লালন
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
বুকের ভেতর ডানা ঝাপটানো অবশেষে আকাশ পেল। তিনদিনের পুরুলিয়ার সবুজ সফর। দীর্ঘ দিন কর্মক্ষেত্র থাকার কারণে পুরুলিয়ার শিরা উপশিরায় বাস আমার।মেয়ে ডকুমেন্টারি বানাচ্ছে 'অরণ্য নির্ভর জীবন ' এর ওপর। আমার উপন্যাস ' ক্লোরোফিলে বাস ' ওকে উৎসাহিত করেছে। পুরুলিয়া ও জঙ্গলমহল নিয়ে ও কাজটা করতে চায়।তাই পুরুলিয়ার প্রজেক্টে কিছুটা গাইডের মতো আমার ভূমিকা।
মোটামুটি ওর কাজ শেষ। দুটো দিন পাহাড় ও আশপাশের এলাকা চষে বেড়িয়েছে।বাঘমুন্ডির ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক ওর বন্ধু। তাই সরকারি সাহায্যের অভাব হয়নি। আমারও একপেট সবুজ খাওয়া হলো অনেক দিন পর।হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাওয়া। শেষ দিন বিকেলে একটু ছুটি পাওয়া গেল মেয়ের কাছ থেকে। ওরা হোম স্টেতে ফিরে গেলে আমি গাড়ি নিয়ে চললাম চড়িদা গ্ৰামে। পর্যটকদের কাছে এই গ্ৰামের পরিচিতি ' মুখোশ গ্ৰাম' হিসেবে। মুখোশ ও ছৌ নিয়ে পুজো সংখ্যায় লেখার অনুরোধ আছে সম্পাদকের।তাই একটু রসদ সংগ্রহে ঘুরতে যাওয়া।
ড্রাইভার বিনোদ এলাকার ছেলে।চলার পথে ও অনেক কথাই জানালো মুখোশ গ্রামের বিষয়ে।ছৌ নাচের ওপর ওর জ্ঞান বিস্মিত করার মতো। আসলে ও কিছুদিন ছৌ নাচের সাথে যুক্ত ছিল।বিয়ের পর সংসারের চাপে ও তাপে গাড়ি কিনে রাস্তায় নামা।ওর গাড়ি চালানোর হাত খুব ভালো। সবচেয়ে ভালো লাগে সাধারণ ড্রাইভারদের মতো ওর কোন নেশা নেই। তিনদিন আমাদের সঙ্গেই আছে।কোন নেশা করতে দেখিনি। সকালে প্রাতরাশে এক কাপ চা ,ব্যস।চাতাল আমি অনেক দোকানে চা খেতে দাড়ালেও ও শুধু দর্শক। তবে কোন দোকানে ভালো চা পাওয়া যায় তার খবর সব ওর নখদর্পনে। অনেক পর্যটকের চা প্রিয়তার জন্য ওর এসব খবর রাখা।
চা খেতে খেতে সন্ধা নেমে এলো ।রাস্তার ধারে ধারে অনেক দোকান। শুধু মুখোশের ছয়লাপ।ও আমাকে দূর্গা মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা ধরে নিয়ে চললো গ্ৰামের একটু ভেতরে। গাড়িতে আশার সময় আমার প্রশ্ন শুনে ও হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে আমার উদ্দেশ্য। অন্ধকারে মোবাইলের আলো সঙ্গী করে হেঁটে চলেছি আমরা দুজন। অদ্ভুত এক নীরবতা চারদিকে। বাড়িগুলো যেন অন্ধকারের বুকে নীরবে দাঁড়িয়ে। ঝিঁঝিঁর আওয়াজ শুধু আমাদের বৃত্তে। কিছুক্ষণ পর বিনোদ একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।দরজায় ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ বেড়িয়ে এলেন বাইরে।পরনে ধুতি একটু তুলে পড়া। ঘোলাটে চশমার কাঁচে দুটো উজ্জ্বল চোখ।হাতময় আঠা মাখা। বুঝলাম কাজে ব্যস্ত।
বিনোদের মুখে সব শুনে আমার মুখোমুখি দুয়ারে বসলেন।বলে চললেন ওনার কথা। আমি টেপ রেকর্ডার অন করে ওনার কথাস্রোতে ভাসতে থাকলাম।একসময় ছৌয়ের দল নিয়ে খুব ঘুরে বেড়াতেন এ মেলা সে মেলা। কলকাতায় দূর্গা পূজোতেও ছৌয়ের দল নিয়ে গেছেন। তখন খুব চাহিদা ছিল চারদিকে।পয়সাও পাওয়া যেত।বেশ কয়েক বছর হলো মানুষ ছৌয়ের আগ্ৰহ হারিয়েছে।এখন চাহিদা খুব কম।তাই দলও গেছে ভেঙ্গে।আগে বিকেলে ছৌয়ের অনুশীলন চলতো সামনের মাঠে বাচ্ছাদের নিয়ে।এখন অভিভাবকরাও ছেলে মেয়েকে ছৌ শেখাতে আগ্ৰহ হারিয়েছে।ছৌ নেচে এখন পেট ভরে না। সংসার চালানো দূর অস্ত।তাই জমিতে চাষ আর মুখোশ তৈরি করেই সংসার চলে এখন। এলাকার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হয় ওনার। সরকারেরও সে রকম উদ্যোগ নেই।যা আছে তা নামমাত্র। সংস্কৃতি বুকের ভেতর লালন করতে হয়।তা চাপিয়ে দিয়ে হয় না। চোখের সামনে তা শেষ হতে দেখছেন ওনারা । পরবর্তী প্রজন্মকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। পেটের ক্ষিদেই একমাত্র শাশ্বত সত্য। দুবেলা দুমুঠো গরম ভাতের নিশ্চিত জোগাড়ই এখন ওদের মুখ্য উপজীব্য।
ওনার বড়ো ছেলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে শহরে স্নাতক পড়তে যায়। রেজাল্টও ভালো হয়। তারপর অনেক চেষ্টা করেও একটা ছোটখাটো চাকরিও জোটাতে পারেনি।নেতা মন্ত্রী টাকা পয়সার চক্করে বিরক্ত বিধ্বস্ত হয়ে শেষমেশ জমিতে এখন চাষবাস করে। অবসরে মুখোশ তৈরি। মুখোশে ওর হাত বেশ ভালোই। কিছু পয়সা আসছে এখন ওর হাত ধরেই।ছোটো ছেলেটা এসব দেখে লেখাপড়ার দিকে আর যায় নি।দাদার সাথে এই কাজই করে সারা দিন।
হঠাৎ চুপ করে রইলেন । দূরের অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। বুঝলাম, মেনে নিতে পারছেন না তার লালনে থাকা সংস্কৃতির এই হারিয়ে যাওয়া। নীরবতা কাটাতে প্রশ্ন করে উঠলাম : " এভাবে চললে তো একদিন ছৌ সংস্কৃতি অবলুপ্ত হয়ে যাবে? " প্রশ্ন শুনে চোখ থেকে চশমা খুলে ধুতির কাপড়ে মুছতে মুছতে বলে উঠলেন :" মানুষ যে চায় না ! আধুনিকতা কেড়ে নিচ্ছে সব।এই ছৌকেও। একদিন হয়তো মুখোশ তৈরিও উঠে যাবে ! বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো অন্য কিছুতে মানুষকে আসক্ত করে তুলবে "।
বুকের ভেতর কেমন যেন একটা মোচড়। বৃদ্ধের শেষের কথাগুলোয় চাপা কান্নার আওয়াজ যেন কানে বাজতে লাগলো। ঘড়ির কাঁটায় নটা বাজে। এবার উঠতে হবে। বিদায় নিয়ে দরজার দিকে এগোতেই বৃদ্ধের মুখনিঃসৃত তীরটা যেন বুক ফালাফালা করে দিল : " আসলে মুখোশ তৈরি করতে করতে মুখ আর মুখোশের পার্থক্যটা ধরে ফেলতে সুবিধা হয় এখন আমাদের !" চমকে উঠলাম।কার উদ্দেশ্যে বললেন কথাটা। আমাদের মতো নাগরিক সুসভ্য মানুষগুলোকে যারা মাঝেমাঝেই তাদের সংস্কৃতির দৈন্যদশা দেখে মেকি হাহুতাশ করে ? নাকি সরকারের বকচ্ছপ সংস্কৃতি রক্ষার পরিকল্পনার অসাড়তা দেখে ক্ষোভ উগরানো? বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখের কোণে জল চকচক করছে।
************************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন