বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩

প্রবন্ধ * কল্পোত্তম



কেন্দু পাতায় জীবন ধারণ

কল্পোত্তম

কেন্দু পাতা বা কেঁদ পাতাকে কেন্দ্র করে কিভাবে একটা শিল্প গড়ে ওঠে এবং অনেকানেক সংসারের জীবন নির্বাহ হয়ে থাকে আজ সেই বিষয়ের উপরই আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। 

              পুরুলিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের শুধু নয়, তার বাইরেও ভারতীয় উপমহাদেশের বহু অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নির্ভর করে জঙ্গলের শাল ও কেন্দু পাতার উপর। এইসব পাতা বিক্রি করেই সংসার অতিবাহিত করে থাকেন সেইসব অঞ্চলের মানুষ।

               এই দু'রকম পাতা বাদ দিয়েও কলা পাতা, চিহড় লতার পাতা, পলাশ পাতা সহ আরও বেশ কিছু পাতা স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন কাজে এসে থাকে। মানুষের জীবন ধারণের গুণগত মানের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কেন্দু পাতা যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে তারই এক সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরা হলো এখানে।

              কেন্দু বা কেঁদ গাছ বা হিন্দিতে তেন্দু পেইড় যার বৈজ্ঞানিক নাম ডায়োস্পাইরোস মেলানোক্সন রক্সব, খেজুর জাতীয় করোমন্ডল আবলুস বা পূর্ব ভারতীয় আবলুস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, যা ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় নামে পরিচিত। স্থানীয়ভাবে এর নাম তেম্বুরিনী। এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন ফল যা শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের মধ্য প্রদেশ, ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ড এবং উড়িষ্যা রাজ্যে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ফলগুলি সুমিষ্ট, অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং ফাইবার সমৃদ্ধ।

               এটি একটি কঠিন, শুষ্ক ও ফাটা ফাটা কালো বাকলযুক্ত গাছ। এর সাধারণ নাম দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের করোমন্ডল উপকূলীয় অঞ্চল থেকে এসেছে। এর পাতাগুলিকে তামাকের চারপাশে আবৃত করে ভারতীয় বিড়ি তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ মূলত  বিড়ির মোড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যে বিড়ি ভারতে প্রচলিত সিগারেটের চেয়েও বেশি পরিমাণে বিক্রি হয়।

              বসন্তে পুরনো পাতা ঝরে যাওয়ার পর গ্রীষ্মকালে নতুন কচি পাতার আগমন ঘটে। তাজা পাতাগুলি মাটি থেকে বের হওয়া ঝোপগুলোর দ্বারা উৎপাদিত হয়। আদিবাসীরা সেই নতুন পাতা হাতে বাছাই করে তোলেন এবং এক দেড় সপ্তাহের মতো রোদে শুকান। ভারতের মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং ছত্তিশগড় রাজ্যে এই প্রথা দেখা যায়। এইসব রাজ্যের সরকার প্রতি বছর টেন্ডারের মাধ্যমে কেন্দু পাতা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের লাইসেন্স দেয়।

              অন্যদিকে এই অঞ্চলের উপজাতিরা লু বা অতিরিক্ত গরম থেকে রক্ষা পেতে কেঁদ ফল খেয়ে থাকেন। এই ফলে প্রচুর পরিমানে শর্করা, প্রোটিন, ফাইবার এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ বি-ক্যারোটিন, টের্পেনয়েডস, স্যাপোনিন এবং ট্যানিন থাকে। কেন্দু পাতা থেকে বিড়ি তৈরি হয়। গ্রামীণ অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে এই পাতা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই পাতা বিক্রি করে পাহাড়ী এলাকা এবং পাহাড়তলীর মানুষ অর্থ উপার্জন করে থাকেন। তাই কেন্দু চাষ বহু অঞ্চলের মানুষের বাঁচার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

               ল্যাটেরাইট এবং কৃষ্ণ মৃত্তিকা এই গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। এছাড়াও, বনাঞ্চলের মাটি এই গাছের জন্য ফলদায়ক। বাণিজ্যিকভাবে কেন্দু চাষ করতে ভাল জল ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হিউমাসযুক্ত মৃত্তিকা প্রয়োজন। তবে কোয়ার্টজাইট, শেল এবং বেলেপাথর সহ পাথুরে মাটিতেও এটি সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে।

              শীতল ও আর্দ্র জলবায়ু কেঁদ গাছকে ভালোভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। কেন্দু হলো  উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলের ফল, যেখানে ০-৯০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় এই গাছ জন্মায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৫০০-১৫০০ মিমি এবং তাপমাত্রা ০-৪৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এই গাছের বৃদ্ধির জন্য উত্তম। উচ্চ তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ফল পরিপক্ক হওয়ার জন্য প্রয়োজন।

                ঠান্ডা জলে প্রায় ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে বীজের অঙ্কুরোদগম হয়। স্ট্যাম্প পদ্ধতিতে বীজ রোপণ করলে এই গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। গ্রাফটিং পদ্ধতি দ্বারা উদ্ভিদের বৃদ্ধি সম্ভব। ৫ : ৩ : ২ অনুপাতের খামারের সার, মাটি এবং বালির মিশ্রণ পলিথিন ব্যাগে দিয়ে বীজের অঙ্কুরোদগম করা হয়। জানুয়ারি-মার্চ মাসে গ্রাফটিং করা যেতে পারে।

                 কেন্দু  হলো মাঝারি আকারের গাছ বা গাছের গুল্ম যা প্রাকৃতিক অবস্থায় বনভূমিতে বা অবনমিত জমিতে পাওয়া যায়। ভালো মাটিতে যেমন বেলে দোআঁশ, গাছের বৃদ্ধি হয় ভালোভাবে। মাটি ও জলবায়ুর ধরণ অনুসারে এই উদ্ভিদের বৃদ্ধির ব্যাবধান লক্ষ্য করা যায়। দেশের পূর্বাঞ্চলে যেখানে পাথুরে মাটি বা ল্যাটেরাইট মাটি রয়েছে সেখানে গাছগুলি ৬ মিটার দূরত্বে রোপন করতে হয়। গাঙ্গেয় সমভূমিতে গাছের ব্যাবধান রাখতে হয় ৮-১০ মিটার। 

                 সাধারণত জুলাই-আগস্ট মাসে এই গাছ রোপণ করা হয়। যেহেতু, কেন্দু ধীর গতিতে বৃদ্ধি পায় তাই এক বছরের বেশি পুরনো উদ্ভিদ যার বৃদ্ধি রয়েছে এবং গাছটি সতেজ সবল সেরকম কয়েকটি পাতাযুক্ত চারা রোপন করা উচিত। বর্গাকার পদ্ধতিতে রোপন করা সর্বোত্তম।

                 চারাগুলি সাধারণত ২ মি × ২ মিটার দূরত্বে রোপণ করা হয় এবং আগাছা মুক্ত করে বেশি পরিমানে  ছাঁটাই করা হয় যাতে তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি ঘটে। কারণ অতিরিক্ত ডাল-পালা এবং আগাছা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।        

                 গাছগুলি সাধারণত ৬০-৯০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় কাটা হয়, যাতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটতে পারে। আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক সময় লাঙ্গল চালিয়েও জমি পরিষ্কার রাখা হয় |

         


      মালচিং-ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করার একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি মাটির আর্দ্রতাকে ধরে রেখে গাছের বৃদ্ধি বজায় রাখে | মালচিং করার সামগ্রী হলো, ধানের খড়, করাত ধুলো, শুকনো কলা পাতা, পলিথিন ইত্যাদি । কালো পলিথিন আগাছা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। জৈব মালচিং মাটির গুণমান উন্নত করার পাশাপাশি আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং মাটির জৈবিক ক্রিয়াকলাপ উন্নত করে।

               কেন্দু গাছের পুরোনো পাতা বেশি রোগাসক্ত হয়। প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক বা মানকোজেব দ্বারা এই রোগ নিরাময় সম্ভব। এছাড়াও, জৈব পদ্ধতিতে নিমতেল ব্যবহার করে এই গাছের রোগ নিরাময় করা যায়। অনেক ধরণের পোকা-মাকড়, মাছির আক্রমণও ঠেকাতে সক্ষম এই পদ্ধতি।

                তবে, কেন্দু গাছ চাষ করা সম্ভব হলেও পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার বনাঞ্চল সহ ঝাড়খণ্ডের গিরিডি, রাজমহল পাহাড়, সাঁওতাল পরগনা, দেওঘর এবং ওড়িষ্যা, আসাম, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যের বিভিন্ন পাহাড়ী ও বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কেন্দু গাছের জঙ্গল রয়েছে। 

                এইসব জঙ্গলে একটা সময় প্রচুর কেন্দু গাছ ছিল কিন্তু বর্তমানে তার ঘনত্ব কমতে কমতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যেতে বসেছে।

                 জানা যায় ১৬০০ - ১৭০০ শতাব্দীতে জমিদারেরা রাজাদের কাছ থেকে কেন্দু গাছের জঙ্গল ইজারা নিত এবং তা থেকে মুনাফা অর্জন করার সাথে সাথে সেই জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন সর্তও থাকতো। কিন্তু বাস্তবে তারা মুনাফা অর্জন করলেও জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রতি যত্নবান ছিল না। ফল স্বরূপ কেন্দু গাছের জঙ্গল ধ্বংসের দিকে এগোতে থাকে। তারপর ব্রিটিশ আমলেও সেই ধারা অব্যাহত থাকায় সময়ের সাথে সাথে বেশিরভাগ জঙ্গলই ধুলিসাৎ হয়ে যায়।              

                বর্তমান সময়েও অন্যান্য রাজ্যগুলো সহ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার মানুষদের অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে জঙ্গলের উপরে। তার মধ্যে অন্যতম একটা বিষয় হল কেন্দু গাছের পাতা।

               ভোর হতেই এইসব অঞ্চলের বহু মানুষ জঙ্গলের কেন্দু পাতার জোগাড়ে বেরিয়ে পড়েন।  বিশেষত মহিলারা। এঁরা পাতা সংগ্রহ করে শুকিয়ে বান্ডিল করে বিক্রি করে দেন বিড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থাকে। কেউ কেউ আবার নিজেই বিড়ি প্রস্তুত করে বিক্রি করে দেন সংস্থাগুলোকে। অনেক অনেক গ্রামে প্রায় প্রতি ঘরেই বিড়ি প্রস্তুত করা হয়। বাড়ির মহিলারা ঘরোয়া কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিড়ি প্রস্তুত করে থাকেন।

               বিড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো বিড়ি প্রস্তুতকারকদের স্বাস্থ্যরক্ষার্থে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থাও তারাই করে থাকে। যার ফলে এই শিল্পের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা এখনো কমেনি।

               এইসব এলাকার কিছু মানুষ যেমন পাতা সংগ্রহের কাজে যুক্ত তেমনি কিছু মানুষ বিড়ি প্রস্তুত করার কাজে যুক্ত রয়েছেন। এই কাজের উপর নির্ভর করেই সংসারের অর্থনীতির অনেকাংশ সংগ্রহ করে থাকেন তাঁরা। বিশেষ করে সরকার এইসব অঞ্চলের অর্থনীতি উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রায় পুরোপুরিই ব্যর্থ হওয়ার কারণে কেন্দু পাতার উপস্থিতি এবং তার ব্যবহার এই অঞ্চলের মানুষের ঐশ্বরিক আশীর্বাদ রূপে প্রতিমান হয়েছে।                  

                 বিড়ি হাতে তৈরি এক ধরনের সস্তা ধূমপানের বস্তু। দাম কম এবং হাতে বানানো যায় বলে গ্রামের কৃষক শ্রমিক প্রভৃতি সাধারণ মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ধূমপান সামগ্রি এটা। শুকনো কেন্দু পাতাকে কেটে সুন্দরভাবে চোঙের ( যার একদিক সরু এবং একদিক মোটা ) মতো করে মুড়ে তামাক পাতা থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি করা মশলা তার মধ্যে দিয়ে পাতলা সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর তা পেকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে কিছু কিছু এলাকার মানুষ সরাসরি তামাক পাতাকে খুব ছোটো ছোটো টুকরো করে হাতে মলে কেন্দু বা শাল পাতায় মুড়ে ধূমপান করে থাকেন। এগুলোকে স্থানীয় ভাষায় চুঁটি বলে। বিড়ি এবং চুঁটিতে ফিল্টার না থাকার কারণে এর ক্ষতিকর প্রভাব বেশি। বিড়ির কাঁচামাল তামাক উৎপাদনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া; মেদিনীপুর এর আশেপাশের অঞ্চল এবং বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চল বিখ্যাত। এজন্য এসব অঞ্চলে বিড়ি শিল্পের প্রসারও ব্যাপক।

                   জানা যায় ১৯৭০ সালের আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ৮০% এরও বেশি মানুষ ধূমপান করার জন্য বিড়ির ব্যবহার করতেন। কিন্তু বতর্মানে দরিদ্র ও প্রত্যন্ত এলাকার লোকেরাই মূলত বিড়ি খেয়ে থাকেন। তবে বর্তমান সময়ে আবার অনেক সম্পদশালী লোকদেরও শখের বশে বিড়ি খেতে দেখা যাচ্ছে। ফলে বিড়ি প্রস্তুতকারীদের কপাল চওড়া হচ্ছে না সরু হচ্ছে সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।


*******************************************************************************************************



 কল্পোত্তম

নিরলস সাহিত্যচর্চায় মগ্ন তরুণ কবি কল্পোতম । একটি উপন্যাস সহ ইতিমধ্যেই তিনি লিখে ফেলেছেন পাঁচটি গ্রন্থ । কাব্যগ্রন্থ  *  সাতরঙা পাড়  *  বত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক* ঝুমুর সঙ্গীতের বই  * রিঝে রঙে  উপন্যাস  *  পেইন্টেড ট্রেন  গল্পগ্ৰন্থ  *  স্বপ্নসিঁড়ি* সম্প্রতি প্রকাশিত





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন