বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩

প্রবন্ধ * ড. শুভঙ্কর দে



রাজা রামমোহন রায় : উনবিংশ শতকের বাংলায় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদি চিন্তার স্বরূপ সন্ধানে


ড. শুভঙ্কর দে

উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায়, তৎকালীন বাংলার সমাজ তথা ভারতবর্ষের সামাজ-প্রেক্ষাপটে, এমন একজন মানুষের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যিনি প্রশ্ন করবেন, যিনি যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে অন্তঃসারশূন্য  সামাজিক আচারগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে, সর্বসমক্ষে তুলে ধরবেন। ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ কিংবা রবীন্দ্রনাথ যাঁকে বলবেন ‘নতুন ভারতের চিত্তদূত’ -– সেই রাজা রামমোহন রায়, খুব সততা ও সাফল্যের সঙ্গে  তার বিবিধ কর্মকান্ডের মধ্যে এক নতুন যুগ এক নতুন ভোর আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। 

এই প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে, আমি মূলত রামমোহনের বিপুল কর্মকান্ডের অন্তত কিছু বিষয়কে বোঝার চেষ্ঠা করব, তাঁরই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসু মন এবং তাঁর যুক্তিবাদের আলোকে। আসলে, রামমোহনের ধর্মচিন্তা, তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত  জ্ঞান কিম্বা সমাজ সংস্কারের নানা ক্ষেত্রে দুটি বিষয়, খুব গুরুত্ব পেত বলে মনে হয়েছে, প্রথমত, লজিক বা যুক্তি এবং দ্বিতীয়ত, আধুনিক বিজ্ঞান চিন্তা।

রামমোহনের বিজ্ঞান মানসিকতা ও যুক্তিবাদের দ্বন্দ্বে ভারতবর্ষ তথা বাংলা সম্পর্কে  কিছু কথা বলার আগে, আমি একটু চলে যাব ইতালির রেঁনেশাস সময়ে। কী হয়েছিল সেই সময়ে? আমরা দেখব পুরানো ধ্যান ধারনা, সংস্কার, ধর্মীয় আচার সর্বস্বতা জগদ্দল পাথরের মত জাঁকিয়ে বসেছিল ইউরোপে। ঠিক এইসময়েই আবির্ভাব হল এক নতুন ‘হিউম্যানিস্ট গোষ্ঠির’। পেত্রাক, ভলতেয়ার প্রমুখ Humanist রা ফিরে যান প্রাচীন  গ্রীক ও লাতিন রচনায়। তারা বারে বারে এর মাধ্যমে পুরানো জীর্ণ ধারা কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে ক্রমাগত আওয়াজ তুলতে লাগলেন। সেই সময়ে ধ্বনি উঠতে থাকল ‘ To awake the dead’. তবে মজার কথা হল, তারা ধর্মকে সমালোচনা করেছেন, আক্রমন করেছেন, কিন্তু চার্চকে ত্যাগ করছেন না। এইভাবে একই সাথে তারা জেন্টাল এবং একই সাথে তারা critical.

এইভাবে আমরা দেখব বৈজ্ঞানিক দৃষ্ঠিভঙ্গি নিয়ে রামমোহন তৎকালীন বাংলায় সমাজ, ধর্ম ও শিক্ষা সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত সংস্কার ও চিন্তাভাবনার মূলেই ছিল বিজ্ঞান ও যুক্তি। 

আসলে, ধর্ম ও সমাজ সংস্কার ছিল একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। ১৮১৫ সাল থেকে রামমোহন কোলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি একের পর এক তাঁর লেখায় হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, প্রতিমাপূজা-সহ বিভিন্ন আচারসর্বস্বতাকে এক হাত নিলেন। তবে একটা কথা খুব পরিস্কার করে নেওয়া দরকার, যে রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মের ক্ষতি সাধন করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, হিন্দু ধর্মের  যে অন্তঃসারসত্য, তাকে বুঝতে। ইউরোপে হিউম্যানিস্টরা যেটা করেছিলেন, লাতিন ও গ্রীক চর্চা করে। রামমোহনও সংস্কৃত চর্চার মাধ্যমে পৌছালেন বেদ, উপনিষদে, তার সারাংশ অনুবাদ করে তিনি বোঝালেন পুরহিততন্ত্র, আচারসর্বস্ব আনুষ্ঠান-এর কোন মানে নেই । ফলে তাঁর   ওপর হিন্দুধর্মের গোঁড়া ‘Orthodox’ Section বেজায় চটে গেলেন আবার তিনি গ্রীক হিব্রু দিয়ে খ্রীষ্টধর্মকে বোঝার চেষ্টা করলেন যুক্তি দিয়ে , পাদরিরা তাকে বেজায় গালমন্দ করলেন। ইসলাম শাস্ত্রে তার বুৎপত্তি ছিল, আনেকেই তাঁকে ‘ জবরদস্ত মৌলবি’ নামে অ্যাখ্যায়িত করতেন। কিন্তু সেখানেও তিনি অলৌকিক ক্ষমতা- ‘তাওয়াতুর’ ও লোকগল্প- ‘ইজমা’কে  পরিত্যাগ করেছিলেন। ধর্ম বিষয়ে তিনি যে -----কতটা যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করতেন, সেটির পরিচয় পাওয়া যায় ‘ তুহফাত- উল- মিজাহিদিন’  এ সেখানে তিনি লিখেছেন “ সমাজে চারটি মুল গোষ্ঠী রয়েছে : 

প্রথমত: প্রতারক = যারা অন্ধবিশ্বাস দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করে।

দ্বিতীয়ত: প্রতারিত = যারা উপরের এই গোষ্ঠী দ্বারা অনুসরণ করে প্রতারিত হয়।

তৃতীয়ত: প্রতারক/ প্রতারিত = এরা নিজেরা বিশ্বাস করে এবং অপরকেও বিশ্বাস করতে বাধ্য করায়।

চতুর্থত এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী হল এরা প্রতারিত হয় না, অপরকেও প্রতারিত হতে দেয় না। রামমোহন আজীবনকাল চেয়েছিলেন যুক্তির দ্বারা, বিজ্ঞানের দ্বারা এই গোষ্ঠীর সংখ্যাটা যতটা বাড়ানো যায়।

তুহফাৎ -এ তিনি লিখেছেন, যুক্তি দিয়েছেন, বাইরের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা লব্ধ জ্ঞান আমরা এটাকে positive knowledge ও বলতে পারি। এই চিন্তাই তো এক নতুন বৈজ্ঞানিক যুগের সূচনা করেছিল। আসলে ধর্মকে কেন্দ্র করে যে অনুশাসন গড়ে উঠেছিল কোথাও গিয়ে তিনি সেটা মানতে পারছিলেন না । নিজের বুদ্ধি, যুক্তি, বোধ -এর ওপর তিনি বার বার জোর দিয়েছিলেন। তুহফাৎ-এ তিনি লিখেছিলেন “ প্রত্যেক মানুষকে ঈশ্বর বুদ্ধিবৃত্তি দিয়েছেন, যাতে সে নিজের জ্ঞান দিয়ে তার ভালো মন্দ বিচার করতে পারে, এটা না করতে পারলে ঈশ্বরের মহান দানটিকেই তো অস্বীকার করা হয়”। 

দিনের শেষে তিনি ধর্মের বাখ্যা করায় তাকে interprate করার অধিকার (ইজতিহাদ) চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নতুন যুগের জিজ্ঞাসু একজন মানুষ। অভ্রন্ত শাস্ত্র নয়, যুক্তিই ছিল তার কাছে একমাত্র প্রামান্য। তিনি নিজে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন। তবে তাঁর বন্ধু দ্বারকনাথ, যিনি মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর সাথে তার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। রামমোহনের বহু উদ্যোগে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৮৩১ সালে সমাচার দর্পণে দেবেন্দ্রনাথ তো লিখেই ফেললেন “ রামমোহনের অনুরাগি হলে কিম্বা ইংরেজি শিখলেই কুলাচার  ত্যাগ করতে হবে এমন কোথায় লেখা আছে”। অবশ্যই রামমোহনের বিরুদ্ধে জোটও হয়েছিল। রামমোহনকে তাঁর  এক অনুরাগি একবার জিজ্ঞাস করেছিল, পরিপ্রেক্ষিতটা ছিল এই রকম: সতীদাহ প্রথা নিয়ে বির্তক চলাকালিন তিনি যখন পালকি করে যেতেন, প্রায়শই ঢিল পড়ত। নানা ভাবে রামমোহনকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করা হত। তো এই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বলা হয়েছিল : আপনার কি ভয় করে না? মৃত্যুর? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন : ভয়! কোলকাতার লোকদের! ওরা কি খায়। হাঃ হাঃ হাঃ।  তাঁর অপর এক anti রাধাকান্ত দেব তো ইংল্যান্ডে হাউস অফ কমন্সে চলে গিয়েছিলেন । শেষ অব্দি অবশ্য তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়েছিলেন ।

শিক্ষায় বিজ্ঞান চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে রামমোহন প্রায় একটা Revolution এনেছিলেন বলা যেতে পারে । ক্ষিতিমোহন সেন তাকে ‘ভারতে বিজ্ঞানচর্চার আদিগুরু বলেছেন’। সম্বাদ কৌমুদিতে তিনি বিজ্ঞানচর্চার ওপর একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেন। গণিত শাস্ত্রে geometry বাংলায় নামকরন জ্যামিতি তিনিই করেন। জ্যামিতিচর্চার জন্য তিনি ‘দ্রাঘিমা’ নামে একটি বই লেখেন। 

রামমোহন যুগের হাওয়াকে বুঝেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার সম্প্রসারণ ছাড়া আলোচ্য সময়ের অন্ধকার দূর হবে না। পাশ্চাত্য শিক্ষাই মানুষের মনে জ্ঞান ও যুক্তিবাদী চর্চা জাগিয়ে তুলতে পারে। এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সর্মথক । ১৮১৩ সালে শিক্ষার প্রসারে ১ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়, কিন্তু বিতর্ক হয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে। রামমোহন ১৮২৩ সালে ১১ ডিসেম্বর, লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি দিয়ে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রর্বতনের দাবী জানান। আমাদের মনে রাখতে হবে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭ বৎসর আগে এরকম দাবী ছিল বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য। যদিও তার দাবী প্রাথমিকভাবে পূরণ হয়নি । তবে মেকেলের সৃষ্ট শিক্ষানীতির blueprint কিন্তু রামমোহনেই তৈরী করে গিয়েছিলেন।

লর্ড আর্মহাস্টকে চিঠি লেখার ঠিক এক বছর আগে , অর্থাৎ ১৮২২ সালে ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ‘অ্যাংলো হিন্দু স্কুল’ নামে একটি অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করেন। উইলিয়াম অ্যাডামকে সেই সময়ে স্কুলের পরিদর্শক রূপে নিযুক্ত করা হয়। ১৮২৭ সালে আমরা দুই জন শিক্ষকের সংখ্যা জানতে পারি। এবং ছা্ত্র সংখ্যা ছিল ৬০ থেকে ৭০। পরবর্তীকালে উইলিয়াম অ্যাডামের সাথে জগমোহনের মতভেদ হওয়ায় তিনি পরিদর্শকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। উল্লেখযোগ্য দেবেন্দ্রনাথের পুত্র এবং ছোট ছেলে বামাপ্রসাদ রায় এই স্কুল থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এই স্কুলের সাথেই জড়িত ছিলেন পূর্ণচন্দ্র মিত্র। রামমোহন বিলাতে যাওয়ার আগে তাকে স্কুলের দায়িত্ব দিয়ে যান। তিনি এই স্কুলের নতুন নামকরণ করেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি’। আমরা এটাও জানতে পারি, ননীমাথব দে প্রথমে এই স্কুলের ছা্ত্র ও পরে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। উল্লেখ্য, ভূদেব মুখোপাধ্যায় এই প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে তিনি কখনও বিরোধকে খুব একটা আমল দিতেন না। তিনি যে কিভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সকলকে মুক্তচিন্তা মনে সাহায্য করতেন। সেই ব্যাপারে একটা উদাহরন দেওয়া যেতে পারে। আলেকজান্ডার ডাফ ১৮৩০ এর দশকে ইংরেজি স্কুল স্থাপনে বাংলায় বিশেষ উদ্দ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে তিনি উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছিলেন না। এক্ষেত্রে ত্রাতা হিসাবে এগিয়ে আসেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি শুধুমাত্র ডাফকে ঘরের ব্যাবস্থায় করে দেননি, সেইসাথে নিজ বন্ধুদের ছেলেদেরকে ঐ প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করতে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেলেছিলেন। কিছু ছাত্র নিয়ে এইভাবেই ‘জেনারেল এসামবেলিজ এনস্টিটিউশন’তৈরী হয়। এখানে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। ডাফ সাহেব যখন বাইবেল নিয়ে প্রভুর প্রার্থনা আবৃতি করতে বললেন , সেখানে কারোর আপত্তি না থাকলেও যখন সেটি ছাত্রদের পড়তে বললেন, তখন ছাত্রদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল। তা দেখে রাজা রামমোহন বলেছিলেন: “হেরাস হ্যামান সাহেব হিন্দু শাস্ত্র পাঠ করেছিলেন, তিনি হিন্দু হন নাই। আমি নিজে কোরান বার বার পাঠ করেছি, আমি কি মুসলমান হয়ে গেছি। আমি বাইবেলও পাঠ করেছি, কিন্তু তোমরা দেখ আমি হিন্দু, খ্রীষ্টান হই নাই। তোমরা পাঠ করো এবং নিজেরাই যুক্তির দ্বারা বিচার বিশ্লেষন কর”।

শোনা যায়, এরপর নাকি তিনি প্রত্যক দিন দেড় মাস সকালে উপস্থত থানতেন যখন বাইবেল শিক্ষা হত। তবে এটা ভাবলে খুব ভুল করা হবে যে, পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে কোম্পানি খুব সদর্থক বা ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল ঠিক উল্টোই।ইংরেজরা হৈ হৈ করে ইংরেজি, বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করতে চাননি। পাছে প্রজারা অসন্তুষ্ট হয়ে যায়। গর্ভনমেন্ট চেয়েছিল হিন্দুদের জন্য সংস্কৃত কলেজ থাকুক, মুসলমানদের জন্য আরবী, ফার্সি, মাদ্রসা থাকুক। পাদ্রি উইলিয়াম এখনকার ধর্মতলায় একটি ইংরেজি স্কুল করতে চাওয়ায়, তাকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মার্শম্যান গর্ভনমেন্টের কাছ থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে দিনেমার রাজাদের কাছে চলে যান। এইভাবে শ্রীরামপুর কলেজের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব আমরা ,সরকার তো সাহায্য করছেই না, বরং নানা ভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্ঠা করছে। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেশিয় ব্যক্তিবর্গ এবং পরবর্তিতে এই কলেজ কিভাবে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, সংস্কৃতিকে একটা ব্যাপক জায়গায় নিয়ে যায়, সেটা its self history.

বিশ্বমানবতা

তার বিজ্ঞান চিন্তাভাবনারই ফসল বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তার বিভিন্ন বিশ্বমানবতাবাদী কর্মকান্ডে। পৃথিবীর সেই সময়ে বিভিন্ন দেশে ঘটে চলা গনতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের তিনি সমর্থক ছিলেন। ১৮২১ সালে স্পেনে নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি টাউন হলে একটা বিরাট Party র আয়োজন করেন। তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রীসের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার প্রবল সহানুভূতি ছিল। আয়ারল্যান্ডে ইংরেজ গভর্নমেন্টের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘মিরাট-উল-আখবরে’ তিনি লেখালেখি করেছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের তিনি সমর্থক ছিলেন। আমেরিকার দাস প্রথা, অত্যাচার নিয়ে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। আয়ারল্যান্ড দুর্ভিক্ষ হলে তিনি সেখানে রিলিফফান্ড পাঠান। ফ্রান্সে লুই ফিলিপ তাকে invite করেছিলেন। তিনি যে কতটা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করতেন, যখন আমরা এটা জানতে পারি ১৮৩২ তিনি ফরাসি বিদেশমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন:

“বৈজ্ঞানিক গবেষনায় অতুলনীয় উন্নতি দ্বারা এটা বলা হয়, মানুষ্যজাতি একটা বৃহৎ পরিবারের অংশ”। তিনিই প্রথম বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

পরেশেষে দু চার কথা বলে শেষ করব। ইংরেজ শাষনকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানের জন্য। তবে তিনি এর অন্ধ সমর্থক ছিলেন না। প্রয়োজন হলে তিনি কড়া হতেন মাঝে মাঝে। ভাগলপুরের কালেক্টর হ্যামিলটন সাহেব ছিলেন প্রচন্ডভাবে নেটিভ বিরোধী। একদিন রামমোহন পাল্কি চেপে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন; তাকে সেলাম না করলে সাহেব ঘোড়া ছুটিয়ে এসে রামমোহকে প্রবল গালিগালাজ করন। রামমোহনও ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। লর্ড মিন্টোকে তিনি বেশ কড়া করে চিঠি লিখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করান। আবার, তিনি permanent settlement এর বিরোধিতা করেছিলেন, civil rights এর কাছে এবিষয়ে বার বার বলেছিলেন। বস্তুত, রামমোহনের যে বিশাল কর্মযজ্ঞ , তা এই স্বল্প পরিসরে ফুটিয়ে তোলা কঠিনই বটে। রামমোহন সব দিক থেকেই তার সময়কে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। আমরা বলতে পারি ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি সহ সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে রামমোহনের চিন্তাভাবনা ও কর্মকান্ড উনবিংশ শতাব্দির ঐতিহাসিকদের কাছে স্মরণীয় করে রেখেছে।


************************************************************************************************



 ড. শুভঙ্কর দে

ইতিহাস তাঁর নিরলস চর্চার বিষয়, তাঁর চিন্তা-চেতনার ধ্যানবিন্দু। বর্তমানে তিনি সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয় (পুরুলিয়া) ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত।


***********************************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন