অমৃতময় সেই মহাজীবন প্রসঙ্গে
- স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ
১)
পরমপূজনীয় দ্বাদশ সঙ্ঘাধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ যে আদর্শ আমাদের সামনে রেখে গিয়েছেন, সেই আদর্শ এবং সেই জীবনের আকর্ষণ চিরকাল থাকবে। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ আদর্শকেন্দ্রিক। সেইজন্য শূন্যতা রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘে আসে না। কারণ এই শূন্যতা অবিলম্বেই পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ব্যক্তির একটি ভূমিকা থাকেই। কারণ, ভাব তো ব্যক্তিকে আশ্রয় করেই মূর্ত হয়ে ওঠে। ব্যক্তিকে ধরে আমরা সেই ব্যক্তির পিছনে যে নৈর্ব্যক্তিক সত্তা রয়েছেন, যে আদর্শ রয়েছে, তার কাছে পৌছাবার চেষ্টা করি। পরমপূজ্যপাদ ভূতেশানন্দজী মহারাজ একজন ব্যক্তি অবশ্যই, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি একটি প্রতীকও। রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ ভাব ও আদর্শের, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের, তিনি একটি প্রতীক। সেই হিসেবে আমাদের কাছে তাঁর ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব।
পূজ্যপাদ মহারাজের জীবনী আমরা সবাই এখন জানি। মহারাজের সম্পর্কে সংবাদপত্রেও বিশদভাবে বেরিয়েছে। এবং বেলুড় মঠ থেকে প্রকাশিত তাঁর ছোট্ট জীবনটিতেও আমরা সবাই দেখেছি যে, ১৯০১ সালে মহারাজের জন্ম। অর্থাৎ যে শতাব্দী (বিংশ শতাব্দী) আমরা অতিক্রম করতে চলেছি, সেই শতাব্দীর সূচনায় তাঁর আবির্ভাব। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম নবজাতকদের অন্যতম এবং আমাদের সঙ্ঘে যাঁরা অধ্যক্ষ হয়েছেন তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিংশ শতাব্দীর জাতক। এর আগে যাঁরা অধ্যক্ষ হয়েছেন তাঁরা সবাই তার আগের শতাব্দীর অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর মানুষ। একমাত্র তিনি বিংশ শতাব্দীর মানুষ। পূজ্যপাদ মহারাজের আগে আমাদের সঙ্ঘাধীশ ছিলেন শ্রীমৎ স্বামী গম্ভীরানন্দজী মহারাজ। দুজনেরই এক সঙ্গে ব্রহ্মচর্য। ভূতেশানন্দজী মহারাজের অবশ্য আগে দীক্ষা হয়েছে। আবার সন্ন্যাসও প্রায় একসঙ্গে, এক-দু'মাসের পার্থক্য। গম্ভীরানন্দজী মহারাজের সন্ন্যাস স্বামীজীর জন্মতিথিতে, আর ভূতেশানন্দজী মহারাজের সন্ন্যাস ঠাকুরের জন্মতিথিতে। বয়সে গম্ভীরানন্দজী ভূতেশানন্দজীর থেকে দু বছরের বড় ছিলেন।
একটা জিনিস আমার ভাবতে ভাল লাগে যে, মহারাজ যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন স্বামী বিবেকানন্দ জীবিত আছেন। ১৯০২ সালের চৌঠা জুলাই স্বামীজীর তিরোধান হয়েছিল। আর ১৯০১ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর মহারাজের জন্ম হয়। ...
২)
পূজনীয় ভূতেশানন্দজী মহারাজের মাতুলালয় ছিল বলরাম মন্দিরের কাছেই -রাজবল্লপাড়ায়। মহারাজের মা, বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ারই মেয়ে। মাঝে মাঝেই তিনি নিশ্চয়ই সোমসার থেকে বাপের বাড়ি রাজবল্লভপাড়ায় আসতেন! তিনি খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি কি বাড়ির পাশেই বলরাম মন্দিরে এই নবজাতককে কোলে নিয়ে একবারও আসেননি -ভাবতেই কেমন লাগে! আরও ভাবতে ভাল লাগে -যখন নবজাতককে কোলে নিয়ে এসেছেন, সেই সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ সেখানেই আছেন। তাহলে নিশ্চয়ই স্বামী বিবেকানন্দ এই নবজাতককে দেখেছেন। আমাদের দশম সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজ বলতেন একটি সুন্দর কথা। বলতেন, যখন স্বামীজী পাশ্চাত্য জয় করে ফিরলেন ভারতবর্ষে, সেইসময় ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাদ্রাজে ক্যাসল কার্নানে স্বামীজী ছিলেন। দলে দলে মানুষ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বামীজীকে দর্শন করতে আসতেন। সেইসময় স্বামীজীকে দর্শন করতে কাকার হাত ধরে এসেছিলেন একটি পাঁচ বছরের বালক। সেই বালকই হচ্ছেন পাণ্ডুরঙ্গ প্রভু, পরবর্তিকালে আমাদের প্রভু মহারাজ। নিজের মুখে তিনি বলেছেন, "স্বামীজীকে আমি দেখেছি, কিন্তু তার কোন স্মৃতি আমার নেই। আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। মনে নাই বা থাকল, কিন্তু স্বামীজী তো আমাকে দেখেছেন!" ভাবতে ভাল লাগে যে ভূতেশানন্দজীর মাও একবার নবজাতককে কোলে নিয়ে বলরাম মন্দিরে এসেছেন এবং স্বামীজী তাকেও দেখেছেন। তাঁর কোন স্মৃতি থাকার কথা নয়।
যখন ভূতেশানন্দজী মহারাজ পৃথিবীতে এলেন তখনকার ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলটি একেবারে charged হয়ে রয়েছে। তখন স্বামী বিবেকানন্দ জীবিত, শ্রীশ্রীমা দেহে রয়েছেন, শুধু স্বামী যোগানন্দ ছাড়া ঠাকুরের অন্যান্য সন্ন্যাসী পার্ষদরা সকলেই দেহে রয়েছেন। তাহলে ভাবুন, স্বয়ং ভগবতী রয়েছেন এবং একজন বাদে ঠাকুরের সমস্ত ত্যাগী পার্ষদেরা রয়েছেন। সেই পরিমণ্ডলে মহারাজের জন্ম। সেই জমাট, super-charged সঘন আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের একটা প্রভাব তো থাকবেই। আর প্রভাব কোথায় বেশি? যার receptivity বা ধারণের ক্ষমতা, গ্রহণের ক্ষমতা, -যত বেশি।
আমরা মহারাজের জীবনীর সঙ্গে এখন পরিচিত। এবং তার জন্ম ও বাল্যজীবনের কথা অনেকটাই জানি। হয়তবা সবটা জানিনা, কিন্তু অনেকটাই এখন আমরা জেনেছি। তা থেকে বোঝা যায়, সেই আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের সত্তাকে গ্রহণের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা পূজনীয় মহারাজের মধ্যে ছিল। ...
৩)
প্রসঙ্গত একটি আশ্চর্য যোগাযোগের কথাও মনে আসছে। মহারাজের নিজের মুখ থেকেই শোনা, -মহারাজের মা চারুবালা দেবী খুব শিবভক্ত ছিলেন। এবং যে গ্রামে মহারাজের জন্ম বা যেখানে মহারাজের পূর্বাশ্রম, বাঁকুড়ার সেই সোমসার গ্রামের গ্রামদেবতা হচ্ছেন সোমেশ্বর শিব। সেই থেকেই গ্রামটির নাম 'সোমসার'। গ্রামে একাধিক শিবমন্দির। গ্রামটি যেন একেবারে শিবক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। মহারাজ এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন যার গৃহদেবতা হচ্ছেন সদাশিব, যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন সেই গ্রামের দেবতাও শিব। মহারাজ সন্ন্যাস নাম হিসেবে পেলেন স্বামী ভূতেশানন্দ। অন্য নাম তো হতে পারত! ভূতেশ মানে শিব। ভূতেশানন্দ মানে শিব যাঁর প্রিয়, যাঁর আনন্দের কেন্দ্র। যেন বেছে বেছে এমন একটি নাম তাঁকে দেওয়া হল! মহারাজের মুখে শোনা গিয়েছে, -বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসীরা তাঁকে বলেছিলেন, "মহাপুরুষ মহারাজকে বলে তুমি নামটা পাল্টে নাও। কি একটা 'ভূতেশানন্দ' নাম! সবাই ভুত ভুত বলবে।" মহারাজ বলেছিলেন, "কেন আমার তো খুব ভাল লাগছে।" ভাল তো লাগতেই হবে, কারণ ব্যাপারটা যে ওই ভাবেই পূর্বনির্দিষ্ট! তাঁকে ব্রহ্মচর্য এবং সন্ন্যাস দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ স্বামী শিবানন্দ। স্বামী শিবানন্দ ছিলেন শিবময় এক মহাত্মা। বাস্তবিকই তিনি ছিলেন শিবস্বরূপ শিবানন্দ। ভূতেশানন্দজীর মন্ত্রগুরু ছিলেন স্বামী সারদানন্দ। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী সারদানন্দকে বলেছিলেন, "তোমার আদর্শ শিব।" বাস্তবিকই স্বামী সারদানন্দ ছিলেন শিবতুল্য, নীলকন্ঠ পুরুষ। সারদানন্দজী মহারাজের যখন উদ্বোধনে মহাপ্রয়াণ হয়, তখন রাত দুটো। বেলুড় মঠে ঠিক সেই সময় মহাপুরুষ মহারাজ স্পষ্ট শুনলেন স্বামী সারদানন্দ তাঁকে বলছেন, "তারকদা কাশী চললাম।" শিবক্ষেত্র কাশীতে কার গতি হয়? শিবপ্রিয় ভিন্ন আর কারও কি কাশীতে গতির ভাগ্য ঘটে? মহাপ্রয়াণের মুহূর্তে স্বামী সারদানন্দের ওই উক্তির অর্থ কি এই নয় যে, তিনি শিবসত্তার অধিকারী? অর্থাৎ শুধু ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাসগুরু স্বামী শিবানন্দই নন, তাঁর মন্ত্রগুরু স্বামী সারদানন্দজীও ছিলেন শিবসত্তার অধিকারী। এখানেও শিবের সঙ্গে ভূতেশানন্দজীর এক অপূর্ব সংযোগ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে গুরু স্বামী সারদানন্দ দেহত্যাগ করেন উনিশে আগস্ট ১৯২৭, শিষ্যের দেহত্যাগ হয় দশই আগস্ট ১৯৯৮। দেহ রক্ষার মাস গুরু ও শিষ্যের একই, আগস্ট মাস। শুধু জীবনেই গুরু ও শিষ্যের সাদৃশ্য নয়, প্রয়াণেও তাঁদের অদ্ভুত সাদৃশ্য! ...
*********************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন