বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল



[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * দুই

বিশ্বনাথ পাল

কিছুক্ষণ কেঁদে বেশ হালকা মনে হল যেন বুকের মধ্যে থেকে কোনও দুঃসহ পাথর নেমে গেল। আমি অয়নকে সংক্ষেপে আমার কান্নার কারণ বললাম। অয়ন আমাকে সাইকেল চালানোর পরামর্শ দিল। বলল, “সাইকেল চালালে এই চিন্তার হাত থেকে কিছুটা মুক্তি পাবি।” 

মৌমিতার প্রত্যাখ্যান ও সামনে পরীক্ষা অথচ কিছুই পড়া হয়নি— এই দ্বৈত চাপ আমি  সামলাতে পারলাম না। আমার মনের ভারসাম্য টলে গেল। মাঝে দুই-একদিন কাটাকলেও যেতে হয়েছিল স্পেশাল ক্লাস করতে। ফলে কল্পনায় ভীতিউদ্রেকারী সহপাঠীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।তা যেন অনুঘটক হিসাবে কাজ করল। মনে হতে লাগল আমি সকলের আলোচনার বিষয়। আমাকে সকলে দেখছে। মানুষকে ভয় পেতে শুরু করলাম।খাওয়া গেল কমে, ঘুম উবে গেল। আমার অস্বাভাবিকতা মায়ের চোখ এড়াল না। একদিন মা আমাকে নিয়ে গেল এক ডাক্তারবাবুর কাছে। সাইকিয়াট্রিস্ট। একটা হাতুড়ির মতো সামগ্রী দিয়ে হাতে পায়ে ঠুকে তিনি আমার পরীক্ষা করলেন। টেবিলে রাখা কাগজ দেখিয়ে বললেন, “কী মনে হয়— এই খবরের কাগজের লেখাগুলো সব সাজানো?” 

আশ্চর্য! আমার তখন সব কিছুকেই বানানো, সাজানো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি সবটা দেখছি না, সবটা শুনছি না। আমাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যই এত আয়োজন। আমার আড়ালে যেন অনেক যুক্তি পরামর্শ করে আমার সামনে নিখুঁত অভিনয় করছে সবাই। কী জন্য  যে এমন মনে হত বলতে পারব না।

ডাক্তারবাবু আমাকে ওষুধ লিখে দিলেন। বেশি না একটা করে ট্যাবলেট রোজ রাতে খাওয়ার পরে। সম্ভবত ওষুধটার নাম ছিল সিজোনিল প্লাস। কী জানি আমার অসুখটার নাম সিজোফ্রেনিয়া ছিল কিনা। এক মাস পরে আবার যেতে বললেন।

ওষুধ খেয়ে আমার ভাল ঘুম হতে লাগল। অনেক সুস্থ বোধ করলাম। একটু যেন আত্মবিশ্বাসীও মনে হল। কিন্তু দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া গেল না। কারণ আমাকে তাড়া করে বেরাচ্ছে পরীক্ষার ভূত। পরীক্ষার বৈতরণি কীভাবে পার হব সেই চিন্তা পেয়ে বসল। পরীক্ষার পড়াশোনা  না করে মৌমিতাকে প্রোপোজ করার জন্য আমার আপশোশ হতে লাগল। কিন্তু হাত থেকে একবার তির নিক্ষিপ্ত হলে আর তা ফেরত আনা যায় না। সেই অনুশোচনায় নাকি দুধের সাধ  ঘোলে মেটানোর আশায় আমি মৌমিতার বন্ধুত্বলাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। সাইকেল চালিয়ে মৌমিতাদের বাড়ি গিয়ে ওর সঙ্গে গল্প করতাম। ইউনিভার্সিটি খোলা থাকতেই একদিন গিয়েছিলাম। আবার এটাও বলা যায় ক্ষতস্থান সারাতে ছুরির কাছেই যেন নিরাময় চাইলাম। ছুরির সঙ্গে মৌমিতার মিলও আছে। মৌমিতার সৌন্দর্যও ধারালো।


তিন


পড়তে বসে পড়লাম অথৈ জলে। পাঁচশো নম্বরের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা— পঞ্চাশ নম্বর করে  দশটা পেপার। কোনও কোনও পেপারে আবার পঁচিশ করে দুটো ভাগ— এ ও বি। আলাদা আলাদা শিক্ষকদের দ্বারা নেওয়া ক্লাস। স্নাতকোত্তরে সাধারণত প্রাইভেট টিউশন কাউকে নিতে দেখা যায় না। উপযুক্ত শিক্ষকও সহজলভ্য নয়। তবে আলাদা বইপত্র খুঁজে না পড়লেও চলে। ক্লাসনোটটাই ভাল করে বুঝে তার মধ্যে থেকে উত্তরের অংশ প্রশ্নানুযায়ী বেছে নিতে হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ কঠিন মনে হল। একে তো অর্থনীতির মতো গুরুগম্ভীর বিষয়। তাও আবার পাঠ্যবই নেই। নিয়মিত ক্লাস করলেও হুবহু নোট তো আর নেওয়া হয়নি। কম সময়ে অনেক কিছু লেখার তাগিদে সংক্ষিপ্তাকারে, কখনও কখনও মূল পয়েন্টগুলো লেখা হয়েছে। এবং সেইসব নোটের খাতা বাড়িতে আর উলটে দেখা হয়নি। ফলে সেই নোট খুলে পড়তে বসে বুঝলাম কেমন হিব্রু, পালি, ল্যাটিনের মতো লাগছে। ক্লাস চলাকালীন যদি বাড়িতে খাতাপত্রগুলো উলটে পালটে পড়াশোনার চর্চা থাকত, তাহলে বিষয়টা অন্যরকম হত। কিন্তু তখন আমার মনোজগতে প্রেম করার উদগ্র বাসনা। কাটাকল থেকে বাড়ি ফিরে ছুটতাম টিউশনি পড়াতে। তারপরে রাতে যেটুকু সময় পেতাম শরীর ও মনের ক্লান্তি কাটিয়ে পড়াশোনায় নিয়োজিত হতে গেলে যে শৃঙ্খলার প্রয়োজন, আমার তা ছিল না।

মন অনুশোচনায় ভরে গেল। কী করব? ইউনিভার্সিটিতে ড্রপ দেওয়ার একটা ব্যাপার প্রচলিত ছিল। প্রস্তুতি যাদের আশানুরূপ  হত না, ভাল রেজাল্ট করার স্বার্থে তারা সেবার পরীক্ষায় বসত না এবং পরের বার পরীক্ষার জন্য তৈরি হত। কিন্তু ভাল রেজাল্ট তো দূরের কথা, আমার মনে হল পরীক্ষায় বসলে আমি ফেল করব। অতএব ড্রপ দেওয়াই উপযুক্ত কাজ হবে। পরীক্ষায় বসে ফেল করলে মুখ দেখাব কেমন করে এই চিন্তায় আমার মুখের হাসি কর্পূরের মতো উড়ে গেল।

ঘুরে ঘুরে মানুষজনের কাছে গিয়ে আমার ড্রপ দেওয়ার স্বপক্ষে সমর্থন আদায় করতে লাগলাম। যদিও তা দুষ্প্রাপ্য ছিল। একদিন মৌমিতার বাড়িতে গেলাম। ইতিমধ্যে আমি মৌমিতার বাড়ি গিয়েছি কয়েকবার। আমাদের বাড়ি থেকে সাইকেলে দশ মিনিটের দূরত্ব। প্রস্তাব দেওয়ার পরিণামে বন্ধুত্ব বা সৌজন্যে ভাটা পড়েনি। ড্রপ দেওয়ার সংশয়িত সিদ্ধান্তের কথা জানাতেই  বলল, “পরীক্ষাটা দে। এম.এস.সি.-তে কেউ ফেল করে না।”

‘এম.এস.সি.-তে কেউ ফেল করে না’— সত্য নয়। গতবছর দু’জন করেছিল। দুশো  জনের মধ্যে দুজন। যেকোনও সাধারণ বুদ্ধির মানুষের কাছে সংখ্যাটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু আমার মনে হল পরীক্ষায় বসলে আমি নির্ঘাত ওই দু’জনের একজন হব।  

শমীক নামে ক্লাসের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ গড়িয়ে বন্ধুত্বে পৌঁছেছিল। ওদের নাকতলার ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে যেতাম। শমীক আমাকে কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছিল। একদিন ওর কাছে রাখলাম আমার সিদ্ধান্তের কথা। শুনেই বলল, “পরীক্ষায় বস, পাশ করে যাবি। এম.এস.সি.-তে কেউ ফেল করে না।’’

দর্পন-এ আমার কবিতা মনোনীত করেছিলেন যে সম্পাদক ও কবি তাঁর নাম অনল আচার্য। একদিন মেট্রোতে তাঁর সঙ্গে দেখা। কাছে গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে বললাম, “দর্পন-এ আপনি আমার একটি কবিতা ছেপেছিলেন।” 

‘কী করি’-র উত্তরে বললাম, “এম. এস-সি. পড়ছি, কিন্তু প্রিপারেশন ভাল হয়নি বলে এবার ড্রপ দেব ভাবছি।” এতটা হয়তো না বললেও চলত, কিন্তু কৃতজ্ঞতায় আমার সারল্য তখন বাঁধনহারা। 

বললেন, “না-না, পরীক্ষাটা দিয়ে দাও।পাশ করে যাবে।”

আমার ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ সিনেমার কথা মনে পড়ল। শীতের এক অমাবস্যার রাতে বাইকে করে জঙ্গলের মাঝে নির্জন রাস্তায় যাওয়ার সময় একজোড়া লোমশ নখওলা হাতের কবলে পড়েন উত্তমকুমার। সেই ভূতুড়ে হাতের থেকে নিস্তার পেতে তিনি চায়ের দোকান, থানা যেখানেই গিয়ে  ঘটনার বর্ণনা দেন, তারা ঠিক সেই লোমশ নখওলা হাত বের বলে, ‘দেখুন তো এরকম হাত?’ আমারও যেন সেই অবস্থা। পরীক্ষার ভূত থেকে বাঁচতে যার কাছেই যাই, তিনি বলেন,  ‘পরীক্ষাটা দাও, পাশ করে যাবে।’  

সেবার বইমেলায় ‘আকাশ’ গ্রুপের পক্ষ থেকে বিগত কয়েক বছরের মতো আমাদের  লিটল ম্যাগাজিনের পসরা টেবিলে সাজিয়ে বসেছিলাম। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমাদের। আমাদেরই গ্রুপের কোনও সদস্যের সূত্রে পরিচয়। নাম  স্বর্ণালী চৌধুরি। নামের মতোই ঝলমলে স্বভাবের স্বর্ণালী আমার থেকে বছর চার-পাঁচের ছোট,  অথচ কী অবলীলায় নাম ধরে ডাকত। আমার থেকে আবার সিগারেটের কাউন্টার চেয়ে খেত। আমাদের মনে তখন গোবি-সাহারার অবস্থান, ফলে কোনও সুন্দরীর মুখে দাদা শোনার চেয়ে স্বনাম শোনা ভাগ্যই মনে হত। তো সেই স্বর্ণালী একদিন পাশের বাড়ির এসটিডি বুথে ফোন করে বলেছিল সোমনাথকে ডেকে দিতে। দিয়েছিল তারা। দেড় মিনিটের কথায় একটা অ্যাপন্টমেন্ট স্থির হয়েছিল। পরদিন সকালে রবীন্দ্রসদনে স্বর্ণালীর সঙ্গে দেখা করি। একসঙ্গে প্রায় সারা দিন  কাটে। প্রথমে হেঁটে পার্কস্ট্রিট। সেখানে একটি আর্ট গ্যালারীতে হরেন দাসের ছবির প্রদর্শনী দেখলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে রক্সিতে দেখি ‘কৌন হ্যায়’। সম্ভবত মনোজ বাজপেয়ীর প্রথম ছবি। হিন্দি থ্রিলার। বেশ ভাল লেগেছিল। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে দু-একবার  আমার হাত চেপে ধরেছিল স্বর্ণালী সিনেমা দেখতে দেখতে ভয় পেয়ে। স্বর্ণালী হল আমার সেই বান্ধবী যাকে সেদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় কবিতা শুনিয়েছি এবং ওর কথাই একদিন সুজাতাকে বলেছিলাম। আরও কত কথা যে বলেছিলাম সেদিন। স্বর্ণালীও অনেক কথা বলেছিল।  না, কোনও পূর্বরাগের ছোঁয়া ছিল না এই সাক্ষাতে। আসলে স্বর্ণালী যাবে ওর প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে, আমাকে ওর সঙ্গী ঠাওরেছিল।  সকাল যখন সন্ধ্যার কোলে আশ্রয় নিয়েছে, আমরা ফিরে এসেছি রবীন্দ্রসদন চত্বরে। সেখানে কোনও এক অফিসে ওর প্রেমিক চাকরি করে। দূর থেকে আগত চাপদাড়ির এক বছর চল্লিশের ভদ্রলোককে ও চিনিয়ে দেয় ওর প্রেমিক হিসাবে। তাকে আসতে দেখেই আমি বাড়ির দিকে পা বাড়াই। একটা গাছের বেদীতে বসে থাকা স্বর্ণালী আমায় বলে, “আর একটু বসে যা।” 

  সেদিন স্বর্ণালীকে বিশ্বাস করে আমার একটি স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। উপন্যাস লেখার স্বপ্ন। বিভূতিভূষণ হবেন আমার প্রেরণা। ওমা! দু-চার দিন পরে দেখি অয়নের কাছে আমার স্বপ্নের কথা ফাঁস  হয়ে গেছে। আমার ভীষণ অভিমান হয়েছিল। কারণ কথাটা তো আমি অয়নকে বলিনি। স্বর্ণালীকে বলেছি। এটা যে অন্য কারও শোনা উচিত নয় ওর বোঝা উচি্ত ছিল। স্বপ্ন রাষ্ট্র হয়ে গেলে দেখার চোখে কুয়াশা নামে বলে মনে হত আমার।   

যাইহোক, প্রেমিকা না হয়েও একটি মেয়ে যে আমার সঙ্গে সারা দিন কাটাল, এতে তার ওদার্যে মুগ্ধতার জন্ম হয়েছিল। অবশ্য আমার প্রেমিকা যদি অন্য কারও সঙ্গে এভাবে সারা দিন কাটাত, ঘুরত—কতটা সহজ ভাবে নিতাম জানি না।  

পরে একটি কথা জেনে ব্যথিত হয়েছি। স্বর্ণালীর সেই প্রেমিকের ঘর-সংসার আছে। তিনি একজন বিবাহিত পুরুষ।

পরীক্ষায় ফেল করার ভয়ের সামনে আমার আত্মবিশ্বাস যখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, পরীক্ষার হল যখন আমার কাছে ফায়ারিং স্কোয়াড, তখন আমার এই স্বর্ণালীর কথাই মনে পড়ল। মনে হল মাকালীর কাছে পুজো দিয়ে প্রার্থনা জানালেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাব। স্বর্ণালীদের  বাড়ি ডানলপে। ওখান থেকে দক্ষিণেশ্বর কাছে। ওকে ফোন করে একদিন ওদের বাড়ি চলে যাই, তারপর ওর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে মাকালীর কাছে পুজো দিই।তার আগে কখনও যাওয়া হয়নি। কিন্তু মাকালীও আমার আত্মবিশ্বাস ফেরাতে ব্যর্থ হল।  

পরীক্ষা দেব না দেব না— এই দোলাচল অনেকদিন চলল। পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা যে করিনি তা নয়। অনেকবারই খাতাপত্র খুলে অর্থনীতির গুরুগম্ভীর তত্ত্ব উদ্ধার করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছি। বাড়িতেও এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলল।    

আমাদের বাড়ির অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। বাবা ঊষা কোম্পানিতে কাজ করতেন। শ্রমিকের কাজ। বদলি বা ক্যাসুয়াল শ্রমিক। নো ওয়ার্ক নো পে। তাই সংসার চালানোর জন্য পারিবারিক পেশা হিসাবে ঠাকুর বানানো যেমন ছিল, বাবা টুকটাক জমিজমার দালালিও করত। কিন্তু বাবার মতো সৎ ও বোকা মানুষ পাওয়া ভার। মায়ের ভাষায় বাবা নাকি জমির  মালিককে বলত, “আপনি একদম দাম কমাবেন না।” আবার জমির ক্রেতাকে বলত, “ওই জমির দাম অত টাকা হয় নাকি?” ফলে কালেভাদ্রেই লেনদেন সম্পূর্ণ হওয়ার শিকে ছিঁড়ত  বাবার কপালে। তার ওপর ডিল ফাইনাল হলে রেজিস্ট্রিবিহীন লাইসেন্স না থাকা দালালকে ফাঁকি দেওয়াও খুব সোজা ছিল এবং সেই সহজ পথ বেছে নিতে প্রায় কেউ-ই দ্বিধা করত না। 

বাড়িতেও বিস্তর ঝামেলা। ট্রেনের দুটো কামরাকে পাশাপাশি জুড়ে দিলে যেমন হয়, আমাদের বাড়িটা ছিল অনেকটা সেরকম। তবে উচ্চতাটা আরেকটু বাড়িয়ে ধরতে হবে। কারণ দোতলা বাড়ি। দৈর্ঘ্যেও বেশি। একপাশের কামরায় আমাদের বাস, অন্যটায় জ্যাঠাদের। রান্নাঘর, বাথরুম ছাড়াও প্রায় প্রতিসম ভাবে দুদিকে দুটো করে ঘর। দ্বিতীয় ঘরটা ভিতরের দিকে প্রস্থে ছোট হয়ে মাঝে সিঁড়ির ঘরের জন্য জায়গা দিয়েছে। জ্যাঠাদের দোতলাটা কমপ্লিট। আমাদেরটা শুধুমাত্র ছাদ ঢালাই হয়ে জানলা দরজাবিহীন, প্লাস্টারবিহীন হয়ে পড়ে থেকে আমাদের আর্থিক দূরবস্থার কথা নীরবে দৃষ্টিকটুভাবে ঘোষণা করছে। নীচের তলার প্রথম যে বড় ঘর, তাতে দুটি  রেলকামরার মাঝের পার্টিশন নেই ধরতে হবে। রাস্তা বা উঠোনের দিকে যাওয়ার রাস্তা আমাদের  দিকে। ফলে দরজা খোলা থাকলে রাস্তা থেকে আমাদের খাটের একাংশ দেখা যেত। এই ঘরটা দুপক্ষের কমন। ঘরের সিলিঙের মাঝে একটা লম্বালম্বি দশ ইঞ্চির বিম যেন সীমান্ত রেখা বা আমাদের  লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি। কমন ঘরের  যৌথ মালিকানা থাকলেও জ্যাঠাদের দাবি ঘরটা তারাই তৈরি করেছেন, তাই তাদের অধিকার। বড় ঘর এবং উঠোনের অনেকটাই ছিল জ্যাঠাদের দ্বারা অধিকৃত। উঠতে বসতে মা-বাবাকে, এমনকী আমাদেরও খোঁটা শুনতে হত। এদিকে ঠাকুরদার কেনা জমিতে একান্নবর্তী পরিবারের বানানো বাড়ি, পরে ভিন্ন হাঁড়ি হওয়া দুই পরিবার বা বাবা-জ্যাঠার মধ্যে লম্বালম্বি সমান ভাগ হবে এমন বন্দোবস্ত অলিখিতভাবে ছিল। কিন্তু গায়ের জোরে ও সম্পন্ন হওয়ার ক্ষমতায় জ্যাঠারা আমাদের নিচু নজরে দেখত শুধু নয়, দাবিয়ে রাখত নানা ভাবে। বুঝিয়ে দিত ওরা আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ্য। ওদের সঙ্গে আমরা সহজে বিবাদে  জড়াতাম না। কিন্তু কালেভাদ্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ফেললে ঝগড়া বেঁধে যেত। ছোটবেলা থেকেই ঝগড়া কাজিয়া শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু আমার মনে ভেসে বেড়াত এক উদাসী নাও। চারপাশের দৈন্য, মালিন্য, হাহাকার যেন আমার অন্তরে প্রবেশ করতে পারত না। ভেসে বেড়ানো আমার বেশ পছন্দের ছিল। কিন্তু বেশি দিন ভেসে বেড়ানো গেল না, শ্রেণিচেতনা আমার মধ্যেও প্রবেশ করল। 

জ্যাঠাদের সম্পন্নতার কারণ জ্যাঠার রাইটার্সে চাকরি। তৃতীয় শ্রেণির কর্মী হলেও সরকারি চাকরি। আর বাবা একটি কারখানার বদলি শ্রমিক। তারওপর আবার বাবার বেশি ঠাকুর  বানানোর পারদর্শিতা ছিল না। আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারটি যোজনা কমিশনের নির্ধারিত দরিদ্রের সঙ্গায় না পড়লেও আমাদের গরিবই বলা চলে। গরিব মানে তো শুধুমাত্র খেয়েপরে বেঁচে থাকার দুশ্চিন্তা বা কিছু সম্পদের অনধিকার নয়, পিছিয়ে থাকার দুঃখও। অথচ আমাদেরও ঈর্ষা করার লোকের অভাব ছিল না। ইর্ষার ধারালো দাঁতের ফাঁকে যেন আমাদের অবস্থান। দোষের মধ্যে আমরা একটু পড়াশোনায় ভাল ছিলাম। এক ক্লাসে বছর বছর থাকার বিলাসিতা ছিল না।  

মা বলল, “দরকার নেই আর পড়াশোনা করে। তুই ডবলুবিসিএসের জন্যই কোথাও ভর্তি হ।”  

মায়ের সিদ্ধান্তও মানতে পারলাম না। পরীক্ষায় বসলে ফেল করব এই ভয়ে না-হয় পরীক্ষা দিলাম না, কিন্তু পরের বার পাশ করার জন্য ঝাঁপাব না? যদি এম. এস-সি.-তে ভর্তি না হতাম, আলাদা কথা ছিল। কিন্তু ভর্তি হয়ে এক বছর ক্লাস করে ফেল করার ভয়ে লেখাপড়াই ছেড়ে দিলে নিজের কাছে নিজে কী জবাব দেব? ডবলুবিসিএসের জন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে প্রস্তুতি  নেওয়া বেশ চাপের ব্যাপার। কারণ বাবা সদ্য চাকরিতে স্বেচ্ছাবসর দিয়েছে মায়ের ঐকান্তিক প্ররোচনা বা পরামর্শে। কাজ হারানোর ক্ষতিপূরণ বাবদ বাবার হাতে নগদ আশি হাজার টাকা এসেছে। সেই টাকার থেকে আট-দশ হাজার নিয়ে মা কোথাও ভর্তি হতে বলছে। বাবাকে বলেলেও বাবা আপত্তি করবে না। মায়ের কথা শুনে একদিন সরদার কলেজ অব ফারদার এডুকেশন নামের একটি সংস্থায় ঘুরে এলাম। তারা চাকরির পরীক্ষার জন্য  প্রশিক্ষণ দেয়। শুধু ডবলুবিসিএসের জন্য এক রকম রেট আবার কম্বাইন্ড কোর্সের রেট আরেক রকম। কিন্তু আট হাজারের নীচে কোনওটাই নয়। এখন এই সংখ্যাটা অনেক কম মনে হলেও আজ থেকে প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে এর যথেষ্ট দাম ছিল। অত টাকা কোথাও বিনিয়োগ করে ভর্তি হয়ে বিনিময়ে যদি রিটার্ন কিছু দিতে না পারি? মানে যদি চাকরি পেতে ব্যর্থ হই? অতএব ও-পথ মাড়ালাম না। আরেকটা কথা বলে নিই, বাবার চাকরি ছাড়ার গুরুতর কারণ বাড়ির ঝামেলা। চাকরি ছাড়লে নগদ মোটা টাকা পাওয়া যাবে এমন প্রচার ছিল কোম্পানির তরফে। সেই টাকায় বসত সম্পত্তি জ্যাঠাদের থেকে আলাদা করে নিলে শান্তি ফিরবে— এটাই ছিল মায়ের অভিমত। বাবার ইচ্ছে ছিল না। মায়ের লাগাতার আগ্রহে বাবা একদিন চাকরি ছেড়েই দিল। গোল্ডেন হ্যান্ডসেক। সোনালি করমর্দন। কিন্তুর বাড়ির ঝামেলা সম্পূর্ণ মিটল না।  

সরদার কলেজ অব ফারদার এডুকেশন থেকে ঘুরে এসেও আমার দ্বিধা গেল না। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোনও কোচিং-এ ভর্তি হয়ে পরীক্ষা দিলে প্রচণ্ড চাপে পড়ে যাব। এত চাপের  মধ্যে আমি কি মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারব? দ্বিতীয়ত ফেল করার ভয়ে যে ছেলে পরীক্ষায় বসা থেকে বিরত হয়, তার মনোবল তো এমনিতেই তলানিতে। সে কী করে বিসিএসে সফল হবে? 


মৌমিতাদের বাড়ির পরিবেশে ঔদার্য ছিল। মেয়ের কোনও ছেলেবন্ধু এসে মেয়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করলে বাবা-মায়ের মনে কোনও সন্দেহ উঁকি মারত না। অথবা মেয়ের প্রতি তাদের বিশ্বাস অটুট ছিল। মৌমিতার মা-ও মনে হয় আমাকে বেশ পছন্দ করতেন। চা করে তো দিতেনই, সঙ্গে এটা-ওটা খেতে দিতেন। মাঝে-মাঝে আমাদের সঙ্গেও টুকটাক গল্পে যোগ দিতেন। কত-কী যে বলতাম তার ঠিক ছিল না। মৌমিতা পরিষ্কার জানিয়েছিল যে বন্ধুত্বের সম্পর্কে ওর কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কোনও প্রত্যাশা রেখে ওর সঙ্গে মেশা যাবে না। কিন্তু আজ মনে হয় সাইকেল  চালিয়ে দু-চার দিন অন্তর ওদের বাড়ি গিয়ে গল্প জুড়ে বসার মধ্যে কোথাও ওকে ইম্প্রেস করার মরিয়া চেষ্টা ছিলই।

ইচ্ছে হত একান্তে কোনও নদীর পাড়ে বসে মৌমিতাকে কবিতা শোনানোর। জীবনানন্দের কবিতা—

‘তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো! 

এখনও নারীর মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।’

একদিনের কথা মনে পড়ে। বিকেলে ছাদে মাদুরে বসে আমরা গল্প করছি। আমার অনর্গল কথার স্রোত ফুরোচ্ছেই না। সন্ধ্যার কোলে মাথা রেখে বিকেল ঢলে পড়বে এরকম সময় মৌমিতা বাধ্য হয়েই বলে, “এবার বাড়ি যা, আমি পড়তে বসব।”

ওর তো আর আমার মতো পড়াশোনা মাথায় ঢোকার সমস্যা নেই। 

শুধু গল্প করতেই নয়, আরও একটা উদ্দেশ্য থাকত ঘন ঘন মৌমিতাদের বাড়ি যাওয়ার।


চার 



আমার ক্লাসনোট নেওয়া নাকি বেশ ভাল ছিল। মানে ক্লাসের বন্ধুরা কয়েকজন বলেছিল।  কীভাবে যেন সেই কথা মৌমিতার কানে যায়। ফলে মৌমিতা আমার ইন্ডিয়ান ইকনমির নোটের খাতাটা নিয়েছিল। বলে যে এটার থেকে ও নিজের মতো করে একটা নোট বানাবে পরীক্ষার জন্য। এই নোটের খাতাটা ফেরত আনা ওদের বাড়িতে ঘন ঘন যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু চাইতে কেমন বাধো বাধো ঠেকত। বাধা কাটিয়ে এক-দু’বার চেয়ে ফেললে শুনতাম, “এখনও লেখা হয়নি রে, কাজ চলছে।” আর এদিকে পড়তে বসলেই খালি মনে হত ওই খাতাটা তো আমার কাছে নেই। ওই খাতাটার অনুপস্থিতি অসম্ভব কষ্ট হয়ে বুকে বাজত। যেন ওই খাতার অভাবে আমার পড়ার প্রস্তুতি শুরু করাই দুষ্কর। মনে হত পরীক্ষা নামক যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র আমার অন্যের বাড়িতে রয়ে গেছে। ওইটি ছাড়া আমার অস্ত্রপ্রশিক্ষণ পূর্ণতা পাবে না। মৌমিতা ওর বানানো নোটটা আমাকে শেয়ার করবে এমনই কথা ছিল। পরীক্ষা শুরুর দিন পনেরো আগে আমার খাতাটা ফেরত পেলাম, সঙ্গে মৌমিতার নোটটাও দিন দুইয়ের জন্য ধার। কিন্তু হাতের লেখা বিশেষ সুবিধের মনে না হওয়ায় এবং অন্যের বানানো নোটে সাচ্ছন্দের অভাবে জেরক্স না করেই ফেরত দিই। 

পরীক্ষার ঠিক দশ দিন আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। পরীক্ষা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত। কাজ নেই পরীক্ষা দিয়ে। জীবনে কখনও ফেল করিনি। পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে। তার চেয়ে সামনের বছর আবার পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভাবা যাবে। আপাতত ফেল করার গ্নানি  থেকে তো মুক্ত হব। অতএব দিলাম পরীক্ষায় ড্রপ।

পরীক্ষার দিনগুলো খুব বাজে কাটল। মনের মধ্যে ভীষণ আবসাদ টের পেলাম। পরীক্ষা দেব বলে দুটো মোটা টাকার টিউশনি আমার এক বন্ধুর কাছে গচ্ছিত রেখেছি মাস খানেকের জন্য। স্টাডি লিভের অবসর পরীক্ষার বৈতরণি পার করতে ঠিকঠাক ব্যবহার করব ভেবে।   বন্ধুটি আমার হয়ে গিয়ে পড়াবে। সোজা কথায় প্রক্সি দেবে। সেই মাসের মাইনেতেও তারই  অধিকার। পরীক্ষার পরে আবার আমি গিয়ে বহাল হব। আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতি টিউশনি হাতছাড়া ও ছাত্রের ক্ষতির কারণ যাতে না হয় তাই এই ব্যবস্থা। সেই টিউশনিতে আবার বহাল হলাম বলে সারাক্ষণ নিজের ব্যর্থতা নিয়ে ভাবা থেকে অস্থায়ী মুক্তি পেলাম।  

এদিকে মৌমিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হল না। হল না আমারই ঐকান্তিক আগ্রহে। কিন্তু আপশোশ রয়ে গেল। হাত থেকে বেরনো তির যদি ফেরত আনা যেত, যদি তির নিক্ষেপের স্মৃতি আমাদের দু’জনেরই মাথা থেকে বিলুপ্ত করা যেত, তাহলে হয়তো মৌমিতার নিঃসঙ্কোচ বন্ধুত্ব পেতাম।

কিন্তু পরীক্ষা দিলে ফেল করার যেমন চাপ, না দিলে লোকলজ্জার চাপও কম নয়।  সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হলে আমাকে মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হবে, কিংবা তারা যদি জানতে চায় পরীক্ষা দিলাম না কেন, কী বলব তখন? হয়তো বলতে হবে না, পাশ থেকে কেউ টোন করবে, “ও তো প্রেমে ল্যাং খেয়ে ড্রপ দিয়েছে।” অথবা মুখে কিছু না বললেও তাদের নিশ্চুপ দৃষ্টিবাণে আমি বিদ্ধ হব। রক্তাত হব। এইসব ভেবে আতঙ্কে দিন কাটতে  লাগল। 


********************************************************************************************

আগামী সংখ্যায়

********************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন