বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩

প্রবন্ধ * স্বপন নাথ



"কবি কথায় কবিতা কথা কয়"

স্বপন নাথ

সূচে সুতো লগ্ন হলেই জেগে ওঠে গোলপোষ্ট।

লক্ষ্যের পিছনে ধাবিত অভিলাষী জয় বয়ে আনে সহিষ্ণু আলো। সেই স্রোতে জেগে ওঠে মন মেজাজ মস্তিষ্ক। হৃদয় শীর্ষের চেনা চেনা রোদ ঝেঁপে আনে কনে দেখা আলোর বিকেল। তখন কথোপকথন বাড়ে । হাত টেনে তুলে ধরার শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। চঞ্চলা হরিণীর ঠমক যমক চলার চকিত চঞ্চলার স্ফুরিত তড়িৎ ম ম করে বনময় মনময়। আশা আকাঙ্খার সাফল্যে হৃদয় এভাবেই হরিণী রূপ পায় ।

এই প্রতীকে  উঠে আসা 2023 এ চারুপত্র প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত এই সময়ের একটি নতুন কাব্যগ্রন্থ "মৃত মৃগ মন "এ এসেছে হরিণ সম্পর্ক ।

এই হরিণে চকিত চঞ্চলার নাচুনে ঘাই নেই।কিন্তু শ্যামের বাঁশি শুনে যোগিনী স্বরূপা রাধার পরাণের বাঁশি শোনা যায় তার প্রাণে। দেখা যায় নয়নে বয়ে ধারা । কিন্তূ কেন এই ধারা ? কেন এই জললিপি মরণ ? কেননা সেই সময় এখন নয়। তারই ব্যঞ্জনা স্বরূপ যদি কথা কই ; বলি : 

"সূচে সুতো লগ্ন হলেই জেগে ওঠে গোলপোষ্ট"; কিন্তু সেই সুতো যদি হয় গিঁট --- গিঁট ---আর--- গিঁট ! মানে বক্র ক্রূর । মানে সিদ্ধির ছলনা । মানে চক্রান্তের জাল বিস্তারী কৌশলী জিঘাংসা ! সুচে সুতো ঢোকে না । 

বিপ্রতীপে গোলপোষ্ট যদি হয় স্থানাঙ্কহীন --- শূন্য --- শূন্য -- শূন্য ---। হ্যালুয়েশান সর্বস্ব - মরীচিকা ! তবে তো জীবন ফুরলো। অসহিষ্ণু । তেঁড়েলমি । গোঁয়ার গোবিন্দ । ডালপালা হীন আমিত্বের বড়াই , মধ্যযুগীয় আবিলতায়  তমশাঘন। 

কিংম্বা অভিমান ক্ষত পুষে নিমজ্জমান । মন কেমনের গর্তে বসবাস।  অর্থাৎ সমূহ পতন । ডোপামিন কম । সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার ব্লক । কিংম্বা করোনারী স্টপ ।  কিংম্বা ফুললি প্যারাফ্ল্যেজিয়া ; হরিণী কাত । অনড় । শুধু বেলপালসিতে বাঁকা ফেসিয়ালি চোখ দুটো কান্না চেপে ছলছল । সেরিবেলাম থরথর । জীবমৃত অবস্থা। 

অর্থাৎ নামকরণের প্রতীকে যে হরিণটা ছিল ; সে মৃত । কাজেই নতুন বইয়ের নাম  মৃত মৃগ মন " সাজুয্য দিল । দিল না কী ?

 কী দেখছি চারপাশ ? কোনটা ঠিক ; কোনটা ভুল : সব ঘুলিয়ে ' ঘ' ।  আদর্শ নীতি মূল্যবোধ সব জলাঞ্জলী । শাসকের নির্দেশ পালনই  সার। দেশ রাষ্ট্র তো ছাড় ! পাড়ার হবু গোবুর স্বজন পোষিত চেয়ারও তাই। হাঁয়ে , হ্যাঁ । নায়ে , না । তাকে মান্যতাই আদর্শ। না মানলেই সন্ত্রাস ।  গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে তালা। উল্টো করে বললে হয় , হত্যাও হলো পরিচয় ।  ফলত  স্বভাব সজ্ঞাত  সাজুয্য পায় - "আত্মপরিচয় "কবিতাটি:

"পড়ে পাওয়া

একটি জীবন অজস্র জীবন 

                                 সহস্র জীবনে

তবু এককে ভয় ।

ভরসা কম

স্বাতন্ত্রীকরণ

আত্মপরিচয়।


অজস্রে যাই

এক ঢেউ অন্য ঢেউয়ে 

                       কাদাগোলা


মৃত্যু অগণন

পরিচয় হারাই ---।"


   এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই  "তাসের দেশ"র  রাজার কথা " ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো/দূরে তাকিয়ো নাকো/চলো সমান পথে/ (শাসকের নির্দেশিত পথে) চলো সরল পথে/ ( শাসকের পথে )   শুধু হুকুম পালন।

যেন কর্তার নির্দেশে চলেছি সবাই। কে যেন বেচে দিয়ে গেছে সমস্থ বিবেক। তাই কাপড় খুলে যাচ্ছে দেখেও নির্লজ্জ নির্নিমেষ। যেন মধ্যযুগীয় দাস বিক্রির হাটে চলেছি সারসার।

তাই তীব্র শ্লেষে বেজে উঠেছে :" ফাঁস " কবিতাটি :

"অদ্ভুত শ্মশান যেন জেগে থাকে

মানুষের শিষ্টাচার মূলে ।

অথচ শৃঙ্গার রসে 

বাষ্পীভূত হয়ে গেছে শরীর

মানুষ যেন বাড়িয়ে আছে গলা

অদৃশ্যে ঝুলছে ফাঁস দড়ির ---"


কিংম্বা যেন সব ছাগল দশায়  বটপাতা চিবিয়ে যাচ্ছি  চ্যাঙর ম্যাঙর। আহা ! কি সুখ ; সুধা ! সুধা ! কসাই এসে নিয়ে যাচ্ছে যখন একটা একটা। জবাই হচ্ছে একটা একটা । তখনও অন্যেরা বটপাতা নিমগ্ন ; চ্যাঙর ম্যাঙর । আহা ! কি স্বস্থি !  কৃপাহি কেবলম । নাও হে প্রভু । কি ভক্তি ! আহা !  জ্ঞাণমার্গে ছাগলের কি স্মরণীয় পন্থা !

এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আমরা মনুষ্যকূল একই দশায় নয় কী ?  সমার্থক হয়ে যাচ্ছে না কী ? দৃশ্যত  কী দেখছি  ? নিজেকে  শিক্ষার্থী  ভাবতে লজ্জা । শিক্ষক ভাবতে লজ্জা । ডাক্তার ভাবতে লজ্জা ।  নেতা ভাবতে লজ্জা । সর্বোপরি মানুষ ভাবতেও লজ্জা ।

 লজ্জা ! লজ্জা ! লজ্জা !

 রবীন্দ্র বীক্ষায় তাসের দেশের মতোই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে নাকি !

সেই সব লজ্জাঘন কুরুনীর দাড়ে , কোরা  কোরা , হৃদি কণা কণা  নিয়ে সেজে উঠেছে  2023 এ প্রকাশিত নতূন কাব্যগ্রন্থ "মৃত মৃগ মন " এর কবিতা সমূহ। যেখানে স্বগতোক্তিতে উঠে এসেছে - "সমর বিন্যাসে" কবিতাটি :

" বাসনাগুলো বসে যাচ্ছে প্রতিদিন।

চতুর্দিক থেকে আটকানো হচ্ছে তাকে ।

শোকে তাপে নিথর নিরুত্তর ---

প্রতিরোধ গড়েও দেখেছে

বৈঠা জলেই পড়ে থাকে।

নৌকা উদাসীন , অভিমুখহীন ---

ধেয়ে আসা ঢেউগুলো বুকের চাতালে

মৃতদের গল্প কথা বলে ।

সহিষ্ণু বলে পিঠ চাপড়ে দেয় লোকে।

অন্যায় সমর বিন্যাসে

ছল কত গভীর হয়

শিখে নেয় ---"


অথবা মেলামেশার জগৎ থেকে ছিঁড়ে পড়া মুখোশগুলো সন্তর্পণে সরিয়ে বলতে হচ্ছে "অহরহ" কবিতাটি :

"দাঁড়াবার জায়গাটা ভিড়ে ঠাসা।

পায়ে পায়ে ঠেকা।

কিছু পা স্থাপকে স্থাপিত

কিছু পা রঙের কৌটোয় সাঁটা।

বাকী পা , পা-ই সাজানো নার্মিতি

পাঁজর পোড়া মাংস গন্ধে বিভোর ---

দয়াময়,ঠেকাঠেকি ওরা আছে ভালো।

দলাদলি কৌশলে কালো মুখগুলো

দৃশ্য বিনিময়ে ছিটোয় পরাবাস্তব আলো।

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো মানুষ আমি

চটিজোড়া সামলে দেখি 

ট্রেন ছেড়ে যায় হুশ

অন্তরাত্মা পুড়ে যায় অহরহ ।"

কিন্তু মন যখন আছে । অবশ হলেও আছে ; সেহেতু  মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। তাই  কবির বিনম্র নিবেদন :" হে প্রেম": 

"ভুলে কিছুই যাইনি হে প্রেম ---

প্রেম পাওয়াগুলোই সরষে ফলিয়ছে ঢের

নিশিডেকে কুহক পরিয়েছে ।

শীর্ষ উঁচানো সেই সব

সরষে পলক মৌ 

ঢেউ তুলে গেছে পায়ে ,

কোনো ঢেউ নোঙর মানেনি  

কোনো ঢেউ আছড়ে কপাল ভেঙেছে ।

সেই সব আহত মুখগুলোর পাশে 

সন্ধ্যা আরতির প্রদীপ জ্বেলে দিই

মুখোমুখি বসি

কথা দেওয়াগুলি ভেজে,

ভিজতে থাকে ----।"  

কিংম্বা  জানু পেতে প্রার্থনাময় সংলাপ : " ও জীবন" :

"বেঁচে থাকার মনীষা গুলোয়

রূপকের ছোঁয়া রাখো জীবন ।

স্পৃহা দিয়ে বাঁধো। 

যাতে আড়ালগুলো আহ্লাদ পায় ।

বিকাশের মোহগুলো

খেলনা প্রিয় ভ্রমণ পেয়ে ঘুরুক । 

সঘনয় নিবিড় বসুক।

এইখানে মাৎসর্য ইদারার ঠাণ্ডা পানীয়ই রাখে যদি চুকচুক চুমুক ; কেঁচিয়ে দিয়ো না উন্মুখ।

মৃত মৃগ মনে মায়ারূপ ফুটুক ।

ঘৃণা , ঘৃণা , শুধু ঘৃণা ধরে গেলে ; ইচ্ছা পূরণের কাঁটাতীক্ষ্ণ মুখ তিষ্ঠতে দেয় না জেদ ।

দাঁড়গুলো যে যার জলে ফেলতে পারি না যে ;

"ও জীবন ,কিছু একটা ব্যবস্থা রাখো হে , যাতে রক্ত ওঠা মুখগুলোর ফেনাময় কসে

 ভালোবাসা দু-দণ্ড বসে "।

_

প্রিয় পাঠক পাঠিকা  আসুন। যাপন যন্ত্রণার অংশী হয়ে কিভাবে নিথর হয়ে আছে জীবন দেখে নিই । কেননা----

"তুমি আমি কাঁচ

মুখোমুখি দাঁড়ালে দুজন

বিম্বে ফোটে

দুজনারই ছাঁচ।"

কাজেই আমি যা করি , অংশত তুমিও তাই করো। অর্থাৎ কবিতার চলনে বলি : "নুন " কবিতাটি :

"একা একা হাঁটি আর মনে মনে কথা কই

ক্ষতগুলো বাড়ে কমে ,হর্ষগুলো আনন্দ বিলোয়

রোদ্দুর কৌশল নিই ; গাঢ়তর মেঘগুলো ছুঁই

অশ্রুপাতে শ্রাবণ যদি পাই

আঁধার কলসগুলো ধুই

রান্না চাপাই ----

বহু ক্লেশে নিঢাল উপোস বহুদিন

হাঁড়িগুলো তাত পেয়ে যদি স্বীকার করে ঋণ

ভাত বেড়ে তোমাকে শুধোই

কষ্টগুলো নুন ভেবে পাতে তুলে নিন ।" 

          অর্থাৎ সময়ের হাঁ গ্রাসকে প্রকাশযোগ্যতায় তুলে আনার যাপন যন্ত্রণাই ছবি আঁকে , কথা বলে কবিতায় । অন্যভাবে বললে হয় কাঁচের পিছনে মারকিউরাস অক্সাইডের মতো সাযুজ্য শব্দের প্রলেপ দিয়ে বিম্ব ধরতে সাহায্য করে কবি কথার কবিতা। তখন বুঝতে পারি "আমার চোখের জল  চোখেই মেরে ফেলেছি অসহায় " - মৃত মূগ মন ।


*********************************************************************************************************



স্বপন নাথ 

পিতা : বলাই চন্দ্র দেবনাথ।মাতা:শ্রীমতি মায়া নাথ।গ্রাম-বেটিয়ারী, ডাকঘর- নলপুর,  থানা-সাঁকরাইল, জেলা- হাওড়া,পেশা- শিক্ষকতা ।
নেশা-লেখা , মূলত কবিতা ও প্রবন্ধ ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : আটটি। প্রথম প্রকাশ (2006)বাতুল বালিয়াড়ি। পর্যায়ক্রমে মৃত্যুজপ শীলিত পরিক্রমা, চন্দ্র হলো না,সেই হরিণী যেই হরিণী, দ্বীপজন্ম, আয়াত পেরনো জল, গ্রহণ,   প্রভৃতি । সবকটিই শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষের তদারকিতে প্রকাশিত । প্রকাশিতব্য "ছিপ ধরা প্রহর "2022কোলকাতা বইমেলা ।
"আয়াত পেরনো জল" কাব্যগ্রন্থটি 2020 অন্নদাশঙ্কর রায় স্মৃতি পুরস্কারে মনোনিত হয়েছিল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আবৃত্তি বিভাকর সম্মানে ভূষিত ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন