বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩

গুচ্ছ কবিতা * দীপংকর রায়



কবিতাগুচ্ছ * দীপংকর রায় 








পাথুরে বোধনের কান্না শুনি কাশবনে

উৎসর্গ : দীপ্তিশিখা দাস


১৬৩.

একটিকেই চিনি ,

দুদিকে প্রসস্ত সকালের অন্ধকার যার ------

আপাত নৈঃশব্দ সেই ঘুটঘুটে পথে ;

তবু ভেঙে চলে যাই পরবর্তী আর একটির

             শেষে ......


কে যে কার !

কে যে কোন দিক থেকে শুধুই তাকে সঙ্গে নিয়ে আসে নি , 

এনেছে তার পর্যাপ্ত রহস্যে মোড়া 

এমন এক একটি তরঙ্গ ঢেউ........


বাঁকে বাঁকে যার এমন এক একটি নদীর 

        পথ চলা ....


আহা

সে কি তার চোখের নৌকোয় সাঁতার শেখাতেই এত চৈতন্য দিলো 

দিলো এত মুগ্ধ হবার‌ অভিনিবেশ ?

মেরু পথ বেয়ে

সেও আড়মোড় ভাঙবে বলেই 

শরীরে ধরেছে এত সরীসৃপ আতঙ্ক ?


একটিকেই চিনি ;

হয়তো চিনি

হয়তো চিনিনি আজও ; 

না চিনতে চিনতেই 

কুয়াশায় সরু হয়েও 

স্পষ্ট হয় কারো চোখের নদী -----

নাকি সে শুধুই দীর্ঘ এক সুর .... 

যদি ঠিকঠাক

স্নানে নামতে পারতাম ,

সেই সকালে একবার অন্ততঃ  


১৬৪.

দাহর আগুনে লুকোচুরি করি ?

ফুটে ওঠে ফুলেদের কথোপকথন যেন ;   

শেকড়ের হাহাকার উঠে আসে তবুও মাটির উপরে -------

হাতে তুলে ধরি কত না অব্যক্ত অভিব্যক্তি !

তার মুখের ছায়াতে ভেঙে চলে জলেদের কথামালা -----


ওহে নিরুত্তর

তবুও তুমিই আমার পাথরপ্রতিমা ;

বুকের ভেতর উপুড় হয়ে আছো কত নিরাসক্তির ঘুমে !

আমি গাছেদের কাছে আর কেন 

কান পাততে যাবো বলো ?

সকল ফুলেই নতুন সুবাস আজও !

পাতারা বাজাতে থাকলো 

তাই না শুনে 

অনেক হাওয়ার খঞ্জনি ;

তাই , সে মূর্তিও তুলে দি তোমার মুখে ------

ধুলোর মতো উড়ে চলে যেখানে রোদেদের হলকারা .....


১৬৫.

সারাদিন পথ খোঁজে অবসরেরা ...

পথের অবসরের গালের হাত উঠিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ,

বন্ধ দরজা উল্টে যায়। 

বুকের ভেতর পৌঁছে যায় দীর্ঘ শূন্যতা নিঃশব্দে -----

ভেতরের কোনো কথা কোনো দিক থেকেই 

ফিরে আসেনি ।

কীভাবে ভাবি সে ছিলো অথবা নেই কোথাও ------


কাজেরা আমার কাছেই ঘর পাইনি যেন ;

না , আমিই পাইনি কাজের কাছে ?

অনেক কাজের ভিড়ে হারিয়ে গেছে কত অকাজ ----- 

তাদের কোলাজ ভেঙে পড়ে আছে

         ওইখানে ?

ওইখানে কত মৃত ও অ-মৃত নক্ষত্রদের ভিড় !

তাদের অহেতুক কর্ম-ব্যাস্ততার কত পথ চলা গল্প :

আমি কি সেইসব দড়দালানের সখী-সঙ্গ

কোনোকালে গল্পের ছলে কানে কানে পৌঁছে দিতে 

তাদের অধিক ঘুমের ঘোরে

অনেক অনিশ্চয়তায় হয়ে গেছি 

আকাশ জুড়ে কালপুরুষের অট্টহাসি ------?


১৬৬.

পাক খাওয়া 

অপাওয়া গুলি 

শ্মশান-শূন্যতায় কুঁকড়ে গেলে 

জীবন-মৃত্যুঘোর হৃদয়কে গামছা নিঙড়ায় যেন ;

সে দৃশ্যচিত্র অনুভবে ফেলে 

বিন্দুমাত্র দেখে ফ্যালো যদি জীবন্ত কোনো ডাক ------


স্থির জানি 

সে কথা হাজার কথার মাঝে 

ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে অনেক আগামীর অনিশ্চয়তা ------

অদৃশ্য সে পথের কান্না গান সব কিছু 


জানি জানি ,

তাও তোমার দৃঢ়তা কোনো ---- ত্যাগ .....

যাইহোক ,

যাইহোক সে ,

আজ তুমিই করেছ 

পার চৈতন্যের অনেক 

            অন্ধ-পথ ----

সেও অনেক কঠিন সত্য ;

যা অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার ----- 

যে পথে 

হাতে নিয়ে দীর্ঘ ছড়

   চলেছি টেনে 

       বাতাসের বুকে ...

নদী যেন সকল পথেই 

              ভাসায়

   উভয়ের ক্লান্তির 

         দুচোখ তবুও ----


১৬৭.

পুঁথি-ঝড় থেকে শব্দ তো পেলে 

পেলে বিলাপও ;

তবু  অস্বীকার করো সকল সত্য ------

ঘুরিয়ে 

যতোই ঘোরাও নাক ,

মুড়িয়ে দেখাও 

নির্বোধ ----

এসব কোনো ঘটনার 

হাততালিতেই 

জেনো না পরিত্রাণ লেখা আছে -----


এখন যে গালে পড়েছে টোল ------

এখন যে গালের গলাগলি ছোঁয়া আগুনে উঠছে ভাপ --

হায় ----

হায় ,  তাই একদিন 

ভেসে যাবে দু-কূল ..

দুকূল ভেঙে তুবড়ে যাবে গাল 

দুমড়ে যাবে নিটোল 

বক্ষস্রোতে যে সব সাঁতারুরা এসেছিলো 

         উজানে .....

সে সব সব ই হারাবে ,

হারাবে  

ওই পুরোনো পুঁথি ঝড়ে একদিন -----

সেদিন 

আবার তুমি নয় 

তোমার ছায়ারা জন্ম নেবে এই পৃথিবীর 

     ভ্রান্ত দিকে দিকে 

               কোনো ---?!











১৬৮.

স্নায়ুর ভেতরে পাক খেয়ে ঘুরে শোবো যে 

তারও উপায় কোই ?


পড়শি আকশি বাঁধিয়ে বিঁধিয়ে দেয় বর্শা ----

যৌথ বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবো যে

তারও উপায় কোই ?

তাই জুতো হাতে কুঁজো হই ,

গুড়ি মারি ,

উল্টে ঢাকি নিজেই নিজের মুখ ; 


লজ্জা হয় 

গ্লানি ,

ভেবে মরি সারাদিন যাকে

সে কি একান্ত প্রশান্তি আমার ?

নাকি দূরে আছো বলেই এত টান 

      কাছের ?


তুমিই আমার গোপন আনন্দ খানিক ,

একা একা খেলার আহ্লাদ ?


যদি সেটাই হয় 

তাহলে এমন কেন হয় , যেদিকেই পরিবর্তীত করি 

যেখানেই তোমার স্বজন খুঁজি ------

ঘুরে আসে হাজার বর্শা বল্লমের তীক্ষ্ণ ধার ----- 

চলে যায় শিরদাঁড়া ফুঁড়ে কথার ত্রিশুল যতো ------ 


আমাকে পরিত্রাণ

         বলো ,

ফেরাও আমার ঘুম 

   তোমার তন্দ্রা ছুঁয়ে ---- ;


ঘোরাও 

বাঁশি

ফেরাও ঢেউ

জল হয়ে বয়ে যাও স্নায়ুতে 

আয়ুতে 

বায়ুতে ....

ও আমার ভুলের সাগর

পূর্ণ হও তুমি ;

স্নানের প্রকৃত অবগাহন চেনাও -----


১৬৯.

একদিন একটি দেশের প্রকৃতি তার সঙ্গে মিশিয়ে 

পাতা ঝরার শব্দ পৌঁছে দিত যে গাছগুলি --------

কী আনন্দেই না আঁতকে উঠতো

সেই সব বিস্ময় বিহ্বলতা ---- গোটা একটি আকাশ কেড়ে নিতো 

মুঠোর ভেতর থেকে ------

কোথাও কোনো মেঘের চিহ্ন পর্যন্ত না রেখে  

ঝকঝকে আকাশ থাকতো তার মুখমন্ডল জুড়ে ; 

কুয়াশা না সরলেও

এমন অপেক্ষা আগলে বসে থাকতো শীতের ভোর গুলি ----

খুঁজে বেড়াতো কাকে যে এই চোখ !

যেন তার জন্যেই সব কিছু মানবিক ;

সব চিহ্ন হারিয়ে আবার অমানবিক হতেও কুন্ঠিত নয় যেন ; 

সেই মহামানবিকতা ছুঁতে ছুঁতে

কবে যে সে এতটাই হয়ে উঠলো -----

কবে যে সে সব বুঝবার জন্যে সেই শক্তিতে পৌঁছে মহাশক্তি রূপ ধারণ 

করলো ;

আমিও কি সত্যি সত্যি মানুষ হয়ে উঠলাম জন্মের সব হিসাব খুইয়ে ?


ছুঁয়ে ফেললো তাকেই যে আমার ভেতর

দ্বি-সত্তার প্রকাশ ঘটিয়ে ;

তার প্রকৃত স্বরূপ প্রদর্শিত হলো তখনই ? 


যার জন্যে কোথাও কোনও বিরহ বিচ্ছেদ থাকলো না একটুও !

সে একটি খন্ড দেশ জুড়ে 

আর একটি পৃথিবী কীভাবে যে কাছে এনে দিলো মুঠো খুলে , 

যেন মুঠোর ভেতর সম্পূর্ণ হলো সেই কথা 

যে কথা কাউকে চিৎকার করে বলবার মতোন না ।


ভালোবেসে সে 

এত সব সীমানা ভেঙে 

এত দেশ গাঁ

একাকার করেই 

আমার সঙ্গে পথে পথে ঘুরলো সারাজীবন ----- ?


সে কি সত্যি সত্যি

তাকে 

ঘরবন্দী করতে চাইলে 

কোনোদিনও

এই ভাবে কাছে কাছে পেতো ?


১৭০.

জল-জঙ্গলের কাছে গেলে বাদাবন ডাকে

নিচু হয়ে উঁকি দিয়ে ,

মনে হয় ওই বুঝি 

আমার গাঁয়ের গাছগাছালি ঘেরা গলি পথ ডাকছে আমায় ---- 

এখানেও ঘর ছিলো  , হারিয়ে ফেলা ঘর ?! 


চারদিকে জনমানবের দেখা নেই তো !

বাঘ হরিণের দেখাদেখি চলে শুনি ,

কুমির বুনো শুকরের টানাটানি ----- 

আকাশ জল কোলাকুলি করে ঝরজলমেঘে ------

ঢেউ জাগে মানবের হৃদয়ে মানসীর সুর  পেলে 

কোনো এক পূর্ণিমায় কখনোও কখনোও.....?

সেই সুরের পথ চেয়ে চেয়ে গোটা এক একটি জীবন প্রতিক্ষায় 

ঘুরতে আসে বুঝি এইখানে রাত জেগে কখনোও কখনোও ?

আমিও কি সেই  হৃদয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরি 

দিগন্তের পথে পথে ----- ? 


কেউ সাড়া না দিলেও বাদাবন হোগলা গড়ান এর সারীরা নোনাজল ছুঁয়ে  

ইশারায় জানায় আমাকেই ----- 

কেন এই সব নির্জনতা ভাঙতে আসো তুমি ?

আমাদের ভেতর কত কোলাহল তার খোঁজ কিছু 

রাখো কি ? 


ওই দ্যাখো হর্ণবিল ডাকতে ডাকতে চলে গেল 

এই জঙ্গল থেকে ওই জঙ্গলের ওপার -----

সে এখন কোন দেশে তার চলার পথ নির্ধারণ করলো 

সে কথা তো জানা গ্যালো না !

ওই দিকে নদী ঘুরে গেছে মানুষের অন্য দেশে ------


পাখিদের নদী আকাশ মাটিতে কোনো দেশের নাম লেখা নেই ।


**********************************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন