কবিতাগুচ্ছ * তৈমুর খান
১
শব্দে জেগে উঠি
বিস্মৃতির কোলে জন্মালাম
আমাকে আয়না দেখায় জল
আমাকে সোহাগ করে ভোর
মৈথুনের আবেগ এসে আমাকে চুমু খায়
চারিপাশে আলোর খেয়াল
আমি অন্ধ মাঝখানে থাকি
বৈরাগ্য আসে গৃহস্থের বাড়ি
আমি তাকে যদিও দেখি না
আমার ইন্দ্রিয়ে স্পর্শ করি
কত যে হ্রদের মাছ
বিকেলের রঙে খেলা করে
মেয়েরা যুবতী হয়ে
একে একে ফিরে আসে ঘরে
তাদের গর্ভের সঞ্চার হলে
মেঘ জমে। যুবক ঘোড়ার পিঠে
আসে অহংকার
আমি তার শব্দে জেগে উঠি
আমি তার নীরব অনুচ্চার
২
আমরা সবাই দুর্গাদাস
সমস্ত জাহাজগুলি থেকে ধর্ম নেমে আসে
প্রতিটি ধর্মের গায়ে স্বর্গের পালক
ধুলোর সংসার পেতে
মা-মাসিরা খই-মুড়ি ভাজে
বিকেলের রাঙা চোখ, নোনতা বিশ্বাস
কোন্ ক্রোধে এমন তাকায়?
রূপকথার কত বাড়ি ঘর
কৌতূহল যাওয়া-আসা করে
আমাদের উন্মুখ কারিগর
দু-একটা ধর্মাশ্রয় বানিয়ে দেয়
তবু নীল ভয় হামাগুড়ি দিয়ে নামে রোজ
তার হাতে-পায়ে কী অসম্ভব জোর
জোড়াতালি-মারা এজীবন
ঠুনকো
বিষাদ-চোর চেয়ে চেয়ে দ্যাখে
কারুবালা, এসো এসো
মা হও, বউ হও, রক্ষা করো
আমরা সবাই দুর্গাদাস
আমাদের সংসারে ঢোকে সন্ত্রাস!
৩
যাত্রা
পার্থিব যাবে অপার্থিবের বাড়ি
আমরা বৈরাগ্য চাইব যদি না ফেরে হলদে শাড়ি
ক্ষতচিহ্ন ঢেকে
চাঁদ উঠবে
মৌসুমিকে কেউ ভোলেনি
মৌসুমী যদিও ঋতু নয়,কিংশুক ফুলের মতো নারী
ডেটল ভেজাচ্ছে তুলো
আমরা তার গন্ধগুলো ভাগ করছি
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছে মৃত্যুগুলো
ছুটি হল
এই মুহূর্তে ছুটি হল
নিরালোকে ছুটে যাচ্ছে নিপুণ হাওয়া গাড়ি
৪
বিবাহসভা
আমি ভাষা বুঝি নাকো তাদের
শুধু নীরব ভাষায় কথা হয়
সে অনেক কথা—
দীর্ঘ রাত্রি জেগে থাকে তারা
করুণ সকাল এলে একে একে প্রশ্রয় ভিখিরি
মিছিল যাচ্ছে আর যুদ্ধ সাজাচ্ছে সভ্যতা
কথাটা কোথায় যাবে—হে আলোক যুগের প্রহরী?
নীলখাম ছিঁড়ে ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি
এখন বিবাহসভা ভাষাহীন ভাষাদের দৈব আরতি
৫
মধ্যপদী
উত্থান-পতনের মাঝখানে আছি
গ্লানি আসছে
সুনাম কবেই ফিরে গেছে
এপারের ডিঙি, ওপারের ডিঙি
ভোর হচ্ছে, ভোর হচ্ছে বলে
পাল তুলেও দিয়েছে
অথচ অন্ধকার তার পোশাক খোলেনি
সারারাত জন্মচর কাঁদে
কখন ভেসে গেছে জলে মৈথুনের চাঁদ
বিরামবিহীন লিঙ্গ আমারও গোপন করেছি
৬
নিহত সংরাগ
আমাদের গান ছিল
গাইতে পারিনি
লজ্জাঘরে নির্লজ্জ হয়ে একাই পুড়েছি
কলসিতে চলে গেছে জল
ভেজাযৌবনের উন্মুখ শিরাগুলি
লাফিয়ে উঠেছে
অথচ স্তব্ধতায়
কষ্ট খুঁটে খুঁটে খেয়েছে এক পাখি
৭
সরলতা
সরলতা কোনো খাদ্যবস্তু নাকি
যা খেয়ে বাঁচা যায়
অথবা সংসার করা যায়?
বাড়িটা হয়ে উঠল ঝগড়ার বাড়ি
এ বাড়িতে সব অসহিষ্ণু ছেলেমেয়ে জন্মাল
তারা কেউ স্কুল গেল না
আমি দন্তবিহীন কাঠুরের মতো
শুধু নির্জন কেটে কেটে ফিরি
সরলতা ততদিনে ভোঁতা অস্ত্র হয়ে গেল!
৮
রস
যেটুকু রস আছে তাই তুলে আনি
আমার এই বিমূঢ় রসাতলে
ধর্ম নেই, কতকগুলি ধর্মের ধাড়ি
চরে আবেগের মাঠে
জল-শুকনো নদী শুধু স্মৃতির ঢেউ তোলে
পরকীয় বাতাস এসে উড়িয়ে দেয় শাড়ি
আমি তবে জ্যোৎস্নার ফ্রকের নিচে
কার উরু খুঁজি?
এমন স্নিগ্ধ ঘাস বয়ঃসন্ধির পাঠশালা বোঝে
ক্রমে ক্রমে জমা হয় রস
আমার একাগ্রহরিণী জনারণ্যে বাঁচে…
৯
সহবাস
অসফলতাগুলি সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে
আমার দোতলায় শ্রমের ঘরে
সহবাস বিছিয়ে রাখি সমূহ লেখায়
অবিশ্বাস এতদিনে বুঝে গেছে
আমি নই তার ক্রীতদাস
মাঝে মাঝে ভালো বন্ধু আসে
ভালো বন্ধুর নাম অন্ধকার
শতাব্দী শতাব্দী ধরে তার সঙ্গে আছি
যদিও আপেল বৃক্ষ নেই
গন্ধম খেতের হাওয়া ডাকে
মূর্খ মোক্ষ কলরব করে
অথচ আজন্ম লিঙ্গ আমার পালক
দুর্দান্ত সহবাসে মৃত্যুর আগল ভেঙে দেয়
জন্মান্তর এসে খেলা করে ছাদে
বিষণ্ন জন্তুর মতো তাদেরও কোনো প্রাগভাষ আছে।
১০
দারিদ্র্য
মায়ের গোল গোল বানানো রুটিগুলি
পাক খেতে খেতে পড়ছে
আমাদের উঠোনে
আমরা ঝটপট কুড়িয়ে নিচ্ছি
প্রত্যেকের দু'টি দু'টি বরাদ্দ
আমাদের সোনালি দুঃখের দিনে
কোনো হা-হুতাশ নেই
আমরা পদবীও পাল্টাইনি কেউ
এই একটা যুগ, রুটি খাচ্ছি
আর যুগের রাস্তার মোড়ে দাঁড়াচ্ছি
কেউ কি আসবে আমাদের?
সমস্ত রোগা দিন বিষণ্নতা মেখে থমকে আছে
সমস্ত ইচ্ছেগুলি বারাঙ্গনাদের মতো
ঘর-বাহির করে
ছেঁড়া মেঘে ইজ্জত ঢাকে না
বৃহৎ দুই উরু ফাঁক করে
আমাদের নিসর্গ চেয়ে থাকে
১১
নিঃস্ব কলোনির সন্তান
সবাই গোলাপ নিয়ে যাচ্ছে
আমার হৃদয়ে কোনোদিন গোলাপ ফোটেনি
একটা ঝাপসা সন্ধে,কয়েক মুঠো জ্যোৎস্না শুধু
আর কয়েকটি পাখির ডাক পড়ে আছে
আমাদের কোনো বাগান ছিল না
শুধু মায়ের একাকী কান্নার গাছতলা ছিল
বেলা গেলে হুহু উঠোনে নামত এক বিশাল শূন্যতা
আমি শূন্যতাকে আরশি বানাতাম
গোলাপের গন্ধ কেমন জানি না
চারিদিকে রঙিন নখের ভিড়
কাদের হৃদয় চিরে চলে যেত দূরে?
আমি আশ্চর্য হয়ে দাঁড়াতাম রাস্তায়
নিজেকে দেখাতাম নিজের বুক চিরে
অজস্র কলমিফুল ঘিরে থাকত আমাদের
তাদের কাছেই বিক্রি করেছিলাম আমার স্বপ্নকে
************************************************************************************************
বাংলা কবিতায় একটি পরিচিত নাম।ছোট বড় বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত লিখে থাকেন।তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ----কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭)




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন