবৃত হইয়াছি । 

     আজ মনে পড়ে , বাড়ি ফিরিয়া আসার পরে আমার এই সুখ-দুঃখে মেশানো জীবনটাকে কে যেন হঠাৎ করিয়া দুই ভাগে ভাগ করিয়া দিয়াছিল । তখন মনে হইয়াছিল, আমার এই  জীবনের দুঃখের বোঝা আর আমার নিজের নয় । এ বোঝা বহিয়া বেড়াক সে , যাহার নিতান্ত গরজ । অর্থাৎ আমি যে দয়া করিয়া বাঁচিয়া থাকিব , এ তো রাজলক্ষ্মীর ভাগ্য । চোখে আকাশের রঙ বদলাইয়া গেল । বাতাসের স্পর্শ আর একরকম করিয়া গায়ে লাগিতে লাগিল ----- কোথাও যেন আর ঘর-বার , আপনার পর রহিল না  । এমনই এক প্রকার‌ অনির্বচনীয় উল্লাসে অন্তর-বাহির একাকার হইয়া উঠিল‌ যে, রোগ কে রোগ না বলা , বিপদ কে বিপদ বলিয়া আর মনে 

হইল না । সংসারের কোথাও যাইতে , কোনো কিছু করিতে দ্বিধা-বাধার যেন আর লেশ মাত্র সংস্রব রহিল না ।… " 

      এর পরেই লিখছেন , " এ সব অনেক দিনের কথা । যে আনন্দ আর আমার নাই , কিন্তু সেদিনের এই একান্ত বিশ্বাসের নিশ্চিন্ত নির্ভরতার স্বাদ একটা দিনের জন্যেও যে জীবন উপভোগ করিতে পাইয়াছে , ইহা আমার পরম লাভ । অথচ হারাইয়াছি বলিয়াও কোনোদিন ক্ষোভ করি নাই । শুধু এই কথাটাই মাঝে মাঝে মনে হয় , যে শক্তি সেদিন এই হৃদয়টার ভিতর  হইতে জাগ্রত হইয়া , এত সত্বর সংসারের সমস্ত নিরানন্দ কে হরণ করিয়া লইয়াছিল , সে কি বিরাট শক্তি ! আর মনে হয় , যেদিন আমারই মত আর দুটি অক্ষম , দুর্বল হাতের উপর এত বড় ভারটা চাপাইয়া না দিয়া , যদি সমস্ত জগৎ ব্রম্ভান্ডের ভারবাহী সেই অখন্ড বিশ্বাসের সমস্ত বোঝা শপিয়া দিতে শিখিতাম তবে আজ আর ভাবনা কি ছিল ? কিন্তু যাক সে কথা । " 

      এর পর নানা কথা ------ রাজলক্ষ্মী কে আবার কাছে পাওয়া তার বাড়িতে । এবং রাজলক্ষ্মীর নানা প্রশ্নের এক একটা জায়গা এরকম : ........ আগে বল , ওই লোকটা এখানে থাকতে তুমি আমাকে কেন মন্দ মনে করনি ? 

      না । 

      পিয়ারী আবার একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল , কিন্তু আমি যে ভালো নই , সে তুমি তো জানো ? তবে কেন সন্দেহ হয় না  ? 

      প্রশ্নটা অত্যন্ত কঠিন । সে যে ভালো নয় , তাও জানি , সে যে মন্দ এও ভাবিতে‌ পারি না । চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম । 

      হঠাৎ সে চোখ মুছিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, আচ্ছা , জিজ্ঞেস করি তোমাকে , পুরুষ মানুষ যত মন্দই হয়ে যাক , ভালো হতে চাইলে তাকে ত কেউ মানা করে না ; কিন্তু আমাদের বেলায় সব মন্দ কেন ?

অজ্ঞানে , অভাবে পড়ে একদিন যা করেচি , চিরকাল আমাকে তাই করতে হবে কেন ? কেন আমাদের তোমরা ভালো হতে দেবে না ?....."


   শ্রীকান্ত পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ের এই আরম্ভের কথপকথন।এই আত্মজাগরণ উভয়ের মধ্যে । তার এক একটি অভিব্যাক্তির সঙ্গে কোথায় কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগলাম । এবং কেন জানি না সমস্ত দুপুর , বিকেল বেলাটা , সন্ধ্যা ঘুরে গেলেও আমি আজ একটি মুখকেই ভেসে উঠতে দেখলাম বারবার আমার চোখের সামনে ,

সে আমার নতুন মামিমা । কেন জানি বারবার মনে হতে লাগলো ,  এ জগতে এমন কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে,  যাদের এক-কথায় অর্থ করা যায় না । সেই সব সম্পর্কের মায়া-টান এমনই , সেখানে কত অর্থ গোপন রেখে অনাদি কাল‌ এমন কিছুর অর্থ দান করে যেতে থাকে , যাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অথচ তার দুই হাতে উজার করে দেওয়া স্নেহ মমতার অজানা দানে , এই জীবনটা  কত প্রাচুর্যে যে ভরে থাকে ;---তা শ্রীকান্ত যেমন অন্নদাদির কাছ থেকে পেয়েছিল , রাজলক্ষ্মীর কাছ থেকে‌ ; তেমন  ঘটনাবহুল  হয়তো আমার নতুন মামিমার কথাটি নয় , তবে , তার কাছে আমার নিরুপদ্রব আশ্রয়‌ যেটুকু ছিলো , তা আর কারো কাছে তো ছিল না ! 

      কেন জানি আজ বারবার তার কথাটি-ই মনে পড়তে লাগলো।

      বারবার মনে পড়তে লাগলো তার অনেক না বলা কথাগুলি । অনেক সন্ধ্যা বেলার ,অনেক দুপুর বেলার , সঙ্গ-সুখানুভূতির মুহূর্তগুলি ভীষণ মনে পড়তে লাগলো । সে  নানা ভাবে , নানা অজানা অর্থ দান করে যেতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে পড়তে লাগলো, কল্যানীর কথা । 

     সেও কি কম ? 

     সেই ওর ছেলেমানুষী , সেই ওর সকল দাবি ; নিশ্চুপে সঙ্গ দিয়ে যাওয়া দিনের পর দিন মাছ ধরার সময় ।

     সেই ওর ভোর বেলায় বকুল ফুল কুড়িয়ে আমার পড়ার টেবিলের উপর রেখে যাওয়া নিঃশব্দে ; তার মধ্যে কি হাজার হাজার রাজলক্ষ্মীর মুখ আমি খুঁজে পেলাম না কি ?!


        এর পরে শ্রীকান্ত অভয়া পর্বে , যেখানে অভয়ার জীবন জটিলতার অমীমাংসিত পর্বে অভয়া তাকে বিবেচকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে , একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো , সে প্রশ্নের উত্তর কি এই এত বছরের পরে এসেও খুব সহজ ভাবে তার সমাধান হয়েছে ?

         নাটক যাত্রাপালা এসব ওদেশে থাকতে সেই যে দেখে চলে এসেছি , এখানে এসে তা আর সেভাবে হয় নি ।

         মাঝে অবশ্য দুদিন দু ' জায়গায় গেছিলাম যদিও ; তাই হয়ে ওঠেনি কথাটা ঠিক না । একদিন দিদি , জামাইবাবু , মা ও ভাগ্নেটিকে সঙ্গে করে নানু বাবুর বাজারের পেছনের মাঠটায় দেখেছিলাম 'চেঙ্গিস খাঁ ' যাত্রাপালা ।

      আর একদিন , শঙ্কর, ফোচন ওদের সঙ্গে সাজাহান পালা টি ।

      এদেশের যাত্রাপালা তো আর ওদেশের যাত্রাপালার মতো সারা রাত্তির ধরে হয় না। কিম্বা সঙ্গে নানা ধরণের নাচ গানও থাকে না । 

      ওদেশে পালার মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে এমন সব নাচ গান থাকে , যা না থাকলে ওদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ-জনেরা সে পালা দেখবেই না ।

     এদেশে যাত্রাপালা , সে যত বড় ই হক না কেন ; তার সময় সীমা তিন চার ঘন্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শুধু  পালাটাই আসল । তাতে অতিরঞ্জন নেই । 

        তাই পালা দেখার মুগ্ধতাটাই নিতে হবে । যাত্রার ভেতর দিয়ে বাড়তি মনোরঞ্জনের অন্য কোনো সুযোগ নেই। ওই তিন চার ঘন্টার মধ্যেই দর্শক কে যতটুকু নাটকীয় মুগ্ধতা দেওয়া যায় , সেইটুকুই ।


     ওদেশে যাত্রাগান শুনে এসে পরদিন কি তারও পরের দিন , সেই কাহিনীর রেশ চলাচল করতো মনের ভেতরে  ; কেমন যেন সকল চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেয়ে বেশ খানিকটা সময় বুঁদ হয়ে থাকা এমনই একটা ভাব । এবং সেই ঘোরটুকু নিয়েই ঘুরে বেড়ানো ছিলো অন্তত আমার ক্ষেত্রে হয়তো খানিকটা বেশিই ।

     

      কিন্তু এদেশের যাত্রাপালা শুনে এসেও সে জিনিস হলো ঠিকই খানিকটা ,  কিন্তু তা বেশি সময় ভেতরে বইতে পারা গেল না কেন যে, তা জানি না ।

      সেটা কি ওই দেশের নানা দিক দিয়ে একটা অবস্থানগত নিভৃতির কারণ ? 

     নাকি আর কোনো মনোরঞ্জনের কিছু ছিল না বলে, বছরে একবার এই ধরণের একটা বিষয়ের রেশ অধিক জায়গা নিয়ে নিত মনের ভেতরে ?

     এখানে নানা ধরণের হয়তো প্রচারের সুযোগ সুবিধা থাকার কারণে, টি . ভি , রেডিও , সিনেমা , নাটক , নানা কিছু ; তাই সেই নির্জন তার প্রভাব টা অতটা অনুভব করতে পারলাম না যেন ।

      তবে , চেঙ্গিসএর রেশ বেশ কিছু দিন ছিলো ।

      যাত্রাপালার কথা থাক ।এখন তো এখানে পাড়ার ক্লাবে ক্লাবে বড় বড় তাঁবু খাটিয়ে যে উনিশ পয়সার সিনেমা আরম্ভ হয় বর্ষার সময়টা পেরোলেই ; পুজো-টুজো মিটে যাবার পর পরই এক এক ক্লাবের আয়োজন শেষ হলেই অন্য ক্লাবের উন্নয়ন বাবদ শুরু হয়ে যায় এই সব সিনেমা ।

      এ উন্নয়ন সে উন্নয়ন উপলক্ষে এই যে উনিশ পয়সার সিনেমা দেখার হিড়িক পড়ে যায় । মাইকিং আরম্ভ হয়ে যায় প্রায় সারা দিন ধরে  রাস্তায় রাস্তায় ; আজ কি দেখানো হবে, আগামীকাল কী কী দেখানোর সম্ভাবনা আছে , সেই সব —-।

সঙ্গে যদিও আর একটি কথা থাকে , যদি ফ্লিম পাওয়া যায় তবেই , এই সবের এনাউন্সমেন্ট ; সে ক্ষেত্রে  ছবির পরিবর্তন হয় একরকম রোজ ই । বলা হয় , না , আজ এই বইটা পাওয়া গেল না । অমুক ফ্লিমের বদলে অমুক ফ্লিম টা দেখানো হবে আজ ।

     আর ঠিক তখনই পাড়ার ভেতরে কীরকম একটা সোরগোল পড়ে যায় সেই সিনেমা টি দেখবার জন্যে ।

    তবে সবটাই ছবির জনপ্রিয়তার উপর টিকিটের ডিম্যান্ড ।

      কোথাও কোথাও চেয়ারের ব্যবস্থা থাকে। কোথাও আবার চট বা শতরঞ্চির উপরে বসেই দেখতে হয় মানুষে মানুষে গাদাগাদি করে ।

      এই সিনেমা গুলি এসে অবশ্য‌ একটি কাজ হয়েছে ,দুপুর বেলা হলেই যেমন মানুষের সিনেমা হল মুখো সাজগোজ করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটবার যে একটা চেনা জানা‌ চিত্র ছিলো , ----সেটায় কিছুটা যেন‌ ছেদ ফেলে দেয় , এই উনিশ পয়সার সিনেমা দেখার হিড়িক পড়লে । মানুষ - জনের হল মুখো ছুটবার লাইন আর দেখা যায় না , দুপুর বেলা হলে । 

     এর পরে সন্ধ্যা বেলায় তাঁবুর নিচের সোরগোলেই মাতে অনেকে।


         এই রকম সব দেখতে পাওয়ার কারণ হলো‌ , এই অঞ্চলে কাছাকাছি দুটি আধুনিক মানের সিনেমা হল তৈরি হয়েছে। আর একটিও নতুন তৈরি হচ্ছে । শুনতে পাই সেটি নাকি এর চাইতেও উন্নতমানের হবে  ।

      এদিকে আজ আবার এরা ধরেছে পাড়ার মাঠের সিনেমা দেখবে না । গঙ্গার পাড়েরটায় যাবে ।

        এ সব ক্ষেত্রে যদিও আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কিছুই থাকে না । লজ্জা হয় , প্রতিদিন ওরা পয়সা দেবে , সেটা আবার কেমন ! এক আধ দিন আমারও তো দেওয়া উচিৎ ?

         কথায় কথায় বলা হয় যদিও উনিশ পয়সার সিনেমা । বাস্তবে তা কিন্তু না , দু' টাকা তিন টাকা । কোনো কোনো দিন চার ও হয়ে যায় সেটা । এক এক সময় এক এক মূল্য নির্ধারণ করা হয় । তাই , সে ক্ষেত্রে উনিশ পয়সার সিনেমা সেটা শুধু মাত্র একটি ঘরোয়া নাম । কেটাগরী ! যার সঙ্গে ওই কথার কোনো মিল নেই । আর সেই কারণেই একদিন এদের সেই প্রশ্নটা করেই বসলাম ,  ''কি যে তোরা উনিশ পয়সার সিনেমা , উনিশ পয়সার সিনেমা করতিছিস ভাই ; এডারে কি সত্যিই সিডা কয় নাকি ? ''


       এই যে বন্ধুবান্ধব , এদের সঙ্গে আমার স্কুল কলেজের কোনো বন্ধুত্ব তো নেই ;—-এরা তো সকলেই যার যার স্কুল কলেজ করে । আমি ওদের বাড়তি সময়ের সঙ্গী শুধু মাত্র । তাও আমাদের বাড়িতেই বেশি । কারো বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারার মতোন সামাজিক কোনো পরিচয় আমার নেই তো ! 


      আমাদের বাড়ির এই আড্ডার খবরাখবর পাড়ার অন্যান্য ছেলেপেলেদের মধ্যেও নাকি আজকাল আলোচিত হয়  । 

তারাও বলে , "ওই কুতুর দাদাটার সঙ্গে এরা সারাক্ষন কি এত আড্ডা মারে রে ! "

        আসলে এর কারণও হয়তো শংকর । হয়তো কাল্টু । নাকি ফোচন?

       বিশেষ ভাবে হয়তো শংকরই । নানা ভাবে সামাজিক একটি মর্যাদা; নাকি ওর স্কুল-কলেজের পড়াশোনাটাই বিষয় ? 

       নাকি বর্তমানে সেনজিভিয়ার্সের উপরি সুনাম ?

    কাল্টু ও ফোচন স্থানীয় স্কুলেই পড়াশোনা করেছে । মাধ্যমিকে কাল্টুর রেজাল্ট ভালো বলে সেও এখন সেনজিভিয়ার্সে । শংকরের সঙ্গেই যাতায়াত করে । এবং সেখানকার কিছু বন্ধুবান্ধব , তারাও আমাদের আড্ডায় চলে আসে ছুটিছাটার দিনে । তারাও কীভাবে কীভাবে যেন শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে যায় এখানে আসা যাওয়ার কিছুদিন বাদেই !

     এদের মধ্যে ফোচনই একটু খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় । বাকি আর সকলেই একটা ধারাবাহিকতার মাঝেই হেঁটে চলেছে।

   ফোচনের খাপছাড়া হওয়ার কারণ কি পায়রার পেছনে ছোটা ? 

     ফাঁক পেলেই গড়িয়ার হাট মুখো সোম শুক্রবার গুলোতে । কয়েক দিন  আমিও গেছি তার সঙ্গে দুপুর রোদে গড়িয়ার সেই হাটে । পায়রা কিনতেই না শুধু , সেখানে পায়রা বিক্রিও করে এসেছি তার সঙ্গে । 

     ওদের বাড়ির ছাদে , পায়রার বাক্সয় নানা ধরনের , নানা নাম ধামের সেসব বকরবকম ব্যাপারসেপার । আমি সে সবের নাম ধাম শুনি , মনে রাখতে পারি না কিছুই ।

     তাই ওর নজর সবসময়ই দেখি আকাশমুখো ।ছাদের এ কোনায় ও কোনায় ঘোরাঘুরি আর হাতে তালি দেওয়া শূন্য-মুখো চেয়ে চেয়ে । 

     সে সব দেখে একটুও ছোটো ভাবি না ওকে । বরঞ্চ মনে হয় পায়রা চরিত্রের কতো সুলুক সন্ধান , কত গবেষণা ওর মধ্যে ! কত সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাদের ! এক একটি পায়রার এক এক রকম , যা তার একেবারে নখদর্পনে সবটা ।

      কিন্তু বিষয়টা হয়ে গেছে এখানেই গন্ডগোল । ফোচনের কী সুন্দর একটি দরদি মানসিকতা রয়েছে ! কত পর্যবেক্ষণ ! নানা বিষয় পশু পাখি নিয়ে । অথচ স্কুলের গন্ডী টি পেরতে না পেরোতেই , ও ওরকম দিশেহারা আকাশ-মুখিন হাততালির জগতে ঢুকে পড়লো কেন যে ! আমি অবশ্য ওর অনেক মানবিক গুনাগুন লক্ষ্য করি । যা অত্যন্ত একান্তের এবং জনদরদি বললে একটুও বেশি বলা হবে না ।


     কিন্তু সে তো যা হচ্ছে তা হোক , পাড়ার মোড়ের আলোচনার প্রধান বিষয় এখন আমাদের বাড়ির এই আড্ডা । তাদের কৌতুহল , " কারা সব এখান থেকে ওখান থেকে নতুন নতুন ছেলেপেলেরা এখানে এসে ভিড়ছে কী কারণে ? কী করে এরা এই ঘরকুনো ছেলেটির সঙ্গে ? যদিও ইদানিং দেখা যাচ্ছে , কালীবাড়িতে , না হলে খালপাড়ে পণ্ডিতের দানাভুসির দোকানে । গোরু - বাছুরের সঙ্গেই তো ওর বেশি যোগ; অথচ তার কাছে এই সমস্ত ছেলেপেলেরা কি এত বকরবকর করে তা কে জানে ? "

       শংকর বিষয়টা শুনেছে ।  তবে ও এসব কানে তুলতে চায় না । কারণ , সেই হচ্ছে এই আলাদা হয়ে যাওয়ার মতন একটা ইমেজ তৈরি তে সব সময় সচেতন ও সতর্কও যেন । তার কথা হলো, " কে কোথায় কখন কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে , মেলা মেশা করবে , তার কৈফিয়ত কি পাড়ার ওই সব ছেলেপেলেদের দিতে হবে ? আমাদের ভালো মন্দর বিচার করবে তারা কেন ? আমরা কি যাচ্ছি তাদের সংশোধন করবার জন্যে ? "

       তাই হঠাৎ কেউ উঁকিঝুঁকি মারলেও ; এখানে এসে দাঁড়ালে ; সে তখন এমন একটা ভাব তৈরি করে তাকায় তার দিকে , সে তখন কোনো কিছুই না জানতে চেয়ে  যেমন এসেছিল তেমনই ফিরে যায় । সে তার সব অভিসন্ধি গুটিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হবেই । সে ক্ষেত্রে আমাকে আর বলতে হতো না তুমি এখন এসো তো বাছাধন , আমরা এখন একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যাস্ত রয়েছি —ছুটি ছাটার দিন হলে এই আড্ডা শেষ হতে হতে বেলা তিনটে চারটেও বেজে যায় এক একদিন। ইদানীং কাজের দিদির তাতে অস্বস্তিও বেড়ে গেছে । 

     আলোচনার বিষয় তো একটা না, সে নানা দিক পরিক্রমা করে ফেরে যেন । সে অলোক থাকলে মাছ , গাছ , যেমন ; ফোচন থাকলে পায়রার অজানা জগৎ ; তার মধ্যে কুকুর, খরগোশ , গিনিপিগ, কী বা নেই ! তাদের দেশ বিদেশে কতরকমের সব নাম -ধাম- খাদ্য -খাবার- উৎপাদন- উদযাপন ; কত কি !  আবার  কখনো সিনেমা তো কখনো রবীন্দ্রনাথ , কখনো নজরুল । জীবনানন্দ ব্যাতিত আর অন্য কোনো কবি তখনো পর্যন্ত প্রবেশ করেনি । তবে দেশ পত্রিকা যে একটি সাহিত্যের মূল্যবান পত্রিকা , এটা ওরা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে বেশ গম্ভীর গলাতেই । 

    অতি কষ্টে পঞ্চাশ পয়সা থেকে সম্প্রতি একটাকা দিয়ে তার প্রত্যেকটি সাপ্তাহিক সংখ্যাগুলি সংগ্রহও করে চলেছি । সেগুলিকে সামনে ফেলে ,একেবারে যেন কাট চেরাইও চলছে ;  ভালো মন্দর ধারণা সবটাই এদের । আমার নীরবে হজম করে যাওয়া ছাড়া ব্যাক্তিগত অভিমতটি জানানোরও অধিকার ছিল না সে সবে । কারণ সমর্থন মিলবে না সে অভিমতের একটিরও । তবে একথা শুনতে হতো প্রায়-ই ----" কীরে , লিখতে পারবি এখানে ? এখানে না লিখতে পারলে কিন্তু তোমার কবিতার কোনো কদরই হবে না ,  সমাজের কোথাও । "

     তারপরেই বলতো শংকরই , " আমি কিন্তু এই কথাটা শুনে শিখেছি । আমাদের নাগতলার ইংরেজীর মাস্টার মশাই কেদার বাবু বলেছেন এই কথাটা । "

     কেদার ভাদুড়ির কবিতা মাঝে মধ্যে ছাপা হতে দেখি দেশ পত্রিকায় । জিজ্ঞাসা করি ," ইনিই কি সেই কেদার ভাদুড়ি ? "

     শংকর বলে ," হুঁ........তিনিই বলেছেন এই কথাগুলি । ওখানে লেখা ছাপা হলে তবেই তোমার একটা সামাজিক পরিচয় হলো । তাছাড়া টাকাও তো ভালোই পাওয়া যাবে ! তাই বলছি ওখানে লেখা ছাপা হলে তবেই তোমাকে লোকে- জনে কবি বলে মানবে । "

   

      একদিকে শংকরের এই কথা বলার মধ্যে দুটি দিককে আমি লক্ষ্য করি , কারণ ওর এই কথাগুলি বলার মধ্যে একটা মিচকি হাসিও আছে যে , তাও আমি লক্ষ্য করেছি খুব ভালো করে । তাও বেশ খানিকটা মুষড়েও পড়ি মনে মনে। আবার মনে মনে ভাবিও , এরা কী এমন লেখে, যার কিছুই তো আমি বুঝি না ! তাহলে ওখানে লিখবো কেমন করে ? 

    ওরা চলে গেলে গতকালের নিজের লেখাটি মেলাই দেশ পত্রিকার বিভিন্ন কবির কবিতার সঙ্গে ।  না , এদের লেখালিখির সঙ্গে কোথাও কোনো একটা জায়গায়ও তো আমার লেখালিখির সঙ্গে মিলছে না !  অন্তত একটুখানি মিলও তো পেতে পারতাম ! কিন্তু কিছুই মিললো না তো ! তাহলে কি করি ?

     কাউকেই বলি না । ঘটনাটা আড়ালেই রাখি । আড়ালে আড়ালেই এই সব ঘটতে থাকে ।

নানা ভাবে তাকে এদিক ওদিক করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি । নিজের কোনো একটি লেখাকে ওদের মতো করে দাঁড় করাতেও চেষ্টা করি । কিন্তু এই যে এতগুলি লেখা , যে লেখার সঙ্গে আমি আমার লেখার ধরণ পাল্টে ওদের মতো করতে চাইছি ; কিন্তু তা কার মতো করবো ?  এখানে তো সকলেই এক তালে , এক ভাষায় , এক ধরণেই লিখছে ! এখানে কে কার থেকে ভাষায় ভাবে আলাদা ? কি বৈশিষ্ট্য তাতে , বিশেষ একটি দিকের ? তা তো বুঝতে পারছি না ! এদের একে অন্যের ভাষার সঙ্গে বিশেষ কোনো আলাদা কিছু তো খুঁজে পাচ্ছি না ! তাহলে কি এখানে সেরকম লেখাই ছাপা হয় , যা এক সুরে , এক তালে , এক ভাষায়ই লেখা হয় ? হয়তো তার একটা বিশেষ বয়ান আছে । আলংকারিক সামঞ্জস্যতা আছে নাকি ? তা না হলে আমি যে এতবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওদের মতো দাঁড় করাতে চেষ্টা করছি , কই , তাতো কিছুতেই হচ্ছে না দেখতে পারছি ! কাটতে কাটতে , ঘোরাতে ফেরাতে যেয়ে দেখতে পারছি , আমার লেখাটির তো আর কোনো অবশিষ্ট থাকছে না কিছুই ;  শেষে পুরোটাই বাদ পড়ে যাবে নাকি খাতা থেকে ? 


    তাই ফের পুরোনো লেখাটিকেই টুকে রাখি , কেটে ফেলা লেখাটি বাদ দিয়ে ।

    ওখানে ছাপা লেখার মধ্যে সম্পূর্ণ একটি ছবি আমি খুঁজে পাই না কোথাও । তাকে এদিক দিয়ে ভাবতে যাই  তো ,  ওদিক দিয়ে সে আবার পালিয়ে যায় । হতে পারে হয়তো তার সকল অনর্থ আমার বোঝাবুঝির মধ্যেই ; কোনো দিক দিয়েই তাতে আমি একটি সম্পূর্ণতার  মুখ দেখতে পাই না । ভাবি , কী যে এরা বলে উঠতে চায় , এদের লেখার মধ্যে দিয়ে ,  তার তো আমি কিছুই বুঝি না  ! এবং এতে বেশ অস্থির ও  হয়ে উঠি মনে মনে । পরে এক সময় আড়ালেই সেই যুদ্ধ ,ধস্তাধস্তিটা বাদ দিয়ে , ওরা ডাকতে এলে , ওদের সঙ্গে চলে যাই সন্ধ্যে বেলার উনিশ পয়সার সিনেমা দেখতে তাঁবুর তলায় । 


      ওমা ! এখানেও একই অবস্থা? ওরা কী সুন্দর 'ওয়াক্ত ' ছবি দেখে পরদিন আলোচনা করে , বলরাজ সাহানীর কী অভিনয় ! ওমুক একেবারে বাঘা আর্টিস্ট ! 

       আমি কিছুই বুঝি না । হাঁ করে চেয়ে থাকি । ওদের অবশ্য বুঝতে দিই না , বিষয়টা নিয়ে একবার শুধু একথাটাই বলি,  এই  ভাষাটাই তো বুঝি না ! তোরা কি সুন্দর বুঝিস রে ভাই …… !

     তাহলে কি আমার ভাষাবোধেই সব গন্ডগোল ? 

       সব ক্ষেত্রেই একটা ঝাপসা ঝাপসা ভাব । সব যেন কীরকম ধরেও ধরতে পারি না  কিছুতেই । 

     ওরা একদিন ' নিশিপদ্ম ' দেখে এসে বললো , হিন্দিতে এই বইটির কী যেন নাম হয়েছিলো ?  মনে নেই । যাইহোক , রাজেশ খান্নার সঙ্গে তুলনা না করে , কত আলোচনা করতে লাগলো ওরা ! আমি তো ছাই এই সব তারতম্যের মাথামুন্ডু কিছুই জানি না । শুধু কেন জানি না , যেদিন পথের পাঁচালী দেখলাম , সেদিন আবার আমি আমার সেই ফেলে আসা ওদেশের গ্রামটিতে চলে গেলাম । কী মনখারাপ হলো ! অপু দূর্গার সমস্ত বিচরণ ভূমি আমার চোখে জল এনে দিলো । আপন মনে লুকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম । অথচ কাঁদবার কারণ তো ইন্দির ঠাকরণ না ! কাঁদবার কারণ কি দূর্গার মৃত্যু ? কই , সেটাও তো না সবটা ! অপু দূর্গার জন্যে মনখারাপের জায়গাটা কি ? না , তাও তো না ! তাহলে ? কোথায় যে ভেতরটা মুষড়ে উঠলো অমন ; সেটাই ভাবতে  থাকি সকল সময় ।

     যদিও পরে বুঝতে পেরেছিলাম পথের পাঁচালীর প্রকৃতিই তো আমার ফেলে আসা সেই প্রকৃতি ! সমস্ত মনটা জুড়ে এখনো যে ছায়া ফেলে রয়েছে । সে তো রোদ-বৃষ্টি ঝড়- জলে মাঠে -পুকুরে , নানা অনটনের চিত্র বুঝিয়ে আজও সেখানেই  রেখেছে আমাকে । যেখানে পথের পাঁচালী শুরু এবং শেষ হলো । সেখানের আমিই তো সেই আমি, যাকে সত্যি সত্যি কি আজ খুঁজে পেলাম ?

       এর বেশ কিছুদিন পরে দিদির বাড়িতে টেলিভিশনে শ্রীকান্ত অন্নদা দিদি বা বড়দিদি , অভয়া শ্রীকান্ত ও শাপমোচন চলচ্চিত্রটি দেখেও একই অবস্থা । কেন জানি না মনটা বারবার ফিরে যেতে চায় সেখানেই ---- যেখানে সমস্ত ঝড় জল মাথায় করে মামাদের সঙ্গে বাগানে যেয়ে আম কালে হয়তো কয়েকটি কাঁচা আম বা একটি নারকেল কিম্বা হাতে একখানি নারকেল ডেগো কুড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসে বাড়ির উঠোনের উপরে ধপাস করে ফেলার মধ্যে যে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ , তাতেই যে প্রশান্তি , ওই গুটিকয়েক কাঁচা আম কিম্বা ওই একটি নারকোলের ডেগোর মধ্যে , বা একটি নারকেলের মধ্যে , কী এমন সম্পদ ছিলো , যা আমায় আজও সেখান থেকে চলে আসবার পরেও , মনটাকে একটা বিরাট মমতার ছায়ায় ফেলে লালন করছে , সেই অমূল্য ধনটি কে ঘিরে কেবলই ; আরো কি কোনো কিছুই নেই তার সঙ্গে ?

      সত্যিই কি এতই মূল্যবান বস্তু সে? 

      তাহলে সেই হাহাকারই তো সকল বিষয় হয়ে উঠতে পারে ! যেখানে মন আনন্দ পায় আজও ফিরে চেয়ে !

      এর পর বেশ কিছুদিন আর খাতা বের করিনি এদের সামনে । কারণ , তখন আমি ফিরে চলেছি সেখানে , যেখানে আজই প্রথম জানতে ও বুঝতে পারলাম , সেই জীবনই আমার মনের দেশ ।

       হয়তো সে আমার মনেরই ধন। আমি তার বাইরে যদি অন্য কোনো দিকে ফিরে চাই , তাহলে তাকে আমি মন থেকে বলতে পারবো কোন দিকে চেয়ে ?

     এখানে আসবার পরে এই কটি ছেলেপেলেদের মধ্যেই তো আমার সব আদানপ্রদান বোঝাপড়া ; এর বাইরে তো এই বিশাল শহরটি — এই দেশের আরো কত বড় বড় শহর নগর গ্রাম - জীবন রয়েছে ; রয়েছে তাদের কত বৈচিত্র্য ;  কত বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাদের ! সে সব কেন আমার বিষয় হয়ে উঠতে দিচ্ছে না , এই মুহূর্তগুলি  ?

     উত্তর পাই না কিছুই । 

      তবে ইদানীং এই লাভটুকু হয়েছে  যেমন এই পত্রিকা রেখে ; সেখানে অনেক বই পত্রের বিঞ্জাপন দেখি । সেই সব বই -পত্র সংগ্রহ করতে পারি কীভাবে , সেটাই মনে হয় সব সময় ।  কত সব বিষয়ের বই পত্র সে সব ! যে ভাবেই হোক সেগুলি সংগ্রহ করবো কীভাবে সেটাই ভাবতে থাকি নিরন্তর । 

    সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হয় , এছাড়াও তো আর একটি সংবাদ পাওয়া যায় — কতো সব পত্র পত্রিকার বিজ্ঞাপন থাকে ! এসব কোথায় পাওয়া যায় তাতো বিস্তারিত জানা নেই ! 

    সে কথাটি কার কাছে জানতে পাবো ?

    

    শেষপর্যন্ত সেও শংকরই আবিস্কার করে এনে আমাকে জানায় । জানতে পারা গেছে কলেজস্ট্রিট এবং রাসবিহারীর মোড়ে , দু-জায়গায় দুটি দোকান আছে । সেখানেই নাকি শিল্প - সাহিত্যের এই সব পত্র-পত্রিকা পাওয়া যায় । তাছাড়া সন্ধ্যাবেলায় রাসবিহারীর মোড়ে নাকি একটা আড্ডাও হয় , এই সব পত্র-পত্রিকার দোকানের সামনে । ইচ্ছে করলে সেখানে নাকি আমিও যেয়ে ঘুরে আসতে পারি ।

     ওদেশ থেকে মা এবং ভাইয়েরা কেউই এখনো ফিরে আসেনি । 

     ''রা '' টা যুক্ত হলো হয়তো এই কারণে , কথা আছে , দিদিমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসবে নাকি ওরা , তাই —-;

     সে ক্ষেত্রে তার পাসপোর্ট ভিসা যদি এর ভেতরে করানো সম্ভব হয় , তবেই । নিয়ম কানুন তো নতুন এখন , হলেও হয়ে যেতে পারে হয়তো ।

     আর এদিকে , দিন কাটছে একই রকম—   সকাল বিকেল গোরু বাছুর পরিচর্যা । বিকেল বেলা গুলোয় দুধের খরিদ্দারদের সঙ্গে কাজের দিদির কথাবার্তা আদান-প্রদান শোনা । সুজিত গোয়ালা গোরুর দুধ দুইয়ে দিয়ে যায় দু- বেলাই । এসবের  মধ্যে ফাঁক পেলেই দিদির বাড়িতে ও ঠাকুমার বাড়ি  ঢু মারা । দিদির বাড়ির বিশেষ টান ছবি দেখার । খবর শোনারও । ঠাকুমার বাড়িতে যাই , আর এক অদ্ভুত টানে , শুনলে হাসি ও পেতে পারে ।  হয়তো বলবে , এটা আবার কিরকম আনন্দ রে বাবা —- !

   

    আমার কাছে আনন্দটা হলো এই রকমের ,----- ঠাকুমা নিজের জন্যে একটি ঘর রেখে বাকি সব কটাই ভাড়া বসিয়ে দিয়েছে । তার মধ্যে পুরোনো ভাড়াটিয়াও আছে কয়েকজন , যাদের আমি অনেক কাল ধরেই দেখে আসছি । এদের জীবনযাপনের মধ্যে এদেশীও একটা ছাপ । যা ঠিক বাঙালদের সঙ্গে মেলে না । কেন জানি না সে সব আচার আচরণ গুলির ব্যবহারিক দিক গুলি দেখে আমি ভীষণ মজা পাই । 

     ঠাকুমার সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনেকটাই অভিভাবক সুলভ । যে কোনো বিষয়ে তারা তার পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না । সব সময় তার কড়া নির্দেশের অপেক্ষায়  চেয়ে থাকে যেন সকলে । যার একটুখানি নমুনার  কথা উঠলে একথাই বলতে হয় , এমনটি কোথাও দেখিনি এখন আর, ভারাটিয়া  বাড়িয়ালির সম্পর্কে ;  আর তাই তারা সকল বিষয়েই এককথায় অভিভাবক মানে তাকেই যেন ।


  


পুব দিকের ঘরের সত্যদার মেয়েটি সম্পা তো ঠাকুমার সব সময়ের সঙ্গী । ফাইফরমাজ যত সব ই সম্পা । আমার সঙ্গে সেই সুবাদে কথা বলা বলি ও গল্প করার একটি সম্পর্ক । সে মাধ্যমিক পাশ করে সম্প্রতি এগারো ক্লাসে উঠেছে । পড়াশোনায়ও বেশ ভালো শুনি । 

     

     সত্য দা এখানে থাকে না । তার একটি আইসক্রিমের কারখানা আছে দূর্গাপুরে । সে সেখানেই থাকে বেশির ভাগ সময় । তার আরও একটি বড় ছেলেও আছে । সে  সেখানেই  থাকে নাকি । সত্যদার ধর্ম সম্পর্কের এক বোনের কাছেই সে প্রতিপালন হয় । 

     এইসব নানা কারণে সত্যদার স্ত্রী ঠাকুমার উপরেই অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল।  অভিভাবকের মতো ।

      আর পূর্ব দিকে , যেখানে আমাদের থাকার ঘর ছিলো , সে ঘরটিতে এখন দত্ত মশাইরা থাকেন ।স্থানীয় বাজারে যাদের মুদিখানার দোকান আছে । 

     বাকি দক্ষিণ অংশে , যে দুখানি ঘর আমার মায়ের তৈরি করা ছিলো , তার একটিতে জয়ন্তি দি নামের একজনের সংসার-ধর্ম , সেখানে সে তার সন্তান - সন্ততিদের নিয়ে থাকে । সেও অনেক কাল । তাদের উত্তর কলকাতার দিকে মনোহারী জিনিসপত্রের দোকান আছে নাকি । 

    তার পাশের ঘরটিতে থাকে একজন বিহারী । তারা তাদের দেশওয়ালী বেশ কয়েকজন মিলে একই জায়গায় রান্নাবান্না করে , দুবেলা হৈ চৈ বাধিয়ে খাওয়াদাওয়া করে । সে সব বিরাট আয়োজন; গামলা গামলা তরিতরকারি রুটি তৈরির দুবেলা হুরুদ্দাম ব্যাপারসেপার । হিন্দি বাঙলা মিলে মিশে একেবারে বিরাট হৈ হল্লা বাধিয়ে , তার পর বাকি আর  সকলের খাওয়া-দাওয়ার পাট মিটলে , যার যার ডেরায় ফিরে যায় সেদিনের মতো । পরদিন আবার একই চিত্র তৈরি হয় । তারা যখন এক জায়গায় মিলিত হয় সকলে এই খাওয়ার সময় হলে ।

       আমি অবশ্য  ঠাকুমার রান্নাবান্নার খোঁজ নি আরও একটি বিশেষ টানে ,  সে হলো তার হাতে রান্না করা ডাটাচচ্চড়ি রুটি । যার 

স্বাদ অন্য কারো হাতের রান্নার সঙ্গে মেলে না । 

     ঠাকুমার ওখানে দিনের বেলাতেও মশারীর ভেতর ঢুকে তার সঙ্গে কথা বলতে হয় । বিশেষ করে দুপুর বেলায় সে যখন বিশ্রামে যায় সে । 

     তাই , আমি তার ওখানে গেলে ,যেয়েই সরাসরি মশারীর ভেতরে ঢুকে পড়ি । তারপর তার পাশে  শুয়ে শুয়ে সে সব  কত কথা 

কওয়াকয়ি ! তার মধ্যে বেশির ভাগটাই তার বাপের বাড়ি সম্মন্ধীও ; আর সে সব বলতে বলতে ঠাকুমার গলায় এমন এক নাটকীয় ভঙ্গী উঠে আসে , আর  আমি সেই ধরণটা  ভীষণ রকম ভাবে উপভোগ করি । 

    হয়তো দুপুরবেলায় কোনো কোনো দিন তার ওখানে কাটিয়ে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসেই বলি , এই যা....! ..... না না , ভীষণ দেরি হয়ে গেছে  ঠাকুমা , এখন যাই , কাল এসে বাকিটা শুনবো আবার -

         নানা অধ্যায়ের কথাই মনে পড়ে ।

           ঠাকুমার বাড়ির গলিটা পেরোতে যেয়ে পুরোনো যারা আছে ,তারা আমার ছেলেবেলার নামটা ধরে দেখা হলে বলে ,কখন এসেছিলি রে ? এখন কোথায় থাকিস ? এখানে ,নাকি পাকিস্তানেই —- এই যা …!.... এখন তো জয়বাংলা , বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে —--- 

          আমি তাদের জানাই , না না , এখন এখানেই থাকি ।

        হয়তো এখন কাউকে কাউকে আর একবারে পরিষ্কার করে মনে করতে পারি না —-- ঝাপসা হয়ে গেছে তাদের আগের মুখটা । সব ক্ষেত্রে সেটা আর মেলাতে পারি না এখন আগের সবটার সঙ্গে , তাও কুশল বিনিময় করি একটুখানি । তারপর হাঁটা লাগাই হনহনিয়ে…..। ভাবি , যদি এই স্মরণে না থাকাটার কথা ধরা পড়ে যায় —-- !

          এদিকে যা ভেবেছি সেটাই ঘটে । কাজের দিদি ঘুমিয়ে পড়েছিলো । সুজিত ভাই তাকে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে নিজেই দানাভুসি নিয়ে , গোরুর জাবনা মেখে নিয়ে দোহাই শুরু করে দিয়েছে।

       একটু পরে হয়তো কাজের দিদি উঠে তাড়াতাড়ি আরো যাতে সব কিছু এগিয়ে যায়, সেই চেষ্টা করছে দেখি ।

         আর এমনই একটা অবস্থার ভেতর হয়তো বাড়িতে ঢুকি ।

         তখন এই এলোমেলো অগোছালো পরিস্থিতিটা দেখে বেশ অপরাধ বোধই হয় যেন ; ভাবি , ইশ্ … এই এতগুলি মানুষকে আমিই দেরি করিয়ে দিলাম বুঝি …..; 


            যদিও খরিদ্দারদের এই নিয়ে খুব একটা হেলদোল নেই । তারা বেশ একটা আসোর সাজিয়ে নিয়ে সমস্ত বারান্দাটা জুড়ে বেশ হাত পা ছড়িয়েই বসে গেছে নানা গল্পগাছায় তখন । তাদের দেখলে বোঝাই যায় , ঠিক আছে বাবা যতো‌ পারো দেরি করো গে , এখন অত তাড়া নেই  কারোরই ; বিকেলের এই অবকাশ টুকুই তো , একটু গল্প গাছা  করে ওঠা যায় যদি সকলের সঙ্গে ….!


        আর এই বাড়ি টা ?

        সে তো আর কিছুক্ষণ বাদেই সন্ধ্যা লাগলে আবার জনমানবহীন হয়ে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়বে একাকী ।

           হয়তো ঘরের ভেতরে আমার বই পড়ার আয়োজন‌ চলবে 

তখন । না হলে কেউ যদি আসে ,তাহলে তো হলো কিছুক্ষণ ; না হলে আবার একার জগতে মুখ লুকিয়ে ঢুকে পড়া ।


             কেন বুঝি না , এই সব ধারাবাহিকতার ভেতরে আমার মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে । মনে হয় , না , হচ্ছে না  কিছুই ! ঠিক পথে চলছে না যেন কিছুই ।


            আচ্ছা , আমি কী এমন কিছু করতে চাই ?  যা না করতে পেরে আমার কেবলই মনে হচ্ছে , ঠিক পথে চলছে না তো কিছুই ! আমি কি সত্যি সত্যিই কিছু একটা করতে চাই , যেটা না করতে পেরে আমার ভেতরে এত অস্থিরতা ? আমি কি তার সবটা পরিষ্কার ভাবে জানি কিছু ? 


           উত্তর পাই না । মনে হয় বাঁধা-ধরা পথে যা যা এখন করা উচিত তাও তো আমি নিয়মমাফিক করি না । কিম্বা তা করার জন্যেও তো কোনো সাড়া পাই না ভেতর থেকে ! 

           এই যে এরা , যারা এখন আমার সব সময়ের বন্ধু , তারাও তো সকলেই একটা নিয়মের মধ্যে দিয়েই তো চলছে । স্কুল কলেজ করছে । পড়াশোনা শেষ হলে হয়তো একটা চাকরিবাকরিরও চেষ্টা করবে , সে এদিক ওদিক যেদিক থেকেই হক ; কিন্তু আমি ? আমি কোন পথ ধরে এই জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাবো ! তাহলে গো-পালন-ই আমার ভবিতব্য , নাকি অন্য কিছু ?--- লিখে তো আর জীবন চলবে না ; তাছাড়া– সে কাজেই বা স্বীকৃতি কোনখানে ?  স্বীকৃতি দেয়ই বা কে ! স্বীকৃতি পাবার যোগ্যতা কিছু আছে নাকি আমার ? এখনকার শিল্পসাহিত্যের মাথামুণ্ডু তো আমি কিছুই ধরতে পারি না !  জানিও না কোথায় কী হয় । আর সেটাই তো ওরাও বোঝাতে চায় আমায় । বলতে চায় , সময় পাল্টে গেছে , এখন আর শরৎচন্দ্রের সময় নেই । নজরুল রবীন্দ্রনাথেরও না । তাই যোগ্যতা প্রমান করতে হবে ।তা না হলে ভবিষ্যত অন্ধকার । 

       এ কথাগুলি যদিও কেউকে আর বলে দেবার দরকারও নেই —-

সে সব যেন নিজেই বুঝে যেতে বাধ্য হচ্ছি দিনে দিনে —-- ; শিক্ষার মান এখন আর বোধের উপর সবটা নির্ভর করে না । কায়দাই তাকে অধিকার করে নিয়েছে । কায়দাই সবটা । তার কৌশলের মূল্যই অধিক । তার জন্যে অনেকগুলি পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয় । যোগ্যতার প্রশ্ন উঠলে , শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উঠলে , আমি তাদের কে একথাই বলি‌, আমি তো কোনো ইস্কুল কলেজে পড়িনি ভাই !

        একথা শুনে অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না ।

         তখন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি । বলি মনে মনে , কেন এরা বিশ্বাস করতে চায় না ?  সত্যিই তো পড়িনি । গেছি মাত্র । সত্যি সত্যিই পড়েছি কি ? ওকে কি অন্তর থেকে পড়া বলে ? তাছাড়া সত্যিই তো , আমি তো অন্য কোনো ভাষায়‌ কথাও বলতে পারি না ! পারতপক্ষে চেষ্টাও করি না । অন্তত যেটুকুও চেষ্টা করলে অন্তত পারি কিছুটা ; তাহলে ,এরা কেন বিশ্বাস করতে চায় না ? একটা স্বভাবসুলভ ভাষায় কথা বলতে পারি এই যা ; তাও আধা এদেশ আধা টা ওদেশিও আঞ্চলিক মিলিয়ে মিশিয়ে ; তাহলে , কেন এরা আমার লেখাপড়ার যোগ্যতার লাইসেন্স টি নিয়ে এত কৌতুহলী হয়ে পড়ে ? 

       শংকর বলে , শোন , তুই কিন্তু ইংরাজী টা শিখে নিতে পারিস ভালো করে । ইংরাজী টা শিখতে তো তোর কোনো বাধা থাকার কথা না ! তোর ভালো না লাগলেও এটা কিন্তু তোকে শিখে নিতে হবে ভাই ; এই ভাষাটি না জানলে তুই কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের কিছুই জানতে পারবি নে । আর এ প্রসঙ্গে আমার কি মনে হয় জানিস , বিশ্বসাহিত্যের গতিবিধি টা না জানতে পারলে তুই কিন্তু অনেকটাই নাজানা থেকে যাবি । 


        বোকার মতো হাঁ করে থাকি এদের কথাবার্তা সব শুনে । নিজের মধ্যে নিজেকেই প্রশ্ন করি , আচ্ছা , ইংরেজি টা শিখতে পারলেই কি  তাঁদের ভাষার শিল্প-সাহিত্য সব আমি বুঝতে পারবো ? 

        শিল্প-সাহিত্যের ভাষার কি আলাদা আলাদা দেশ আছে ?                       আমাদের দেশিও ভাষায়‌ কি শিল্প-সাহিত্যের সঠিক ভাষাটি বোঝবার কোনো উপায়-ই নেই ? ভাষার আলাদা আলাদা দর্শন হয় নাকি —-? যা দিয়ে খুব সহজে আমরা শিল্পকে বর্ণনা করতে পারি ? অথচ বুঝিয়ে দিতে পারি না ঠিকঠাক ভাবে যেন…… । 

         শিল্পের চোখ এবং কান দুটোই আলাদা হয় । অন্তত আমার তো সেটাই মনে হয় কেন যেন । 

        আমরা যা লিখি , আমরা যা উপস্থাপন করি , তার তো একটাই ভাষা । যা সমস্ত ভাষাতেই ধরা দেয় এক-ই রূপে । তাকে ইঙ্গিত থেকেই তো বুঝতে হয় । তার ইঙ্গিতের ভাষা আলাদা আলাদা হয় কি কোথাও ? তাহলে ইংরাজী শেখার দাবি যেমন , তেমন পৃথিবীর সব দেশের ভাষা  বুঝতে পারলে কি আমি তাঁদের সব শিল্প-সাহিত্য বুঝে যাবো ?

          তাহলে শংকর কেন বলছে ,ইংরাজী ভাষাটা না জানতে পারলে আমি সব কিছু থেকে বাদ পড়ে যাবো ?

          আমার চুপ করে থাকা দেখে শংকর হঠাৎ করেই বলে ওঠে —- 'তুই একটা কাজ কর , এর আগে তুই আমাদের বেদ , পুরাণ , উপনিষদ এইগুলো একবার ভালো করে পড়ে নে তো দেখি— তুই কি জানিস , আমাদের দেশে কত জন দার্শনিক আছেন ? আচ্ছা থাক না হয় সে সব , তুই আপাতত  যোগ কটিই আগে পড়ে নে , তার পরে  ওগুলি পড়িস না হয়‌ । এভাবেই এগোতে হবে তোমাকে ভাই । একটি একটি করেই সংগ্রহ করে এগো না , দেখবি অনেক কিছুই ইশারাতেই বুঝে যেতে পারছিস। তখন হয়তো তোর অনেক কিছুই  বুঝে যেতে আর কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না দেখবি ।

     ওর হঠাৎ করে বলা আর একটি  ইংরাজী শব্দরও সবটা বুঝতে পারলাম না যেন ; ইঙ্গিতে ইশারায় তবুও কি খানিকটা বুঝে নিতে পারতাম না , আর একটু চেষ্টা করলে?

      তবে খুব গভীর ভক্তি সহকারেই শুনে যেতাম সকলের সব কথাগুলি । তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সরিয়ে রাখিনি  কখনো কিছুই ।  তবে যেগুলি খারাপ লাগতো সেটা তো লাগতোই । একটি কথা তো সত্যিই , আমি কত কিছুতেই তো ওদের থেকে পিছিয়ে ! ওরা ইতিমধ্যে কত কিছুই তো আমার থেকে বেশি জানতে পেরেছে ! 

       ওকে বলতাম , তুই এই সব বিষয়ে এত কিছু জানিস কোথা থেকে রে ? তুই তো শিল্প-সাহিত্যের ধার কাছ দিয়েও হাঁটিস নে ! পছন্দও করিস নে । তেমনই তো মাঝেমধ্যে বলিস ও ; লেখালিখিও‌ করিস নে ,তাহলে এসব বিষয় নিয়ে অবলীলায় এত কিছু বলে যাস কি করে ?

        সে তার উত্তরে বলতো , এগুলো জানার জন্যে কি সাহিত্য করতে হয় নাকি ? তুই তো সাহিত্য করিস , তাহলে তুই এগুলো জানিস না কেন ? এসবের সঙ্গে সাহিত্য‌ করার কোনো সম্পর্ক নেই । 

          ওর এই গুরু-গম্ভীর কথাগুলি অনেকেই শুনলে মনে করবে হয়তো , এই কথাগুলি একটু বুঝি বা সবজান্তা গোছের না ?  অথচ আমি কিন্তু একবারও সে কথা ভাবতাম না । বরঞ্চ ওরা চলে গেলে ভাবতাম বসে বসে । ভাবতাম , এই বইগুলি এখুনি হাতে পেলে বুঝি খুবই ভালো হতো ।


          একটি বিষয় নিয়ে ভীষণ ভাবে ভাবছি কদিন ধরে —- আচ্ছা , কোনো একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে গেলেই , ধরো , কোনো একটি বই , বা সিনেমার বিষয়টাই ধরো না কেন ; তার সবটা প্রভাব কেন এরকম ভাবে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ! আর তখনই আমার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় । আচ্ছা , এ পর্যন্ত আমি যেসব লেখালিখি করেছি , তার সবটা কি আমি এই ধরণের একটা প্রভাব থেকেই করেছি ? কোই , নাতো ! তাও তো না ! 

         কিছুই তো  একেবারে জানি না  সেসব বিষয়ে !  খাতা কলম নিয়ে বসবার আগেও আমি জানি না , কী লিখতে চলেছি তখন । সত্যি বলতে কি , লিখতে বসার পরেও জানতে পারি না সে সব বিষয়ে । আমি যা লিখে চলি , তাতে পূর্ব-পরিকল্পনা বলে কিছুই তো থাকে না । থাকে শুধুই একটা অনুভব , অন্তরালে । সেই যেন ঠেলে নিয়ে চলে আমাকে । বিষয়-টিষয় নিজেই তৈরি হয়ে চলতে থাকে , শব্দ ও আসে সেই বিষয়ের গতিতেই একটি তরঙ্গের মতো ! কলম নিজেই চালিয়ে নিয়ে চলে আমায় তখন ।

      তাহলে , শংকর যে এতকিছু পড়তে বলছে আমায় , তার প্রভাবটা যাবে কোথায় ?

       আমি কি সে সব পড়ার পরে , জানার পরে ,  ভুলে যাবো সে সব ?

        আর যদি ভুলেই যাই , তাহলে পড়ার অর্থটাই বা কী দাঁড়ালো ? পড়ার অর্থ তো একটা কিছু থাকবে ! 

হয়তো বা সে সব ওই তরঙ্গের মধ্যে দিয়ে মিশে যেয়ে আমাকে এমন একটা কিছু দেবে , হয়তো তা আরো উৎকৃষ্ট কিছু ; তা না হলে সে সব পড়েই বা কি হবে ?

          এসব সব আপন মনের ভাবনার কথা । এসব সব একান্তের । কেউ নেই তাতে ! এমন কেউ যেন সেখানে নেই কোনো দিনও । থাকেও না  ?

          আজ সকালে উঠেই লক্ষ্য করছি সামনের বাড়ির মাসিমার সেই বোনঝিটির আবারও আগমন ঘটেছে ।

           এই তো সেদিন এসে গেল চলে ; আবার কেন রে বাবা ! এর আগে তো এত ঘনো ঘনো কেন , দেখিই নি । এই কদিন যেতে না যেতে তাহলে আবার কেন ?

            হয়তো বিশেষ কোনো দরকারেই হবে হয়তো এই আগমন । যাক সে যে দরকারেই হোক গে ,আমার কি তাতে ?

             

             একটু বেলা হলেই চারদিক কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায় । তখন আবার তার সেই ওবাড়ি থেকে এ বাড়ির দিকের পর্যবেক্ষণ শুরু হয়ে যায় । মনে মনে বলি , কী এত দেখে রে বাবা ! 

