কবিতাগুচ্ছ * স্বপ্নদীপ রায়
সাফাই
একটা পোটো মায়ের চক্ষুদান করছিল।
কর্মে তার নিবিষ্ট মনঃসংযোগ...
যেন হৃদয় আর চোখ একই সরলরেখায় দুটি
বিভিন্ন হয়েও আদপে অভিন্ন বিন্দু।
চুঁয়ে পড়া জিরো ব্রাশটা থেকে প্রায় আণবিক্ষণিক
দু এক ফোঁটা উচ্ছন্নতা গুঁজে দেয় সে
বহুল বিক্ষত একটি রক্তাক্ত লিটমাসের জঠরে...
দেখেও দেখে না যেন... যা কিছু অনুচ্চ--
এইভাবেই...এগিয়ে চলে
তার নিত্যকার নিপুণ শিল্পকর্ম।।
হয়তো সেদিনটা ছিল তার জীবনে নিছকই একটি সাধারণ দিন....
ভিড়ে অনায়াসে হারিয়ে যাওয়ার সামিল!
তুলি ধুয়ে পোটো এগিয়ে যায়
তার একমাত্র ছেলের কাছে কিছুটা তাড়িত হয়ে...
একটা মোটরবাইকের চাকা থেকে
জেট গতিতে কোন এক গর্ভজাত
ধুয়ে চলেছে সেখানে গর্ভধারিণী কাদা-জঞ্জাল...
বাইরের সাইনবোর্ডে নজর যেতেই দেখি
লেখা-"এখানে টু হুইলারও সাফাই হয়!"
আজ বড় অসহায় মনে হল নিজেকে...আরেকবার!
মনে পড়ে গেল শেষদৃশ্যে- রাবণের "অকাল বোধন!"
ঝুটা যত মহাকাব্য..
চিরটাকাল নানারূপে অসুর
নিজে হাতেই লিখেছে নিজ অমোঘ--নিধন!
বিস্ময়াপন্ন আমি!
কতবার বলেছি বলত তোমাকে
--আমি বিস্ময়াপন্ন।
বেলা-অবেলা-কালবেলা--
বারবার মুহুর্মুহু.....
আমার জ্বর মেপেছো তুমি।
আমি তখন তন্দ্রাসমর্পিত এক-পৃথিবী জঙ্গল!
কত ক্লান্তি আমার ছায়ার চারিপাশে...
তবু মাথাভর্তি পাতার নিবিড় আবডালে
আগলেছি তোমার লজ্জাবস্ত্রের শেষ সম্বল!
তুমি সিংহের মতো জ্যোৎস্না রাত্রে পান করতে
এসেছো আমার বুকের সবটুকু পাথুরে ঝর্ণা..
আছিলায়....নিছকই
ছিঁড়ে খেয়েছো পথচলতে
এক শাবক হরিণের মাতৃ-অঞ্চল...
নিরুত্তর থেকেছি আমি...
ভাবতাম হয়তো একদিন কেটে যাবে
তোমার খাজাঞ্চিখানায় গুমোট যত
বিস্ময়ের কালান্তর বাদল!
জানতাম না....
আমার সবটা বিস্ময় ঘিরেই
শ্বাস ফেলে চলেছে তোমার অসহিষ্ণু বিস্ময়ের
বিরামহীন কৃষ্ণ-কাজল!
আশ্রয় হয় না কেউ.....
আশ্রয় হয় না কেউ........
আশ্রিতই এখানে উত্তম পুরুষ বহু বচন!
এসো যেন!
ওপারের সূর্যটাকে
এপারে অনেকক্ষণ না দেখলে
মেঘলা করে যে আকাশে
আমার কাছে.... জলনূপুর পায়ে এসো...
-- সেই আকাশটাকে ভালোবেসে।
আমি সাধক নই।তাই,
আমার সমুখে তোমাকে দিতে হবে না
কোন অগ্নিপরীক্ষা কিংবা সহমরণের ফিডব্যাক!
আমি শ'দন্তী নই যে নির্বিচারে
ছিঁড়ে খাবে তোমার হস্তান্তরের কাল-বুদ।
আমি হৃদয়।
-যার আকাশ আছে।মাটি আছে।
আর মাঝে আছে ফুরাবার অনিবার প্রবণতা।
সেই প্রবণতার কাছে এসো। একটিবার।
মিলন ক্ষণিকের দ্যোৎনা।
সেই স্পিনারেটের খেলা খেলতে গিয়ে
ভুলো না যেন আদি অমোঘ ছায়া--
-- অপরাহ্নের কালপুরুষ বেদনা!
আর্শি
লেপটিনে লেপ্টে গেছে খরস্রোতা....
আজ আইসবার্গে ঠোকা খেল আবারও,
আমার অহমিকার মান্দাস!
চেনা আঙুল ওঠানামা করতে চায় ধূলোপড়া
তানপুরাটার সেই 'সা' ধরা তারে;
কিন্তু সে এখন নিছকই চাওয়া...
মধ্যরাত্রে খুঁজছি আমি আমার সেই শ্রীজাত-মা!
তার স্তনে কতকাল আগের প্রথম চুমুক
আমাকে শিখিয়েছিল অমৃতের ললিত কথা!
পোড়ো বাড়ির শ্যাওলা ধরা দেওয়াল ধরে
এখন আমি কাঁদতে বড় ভালোবাসি....
হাতে সেই ছেলেবেলার সানকি...
আকাশে মেঘ দেখলেই ছুটে যাই
ব্যাকলনির ঝোলায় দুদানা বৃষ্টি কুড়াতে...
.....ভিজতে যে বড় কুণ্ঠা হয়!
বুঝি তা অনুশোচনার পূর্বরাগ!
আমার ভিতরে কেন এতো নিখোঁজের প্রতীক্ষা?
চোখের কাজলে লিটমাসটা গিরগিটির মত
যথাস্থানে চরিত্রবান!
এই তো আমি....নিঃশব্দে সয়ে যাই
লক্ষ্যাধিক রক্তকণিকার নিত্য পতন!
তবু জনহীন মধ্যরাত্রের মেট্রোর ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে
বেসামাল আমি গোছাতে চেষ্টা করি নিজেকে...
শেষবারের মত একটা প্রচেষ্টা!
কে দেবে এমন প্রচেষ্টার দাম বা স্বীকৃতি?
গর্ভের কত ভ্রূণ আজকের তারিখে চুরি করেছে
এক পৃথিবী শপথের দুষ্কৃতী!
**************************************************************


আহা, ভীষণ সুন্দর করে লেখা প্রতিটি কবিতা । বড়ো যত্নে লালিত্যে বেড়ে উঠেছে এই ভাবনারা ।
উত্তরমুছুনএ আমার পরম প্রাপ্তি।চিরকাল তোমার স্নেহধন্য থাকতে চাই একভাবে...শুভকামনা নিরন্তর 🙏🙏
মুছুন