            সে যেন আমাদের এই বাড়িটা উল্টে নিয়ে দেখে সব সময় । নিশ্চয় এটাই দেখে , আমাদের বাড়ির নানা দৈন্যটুকু । এই একটি বারান্দা , তার প্লাস্টার চটা দেওয়ালগুলি , যাতে কয়েক বছর রং হয় নি । ওপাশে একখানি টালির চালের বাথরূম , পায়খানা , কলতলা। আর টালির চালের ঘরটির সঙ্গে কাঠের দোতলা , তাতে  মুরগির ঘর । তার নিচটায় একটি কালো ও লালচে আভার দুটি গাই গোরু বাঁধা । আর একটি সাদা লালে মেশানো খানিকটা , সেটি তো একটি নুলো বাছুর , বাঁধা রয়েছে ঘরের সামনের দিকটায় । বাকি মানুষজন কে বা কারা থাকে তার সবটা তো ইতিমধ্যেই সে জেনেছে ।  তাহলে এই সব কিছু নিয়ে ওর এত কৌতুহল তো থাকার কথা নয় ! 

          তাহলে বাকি আর কিসে এতো কৌতুহল ? 

          মাসিমাদের বাড়িটায় হয়তো সম্প্রতি একটু নতুন ঘরদোর হচ্ছে ঠিকই , তাও এখনও তো মাসিমার পুরোনো বেড়ার ঘরটিও রয়েছে ।

           আচ্ছা , ওদের বাড়িটার কথা তো শুনলাম সেদিন কথায় কথায় মাসিমার মুখে , বেহালার দিকে ।

           সে যাই হোক , এসবের সঙ্গে তার এই উঁকিঝুঁকির কি অর্থই বা থাকার আছে !  আচ্ছা , আমার ই বা এত লক্ষ্য করার কি আছে এতো ? কেন ই বা এত ভাবাচ্ছে , বুঝতে পারছি না তো !

          

           একটি সম বয়সি বা কম , যাই হলো , সে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছু একটা লক্ষ্য করছে , সেই নিয়ে এত বাড়ি-ঘর-দুয়োর গোরু-বাছুর বাথরূম-পায়খানা-কলতলা রং বেরঙে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে তুল্যমূল্য কুরুক্ষেত্র বানাতে নেমে পড়েছি , কেন ই বা এমন করে !

             এত লজ্জা বোধ ?

             কই , ওদেশে থাকতে তো এসবের ধারকাছ দিয়েও কখনো ঘেঁষি নি ! এসবের বিন্দুবিসর্গ কোনোদিন মাথায়ও তো আসেনি ! তাহলে , কেন এখানে এসেই বা এমন একটি চটকদার মেয়ের উঁকিঝুঁকি মারা দেখে কেনই বা  আমার মনে হচ্ছে এত কিছু  ? ওই মেয়েটি যদি , কখনও এমনটা হয় ,  সে আমাদের বাড়িতে এসে সোজা ঘরের ভেতরে বসে পড়ে ; তাহলে কী লজ্জাতেই না পড়বো ! এরকম দেয়ালগুলোর সব চুন খসা , নোনা ধরা জায়গায় জায়গায় ; ঘরখানার ভেতরে ঢুকেই হয়তো সে হাঁপিয়ে উঠবে । ওরা হয়তো কত সচ্ছল‌ ! ঝকঝকে, মোজাইক করা ঘরদুয়োর ওদের । একতলা কিম্বা দোতলা ঘরদুয়োর ,  ছাদ আঁটা বাড়ির মালিকানা হয়তো তাদের । বুঝি বা হয়তো মলিদের মতোন । না হলে ফোচনদের বাড়ির মতোন হলেও তো হতে পারে !  না হয় শংকরদের মতোন ! আমাদের এই টালির চালের চুন খসা দাঁত বের করা , একেবারে পঞ্চপাটি হাসি যেন তার ! সর্বদা হাসতে থাকে ।

             আচ্ছা ওর কি এসবে চোখ পড়বে আদেও ?

              কেনোই বা পড়বে ?

              পড়ার তো একটা কারণ চাই  !  এমন কারণ , বিষয়ী চিন্তা-ভাবনা নাও তো থাকতে পারে তার ! এসব হয়তো চোখেই পড়লো না । আবেগে হাসতে হাসতে হয়তো ফাটিয়ে দিলো এইসব তুচ্ছ বিষয় আসয় ; কোনো দিকে একবারও চাইলোই না । শুধুই নিছক সৌজন্য মূলক একটা আড্ডা মেরে‌ হোইহোই করে চলে গেলো । 


          মনে মনে কী সব ছাইপাঁশ ভাবছি যে ! 

          আমি কি শুধুমাত্র ওই মেয়েটির চোখের ভেতর দিয়ে এইসব অনটন বা আভিজাত্যপূর্ণ বিষয় আসয় , বা সচ্ছল অসচ্ছল এই সব বিষয়গুলোই শুধু ভাবতে বসেছি! কোথায় এই বয়সে একটি মেয়ের চোখের ভেতর দিয়ে কত সব অনুভূতির দেশে পৌঁছে যাওয়ার কথা , তা না ওর চোখের ভেতর দিয়ে কেন জানি আমি এই বাড়িটার দৈন্য টাই লক্ষ্য করার কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছি শুধু শুধু  !

           হয়তো আমি যা ভাবছি ও আদেও তা ভাবছে না । ও হয়তো হলেও হতে পারে একটুখানি কৌতুহলী এই কথা ভেবে —- আমি যে এত লক্ষ্য করছি এই বাড়িটার মানুষগুলির প্রতি , অথচ ওই ছেলেটি কেবলই দেখো আমাকে দেখে কোথায় লুকিয়ে যাচ্ছে আড়ালে ! ঘরের বাইরেও বের হচ্ছে না একবার । আগের বার তবু সকালের দিকে উঠোনের বাগান পরিচর্যা করতে দেখেছিলাম । এবারে তাও আসছে না !

           ও হয়তো ভাবছে , এমন বিচিত্র পাগল তো দেখি নি কোথাও ! 

        ওর ভাবনাই তো ঠিক ! তা না হলে আজকে কাজের দিদিকে আগেভাগেই বা বললাম কেন এই কথা —- আজকের বিকেল বেলার সব তুমিই সামলিও দিদি । আমাকে কিন্তু বাইরে ডেকো না । আমার একটা বিশেষ কাজ আছে ওই সময় টায় । কেউ এসে ডাকলেও আমাকে ডেকো না । বলো বাড়িতে নেই সে । বেরিয়ে গেছে বাইরে ।

          কাজ তো ঘোড়ার ডিম । কোনো কাজই ছিলো না । শুধু শুয়ে শুয়ে না হলে বসে , বিছানা থেকে সামনের দিকের জানালাটা আধপাল্লা খুলে এই সব নজর রেখে বেড়াচ্ছি । ছাইপাঁশ ভেবে বেড়াচ্ছি । যেন নানা  মুদ্রাদোষে পেয়ে বসেছে আমায় ! আর সেই সব ভেবে ভেবে আড়ালে সিঁধিয়ে যাচ্ছি কোথাও ।

         একাত্তরের পর থেকেই আমাদের এই বাড়িটার একটি নামকরণ করা হয়েছিলো । জয় বাংলা বাড়ি । পাড়ার রকে বসা ছেলেপেলেরা কেউ বাইরে থেকে এসে খোঁজ করলে আমাদের বাড়িটার , ওরা তাদের কে জিজ্ঞাসা করতো , আপনারা কি জয় বাংলা বাড়িটা খুঁজছেন ?


      একাত্তর এখন অনেকটাই পেছনে চলে গেছে । তাই সেই সময়ের আবহটাও এখন নেই । তাই এখন হয়তো সেই নামটার আলাদা ঠাট্টাতে আর জমবে না তেমন , তাই এখনকার মাধুর্যের বিষয়টা বিবেচনা করে ,  আর একটি বিশেষত্ব বের করে ফেলেছে এইসব ছেলেপেলেরা —---তাই এখন এই বাড়িটার নামকরণ হয়েছে গোরুওয়ালা বাড়ি ।


********************************************************************************************

আগামী পর্বে

*********************************************************************************************